৬ জানু, ২০২৫

দেশের খবর নিয়ে তৃপ্তির ঘুম দেন ফরিদ শেখ

ছাত্রজীবনে ছাত্রদলের সাথে যুক্ত ছিল সে। তাই মামলার ভারে জর্জরিত ছিল ফরিদ। পালিয়ে থাকতে হয় তাকে। কিন্তু তাই বলে তো জীবন থেমে থাকে না। ফরিদকে বিয়ে দেয় তারর পরিবার। মায়ের বড় আদরের ছিলেন ফরিদ। ৫ মেয়ের পর ৬ষ্ঠ সন্তান হিসেবে ফরিদের মা ফরিদকে পায়। ব্যবসা করার জন্য বিভিন্ন মানুষ থেকে ১১ লক্ষ টাকা ধার করে ফরিদ।

জীবনটা বড় কঠিন ফরিদের। সরকার ও আওয়ামী লীগের ক্রমাগত নির্যাতনে ব্যবসাটা ঠিকভাবে করতে পারে না মুন্সিগঞ্জের ফরিদ শেখ। ব্যবসায় লস করতে থাকে। একদিকে পরিবার চালানোর চাপ অন্যদিকে পাওনাদারদের তাড়া। জীবন ওষ্ঠাগত হয়ে উঠে শেখ ফরিদের।

মুন্সিগঞ্জ ছেড়ে চলে আসেন যাত্রাবাড়ীতে। কাজ নেন ফলের আড়তে। মানবেতর জীবনযাপন করে টাকা জমিয়ে কিছু ঋণ শোধ করেন কিছু দিয়ে পরিবারের খরচ চালান। এভাবেই চলছিল তাঁর জীবন। প্রায় দুই লক্ষ টাকা শোধও করেছনে তিনি।

শুরু হয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের আন্দোলন। ফরিদ শেখ প্রথমে ছাত্রদের সহায়তা করতেন। পরে একেবারেই সম্পৃক্ত হয়ে যান আন্দোলনের সাথে। ৪ আগস্ট ছিল খুবই উত্তপ্ত একটি দিন। যাত্রাবাড়ীতে সেদিন ২০ জনের বেশি মানুষ শাহদাতবরণ করে। বেলা ১১ টায় ফরিদ যখন ফলের আড়তের কাজ শেষ করে তখন ইতোমধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়ে যায়।

ফরিদ তার বন্ধুদের নিয়ে যাত্রাবাড়ীতে আন্দোলনে অংশ নেয়। তারা শ্লোগানে শ্লোগানে আকাশ বাতাস মুখরিত করে তুলে। যাত্রাবাড়ির পুলিশ, বিজিবি ও সেনাবাহিনী সমানে গুলি করতে থাকে। এমনি একটি গুলি ফরিদের পেটে এসে লাগে। নাড়ি ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় ফরিদের। বন্ধুরা ফরিদকে নিয়ে প্রথমে যাত্রাবাড়ীতে একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে তার চিকিৎসার অপর্যাপ্ততা থাকায় নিয়ে যায় মুগদা মেডিকেল হাসপাতালে।

এর পরদিন অর্থাৎ ৫ আগস্ট পালিয়ে যায় ডাইনী হাসিনা। দেশ স্বাধীন হয়। কিন্তু জ্ঞান ফেরে না ফরিদ শেখের। ৬ আগস্ট অল্প সময়ের জন্য জ্ঞান ফেরে তার। চোখ খুলেই জিজ্ঞাসা করে, দেশের কী খবর? তাকে স্বজনেরা জানায়, দেশ স্বাধীন! হাসিনা পালাইছে। যেন তৃপ্তি নেমে আসে ফরিদের চোখে। চোখ বন্ধ করে ফরিদ। এই চোখ আর খুলে নি।

৬ আগস্টই শাহদাতবরণ করে ফরিদ শেখ।

প্রতিদিন বাড়িতে মা-বাবার কাছে অন্তত দুবার ফোন দিয়ে কথা বলতেন মুন্সিগঞ্জের মো. ফরিদ শেখ। তাঁর বয়স এখন তিরিশের ঘরে। একসময় ছাত্রদলের রাজনীতি করা ফরিদ ৪ আগস্ট মাকে চারবার ফোন দিয়েছেন। প্রতিবার ফোনে মাকে দেশের অবস্থা জানিয়ে সতর্ক করেছেন। বাবা ও ছোট ভাইকে বাড়ি থেকে বাইরে যেতে নিষেধও করেন। কিন্তু ওই দিন নিজে আন্দোলনে গিয়ে শাহদাতবরণ করেন।

তাঁর মা আলেয়া বেগম বলেন, ‘আমাগো সাবধানে থাকতে কইয়া নিজে আন্দোলনে গিয়ে জীবন দিল। পোলাডার পেটে গুল্লি কইরা নাড়িভুঁড়ি ছিঁড়া দিল। দুই দিন হুঁশ ছাড়া বাইচ্চা আছিল। ৬ আগস্ট কিছু না কইয়াই মইরা গেল।’

ফরিদ মুন্সিগঞ্জের সদর উপজেলার সুখবাসপুর এলাকার সুলতান শেখের ছেলে। সাত ভাই-বোনের মধ্যে ফরিদ ভাইদের মধ্যে বড় ছিলেন। আলেয়া বেগম বলেন, ‘ফরিদ ৫ মেয়ের পর হইছে। আমার খুব আদরের পোলা। পোলাডাও আমারে ছাড়া কিছু বুঝত না। দেশের লাইগা আন্দোলনে গেল। পুলিশ ও আওয়ামী লীগের মাইনষেরা মাইরা ফালাইল।’

ফরিদের বাবা সুলতান শেখ বলেন, ‘আমাগো খুব অভাব-অনটনের সংসার। ফরিদ ব্যবসা করার লাইগা ১১ লাখ টাকা ধার করছিল। ব্যবসায় মাইর খাইয়া যাত্রাবাড়ী ওর চাচাতো ভাইগো দোকানে এক বছর আগে কাজ লইছিল। দুই লাখ টাকা ধার শোধ করছিল। এখন আমাগো সংসারই তো ঠিকমতো চলব না। ধারের টাকা কেমনে শোধ করমু?’

ঘটনার দিনের বর্ণনা দিয়ে সুলতান শেখ বলেন, ‘ফরিদ ৪ আগস্ট সকালে আড়তে কাজ করছিল। দুপুর ১২টার দিকে ওর ফোন থেকে একটি ফোন আসে। ফোন রিসিভ করতেই অচেনা একজন বলল, ফরিদের পেটে গুলি লাগছে। ওরে হাসপাতালে নিতাছে। আমরা যেন তাড়াতাড়ি যাই। ওই দিন ঢাকার অবস্থা অনেক খারাপ আছিল। রোগী আর লাশে ভরা। কয়েকটা হাসপাতালে নিয়াও চিকিৎসা দিতে পারি নাই। শেষে মুগদা হাসপাতালে জ্ঞানহীন অবস্থায় ভর্তি করাই। পরদিন একবার চোখ খুইল্লা তাকাইয়া জিগাইল, দেশের কী অবস্থা। ওই দিনই বেলা ১১টার দিকে মারা যায়।’

ফরিদদের বাড়িতে গেলে জরাজীর্ণ একটি টিনের ঘর দেখিয়ে জানানো হয়, ওই ঘরেই থাকতেন ফরিদ। ফরিদের বিছানায় বসে স্বজনদের সঙ্গে ফরিদের স্মৃতিচারণা করছিলেন তাঁর বাবা-মা। পাশেই বসে ছিলেন ফরিদের চাচাতো ভাই রবিউল ইসলাম। তাঁদের আড়তে কাজ করতেন ফরিদ।

রবিউল ইসলাম বলেন, জুলাই মাসে দেশে যখন আন্দোলন শুরু হলো, তখন থেকে ফরিদ আন্দোলনে যেতেন। ভোর থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত আড়তে ব্যস্ত থাকতেন। কাজ শেষ করে তাঁদের না জানিয়ে আন্দোলনে চলে যেতেন। বিষয়টি জানতে পেরে ওকে নিষেধ করতেন। যখন বলতেন, চুপ করে শুনতেন। পরদিন আবার আন্দোলনে চলে যেতেন।

ফরিদ শেখের আড়াই বছরের একটি মেয়ে আছে। স্ত্রী ও সন্তানের কথা জিজ্ঞেস করতেই স্বজনেরা জানালেন, চার বছর আগে ফরিদকে বিয়ে করান। মৃত্যুর পর পাওনাদাররা বাড়িতে আসতে পারেন ভেবে তাঁর স্ত্রী ইতি আক্তারকে বাবার বাড়িতে নিয়ে গেছেন স্বজনেরা। ফরিদের চল্লিশার দিন তাঁর আসার কথা আছে। ফরিদের বাবা সুলতান শেখ বলেন, ‘যারা আমার ছেলেকে হত্যা করেছে, পুরো সংসারটি এলোমেলো করে দিয়েছে, আমি সেই হত্যাকারীদের বিচার চাই।’

ফরিদের প্রতিবেশী ও জেলা ছাত্রদলের দপ্তর সম্পাদক ইমতিয়াজ নিপু বলেন, ‘ফরিদ সব সময় স্বৈরাচার সরকারের বিরুদ্ধে যেকোনো কর্মসূচিতে আমাদের সঙ্গে অংশ নিতেন। বিয়ের পর কাজের জন্য আমাদের সঙ্গে কর্মসূচি করতে পারেননি। তবে ঢাকায় যেকোনো কর্মসূচিতে অংশ নিতেন।’ তিনি বলেন, ফরিদ দেশকে স্বৈরাচারমুক্ত করতে গিয়ে জীবন দিয়েছেন। এখন তাঁর পরিবার সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। পরিবারটির পাশে দাঁড়াতে সবার প্রতি অনুরোধ জানান তিনি।

ছোট্ট আড়াই বছরের শিশু কন্যা ফাতেমা আক্তারকে এতিম করে চলে গেলেন ফরিদ। তার মৃত্যুর পর স্ত্রী ইতি আক্তারের আড়াই বছরের একমাত্র মেয়েকে নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন পিতার অভাব অনটনের সংসারে। বাবা ঢাকায় আছে বললে আদরের অবুঝ ফুটফুটে শিশু কন্যা ফাতেমা আশায় থাকে বাবা সেখান থেকে ‘মজা’ নিয়ে আসবে। পরক্ষণেই হারিয়ে যায় আবার খেলার জগতে। বাবাকে বাবা বলে ডাকতে পারলো না ফাতেমা। যে দিন জানবে পিতার মৃত্যুর ঘটনা সেদিন তার সামনে চলে আসবে এক ভয়ংকর ইতিহাস। ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করবে হাসিনার ফ্যাসিষ্ট দোসরদের।

ফরিদের মৃত্যুর তিন মাস পরেও মা অপেক্ষায় থাকেন ছেলের ফোনের জন্য। আদরের প্রথম পুত্র ফরিদের শোকে কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানি শুকিয়ে গেছে তার।

ফরিদ স্থানীয় বছিরননেছা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাশ করে। সংসারে অভাবের কারণে পড়াশুনা বেশি করতে পারেনি। আমি দীর্ঘদিন হিমাগারে কাজ করায় শারীরিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ি। কোন কাজ করতে পারিনা। সংসারে হাল ধরতে ফরিদ দেড় বছর আগে ঋণ নিয়ে ফোনের দোকান দেয়। ব্যবসায় মার খেয়ে তা বন্ধ হয়ে যায়। অভাবের সংসারে সুখ আনতে ঢাকার যাত্রাবাড়িতে চাচাত ভাই নুরুল আমীনের কলার আড়তে কাজ শুরু করে।

ফরিদের পিতা জানান, জেলা প্রশাসন থেকে ২০ হাজার এবং জামায়াতের পক্ষ থেকে দুই লক্ষ টাকা সহায়তা হিসেবে দেয়া হয়েছে। আগামী দিনের অজানা এক চিন্তায় দিশেহারা ইতি আক্তার আরো বলেন, বিশ হাজার টাকা শুধু পেয়েছি। জামায়াতে ইসলামী থেকে শ্বশুর যে দুই লক্ষ টাকা পেয়েছেন সেখান থেকে কিছুই আমি পাইনি।

এ সময়ে তার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে। অশ্রুভেজা চোখে ইতি বলতে থাকেন, ‘স্বামীর সংসারও করতে পারলাম না, শ্বশুর বাড়ীতেও এখন স্থান হচ্ছে না। জীবনের বড় সম্পদ স্বামীকে হারিয়েছি।’ এতিম সন্তানকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করতে প্রশাসনসহ সকলের সহযোগিতা কামনা করেছেন ইতি।

আমরা আমাদের বীর শহীদ, যারা নিজের জীবন দিয়ে আমাদেরকে খুনী হাসিনার হাত থেকে রক্ষা করেছে তাদেরকে ভুলে যেতে দেব না। তাদেরকে তাদের সন্তানকে কোলে পিঠে করে রাখবো ইনশাআল্লাহ।

পুনশ্চঃ এই খবর জানার পর জামায়াত পুনরায় ফরিদ শেখের স্ত্রী ইতি'র কাছে এক লক্ষ টাকার সহায়তা হস্তান্তর করে।


২৪ ডিসে, ২০২৪

মা, যাচ্ছি, দেশ স্বাধীন করে ফিরে আসবো


ইনতিশারের বয়স আর কত হবে? ২০ বা ২১। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছিলো সে। আন্দোলন করার বয়স তার কি হয়েছে? কোটা বিরোধী আন্দোলনের শুরুতে জানতোই না সে দেশে কী হচ্ছে বা হবে। কিন্তু যেদিন আবু সাঈদ শহীদ হয়েছে সেদিন তার মাথা ঘুরে যায়। তার উপলব্ধি হলো, আবু সাঈদ ভাই তো আমাদের জন্য জীবন দিয়েছে। আমাদের ভবিষ্যত জীবনের বিশাল ফাঁড়া কোটাপ্রথা দূর করার জন্য আবূ সাঈদ ভাই জীবন দিয়েছে। 

এই উপলব্ধি থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কোটা সংস্কারের দাবিতে ছাত্রসমাজের ডাকে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো ময়মনসিংহের ত্রিশালের ইনতিশার। আন্দোলনের শুরু থেকেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন তিনি। প্রতিদিন রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ মিছিল শ্লোগানে মাতিয়ে রেখেছিলো সারা মাস। বেশ কয়েকদিন পুলিশের সাথে লড়াইও করতে হয়েছে। হালকা আহতও হয়েছিল বেশ কয়েকবার। 

কিন্তু কোনো ভয়ই তাকে আন্দোলন থেকে দূরে রাখতে পারে নি। আন্দোলনের ২য় পর্যায়ে আবারো রাস্তায় নামে ইনতিশার। ৩ আগস্ট থেকে সে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। এত রক্ত নিশ্চয়ই বৃথা যাবে না। এবার নিশ্চয়ই হাসিনার পতন হবে। গ্রাফিতি আঁকিয়ে তারা পুরো এলাকায় আন্দোলন চাঙ্গা রেখেছে।   

৪ আগস্ট সারাদেশে শতাধিক মানুষকে খুন করে ডাইনি হাসিনা। ইনতিশাররা আরো ক্ষেপে যায়। চোখে মুখে ফুটে ওঠে প্রতিশোধের আগুন। এর মধ্যে ঢাকা থেকে ঘোষণা এলো লংমার্চ ৬ তারিখ না হয়ে ৫ আগস্ট হবে। প্রস্তুতি নেয় ইনতিশাররা। ৫ আগস্ট ‘মার্চ টু ঢাকা’ অংশগ্রহণের জন্য মা-বাবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যান ইনতিশার। ভোর থেকেই শুরু হয় তাদের পদযাত্রা। যত সময় বাড়ে তত মিছিলের দৈর্ঘ্য বাড়ে। হাজার হাজার মানুষ ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হয়। 

পথিমধ্যে গাজীপুরের মাওনা পৌঁছালে তাদের বাধা দেয় পুলিশ বিজিবি লীগ। গুলি করতে থাকে পুলিশ। অকুতোভয় ইনতিশারই ইট হাতে প্রথমে প্রতিরোধ করে পুলিশকে। স্বৈরাচার হাসিনার পুলিশ ও বিজিবি গুলি করে ঝাঁঝরা করে দেয় ইনতিশারের ছোট বুক। বিকেল ৪টা ১১ মিনিট থেকে ৪টা ২৫ মিনিটের মধ্যে ইনতিশার গুলিবিদ্ধ হন বলে ধারণা পরিবারের। কারণ, ৪টা ১১ মিনিটের আগে নিজের ফেসবুকে সরব ছিলেন ইনতিশার। গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর মাওনার একটি হাসপাতালে নিলে সেখান থেকে চিকিৎসকেরা ময়মনসিংহ মেডিকেলে নেওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু ময়মনসিংহে নেওয়ার পথে সঙ্গে থাকা লোকজন ইনতিশারের নড়াচড়া না পেয়ে তাঁকে ভালুকা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান। সেখানে চিকিৎসক পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।

ততক্ষণে জানা গেছে ডাইনি হাসিনা পালিয়ে ভারত চলে গেছে। ছাত্র আন্দোলনের বিজয়বার্তায় যখন সারা দেশ আনন্দে উদ্বেলিত ঠিক সেই সময় ইনতিশারের বাড়িতে খবর আসে সে আর নেই। এ খবরে তার মা-বাবা পাগলপ্রায়। ছেলের কথা মনে হলেই বার বার মূর্ছা যান মা। মা নাজমুন্নাহার বলেন, আমার ছেলে বলে গেল 'মা, যাচ্ছি, দেশ স্বাধীন করে ফিরে আসবো। দেশ স্বাধীন হলো কিন্ত, সে আর ফিরল না। আমি এখন কাকে আদর করে বাবা বলে ডাকবো!!

ইনতিশারের বাড়ি ত্রিশাল উপজেলার বইলর ইউনিয়নের উজান বইলর গ্রামে। সে ওই গ্রামের আ হ ম এনামুল হক লিটনের বড় ছেলে। সে ময়মনসিংহ নগরের রুমডো পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের সিভিল বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। পাশাপাশি ত্রিশালের কাঁঠাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে ২০২৩ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ইনতিশারের মা-বাবা দাবী করেন, আমাদের আদরের সন্তান চিরদিনের জন্য সব মায়া-মমতা ফেলে দেশের জন্য যুদ্ধ করে না ফেরার দেশে চলে গেছে, তাকে যেন জাতীয় বীরের মর্যাদা দেওয়া হয়। 

ইনতিশারের ছোট ভাই বাশিরুল হক মাহির বলেন, আমার ভাই আমার বন্ধু ছিল, কোটা সংস্কার আন্দোলনে আমার ভাই নিহত হয়েছেন। আমার ভাই যেন আবু সাঈদের মতো জাতীয় বীরের মর্যাদা পান। চাচা অধ্যক্ষ মাওলানা নাজমুল হক বলেন, আমাদের পরিবারের সবার বড় ইনতিশার কোটা আন্দোলনে লং মার্চ টু ঢাকায় যাওয়ার পথে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে নিহত হয়। বর্তমান সরকারের কাছে আমাদের পরিবারের আবেদন তাকে যেন জাতীয় বীরের মর্যাদা দেওয়া হয়। বইলর ধানীখোলা সড়ককে ইনতিশারের নামে নামকরণ করার দাবি জানান তিনি।

বৈষম্যবিরোধী কোটা সংস্কারের দাবিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে শহিদ ইনতিশারের মা-বাবাকে সান্ত্বনা ও তার আত্মার মাগফিরাত কামনায় কবর জিয়ারত করতে ছুটে যান ত্রিশাল উপজেলা নির্বাহী কর্মকতা জুয়েল আহমেদ। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ছাত্ররা ইনতিশারকে জাতীয় বীরের মর্যাদা দেওয়ার জন্য বর্তমান সরকারেরকাছে জোর দাবি জানান।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক রবিউস সানি বলেন, ইনতিশার আন্দোলনের প্রথম থেকেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছিলেন। মার্চ টু ঢাকায় যাওয়ার পথে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে নিহত হন তিনি। আমরা এ হত্যার বিচার চাই। জাতীয় বীরের নামের তালিকায় ইনতিশার যেন স্বর্ণ অক্ষরে লেখা থাকে এ দাবি জানাই।

ছেলের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে বাবা এনামুল হক বলেন, 'সে আগেও আন্দোলনে গেছে, সে সময় বাধা দিইনি। আমাদের মনে ভয়-আতঙ্ক ছিল, তবে আমাদের মৌন সম্মতি ছিল।' তিনি আরও বলেন, 'তিন ছেলের মধ্যে বড় ইনতিশার। আমাদের পরিবারের সবাই উচ্চশিক্ষিত। আমাদেরও স্বপ্ন ছিল পড়ালেখা শেষ করে সে প্রতিষ্ঠিত হবে। সামাজিক ও একজন ভালো মানুষ হবে, এই প্রত্যাশা ছিল। জাতির বৃহত্তর প্রয়োজনে সন্তান মৃত্যুবরণ করেছে। আমার মনে দুঃখ নেই। সবাই তাঁদের শহীদ বলছে। আল্লাহ তাআলা যেন শহীদের মর্যাদা দেন, বাবা হিসেবে এটিই চাওয়া।'

ইনতিশারের বাবা বলেন, ভালুকা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আনা হয়েছে এই খবর পেয়ে সেখানে যাই। সেখানে ছেলের লাশ পাই। একটি গুলি বুকের বাঁ পাশে লেগে ডান দিকে বেরিয়ে যায়। পরে সেখান থেকে আমরা লাশ নিয়ে আসি।’ তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে তাঁর ফেসবুকে শেষ পোস্ট দিয়েছিল, লাল বৃত্তের মধ্যে স্বাধীনতা লেখা। কিন্তু আমার ছেলে সেই স্বাধীনতা দেখে যেতে পারেনি, স্বাদ ভোগ করতে পারেনি।’


২৩ ডিসে, ২০২৪

আল্লাহ আমাকে একটা সন্তানও দেননি। আমি এখন কীভাবে বাঁচব?


১৯ জুলাই। ঘটনাস্থল রামপুরা। ভীষণ গোলাগুলি চলছে। আবুল হোটেল থেকে রামপুরা পূর্ববাজার পর্যন্ত ছাত্র-জনতার দখলে। পুলিশ ও বিজিবি বিটিভি সেন্টারের সামনে থেকে কিছুক্ষণ পর পরই গুলি চালাচ্ছিল। গুলিতে খুলি উড়ে গেছে বেশ করেকজনের। জুমআর পর থেকেই আন্দোলনে অংশ নিয়েছে শোহান, ওলি উল্লাহ ও নূর হোসেন। স্বৈরাচার শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে লড়তে থাকে ক্রমাগত। বিকেল ৪ টার দিকে বিজিবির গুলি ঝাঁঝরা করে দেয় শোহানকে।

দুই বন্ধু ও আন্দোলনকারীরা শোহানকে পাশেই থাকা বেটার লাইফ হাসপাতালে নিয়ে যায়। কিন্তু সেখানে থাকা কর্মকর্তারা চিকিৎসা দিতে চায় নি। প্রাথমিক কিছু কাজ শেষে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা মেডিকেলে। সেখানে এক্স-রে করে বুকে গুলি থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায়। ঢাকা মেডিকেল কর্তৃপক্ষও ভর্তি নেয়নি। তদুপরি তখন ঢাকা মেডিকেলেও সংঘর্ষ চলছিল। পুলিশ ও আওয়ামী লীগের কর্মীরা আহতদের ওপর নির্যাতন করছিলেন। এমন পরিস্থিতিতে সেখান থেকে একপ্রকার পালিয়ে আসেন তাঁরা।

এরপর আরও কয়েকটি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ঘুরে গুলিবিদ্ধ শোহানকে ভর্তির চেষ্টা করে ব্যর্থ হন পরিবারের সদস্যরা। প্রায় ১২ ঘণ্টা অ্যাম্বুলেন্সে ঘুরে ভোর সাড়ে ৪টার দিকে জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ভর্তি করা হয় শোহানকে। সেখানে ওই দিনই ছোট একটা অস্ত্রোপচার করা তাঁর। তবে গুলি শরীরে থেকে বের করা যায় নি।

ডাইনি শেখ হাসিনার নৃশংস নির্যাতন এখানেই শেষ হয়নি। বক্ষব্যাধি হাসপাতালে জামায়াত-শিবিরকে শোহানের সহকর্মী ওলিউল্লাহ ও নূর হোসেনকে পিটিয়েছে পুলিশ। ওলিউল্লাহ বলেন, গত ২২ জুলাই বক্ষব্যাধি হাসপাতালে শোহানকে অক্সিজেন নিতে সহযোগিতা করছিলেন। এমন সময় পুলিশ এসে ‘জামায়াত-শিবির’ বলে লাঠি দিয়ে বাড়ি দেয়। বাইরে বসে থাকা আরেক সহকর্মী নূর হোসেনকেও লাঠিপেটা করা হয়। শুধু তাই নয়, শোহানের দুই সহকর্মীকে আটক করে বনানী থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। সেখানে ৪ ঘণ্টা আটক থাকার পর বহু চেষ্টা তদবির করে মুক্তি পান তারা।

এদিকে শোহানের অবস্থা খারাপ। পরিবারের সদস্যরা বলেছেন, উন্নত চিকিৎসার জন্য শোহানকে ভারতে নেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন তাঁরা। এর জন্য পাসপোর্ট করতে গিয়ে নানা রকম বাধার মুখে পড়তে হয়। এমনকি শোহান যখন ঢাকায় বক্ষব্যাধি হাসপাতালে ভর্তি তখন গাজীপুরের শ্রীপুর থানায় করা নাশকতার একটি মামলায় তাকে আসামি করা হয়েছে।

২৪ জুলাই শ্রীপুর থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইন ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে একটি মামলা করেন থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. আবদুল খালেক। সেখানে আসামি হিসেবে ৯৫ জনের নাম উল্লেখ করা হয়। অজ্ঞাতনামা আসামি দেখানো হয় ১৫০ থেকে ২০০ জনকে। মামলার এজাহারে ১৮ নম্বর আসামি হিসেবে নাম রয়েছে শাহ সেকেন্দারের ছেলে শোহানের। মামলার অভিযোগে বলা হয়, ওই দিন (২৪ জুলাই) সকাল ৬টার দিকে শ্রীপুরের আলতাফ হোসেন মহিলা কলেজ মাঠে জড়ো হয়ে ককটেল বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টির করছিলেন আসামিরা। একদিকে চিকিৎসার অপর্যাপ্ততা অন্যদিকে মামলার আসামী হওয়ায় শোহান ও তার পরিবারের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যায়।

অতঃপর ৫ আগস্ট বিপ্লব হয়। বিপ্লবের ধাক্কায় নতুনভাবে চিকিৎসা ব্যবস্থা ঢেলে সাজানো হয়। ইনফেকশনের শিকার হয় শোহান। বক্ষব্যাধি হাসপাতাল থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ)। কিন্তু দীর্ঘদিন চিকিৎসায় অবহেলা হওয়াতে শোহানের অবস্থা দিন দিন খারাপ হয়ে পড়ে। অবশেষে গুলিবিদ্ধ হওয়ার ৩৯ দিন পর ২৭ আগস্ট সিএমএইচ চিকিৎসাধীন অবস্থায় শাহদাতবরণ করে সে।

খুব অল্প বয়সেই সংসারের হাল ধরেছিলেন শোহান শাহ। মা-বাবা, স্ত্রী ও স্কুলছাত্র ছোট ভাইয়ের সব খরচের জোগান আসত একজনের বেতন থেকেই। পরিবারের সবার ভরসার শোহান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচিতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হন। বুকে বুলেট নিয়ে ৩৯ দিন কষ্ট করেছে সে। এখন পরিবারের সদস্যরা পড়েছেন অকুল পাথারে।

শোহান শাহের (২৯) বাড়ি মাগুরার শ্রীপুর উপজেলা সদরে আলতাফ হোসেন মহিলা কলেজ রোড এলাকায়। অর্থ সাশ্রয়ের জন্য স্ত্রীকে বাড়িতে মা-বাবার কাছে রেখে ঢাকায় মেসে থেকে চাকরি করছিলেন। গ্রামের বাড়িতে নতুন ঘর নির্মাণ করা হচ্ছিল। যেখানে স্ত্রী শম্পা বেগমের সঙ্গে সুখের সংসার পাততে চেয়েছিলেন শোহান শাহ। তবে তাঁদের সেই স্বপ্ন অপূরণ থেকে গেল।

শ্রীপুরে শোহানদের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তাঁর স্ত্রী শম্পা বেগমের বিলাপ কিছুতেই থামছে না। পরিবারের অন্য সদস্যরা তাঁকে নানাভাবে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। তিনি বারবার বলছেন, শোহানকে ছাড়া এখন আমি কীভাবে বাঁচবো? শম্পা বেগম বলেন, তাঁদের বিয়ে হয়েছিল ২০১৭ সালের ১৯ নভেম্বর। এরপর মধ্যে তিন বছর দুজন একসঙ্গে ঢাকায় সংসার পেতেছিলেন। বাকি সময় স্ত্রীকে গ্রামে পরিবারের সঙ্গে রেখে ঢাকায় চাকরি করেছেন শোহান। শম্পা বেগম বলেন, ‘আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবার। অর্থসংকটের কারণে ও একা ঢাকায় থাকত। অর্থের কারণে দুজন একসঙ্গেও থাকতে পারিনি। গত এক বছর বাড়িতে একটা নতুন ঘর দিচ্ছিল। সে আমাকে বলেছিল, “শম্পা, আমি আর তুমি এই ঘরে থাকব।”’

গত মঙ্গলবার ঢাকায় সিএমএইচে স্বামীর সঙ্গে শেষ কথা হয়েছিল শম্পার। তখন শোহান শম্পাকে বলেছিলেন, ‘তুমি কেঁদো না। আমার কিছুই হবে না।’ তবে শোহান আর ফেরেননি। অস্ত্রোপচার করে শরীর থেকে বুলেট বের করা গেলেও রক্ত বন্ধ করা যায়নি। ১৮ ব্যাগ রক্ত দিয়েও বাঁচানো যায়নি শোহানকে। সংসারে অভাব থাকলেও ভালোবাসার কমতি ছিল না উল্লেখ করে শম্পা বলেন, ‘স্বামী ছাড়া কেউ ছিল না আমার। সে সব সময় সব ধরনের পরিস্থিতিতে আমার পাশে থেকেছে। সে বলত, “চিন্তা করো না, আমি তোমার পাশে আছি।” আল্লাহ আমাকে একটা সন্তানও দেননি। আমি এখন কীভাবে বাঁচব?’

মাগুরার শ্রীপুর ডিগ্রি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে প্রায় ১০ বছর আগে সংসারের হাল ধরতে চাকরিতে যান শোহান। সবশেষ ঢাকার রামপুরা এলাকায় একটি পোশাক কারখানায় টেকনিশিয়ান হিসেবে কাজ করছিলেন তিনি। তাঁর বাবা শাহ সেকেন্দার এক দশকের বেশি সময় আগে নিজের ব্যবসা গুটিয়ে বেকার হয়ে পড়েন। তাঁর একমাত্র ছোট ভাই অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে।

বাবা শাহ সেকেন্দার বলেন, ‘আমার ছেলে ছোটবেলা থেকেই স্মার্ট, কর্মঠ আর দায়িত্বশীল। ছোটবেলা থেকেই ইনকাম করে। বিশেষ করে বিয়ের পর একদিনও বসে থাকেনি। চাকরি না থাকলে বাড়িতে এসে রাজমিস্ত্রির কাজও করেছে। আমার পকেটখরচও সে দিত। যেদিন মারা গেল সেদিন সকালেও বিকাশে আমাকে এক হাজার টাকা পাঠিয়ে বলল, এই টাকাটা তুলে চলে আসেন।’

ছেলে হারানোর শোকে বিলাপ করছিলেন শোহানের মা সুফিয়া বেগমও। তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে আমার মনের কথা বুঝত। কোনো কথা লুকালে ও বুঝে ফেলত। টাকা পাঠিয়ে বলত, “মা তুমি আঁচলে গুঁজে রেখো না, যা লাগে কিনে খাও আমি আছি তো। আমার ইনকাম না খেয়ে তোমাদের মরতে দেব না।”’ সুফিয়া বেগম বলেন, ‘এখন এই কথা আমাকে কে বলবে? সবাই আছে শুধু আমার ছেলে নেই।’

বাবা শাহ সেকেন্দার বলেন, ‘আমার ধারণা, ওর গুলি লেগেছে, এটা জেনেই এলাকার লোকজন ও পুলিশ ষড়যন্ত্র করে মামলায় তাঁকে আসামি করেছে। আমার ছেলেকে গুলি করা থেকে শুরু করে চিকিৎসায় বাধা দেওয়া, মিথ্যা মামলা দেওয়া সব অপরাধের ন্যায়বিচার চাই আমি।’

২০ ডিসে, ২০২৪

আমার জন্য গর্বিত হয়ো, মা !


কান্নায় বার বার গলা ধরে আসছে আনাসের। অস্থির হয়ে পড়েছে সে। কিন্তু সে তো ছোট, তার কিছুই করার নেই। আজ ৪ আগস্ট। আজকেও খুনী হাসিনা খুন করেছে ১০০-এর বেশি মানুষকে। হাজার হাজার আহত মানুষ আর লাশের সারি দেখতে দেখতে রীতিমত কান্না করছে আনাস। কতটুকু আর বয়স তার! ১৫ বা ১৬। কিন্তু এতটুকু বয়সেই তার বয়সী ছেলেরা দায়িত্ব নিয়েছে রাষ্ট্রের। রাষ্ট্রকে তারা ফ্যাসিবাদ মুক্ত করবেই। জীবনের বিনিময় হলেও রক্তখেকো স্বৈরাচারী হাসিনাকে তারা শাস্তি দিবেই।

জুলাই বিপ্লব দুই ধাপে হয়। ১ম ধাপ ১৬-২১ জুলাই। এরপর আন্দোলন থমকে যায়। শুরু হয় গণগ্রেপ্তার। ঘরে ঘরে হানা দিয়ে ছাত্রদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে হাসিনা। একে একে ১৯ হাজার ছাত্রকে গ্রেপ্তার করে হাসিনা। আনাস এই কঠিন পরিস্থিতি দেখছে আর রাগে ক্ষোভে ফুঁসছে। সরকারের জুলুমের ভয়ে আনাসকে আন্দোলনে যেতে বাধা দেয় তার পরিবার। মা তার ওপর কড়া নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। আন্দোলনের ২য় পর্যায় শুরু হয় ৩১ জুলাই থেকে। ৩ ও ৪ আগস্ট আবারো মানুষ খুন করতে থাকে আনাস। আনাসের আর সহ্য হয় না। ৪ তারিখে ভয়াবহ গণহত্যা তাঁর ছোট্ট মনকে ভেঙ্গে দেয়। এদিকে হাসিনা বৃদ্ধ থেকে শিশু বাচ্চা কাউকে রেহাই দিচ্ছে না। ৭১ সালে পুরো ৯ মাসের যুদ্ধে ঢাকায় যত গুলি বর্ষিত হয়নি তার চেয়ে বেশি গুলি চলে জুলাই বিপ্লবের ১ মাসে।

আনাস আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। ৫ তারিখ সকালে সে ঘুম থেকে ওঠে একটি চিঠি লিখে তার মাকে উদ্দেশ্য করে।
//মা, আমি মিছিলে যাচ্ছি। আমি নিজেকে আর আটকিয়ে রাখতে পারলাম না। সরি আব্বুজান। তোমার কথা অমান্য করে বের হলাম। স্বার্থপরের মতো ঘরে বসে থাকতে পারলাম না। আমাদের ভাইরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কাফনের কাপড় মাথায় বেঁধে রাজপথে নেমে সংগ্রাম করে যাচ্ছে। অকাতরে নিজেদের জীবন বিসর্জন দিচ্ছে। একটি প্রতিবন্ধী কিশোর, ৭ বছরের বাচ্চা, ল্যাংড়া মানুষ যদি সংগ্রামে নামতে পারে, তাহলে আমি কেন বসে থাকব ঘরে। একদিন তো মরতে হবেই। তাই মৃত্যুর ভয় করে স্বার্থপরের মতো ঘরে বসে না থেকে সংগ্রামে নেমে গুলি খেয়ে বীরের মতো মৃত্যু অধিক শ্রেষ্ঠ। যে অন্যের জন্য নিজের জীবনকে বিলিয়ে দেয় সে-ই প্রকৃত মানুষ। আমি যদি বেঁচে না ফিরি, তবে কষ্ট না পেয়ে গর্বিত হয়ো। জীবনের প্রতিটি ভুলের জন্য ক্ষমা চাই।
-আনাস।//

আনাস উপলব্ধি করতে পারে তাকে তার মা বের হতে দিবে না, তাই সে চিঠি লিখে গোপনে বাসা থেকে পালিয়ে যায়। ৫ আগস্ট কর্মসূচি শাহবাগ অভিমুখে লংমার্চ। সকাল সাড়ে নয়টার মধ্যেই আনাস গেন্ডারিয়া থেকে শাহবাগ চলে আসে। হঠাত পুলিশ সায়েন্স ল্যাব থেকে গুলি ছুঁড়ে। ছাত্র জনতা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। পর মুহূর্তেই তারা ঘুরে দাঁড়ায়। ইট পাটকেল হাতে পুলিশকে প্রতিরোধ করতে থাকে। ছাত্রজনতা চারদিক থেকে ঘিরে ধরে পুলিশকে। পুলিশের বেপরোয়া গুলিতে একের পর এক মানুষ ঢলে পড়ে যাচ্ছে। তবুও মানুষের ভয় নেই।

এদিকে নিউমার্কেট থানা থেকে আরেকদল পুলিশ চাংখার পুল হয়ে শাহবাগের দিকে এগিয়ে আসে। তড়িৎ গতিতে প্রতিরোধ গড়ে তুলে ছাত্ররা। তাদের মধ্যে একজন ছিল আমাদের আজকের গল্পের নায়ক আনাস। চাংখার পুল থেকে পুলিশকে হটিয়ে দেয় ছাত্ররা। কিন্তু পিছু হটতে থাকা পুলিশের বেপরোয়া গুলিতে ঢলে পড়তে লাগলো একের পর এক ছাত্র। এর মধ্যে আনাসও গুলিবিদ্ধ হয়। দশম শ্রেণির কিশোর ছাত্র বুকের বাঁ পাশ দিয়ে হজম করে নেয় স্বৈরাচার হাসিনার নির্মম বুলেট। আনাস মাকে বলে এসেছিল আমার জন্য গর্বিত হয়ো। মাকে সেই গর্ব করার উপলক্ষ্য এনে দিয়ে আনাস বুক দিয়ে রুখে দিয়েছে হাসিনাকে। বাঁচিয়ে দিয়েছে আমাদের মতো কোটি কোটি জনতাকে।

আনাসের পকেটে একটি পুরোনো ছোট মোবাইল ফোল ছিল। এতে সবার নম্বর ছিল। সেখান থেকে নম্বর নিয়েই মা সানজিদা খানকে ফোন করে হাসপাতালে যেতে বলেছিলেন আন্দোলনকারীদের একজন। ফোন পেয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েন মা। তিনি ভেবেছিলেন, ছেলের শ্বাসকষ্ট আছে, সে হয়তো কাঁদানে গ্যাসের শেলে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আর বড় কোনো অঘটন ঘটলে গায়ে রাবার বুলেট লাগতে পারে। তবে হাসপাতালে গিয়ে মা দেখেন, সিঁড়ির পাশে একটি স্ট্রেচারে পড়ে আছে ছেলের রক্তাক্ত নিথর দেহ। যেই দেহে কোনো প্রাণ নেই।

সানজিদা খান বলেন, ছেলের লাশ হাসপাতাল থেকে বাইরে আনার পর বাসায় ফেরার জন্য কোনো যানবাহন পাওয়া যাচ্ছিল না। ব্যাটারিচালিত এক অটোরিকশাচালক যেতে রাজি হন। অটোরিকশায় বসে কোলে করে ছেলের লাশ বাসায় আনি। যে দেশটাকে ছেলে ভালোবাসল, সেই দেশ তো নিরাপত্তা দিতে পারল না। আমার বুক তো খালি হয়ে গেল। আল্লাহ যেন এর বিচার করেন।

অটোরিকশায় তিনি ও তাঁর স্বামী বসেন। কোলে নেন ছেলের লাশ। এভাবেই বাসায় ফেরেন তাঁরা। আন্দোলনে যাওয়ার জন্য উদ্গ্রীব ছিল ছেলে। বাবার নিষেধ থাকায় সে যেতে পারছিল না। তবে শেষ পর্যন্ত ছেলেকে আর আটকে রাখা যায়নি। ছেলে আন্দোলনে যেতে পারছিল না বলে মন খারাপ করত।

শাহারিয়ার খান আনাস গেন্ডারিয়ার আদর্শ একাডেমিতে বিজ্ঞান বিভাগে দশম শ্রেণিতে পড়তো। দুপুরে স্কুল থেকে ছেলে ফিরলে সবাই মিলে খাবার খেতেন। সানজিদা খানের কোনো মেয়ে না থাকায় আনাসই তাঁকে তাঁর দৈনন্দিন কাজে সাহায্য করত। মায়ের কাছে ছেলের তেমন কোনো বায়না ছিল না। করোনা মহামারি দেখা দেওয়ার পর থেকে বাবার ব্যবসা ভালো যাচ্ছিল না। বিষয়টি বুঝত আনাস। বাসার একটি চাবি আনাসের কাছে থাকত। অন্যদিন চাবিটি সঙ্গে রাখলেও সেদিন ছেলে ঠিকই চাবিটি বাসায় রেখে গিয়েছিল।

আনাসের শাহদাতের খবর যখন বাবা মা পেয়েছিলেন ততক্ষণে আনাসের রক্তধৌত হয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গিয়েছিল। ডাইনি হাসিনা পালিয়ে গিয়েছিল। সারা দেশবাসী আনন্দ উল্লাসে ফেটে পড়েছে। ঢাকার এক কোটি মানুষ রাস্তায় নেমে আনন্দ করছিল। কিন্তু আনাসের বাবা মা হারিয়ে ফেললেন তাদের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। হাসিনা পতনের খুশিতে আনন্দ করার অবকাশ পাননি আনাসের পরিবার। তাদের ছোট্ট আনাসের রক্তেই পবিত্র হয়েছে বাংলাদেশ।

আনাস শুধু তার মা-বাবার গর্ব নয়। আনাস আমাদের গর্ব। আনাস যেভাবে বীর বিক্রমে ও ভালোবাসায় আমাদের ডাইনির হাত থেকে রক্ষা করেছে আমরাও সেই ভালোবাসা দিয়ে আনাসকে স্মরণ করবো ইনশাআল্লাহ।

৫ ডিসে, ২০২৪

যদি বেঁচে না ফিরি গর্বিত হয়ো মা।

 


৪ আগস্ট, রাত ১১ টা । উত্তেজনা কাজ করছে সা'দের মধ্যে। অনলাইনে বন্ধুদের সাথে মিটিং করছে সে। আগামীকাল লংমার্চ কীভাবে সফল করবে এটা নিয়েই তাদের আলোচনা। নানান দিক নিয়ে আলোচনা করছিল। এর মধ্যে মূল বিষয় ছিলো কীভাবে ডাইনী শেখ হাসিনার পোষা সন্ত্রাসী পুলিশ লীগকে দমানো যায়।

একইসাথে আওয়ামী যুবলীগ ও ছাত্রলীগও আজকে অস্ত্র নিয়ে হামলা চালিয়েছে। যদিও সা'দরা ছাত্রলীগ-যুবলীগকে খুব একটা পাত্তা দিচ্ছে না। কারণ তাদের ধাওয়া দিলেই পালিয়ে যায়। তুমুল আলোচনা শেষে এই মর্মে তারা সিদ্ধান্তে আসলো যদি হাজার হাজার মানুষ নামে তবেই সব প্রতিকূলতা এড়ানো যাবে। সা'দরা সাভারে থাকে। সেখান থেকে ঢাকা অভিমুখে রওনা হবে তারা।

সিদ্ধান্ত হলো, শুধু ছাত্ররা নয়, সর্বস্তরের মানুষকে নিয়ে রওনা হতে হবে। তাই মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। তারই অংশ হিসেবে সা'দ দায়িত্ব নিলো অনলাইনে প্রচারের জন্য কিছু পোস্টার সে বানাবে। সা'দ মাত্র দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র হলেও সে ছিল একজন ফ্রিল্যান্সার। গ্রাফিক্সের কাজ জানে। সা'দ পোস্টার বানিয়ে ফেসবুকে পোস্ট করলো, 'যে দেশের ইতিহাস রক্ত দিয়ে শুরু হয়েছে, ওই ইতিহাস আবার লিখতে রক্তই লাগবে'।

কে জানতো এই সা'দের রক্ত দিয়েই লেখা হবে নতুন স্বাধীনতার গল্প।
পরিবারের বড় ছেলে ছিল আফিকুল ইসলাম সাদ। স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হওয়ার। পরিবারের আর্থিক দূরাবস্থার কথা ভেবে ফিল্যান্সারও হয়েছে। ছোট বয়সেই আয় করতো সে। মাধ্যমিক পাস করার পর ভর্তি হয় ঢাকার সাভার ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজে। ইচ্ছা পূরণে মন দিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছিল। এরই মধ্যে স্বৈরাচার পতনের এক দফা আন্দোলনের ডাক দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। অন্য শিক্ষার্থীদের মতো দেশ বাঁচানোর জন্য রাজপথে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাদ। ৫ আগস্ট 'মার্চ টু ঢাকা' কর্মসূচিতেও অংশ নেয় এ মেধাবী ছাত্র।

৫ আগস্ট দুপুরে তার সঙ্গে সর্বশেষ কথা হয় পরিবারের সদস্যদের। এর পর আর যোগাযোগ করা যায়নি। সেদিন গণঅভ্যুত্থানের মুখে ডাইনি হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর সা'দের সন্ধানে বের হন তার স্বজন। তার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সাভারের বিভিন্ন হাসপাতালে তন্ন তন্ন করে খোঁজ করা হয়। এক পর্যায়ে তারা জানতে পারেন, সাভার এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী ভর্তি আছে। সেখানে গিয়ে কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর অজ্ঞান অবস্থায় পাওয়া যায় সা'দকে।

সা'দরা দুই ভাই। ছোটজন হাইস্কুলে পড়ে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক দফা দাবি আদায়ের সংগ্রামে শামিল হয়ে ধামরাই হার্ডিঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের সামনে মিছিল করা অবস্থায় পুলিশের গুলিতে আহত হয় সাদ। সাদ তার মাকে বলেছিল, 'যদি বেঁচে না ফিরি গর্বিত হয়ো মা।' তার মা এখন ছেলের ছবি বুকে জড়িয়ে নিয়ে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন। সাদ সাভার ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ত। অধরাই থেকে গেল তার চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন।

মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ার দরগ্রাম এলাকার শফিকুল ইসলামের ছেলে সাদ। মিছিলে নির্বিচারে গুলি চালায় পুলিশ লীগ। হঠাৎ একটি গুলি সাদের কপালের বাঁ পাশে ঢুকে যায়। ঢলে পড়ে রাস্তায়। সহযোদ্ধারা উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে। তিন দিন এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে ৮ আগস্ট সকালে মারা যায় সে।

কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে আফিকুল ইসলাম সা'দ ফেসবুকে বেশ সক্রিয় ছিল। গত ১৬ জুলাই বাংলাদেশের মানচিত্র দিয়ে একটি ব্যানার বানিয়ে ফেসবুকে 'কোটা আন্দোলন' শব্দটি কেটে 'স্বাধীনতা আন্দোলন' লিখেছিল। তার সেই চিন্তার পথ ধরেই আমরা স্বাধীন হয়েছি। কিন্তু হারিয়ে ফেলেছি সা'দকে।

সা'দের মা আঞ্জুমান আরা জানান, ৫ আগস্ট সকালে ছেলে তাঁর বিছানায় শুয়ে ছিল। হঠাৎ একটি ফোন আসে। মায়ের কাছ থেকে ৩০ টাকা নিয়ে তড়িঘড়ি করে বের হয়ে যায়। এই মা পরে শুনেছেন, ধামরাই থানা থেকে বের হয়ে পুলিশ গুলি করতে করতে সামনে এগোলে হার্ডিঞ্জ স্কুল অ্যান্ড কলেজের মূল ফটকের কাছে ছেলে গুলিবিদ্ধ হয়। গুলিটি লাগে সা'দের কপালের বাঁ পাশে। অস্ত্রোপচার করা সম্ভব হয়নি বলে গুলিটি কপালে লেগে বাইরে বের হয়েছিল কি না, তা–ও জানা যায়নি।

আঞ্জুমান আরা আরও জানান, বেলা দেড়টার দিকে একজন ফোন করে জানান, সা'দের গায়ে গুলি লেগেছে। গুলি লাগায় প্রচুর রক্তক্ষরণ হতে থাকে। কয়েকজন মিলে সা'দকে হাসপাতালে ভর্তি করার চেষ্টা করেন, কিন্তু ভয়ে কোনো হাসপাতাল ভর্তি করতে রাজি হয়নি। সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথেও পুলিশের গোলাগুলি চলে। পরে অ্যাম্বুলেন্স ওই পথ থেকে ফেরত এসে নয়ারহাট হয়ে গ্রামের ভেতর দিয়ে আবার এনাম হাসপাতালে যায়। সেখানে তাকে ভর্তি করা হয়। হাসপাতালে পৌঁছাতে প্রায় তিন ঘণ্টা লেগে যায়।

মা আরো বলেন, 'আন্দোলনে মারা গেলে সবাই আমাকে শহীদের মা বলবে, এটা বলত ছেলেরা। মা আঞ্জুমান আরা ৫ আগস্ট ছেলেকে বারবার ফোন দিচ্ছিলেন। ছেলে তাঁকে নিয়ে চিন্তা না করতে এবং ফোন করে বিরক্ত না করার জন্য বলেছিল। এটাই ছিল মা ও ছেলের শেষ কথা। বেলা পৌনে একটার দিকে তিনি আবার ছেলেকে ফোন দিয়েছিলেন, কিন্তু ছেলে আর ফোন ধরেনি। পরে অ্যাম্বুলেন্সে রক্তে ভেসে যাওয়া ছেলেকে যখন দেখেন, তখন ছেলে আর কোনো সাড়া দেয়নি, শুধু নিশ্বাস নিচ্ছে, বেঁচে আছে, এটুকুই বুঝতে পেরেছিলেন এই মা।

বাবা শফিকুল ইসলাম একটি কোম্পানিতে উচ্চপদে চাকরি করতেন। দুই বছর আগে চাকরিটি চলে যায়। তার পর থেকেই সংসারে টানাটানি যাচ্ছে। সা'দ ফ্রিল্যান্সিং করে কিছু টাকা আয় করত। নিজের খরচের পাশাপাশি সংসারেও কিছু টাকা দিত। ডিসেম্বরে মা, বাবা ও ভাইকে নিয়ে সাজেকে বেড়াতে যেতে চেয়েছিল। ভাই সাজিদুল ইসলাম জানায়, ভাইকে নিয়ে যখন হাসপাতালে গিয়েছি, ততক্ষণে মানুষ বিজয় মিছিল নিয়ে বের হয়েছে। স্বাধীনতা পেতে ভাইকে হারাতে হবে, তা তো জানা ছিল না। তাই বিজয়ের উল্লাস করতে পারিনি। শুধুই কানছি।

ছেলে মারা যাওয়ার তিন–চার দিন আগে মা আঞ্জুমান আরা ছেলেকে পরিবারের চারজন মিলে একটি ছবি তোলার কথা বলেছিলেন। মায়ের আক্ষেপ, 'চারজন মিলে সেই ছবি আর কোনো দিন তোলা হবে না।'

সা'দ বাইচান্স আন্দোলনে যায় নি। সে স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের হাত থেকে দেশকে ও দেশের মানুষকে উদ্ধার করার জন্য লড়াই করেছে। সে ১৬ তারিখ থেকে এই আন্দোলনকে স্বাধীনতা আন্দোলন হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য সে তার জীবন দিয়েছে। আমরা আমাদের এই যোদ্ধাকে ভুলে যাবো না। তাকে মাথায় তুলে রাখবো ইনশাআল্লাহ।

১ ডিসে, ২০২৪

মা শাহীনূরের অবলম্বন এখন রক্তাক্ত শার্ট

 

বাইরে আন্দোলন চলছে। ভাত খাওয়া শেষে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিল মাহদী। তাকে নামতেই হবে নিচে। কিন্তু মায়ের বাধায় সে নামতে পারছে না। এদিকে বার বার ফোন দিচ্ছে রোহান।

রোহান আহমেদ খান আর মাহাদী হাসান (পান্থ) ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে একসঙ্গে বড় হয়েছেন। রোহান বিজ্ঞান আর মাহাদী কমার্স থেকে এবার এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছিলো। ইন্টার পরিক্ষার্থী হওয়ায় কোটা সংস্কার আন্দোলনে তারা শুরু থেকেই ততটা যুক্ত ছিল না। তবে আবু সাঈদের শাহাদাতের পর তারা তাদের কলেজে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কমিটি তৈরি করেছে।

মাহাদী পড়তো নারায়ণগঞ্জের সরকারি তোলারাম কলেজে। অন্যদিকে রোহান ছিল দনিয়া কলেজের। দুইজন দুই কলেজের হলেও তারা এক এলাকাতেই বড় হয়েছে। রোহান আর মাহাদীর বাসা যাত্রাবাড়ীর দক্ষিণ দনিয়ায় কাছাকাছি দূরত্বে। মাহাদীর বাসা পাটেরবাগে আর রোহানের বাসা বায়তুস সালাম জামে মসজিদ রোডে। তারা বন্ধু ছিল এবং আন্দোলনেও ছিল তারা একে অপরের বিশ্বস্ত সঙ্গী।

মা'কে ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে মাহাদী। এর আগে দুপুরে বাবা জাহাঙ্গীর হোসেন আর অনার্সে পড়া বড় ভাই মেরাজ হোসেনের সঙ্গে জুমার নামাজ পড়ে সে। তখনই তারা দেখেছে পরিস্থিতি কতটা খারাপ। বাবা হাত ধরে তাকে ঘরে নিয়ে আসে। তিনজন একসঙ্গে দুপুরের খাবার খান।

এদিকে মাহাদীর গলা দিয়ে ভাত নামছে না। তার বন্ধুরা তার জন্য অপেক্ষা করছে। বিশেষ করে তার অন্যান্য বন্ধু সন্ত্রাসী পুলিশের সাথে লড়ছে, আহত হচ্ছে, গুলি খাচ্ছে, শহীদ হচ্ছে। মাহাদী তার বন্ধুদের সাথে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছে যে, ডাইনী হাসিনার পতন না হওয়া পর্যন্ত তারা লড়াই করে যাবে।

এক পর্যায়ে বিকেলে মাহাদী ঘর থেকে বের হয়ে যায়। বন্ধুরা তখন রাস্তায় ওঠার প্লান করছিল। কিন্তু পেরে উঠছিলো না। বন্ধুদের মধ্যে রোহান ছিল সবচেয়ে সাহসী। তার নেতৃত্বে তারা একেকবার একেক পরিকল্পনা করছিল। অবশেষে তারা প্ল্যান করেছে আন্দোলনকারী বীর ছাত্ররা দুই ভাগ হয়ে রাস্তার দুই পাশে দুই গলিতে অবস্থান নিবে। এক গ্রুপ শ্লোগান দিয়ে রাস্তায় উঠে আসবে। পুলিশ তাদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। তখন অন্যদল ইট পাটকেল নিয়ে সন্ত্রাসী গণহত্যাকারী হানাদারা আওয়ামী পুলিশ লীগের বিরুদ্ধে আক্রমণ করবে।

পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ হয়েছে। ভয়ংকর সংঘর্ষ লেগে গেলো। দেশের মানুষকে রক্ষা করতে শাহদাতের নেশায় পঙ্গপালের মতো যাত্রাবাড়ির ছাত্ররা পুলিশকে নাজেহাল করে ফেললো। পুলিশকে রায়েরবাগ থেকে পিছু হটাতে হটাতে একেবারে যাত্রাবাড়ী থানার ভেতরে ঢুকিয়ে দিলো।

বাংলার সাহসী বীর সন্তানেরা আমাদের জীবন রক্ষা করতে, এদেশের মানুষের স্বাধীনতা আনতে নিজের জীবন বাজি রেখেছে। রায়েরবাগ থেকে কাজলা পর্যন্ত দুই কিলোমিটার রাস্তা পুরো রক্তাক্ত হয়ে গেছে। শত শত কিশোর ছেলে গুলি খেয়ে আহত হয়েছে। তাদের তাজা রক্তে পবিত্র হয়েছে আমাদের দেশ। দশজনের মতো শহীদ হয়েছে।

আর সেই শাহদাতের তালিকায় আছে আমাদের বীর, আমাদের প্রাণ, আমাদের সাহসী সন্তান, আমাদের কলিজার টুকরো মাহাদী। ঘর থেকে বের হওয়ার আধাঘন্টার মধ্যেই আমাদের বীর মহান প্রভুর সান্নিধ্যে চলে যায়। ডাইনী হাসিনার ভয়ঙ্কর বুলেট উলোট পালোট করে দেয় মাহাদীর ছোট বুক। এই ছোট বুক দিয়েই মাহাদী আমাদের রক্ষা করে গেছে। আমাদের জীবন বাঁচিয়েছে।

মাহাদী ঘর থেকে বের হওয়ার ৪০ মিনিটের মাথায় কাজলার সালমান হাসপাতাল থেকে মাহাদীর এক বন্ধু ফোন করে জানায়, মাহাদীর শরীরে গুলি লেগেছে। সেই মাহাদীকে কত ডাকলো মা, কত ডাকলো বাবা। মাহাদী তো তখন সবুজ পাখি হয়ে ঘুরছে জান্নাতে। সে কীভাবে জবাব দেবে!!

মাত্রই একসাথে থাকা পরিবারের সদস্যরা বুঝতেই পারলো না, কত দ্রুত রাক্ষসী হাসিনা তাদের সন্তানকে শেষ করে দিলো। মাহাদীর মা শাহীনূর বলছিলেন, ছেলে কোটা আন্দোলনকারীদের ওপর নির্যাতনের ছবি ও ভিডিও দেখে কষ্ট পেত। নিজেও আন্দোলনে যেতে চেয়েছিল। যেহেতু পরীক্ষা চলছে, তাই নিষেধ করেছিলাম। কিন্তু সে তো বীর, সে তো শহীদ। সে তো না যেয়ে পারবে না।

মারা যাওয়ার সময় মাহাদীর পরনে ছিল গোলাপি রঙের একটি শার্ট, রক্তে তা কমলা হয়ে গেছে। রক্তমাখা শার্টটা না ধুয়ে সেভাবেই রেখে দিয়েছেন শাহীনূর বেগম। রোদ উঠলে শুকাতে দেন। এটাই এখন মা শাহীনূরের অবলম্বন। এটাকে আঁকড়ে ধরেই বাকী জীবন পাড়ি দিতে চান।

মাহাদীর বাবা জাহাঙ্গীর হোসেন ছেলের পরীক্ষার প্রবেশপত্র হাতে নিয়ে বসে ছিলেন। একটু পরপর হাউমাউ করে কাঁদছিলেন। মাহাদী তার কাছে আবদার করেছে সে জাপানে যাবে। জাপানে মাহাদীকে পড়ানোর জন্য প্রস্তুতিও নিয়ে রেখেছিলেন তিনি। এই কথাগুলো স্মরণ করছেন আর বুক ভাসিয়ে দিচ্ছেন। কীভাবে আমরা এই বাবা-মাকে সান্ত্বনা দেব? কীভাবে তাদের ক্ষত পূরণ করবো?

আমাদের মাহাদী আমাদের অনুপ্রেরণা। ১৯ জুলাই রোহান ও মাহাদীসহ শতাধিক মানুষ জীবন দিয়েছে। আমরা মাহাদীকে স্মরণ করে যাবো যেভাবে মাহাদী আমাদের ভালোবেসে আমাদের জন্য জীবন বাজি রেখেছে, নিজের ছোট শরীর দিয়ে দানবকে রুখে দিয়েছে।


৩০ নভে, ২০২৪

বন্ধুকে সাথে নিয়ে জান্নাতে যাত্রা

 

- দোস্ত তুই কইরে?
- বাসায়!
- এখনো বাসায়?
- বাহির হইতে পারতেছি না, একটু অপেক্ষা কর।
- তোর বাসার নিচে আমি, তাড়াতাড়ি নাম

রোহান দাঁড়িয়ে আছে মাহাদীর বাসার নিচে। রোহানের বুঝ বুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই সে দেখে আসছে শেখ হাসিনার জুলুম, দুর্নীতি ও লুটপাট। এদেশের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো যখন নিশ্চিত হয়েছে তারা আর আন্দোলন করে এই জুলুম থেকে জনগণকে উদ্ধার করতে পারবে না, তখন রোহানের মতো কিশোর তরুণরা সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা হাসিনার জুলুম থেকে দেশকে মুক্ত করবেই। এজন্য প্রয়োজনে তারা জীবন দেবে।

রোহান তার বন্ধুদের সাথে অপেক্ষা করছে। মাহাদী নামলেই তারা রাস্তায় উঠবে। রাস্তায় ওঠা কোনো সহজ কাজ ছিল না। রাস্তায় উঠলে পুলিশ গুলি করছে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো স্নাইফারের গুলি। কই থেকে যে গুলি হয় তাই বুঝা যায় না।

১৬ জুলাই ও ১৮ জুলাই বহু মানুষের মৃত্যুর পর রোহানরা সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা আর ফিরে যাবে না। মাহাদী বের হয়ে এলে তারা সবাই গলির মুখে যায়। পাটেরবাগ থেকে বেরিয়ে রায়েরবাগে ওঠার সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে না। এর মধ্যে আন্দোলনকারী ছাত্রের সংখ্যা দুইশত পার হয়ে যায়। একে অপরের দিকে তাকিয়ে চোখে চোখে ইশারা করে। সবাই প্রস্তুতি নেয়, একযোগে পুলিশ অভিমুখে দৌড় দেওয়ার জন্য।

তখন বিকেল তিনটা। রোহান গগনবিদারি শ্লোগান দেয়,
//আমার ভাই মরলো কেন
খুনী হাসিনা জবাব দে।//

//আমার ভাই কবরে
খুনি কেন ওপরে?//

মুহূর্তের মধ্যেই মৌমাছির মতো ঝাঁকে ঝাঁকে ছাত্ররা রাস্তায় চলে আসে। পুলিশ পিছু হটতে থাকে। একইসাথে সন্ত্রাসী পুলিশ লীগও সরাসরি গুলি করতে থাকে। কিছুক্ষণ পর পর গুলিতে লুটিয়ে পড়ছে ছাত্ররা। এত গুলি, এতো লাশ, এতো রক্ত কোনো কিছুই দমিয়ে রাখতে পারছে না ছাত্রদেরকে।

এক পর্যায়ে গুলি এসে লাগে রোহানের বন্ধু মাহাদীর বুকে। মাহাদী মুহূর্তেই লুটিয়ে পড়ে। মাহাদীকে নিয়ে রোহান ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আরো দুইজন বন্ধুকে সাথে নিয়ে মাহাদীকে হাসপাতালে পৌঁছে দেয় রোহান। ফোন করে মাহাদীদের বাসায় খবর পাঠায়।

বন্ধুর জন্য কলিজা ফেটে যাচ্ছে। অজ্ঞান হয়ে থাকা বন্ধুকে ডাক্তাদের হাতে ছেড়ে দিয়ে ফিরে আসে রোহান। আবার কী জানি ভেবে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় মাহাদীর। যেন বলতে চাইছে, বন্ধু যাও, আমিও আসতেছি। তারপরও হাসিনার শেষ দেখে ছাড়বো।

রোহান স্কাউট করা ছেলে। প্রাথমিক চিকিৎসার ট্রেনিং নেওয়া আছে তার। শত শত আহত আন্দোলনকারীকে সেবা দিয়ে যাচ্ছে সে। কাউকে পানি খাওয়াচ্ছে, কাউকে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিচ্ছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের যাত্রাবাড়ী অংশ এখন আন্দোলনকারীদের দখলে। গলা ফাটিয়ে বিক্ষোভ করছে সবাই।

রোহান ঘুরে ঘুরে খবর নিচ্ছে সবার। ইতোমধ্যে খবর এলো তার বন্ধু মাহাদী আর নেই। বন্ধুরা পরস্পর গলা জড়িয়ে কাঁদলো। বন্ধুর রক্ত ছুঁয়ে শপথ করলো আমাদের বন্ধুর খুনী হাসিনাকে পরাজিত না করা পর্যন্ত শান্ত হবো না। আমরা প্রতিশোধ নিবোই।

আসরের নামাজের পরে পুলিশ নতুনভাবে অস্ত্র সজ্জিত হয়ে ব্রাশ ফায়ার করতে করতে রাস্তায় নামলো। প্রথমে পিছু হটে ছাত্ররা আবারো তাদের ঘিরে ফেললো। লড়াই শুরু হলো। এক অসম যুদ্ধ। একদিকে হাজার হাজার নিরস্ত্র জনতা। অন্যদিকে শতাধিক সশস্ত্র পুলিশ লীগ। পুলিশলীগকে সহায়তা করার জন্য এবার এলো র‍্যাবের হেলিকপ্টার। হেলিকপ্টার থেকে গুলি ছুঁড়ে ছাত্রদের ছত্রভঙ্গ করতে লাগলো র‍্যাব।

বন্ধুদের লিড দিয়ে নিয়ে যাওয়া রোহানকে টার্গেট করে হেলকপ্টারে থাকে র‍্যাবের সন্ত্রাসীরা। তাকে লক্ষ্য করে গুলি করে। কয়েকটি লক্ষ্যভ্রষ্ট হলেও একটি গুলি রোহানের বুককে ঝাঁঝরা করে দেয়। লুটিয়ে পড়ে রোহান। বন্ধু মাহাদীকে বিদায় দেওয়ার দুই ঘন্টার মধ্যে তার সাথী হয়ে যায় রোহান।

এইচএসসি পরীক্ষার্থী রোহানের স্বপ্ন ছিলো সেনা কর্মকর্তা হওয়ার। কিন্তু জুলাই মাসের মাঝামাঝি বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন যখন সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণে গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয় তখন ১৯ জুলাই রোহান পুলিশের গুলিতে শহিদ হন। সে সাথে স্বপ্নও ধুলিস্যাৎ হয়ে যায় তার। বাবা-মায়ের স্নেহ, ভালবাসা এবং পারিবারিক বন্ধনকে উপেক্ষা করে রোহানের মতো অনেক কিশোর-কিশোরীই আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল। ফলে তাদের জোরালো এই প্রতিবাদ এক পর্যায়ে ছাত্র-জনতার যৌথ আন্দোলনে রূপ নেয়। যার মধ্যে দিয়ে স্বৈরাচারী শাসক শেখ হাসিনার ১৬ বছরের দীর্ঘ ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসান ঘটে।

রোহানের বাবা বলেন আমরা প্রতিবেশীদের শেষ বারের মতো দেখানোর জন্যই রোহানের লাশ মসজিদে নিয়েছিলাম। কিন্তু রোহানের সহপাঠী, বন্ধুবান্ধব এবং শিক্ষকসহ হাজার হাজার মানুষ তাকে শেষ বারের মতো দেখার জন্য মসজিদে ভিড় করে এবং সেখানে তার প্রথম জানাজায় অংশ নেয়।

রোহানের মধ্যে আন্দোলনের নিয়ে রোহানের মধ্যে একাগ্রতা ছিল। তার মা মনিরা বেগম জানান, রোহান শুরু থেকেই আন্দোলনে অংশ নিতো। কিন্তু তারা বিষয়টি জানতেন না। প্রথম যেদিন রোহান আন্দোলনে যায় সেদিন সে আমাকে বলেছিলো যে সে কলেজের একটি অনুষ্ঠানে যাচ্ছে। কিন্তু ১৬ জুলাই আমি আমার এক ছাত্রের মায়ের কাছে জানতে পারি, রোহানকে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নিতে দেখা গেছে। সেসময় রোহানকে ছাত্র আন্দোলনে অংশগ্রহণের কথা জিজ্ঞেস করলে প্রথমে সে অস্বীকার করে।

অশ্রুসিক্ত কন্ঠে তিনি বলেন, আমি তাকে আন্দোলনে যেতে নিষেধ করলে সে আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করে। সে বলে, যখন আমার অনেক ভাই আন্দোলনে যোগ দিয়েছে তখন তো আমি আর ঘরে বসে থাকতে পারি না। শাহদাতের দুই দিন আগে অর্থাৎ ১৭ জুলাই রোহান আন্দোলনে অংশ নিলে সেদিন তার পায়ে ইটের আঘাত লাগে। এতে তিনি আহত হলে মায়ের কাছে আন্দোলনে যোগ দেয়ার কথা স্বীকার করেন এবং পায়ের একটা এক্সরে করার কথা বলেন।

রোহান আবু সাঈদ ও মীর মুগ্ধর মৃত্যুতে অত্যন্ত মর্মাহত হয়েছিলো উল্লেখ করে মনিরা বেগম বলেন, ১৮ জুলাই সন্ধ্যায় রোহান আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করছিল আবু সাঈদ আর মুগ্ধ ভাইকে দেখো। তাদের হত্যা করা হয়েছে। আমরা সবাই যদি ঘরে বসে থাকি এবং একে অপরকে আন্দোলনে যোগ দিতে বাধা দিই, তাহলে আমরা কীভাবে স্বাধীনতা অর্জন করব? ১৮ জুলাই সারারাত রোহান "আমি হবো আন্দোলনের চাবি, তোমরা করবে সিংহাসনের দাবি" এই শ্লোগানটি আবৃত্তি করেছিল।

রোহানের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তার টেবিলে স্কাউটের ইউনিফর্মসহ একটি ছবি এবং বাংলাদেশ স্কাউটসের সম্মাননা স্মারকসহ তার সব বই এবং জিনিসপত্র একইভাবে রাখা আছে। তার টেবিলেই একটি কোরআন শরীফ রাখা। যা তিনি পাঠ করতেন। কোরান শরীফে রোহানের দেয়া চিহ্নটি দেখিয়ে তার মা বলেন, 'এখন আমি এই কোরআন তেলাওয়াত করি, কিন্তু আমি আমার ছেলের দেয়া চিহ্ন সরাইনি। এটা আমার ছেলের স্মৃতি হিসেবে রেখে দিয়েছি।'

রোহান ও মাহাদীরাই আমাদের প্রাণ ভোমরা। আমরা যদি তাদের রক্তকে অস্বীকার করি তাহলে নিজেদেরই অস্বীকার করা হবে। রোহানসহ সকল শহীদের স্মৃতি আমরা আগলে রাখবো যেভাবে তারা আমাদের আগলে রেখে স্বাধীনতা এনে দিয়েছে।

২৬ নভে, ২০২৪

সবাই ভয় পেয়ে পেছনে চলে গেলে হবে নাকি?

উল্লাস চলছে, বিজয়ের উল্লাস!!

হঠাৎ গুলির শব্দ আসলো থানার দিক থেকে। দৌড়ে গেলো ইয়াসির ও তার বন্ধুরা। যাত্রাবাড়ী থানা থেকে সমানে গুলি করছে ফ্যাসিস্ট হাসিনার পোষা সন্ত্রাসী পুলিশ লীগ। প্রতিরোধের ব্যবস্থা করলো ইয়াসির ও বন্ধুরা। এক পর্যায়ে পিছু হটলো পুলিশ। তারা যাত্রাবাড়ী থানার অভ্যন্তরে ঢুকে গেল। ইতোমধ্যে ৫ জন স্পট ডেড। আহত পঞ্চাশের কাছাকাছি। আহত ও নিহতদের হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হলো। হাজার হাজার প্রতিবাদী ঘিরে ফেললো যাত্রাবাড়ি থানা। বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে লাগলো তারা।

সেদিন ছিল ৫ আগস্ট। ডাইনী শেখ হাসিনা পালিয়ে গেল ভারতে। দুপুর থেকেই শুরু হলো জনতার বাঁধভাঙ্গা উল্লাস। বিপ্লবীরা আল্লাহকে সিজদা দিয়ে শুকরিয়া আদায় করতো। মিষ্টি বিতরণ করতে লাগলো জনতা। এমন এক আনন্দঘন মুহূর্ত বিষাদে পরিণত করলো যাত্রাবাড়ী থানার পুলিশেরা। হাসিনার পতনে জনতার এমন উল্লাস তাদের পছন্দ হয়নি। তাই তারা গুলি করে মানুষকে ছত্রভঙ্গ করে দিতে চাইলো।

নারায়ণগঞ্জের সরকারি আদমজীনগর এম ডব্লিউ কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিলো ইয়াসির সরকার। তাদের বাসা শনির আখড়ায়। যাত্রাবাড়ির আন্দোলনের একজন সফল বিপ্লবী ইয়াসির। তাদের জীবন বাজি রেখে করা আন্দোলনে হাসিনাকে শেষ পর্যন্ত পালিয়ে যেতে হয়েছে। ঢাকার যেসব স্থানের মানুষ সবচেয়ে বেশি রক্ত দিয়েছে তার মধ্যে যাত্রাবাড়ী অন্যতম। খুব সম্ভবত সবচেয়ে বেশি শাহদাতের নজরানা এই যাত্রাবাড়ীতেই। বিজয়ের পরেও যাত্রাবাড়ী থানার পুলিশ মানুষ খুন করে।

প্রতিরোধ গড়ে তুলে ইয়াসিররা। প্রায় শ'খানেক পুলিশ আবারো গুলি করতে করতে থানা থেকে বেরিয়ে আসে। ইয়াসিররা ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে পুলিশদের উদ্দেশ্যে। এক পুলিশের নির্মম গুলি এসে এফোঁড় ওফোঁড় করে দেয় ইয়াসিরের ছোট্ট বুক। থেমে যায় ঘাতকের বুলেট। প্রবল আক্রোশে সন্ত্রাসী পুলিশ আবারো গুলি করে। আরেকটি গুলি এসে গুড়িয়ে দেয় কিশোর ইয়াসিরের পাঁজরের হাড়। না, তারপরও খুনীদের রক্ত পিপাসা থাকে। লুটিয়ে পড়া ইয়াসিরের কোমরে আরেকটি গুলি করে তারা। ৫ আগস্ট সন্ধ্যায় সারা দেশের বিপ্লবীরা যখন উল্লাস করছে তখন একের পর এক যাত্রাবাড়ীর বিপ্লবীরা শহীদ হচ্ছিলেন।

পুলিশের গুলিতে ইয়াসিরের বন্ধুরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েছিলো। ইয়াসিরের লাশ নিয়ে কয়েকজন মানুষ রওনা হন হাসপাতালের দিকে। কিন্তু তারা তার পরিচয় জানেন না। এমন সমন একজন বলে উঠলেন, এরে আমি চিনি, এর নাম ইয়াসির। ইয়াসিরকে বহনকারীরা ইয়াসির না শুনে শুনেছে ইয়াসিন। লাশটার নাম হয়ে পড়ে ইয়াসিন। চলে যায় ঢাকা মেডিকেলের মর্গে।

এদিকে ইয়াসিরকে ফোনে না পেয়ে ইয়াসিরের পরিবার বেশ উদ্বিগ্ন। তারা সব যায়গায় খবর নেওয়া শুরু করেছিলেন। কিন্তু কেউই খবর দিতে পারে নি। ইয়াসিরের বড় বোন ফেসবুকে ইয়াসিরের একটি ছবি পোস্ট করে জানায়, ইয়াসিরকে পাওয়া যাচ্ছে না। অনেকেই ইয়াসির খোঁজ করে। ঢাকা মেডিকেলের মর্গ থেকে করা লাইভ করে এক ব্যক্তি। সে লাইভে ইয়াসিরের মতো একজনকে দেখা যায়। লাইভের লিংক দেওয়া হয় ইয়াসিরের বোনের করা পোস্টের কমেন্টে।

ইয়াসিরের পরিবার দেখে বুঝতে পারে এটা তাদের ইয়সিরেরই লাশ। তার পরিবার চলে যায় মর্গে। দেখে, ইয়াসিরের নিথর দেহ। পাশে রয়েছে একটি চিরকুট। তাতে লেখা 'ইয়াসিন সরকার'। কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে ইয়াসিরের পরিবার। খুনী হাসিনার পতনে যাত্রাবাড়ীর সফল বিপ্লবী বীর ইয়াসিরের পরিবারের নেমে আসে ঘন দুর্যোগ।

ইয়াসিরের বোন হাফসা বলেন, "মর্গে গিয়ে ভাইকে দেখে মনে হলো, আমি কোনো দুঃস্বপ্ন দেখছি। ভাইয়ের গালে স্পর্শ করে দেখলাম, একদম ঠান্ডা হয়ে আছে। হাতও একদম শক্ত। ইয়াসির বলে ডাকলাম, যদি আমার ভাই আমার ডাকে সাড়া দেয়! কিন্তু না, ভাই আমার ডাকে একটুও সাড়া দিল না। বুকের একপাশে গুলির চিহ্ন। অন্যপাশে ব্যান্ডেজ। পেছনে কোনো গুলি আছে কি না, দেখার জন্য কাত করতেই পিঠ থেকে অনবরত গল গল করে রক্ত বের হতে থাকে। বুকের দুই পাশে দুইটা, কোমরের মাঝ–বরাবর পেছনের দিক থেকে একটা—মোট তিনটা গুলি করেছে আমার ভাইকে"

ইয়াসির সরকারের বাবার একটি কাপড়ের দোকান ছিল শনির আখড়ায়। তিনি একজন ক্যান্সার রোগী। ছোট ছেলে ইয়াসিরের শোকে বাবা আর দোকানে যেতে পারেননি। দোকান বন্ধ করে দিয়েছেন। বড় দুই ভাই চাকুরি করেন বিধায় ইয়াসিরই তার বাবাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেত। ৫ আগস্টের কথা উল্লেখ করে ইয়াসিরের বাবা ইউসুফ সরকার বলেন, সেদিন দিবাগত রাত একটা থেকে দেড়টার দিকে ছেলের লাশ নিয়ে বাসায় ফিরি। বিভিন্ন ভিডিওতে দেখছি, পুলিশ পাখির মতো মানুষকে গুলি করে মেরেছে।

ইয়াসিরের বড় বোন হাফসা বুশরা জানালেন, তাঁর ভাই আন্দোলন থেকে ফিরে সারাদিনের গল্প শোনাতো। নিজে কী করতেন, তা বলতো, বন্ধুরা কী করেছে তা বলতো, কত মানুষ রক্তাক্ত হয়েছে তা বলতো। কীভাবে পুলিশ ফাঁকি দিয়ে বেঁচে এসেছে তা বলতো। এত সাহস দেখানোর জন্য বোন তাকে বকাও দিতো। উত্তরে ইয়াসির বলেছিলো, 'সবাই ভয় পেয়ে পেছনে চলে গেলে হবে নাকি'?

ইয়াসির পরিবারের সদস্যদের বলেছিলেন, তিনি সরকারি চাকরি পাওয়ার জন্য আন্দোলনে যাচ্ছেন না। তিনি আন্দোলনে যাচ্ছেন ছাত্র-জনতাকে যেভাবে মারা হচ্ছে, তার প্রতিবাদ জানাতে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ইয়াসিরের আন্দোলনে যাওয়াতে ভয় পেতেন তাঁর মা বিলকিস আক্তার। যেতে দিতে চাইতেন না। তাই সে মা'কে ফাঁকি দিয়েই প্রতিদিন আন্দোলনে গিয়েছিলো। মা তাকে ফোন দিলে বলতো, বাসার কাছেই আছি, দ্রুত চলে আসবো।

আগেরদিন ৪ আগস্টও ইয়াসির আন্দোলনে গিয়েছিলো। সেদিন হাতের আঙুলে ব্যথা পেয়ে বাসায় ফিরেছিলো। মা বিলকিস আক্তার নিজেই ছেলের হাতে বরফ ও মলম লাগিয়ে দিয়েছিলেন। তখন তিনি ছেলেকে আর আন্দোলনে যেতে নিষেধ করেছিলেন। বিলকিস আক্তার বলেন, আমি তাকে বলেছি, আঙুলে একটু ব্যথা পেয়েই তোমার কত কষ্ট হচ্ছে। যাঁরা আন্দোলনে গিয়ে পঙ্গু হচ্ছে, তাঁদের কেমন কষ্ট হচ্ছে বলো? তুমি আর আন্দোলনে যেয়ো না। ইয়াসির বললো, আমি আন্দোলনে গিয়ে শহীদ হবো। এ কথা শুনে মা বলেছিলেন, যাঁরা শহীদ হন, তাঁরা তো চলেই যান। কিন্তু তাঁদের মা-বাবাকে সারাজীবন এই কষ্ট বুকে নিয়ে বেড়াতে হয়।

আল্লাহ তায়ালা ইয়াসিরের কথা কবুল করেছেন, আর মা তার ছোট ছেলে হারানোর ব্যথা সারাজীবন বুকে নিয়ে বেড়াবেন। আর আমরাও ভুলে যাবো না ইয়াসিরকে। পরম মমতায় জীবন দিয়ে ইয়াসির যেভাবে আমাদের উদ্ধার করেছে হাসিনার কবল থেকে আমরা সেভাবে আমার অন্তরের সবচেয়ে সুন্দর স্থানে ইয়াসিরের স্মৃতি ধারণ করে রাখবো, ইনশাআল্লাহ।