৩০ এপ্রি, ২০২৪
২৯ এপ্রি, ২০২৪
আদর্শ রাষ্ট্র, পর্ব -০১ : আদর্শ রাষ্ট্র ও আদর্শ মুসলিম!
আদর্শ রাষ্ট্রের সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যা যার যার আদর্শ অনুযায়ী হবে। আমরা যেহেতু মুসলিম আমাদের আদর্শ রাষ্ট্র হলো সেই রাষ্ট্র যে রাষ্ট্র ইসলামী আইন অনুযায়ী পরিচালিত হয়। আরেকটু ব্যাখ্যা করে যদি বলতে হয় তবে বলা যায়, আদর্শ রাষ্ট্র হলো সেই রাষ্ট্র যা ইসলামী আকিদা অনুযায়ী পরিচালিত হয়।
ইসলামী আকিদা হলো 'লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ'। কালেমা তাইয়্যেবার বেসিক কথা হলো সকল বিধান দেওয়ার মালিক একমাত্র আল্লাহ তায়ালা। তিনিই সকল সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। আর যেহেতু আল্লাহর মনোনীত রাসূল হলেন মুহাম্মদ সা.। সুতরাং তাঁর কথা ও কর্মকে অনুসরণ করতে হবে।
কালিমা তাইয়্যেবাকে মেনে নেওয়া মানে নিচের বিষয়গুলোও মেনে নেওয়া।
১- আল্লাহ ব্যতীত কাউকে সাহায্যকারী, রক্ষাকর্তা ও পালনকর্তা মনে না করা।
২- আল্লাহ ছাড়া কাউকে কল্যাণের কারণ ও আল্লাহ ছাড়া কাউকে বিপদদাতা মনে না করা।
৩- আল্লাহ ছাড়া কারো নিকট দোয়া, প্রার্থনা ও আশ্রয় খোঁজা যাবে না।
৪- আল্লাহ ছাড়া কারো সামনে মাথা নত করা যাবে না।
৫- আল্লাহ ছাড়া কারো কাউকে সার্বভৌমত্বের মালিক মনে করা যাবে না।
৬- মুহাম্মদ সা. থেকে প্রামাণ্যসূত্রে প্রাপ্ত সকল বিধান দ্বিধাহীনভাবে গ্রহণ করতে হবে।
৭- আল্লাহ ও মুহাম্মদ সা. থেকে প্রাপ্ত আদেশ ও নিষেধকেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হিসেবে মেনে নিতে হবে।
৮- আল্লাহ ও মুহাম্মদ সা. ছাড়া অন্য কারো নিরঙ্কুশ আনুগত্য করা যাবে না। বরং অন্য যে কাউকেই শরিয়ত দিয়ে বিচার করতে হবে।
৯- আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ভালোবাসার চাইতে অন্য কাউকে বেশি ভালোবাসা যাবে না।
১০- মুহাম্মদ সা. ছাড়া অন্য কারো আনুগত্যের ব্যাপারে এমন মর্যাদা পোষণ না করা যে, তার আনুগত্য করার সাথে ঈমান ও কুফর ফয়সালা জড়িত।
অতএব যে রাষ্ট্রের আকিদা 'লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ' সেই রাষ্ট্রই আদর্শ রাষ্ট্র। এই রাষ্ট্রের সবচেয়ে সুন্দর উদাহরণ হলো মুহাম্মদ সা. ও খুলাফায়ে রাশিদা শাসিত চল্লিশ বছর। এরপর পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে আদর্শ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলেও তা পুরো মুসলিম উম্মাহকে ধারণ করতে পারে নি। সেই থেকে বিভিন্নভাবে আদর্শ মুসলিমরা বিভিন্ন পথে চেষ্টা করে যাচ্ছে আদর্শ রাষ্ট্র কায়েম করার জন্য।
কারো কর্মপন্থা রাসূল সা. এর মতো হচ্ছে কিছু রাষ্ট্র গঠন করতে পারে নি। কেউ কেউ রাষ্ট্র গঠন করতে পেরেছে অথচ তাদের কর্মপন্থা রাসূল সা.-এর মতো নয়। কারো সফল হওয়ার সাথে সাথে কর্মপন্থাও সঠিক। কেউ সঠিক কর্মপন্থা ও সফলতা কোনোটারই দেখা পায় নি।
আমি সচেতনভাবে 'আদর্শ মুসলিম' শব্দটা ব্যবহার করেছি। এর একটি দুঃখজনক কারণ রয়েছে। বেশীরভাগ মুসলিমই আদর্শ রাষ্ট্র গঠনের ব্যাপারে উদ্যোগী নয়। উদ্যোগী তো দূরের কথা অনেক মুসলিম ইসলামী আকিদা সম্পন্ন রাষ্ট্র গঠন করতে ইচ্ছুকই নয়। আবার কেউ কেউ একধাপ এগিয়ে ইসলামী রাষ্ট্র তথা আদর্শ রাষ্ট্রের বিরোধীতা করে যাচ্ছে। অথচ সবপক্ষই নিজেদের মুসলিম দাবি করে যাচ্ছে। যারা আদর্শ রাষ্ট্র গঠনের জন্য কাজ করে যাচ্ছে তাদের জন্যই আমি 'আদর্শ মুসলিম' শব্দটা ব্যবহার করতে চাই।
আমি মনে করি যে বা যারা আদর্শ রাষ্ট্রের জন্য কাজ করবে না তারা আদর্শ মুসলিম হওয়াটা দূরহ। কিন্তু সমাজে এমন মুসলিম খুবই এভেইলেবল যারা সমাজ ও রাষ্ট্রের অনৈসলামিক নিয়ম কানুন দেখে, কিন্তু তাদের শরীরে জ্বালাপোড়া করে না। সমাজের অনাচার দেখে তাদের কষ্ট হয় না। শিরক, সুদ, ঘুষ, দুর্নীতি, ব্যাভিচার দেখেও তাদের কষ্ট লাগে না। এই সমাজ পরিবর্তনে তারা কোনো ভূমিকাই রাখতে চায় না। তারা মনে করে নিজে নামাজ পড়লে ও রোজা রাখলেই তাদের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়।
আবার কেউ কেউ বলতে চায়, রাজনীতি নোংরা জায়গা। এখানে ইসলামকে এনে ইসলামকে কলুষিত করার কোনো মানে হয় না। ইসলাম ও রাজনীতি আলাদা। আমাদের খ্রিস্টান, মুশরিক ও ইয়াহুদী শত্রুরা আমাদের এভাবেই দেখতে চায়। যাতে করে আমরা রাজনীতি থেকে দূরে চলে যাই আর তারা আমাদের ওপর রাজত্ব করতে পারে। মুসলিমদের একটি বড় অংশ বুঝে কিংবা না বুঝে ইসলাম ও রাজনীতিকে আলাদা করে দেখতে চায়। তারা কীভাবে আদর্শ মুসলিম হতে পারে!
মহান রাব্বুল আলামীনের অশেষ রহমতে 'আদর্শ রাষ্ট্র' নিয়ে লেখার পরিকল্পনা করেছি। এই পরিকল্পনা অবশ্য বিগত বছরের। কিন্তু নানান ব্যস্ততায় লেখালেখি ও পড়াশোনায় আত্মনিয়োগ করা সম্ভব হয়নি। একটি ভূখণ্ডে যারা আদর্শিক রাজনীতি করতে চায় তাদের কয়েকটি বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করা আবশ্যক বলে মনে করি।
১. ঐ ভূখণ্ডের রাজনৈতিক ইতিহাস
২. যে আদর্শ বাস্তবায়নে কাজ করবে সে আদর্শ সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান
৩. আদর্শ বাস্তবায়িত হয়েছে এমন কোনো প্রায়োগিক রাষ্ট্রের উদাহরণ পর্যালোচনা
৪. বর্তমান পরিস্থিতিকে আমলে নিয়ে আদর্শ রাষ্ট্রের রূপরেখা
১ম অর্জিতব্য জ্ঞানের ব্যাপারে আমি একটি বই লিখেছি 'বঙ্গকথা' নামে, যা ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। ২য় অর্জিতব্য জ্ঞানের ব্যাপারে 'দ্বীন প্রতিষ্ঠায় রাসূল সা.' নামে একটি ধারাবাহিক লেখা লিখেছি। ৩য় অর্জিতব্য জ্ঞানের ব্যাপারে 'রাশিদুন খিলাফত' নামে ধারাবাহিক লেখা তৈরি করেছি। সর্বশেষ অর্জিতব্য জ্ঞানের ব্যাপারে 'আদর্শ রাষ্ট্র' নামে ধারাবাহিক লেখা আজ শুরু করলাম। সাথে থাকুন। আপনাদের প্রতিক্রিয়া আমাকে সমৃদ্ধ করবে বলে আমার বিশ্বাস।
আদর্শ ইসলামী রাষ্ট্রের রূপরেখা #আদর্শ_রাষ্ট্র : পর্ব-০১
আগের লেখাগুলোর লিংক কমেন্ট বক্সে দেওয়া হয়েছে।
২৫ এপ্রি, ২০২৪
যে দোয়া আল্লাহ তায়ালা শিখিয়ে দিয়েছেন!
২৭ মার্চ, ২০২৪
মওদূদীবাদের স্বরূপ উদ্ঘাটন || পর্ব ০৫
১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধে পরাজয়ের মাধ্যমে বাংলায় মুসলিম শাসনের অবসান হয় ও ইংরেজদের বর্বর শাসন শুরু হয়। ক্ষমতা দখল করেই ইংরেজরা দীর্ঘ ৫৫০ বছরে গড়ে ওঠা শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করে দেয়। বাংলার দুইটি বিষয়ের ব্যাপারে তারা খুবই কনসার্ন ছিল। এক বাংলার শিক্ষাব্যবস্থা, দুই বাংলার শিল্প।
তারা ক্ষমতা দখল করেই এই দুটি সেগমেন্ট তারা বন্ধ করে দেয়। সকল শিল্প কারখানা বন্ধ করে দেয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল টেক্সটাইল, জাহাজ শিল্প ও যুদ্ধাস্ত্র। শুধু শিল্প কারখানা বন্ধ নয়, শিল্প কারখানা যাতে আর কোনোদিন গড়ে না ওঠে এজন্য সকল উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়। বস্ত্র শিল্প ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জন্য হুমকি। এদেশের ভালো কাপড়ের বিপরীতে ব্রিটিশদের নিন্মমানের কাপড় চালানোর জন্য তারা বস্ত্রশিল্পকে একেবারে নির্মূল করে দিয়েছে।
যারা তাঁতের ইঞ্জিনিয়ার/ কারিগর ছিল তাদের প্রতি হুমকি ছিল তারা যাতে মেশিন তৈরি না করে। আর যারা লুকিয়ে মেশিন তৈরি ও এর আপগ্রেডেশনের সাথে যুক্ত ছিল তাদের হাত কেটে দেওয়া হয়েছিল। মাত্র দশ বছরের ব্যবধানে বাংলার সকল শিল্প বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। এর মাধ্যমে ব্রিটিশদের পণ্য এদেশে চালু হতে শুরু করে। বাংলার ইতিহাস থেকে শিল্প কারখানা ও শিল্প গবেষণা হারিয়ে গেছে। আর অন্যদিকে ইউরোপে শিল্প গবেষণা এগিয়ে যায়। আমাদের এখানে লুটপাট ও মনোপলি বিজনেস করে ইউরোপে শিল্প বিপ্লব সাধিত হয়।
এদেশের মানুষ যাতে পিছিয়ে থাকে ও সভ্যতার বিকাশ না ঘটে সেজন্যে ব্রিটিশরা এখানের সকল উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়। কোনো জাতির মধ্যে শিক্ষা না থাকলে প্রথমত তারা সভ্যতার বিকাশে অংশ নিতে না পারায় হারিয়ে যায়। দ্বিতীয়ত নিজেদের সংস্কৃতি ও সভ্যতা ভুলে অন্য জাতির গোলামীর পথ ধরে। বাংলায় এই ব্যাপারটাই হয়েছে।
যতদূর জানা যায় এই বাংলায় সভ্যতার বিকাশ হয়েছে দ্রাবিঢ় জাতিগোষ্ঠীর মাধ্যমে। তারা ছিল নূহ আ.-এর সরাসরি বংশধর ও একেশ্বরবাদী। সেসময় গোত্রভিত্তিক মানুষ বসবাস করতো। প্রতিটা গোত্রে কয়েকজন পণ্ডিত মানুষ থাকতেন। তাদের বাড়িই ছিল জ্ঞানর্জনের কেন্দ্র। প্রাথমিক লেখাপড়া সবাই করতো। এর মধ্যে যারা সক্ষম ছিল তারাই জ্ঞানের ধারাকে এগিয়ে নিতেন। জ্ঞানের শাখা-প্রশাখা সীমিত ছিল বিধায় একজন জ্ঞানী ব্যাক্তি সকল বিষয়ে জ্ঞানী ছিলেন। যেমন কৃষি, শিল্প, ধাতুবিজ্ঞান, চিকিৎসাবিজ্ঞান সব বিষয়েই তারা পারদর্শী ছিলেন।
এরপর ইরান থেকে বহুঈশ্বরবাদী আর্যরা এসেছে এখানে ও উপমহাদেশের উত্তর দিক থেকে ধীরে ধীরে দখলে নেয়। বাংলার দ্রাবিঢ়রা দীর্ঘদিন তাদের ঠেকিয়ে রাখলেও এক পর্যায়ে ব্রাহ্মণ্যবাদীদের দ্বারা পরাজিত হয়। ব্রাহ্মণ্যবাদীদের অত্যাচারের শিকার হয় এখানকার জ্ঞানী সমাজ ও পন্ডিত ব্যাক্তিরা। ব্রাহ্মণ্যবাদী সভ্যতায় জ্ঞানর্জন শুধুমাত্র ব্রাহ্মণদের জন্য সংরক্ষিত ছিল। আর কিছু প্রাথমিক জ্ঞান ক্ষত্রিয়, বৈশ্যরা পেত। শুদ্র ও এই অঞ্চলের আদি বাসিন্দাদের জন্য জ্ঞানর্জন নিষিদ্ধ ছিল।
একেশ্বরবাদী বুদ্ধের আগমনের পর এদেশের বেশিরভাগ মানুষ বৌদ্ধধর্মের অনুসারী হন। বৌদ্ধ ধর্মের হাত ধরে এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতি সাধিত হয়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও উচ্চশিক্ষার ধারা শুরু হয় বিহার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। গুপ্ত আমলে আর্যরা বৌদ্ধ ধর্মের ওপর ব্যাপক অত্যাচার করে। বিহারগুলো ধ্বংস করে। আবারো ক্ষতিগ্রস্থ হয় এই অঞ্চলের শিক্ষা।
বৌদ্ধরা আবারো ব্রাহ্মণ্যবাদীদের ওপর বিজয়ী হয়। পাল আমলে আবারো বাংলায় প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখা চালু হয়। পাল আমলে মুসলিমরা সারা বিশ্বে মাদরাসা বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরি করেছে। সে সময়ে সভ্যতায় সবচেয়ে এগিয়ে ছিল বাগদাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। বাংলায়ও মুসলিমরা আসতে শুরু করেছে ও এই অঞ্চলের আদি বাসিন্দাদের প্রায় সবাই মুসলিম হয়ে গেছে। বহুঈশ্বরবাদীদের মধ্যে যারা নিন্ম বর্ণের ছিল তারা ও বৌদ্ধরা দ্রুতগতিতে ইসলামে দাখিল হতে থাকে। মুসলিমরা পাড়াভিত্তিক মক্তব ও মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করে। এই নিয়ে হিন্দু/ আর্য জমিদারদের সাথে প্রায়ই বিবাদে লিপ্ত হতে হতো। বিহার বা বৌদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি জাগতিক শিক্ষাও হতো। ফলে দেখা যায় উচ্চশিক্ষার জন্য সকল ধর্মের (হিন্দু, বৌদ্ধ ও মুসলিম) লোকেরা বৌদ্ধবিহারে যেতেন।
এরপর আসে সেন আমল অর্থাৎ আর্য হিন্দুদের আমল। এবার তারা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষার প্রতিষ্ঠান পাঠশালা প্রতিষ্ঠা করে। উচ্চশিক্ষার জন্য বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে। তবে সেগুলো ছিল উচ্চ বর্ণের মানুষদের জন্য। বিহারগুলোর সাথে অসহযোগিতা ও ক্ষেত্র বিশেষে বন্ধ করে দিত। বেশিরভাগ সমস্যা হতো মুসলিমদের মাদরাসার সাথে। বাংলার বৌদ্ধরা ও মুসলিমরা বর্বর সেনদের অত্যাচার থেকে বাঁচতে দিল্লির সুলতান, সিন্ধের মুসলিম শাসকদের কাছে প্রায়ই আবেদন করতেন।
কিন্তু বাংলায় রাস্তাঘাটের অপ্রতুলতা ও স্থল যোগাযোগের সুবিধা বেশি না থাকায় মুসলিমরা শাসকরা বাংলা কন্ট্রোলে আনতে পারেননি। এমন পরিস্থিতিতে ১২০৫ সালে আমাদের ত্রাণকর্তা হিসেবে আসেন আফগানিস্তানের ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি। তাঁর হাত ধরে বাংলায় মুসলিম শাসন শুরু হয়। প্রায় সাড়ে পাঁচশত বছর ধরে চলে মুসলিম শাসন। বাংলার শাসন ব্যবস্থা, যোগাযোগ ব্যবস্থা, সভ্যতার উৎকর্ষ, বস্ত্র ও জাহাজ শিল্পের উন্মেষ, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সবই হয় ৫৫০ বছরে। অনেক পর্যটক এই বাংলাকে পৃথিবীর জান্নাতের সাথে তুলনা করেছেন। এখানের প্রাচুর্য ও এখানের মাটিতে সারাবছর কৃষি কাজ করা যায় বিধায় এখানের মানুষ অভাবে পড়তেন না। যারা এখানে ব্যবসা ও ধর্মপ্রচারে এসেছেন তাদের সিংহভাগ এত সুন্দর পরিবেশ দেখে এখানে স্থায়ীভাবে থেকে গেছেন। আমার পূর্বপুরুষরাও এভাবে এই অঞ্চলের বাসিন্দা হয়ে যান।
বাংলায় সুলতানী আমলে শিল্পের বিপ্লবের মূলে ছিল এখানের বড় বড় মাদরাসাগুলো। বাংলার মুসলিম শাসনের শুরু থেকেই পাড়া ও মহল্লাভিত্তিক মাদরাসা, মসজিদভিত্তিক মক্তব চালু হয়ে যায়। মুসলিম সন্তানদের পাশাপাশি সকল ধর্মের মানুষ এসব প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা নিতেন। তখন সেক্যুলার শিক্ষা ছিল না। মাদরাসাগুলোতেই ইতিহাস, রাজনীতি, ধাতুবিজ্ঞান, চিকিৎসাবিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান, কবিতা, ভাষাবিজ্ঞান, আইনশাস্ত্র, রসায়ন, ভৌতবিজ্ঞান সবই পড়ানো হতো। পাশাপাশি ফিকহ, হাদীস, তাফসীরও পড়ানো হতো।
বাংলায় ১ম বিশ্ববিদ্যালয় মানের মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন শেখ শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা। তিনি ছিলেন হাদিস বিশেষজ্ঞ ও ইসলামি আইনবিদ। রসায়ন, ভৌতবিজ্ঞান ও জ্যোতির্বিজ্ঞানেও তিনি ছিলেন পারদর্শী। স্বাধীন সুলতানি আমলে বাংলায় আসেন তিনি। সুলতান গিয়াসউদ্দীন বলবনের শাসনকালে (১২৬৬-৮৭) তিনি দিল্লিতে পৌঁছেন এবং সেখান থেকে বাংলায় আসেন। এরপর সোনারগাঁতে তিনি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। এরকম আরেকটি বড় প্রতিষ্ঠান হলো তৎকালীন গৌড় ও বর্তমান চাঁপাইনবাবগঞ্জের দারাসবাড়ি মাদরাসা।
সাড়ে পাঁচশত বছরে বাংলায় হাজার হাজার মাধ্যমিক মাদরাসা ও শ'খানেক জামেয়া/ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়। ১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধের পরাজয়ের ক্ষত আমাদের এখনো বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। ইংরেজরা সমস্ত মাধ্যমিক মাদরাসা ও জামেয়া বন্ধের ঘোষণা দেয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য বরাদ্দকৃত নিষ্কর লাখেরাজ সম্পত্তি সরকারের অধিকারে নিয়ে নেয়। এতে মাদরাসাগুলোর আয় বন্ধ হয়ে যায়। মাদরাসায় জমি সরকার দখল করে প্রতিষ্ঠান গুঁড়িয়ে দেয়। এরপরও কিছু প্রসিদ্ধ শিক্ষক ব্যক্তিগতভাবে নিজ বাড়িতে শিক্ষা চালু রাখার চেষ্টা করেন। সেসব শিক্ষকদের নির্মমভাবে খুন করে ইংরেজরা।
১০ বছরের মধ্যে তারা বাংলাসহ উপমহাদেশের সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়ে এক মূর্খ সমাজে পরিণত করার চেষ্টা চালায়। তাদের টার্গেট ছিল উপমহাদেশের মানুষ কেবল কৃষিকাজ করবে। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্পে তাদের কোনো ভূমিকা থাকবে না।
১৮০০ সাল থেকে তারা পাশ্চাত্য শিক্ষানীতির নামে নতুন ষড়যন্ত্র শুরু করে। নতুনভাবে স্কুল কলেজ প্রতিষ্ঠা ও পাঠ্য কার্যক্রমের পরিকল্পনা করে। এতে তাদের টার্গেট ছিল ভারতীয়রা যাতে ইংরেজদের প্রতি অনুগত থাকে সেরকম শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা। এজন্য তারা মুসলিম শাসনামলকে অন্ধকারচ্ছন্ন মধ্যযুগ বলে অভিহিত করে। তাদের পুরাতন সভ্যতাগুলো মহান ও মানবিক সভ্যতা হিসেবে উপস্থাপন করে। ইংরেজরা এদেশ থেকে মুসলিম শাসকদের হটিয়ে আমাদের অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে এসেছে এমন কথা দ্বারা পাঠ্যক্রম সাজায়। যাতে ভারতীয়রা ইংরেজদের মহান ভাবে। ইংরেজদের অনুসরণ করে তাদের অনুগত থাকাকে গর্বের বিষয় হিসাবে ভেবে নেয়।
১৮৩৫ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি মেকলে তাঁর বিখ্যাত পাশ্চাত্য শিক্ষানীতির প্রস্তাব বড়লাটের কাছে পেশ করেন। এই প্রস্তাবের প্রধান দিকগুলি হল –
(১) তিনি প্রাচ্যের সভ্যতাকে ‘দুর্নীতি, অপবিত্র ও নির্বুদ্ধিতা’ বলে অভিহিত করে সরাসরি পাশ্চাত্য শিক্ষার পক্ষে মত প্রকাশ করেন।
(২) তাঁর মতে প্রাচ্যের শিক্ষায় কোনও 'বৈজ্ঞানিক চেতনা' নেই এবং তা পাশ্চাত্য শিক্ষাব্যবস্থা অপেক্ষা সম্পূর্ণভাবে নিকৃষ্ট (Oriental learning was completely inferior to European learning”)।
(৩) তাঁর মতে, “ভালো ইউরোপীয় গ্রন্থাগারের একটি তাক আরব ও ভারতের সমগ্র সাহিত্যের সমকক্ষ। বলা বাহুল্য, মেকলের এই মত ছিল সম্পূর্ণভাবে অহমিকা-প্রসূত ও অজ্ঞানতাপূর্ণ।
(৪) তিনি বলেন যে, উচ্চ ও মধ্যবিত্তদের মধ্যে ইংরেজি শিক্ষা বিস্তৃত হলে তা ‘ক্রমনিম্ন পরিস্রুত নীতি’ (Downward Filtration Theory) অনুযায়ী ধীরে ধীরে জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে।
(৫) মেকলের লক্ষ্য ছিল সাংস্কৃতিক বিজয়। তিনি বলেন যে, পাশ্চাত্য শিক্ষার ফলে এমন এক ভারতীয় গোষ্ঠী তৈরি হবে যারা “রক্তে ও বর্ণে হবে ভারতীয়, কিন্তু রুচি, মত, নৈতিকতা এবং বুদ্ধিমত্তায় হবে ইংরেজ।”
মেকলের এই প্রস্তাবনা অনুসারেই পাশ্চাত্য শিক্ষাক্রম চালু করে করে ইংরেজরা। একই সাথে ইংরেজরা পাঠ্যক্রমে 'বৈজ্ঞানিক চেতনা'র নামে সেক্যুলার শিক্ষা চালু করে। যাতে মানুষ জীবন যাত্রায় ধর্মের কোনো সংযুক্ততা না পায়। ধর্মকে শুধুমাত্র আচার ও রীতিনীতি সর্বস্ব সংস্কৃতিতে পরিণত হয়। মুসলিম ও হিন্দুরা যাতে ভেবে নেয় ধর্মই তাদের পিছিয়ে যাওয়া ও পরাজিত হওয়ার মূল কারণ। যত দ্রুত ধর্মকে ছেড়ে দেবে ততই উন্নতি হবে এমন শিক্ষা দেওয়া হয় ভারতীয়দের। ইংরেজদের এই পাশ্চাত্য শিক্ষানীতি ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে উপমহাদেশে। নির্যাতন, দুর্নীতি ও শোষণ করে দুর্ভিক্ষে ঠেলে দিলেও ইংরেজদের সভ্য ও মহান ভাবতে থাকে এই অঞ্চলের মানুষরা।
নানা ঘটনা ও উপ-ঘটনার মধ্য দিয়ে ১৯৪৭ সালে আমরা ইংরেজদের থেকে স্বাধীনতা লাভ করি। কিন্তু আমাদের নীতি নির্ধারকেরা পূর্বের মিথ্যা ও ফাঁকা বুলি সর্বস্ব শিক্ষানীতিকে পরিত্যাগ করতে সক্ষম হয় নি। পাকিস্তান আমলে পূর্বের পাশ্চাত্য শিক্ষার সাথে কিছু ধর্মীয় শিক্ষা যুক্ত হয়েছে ও ইতিহাসে মুসলিম শাসনকে পুনরায় আলোকজ্জল হিসেবে দেখানো ছাড়া তেমন কোনো পরিবর্তন হয় নি। তাতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাব কাটানো যায় নি। ইংরেজি সভ্যতা, তাদের প্রশাসনিক ব্যবস্থা ও তাদের আইন দিয়ে বিচার ব্যবস্থা অব্যাহত রাখতে হয়। এটিও হয়েছে পাশ্চত্য শিক্ষানীতির জন্য।
১৯৭১ সালে আমরা পুনরায় স্বাধীন হই। সেই থেকে এখন পর্যন্ত ৭ টি শিক্ষা কমিশন গঠন হয়েছে। প্রথমটি ছিল শেখ মুজিবের সময়কালে কুদরত ই খুদা শিক্ষা কমিশন। এই কমিশন আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় মারাত্মক গলদ ঢুকিয়ে দেয়। পাশ্চাত্য শিক্ষার পাশাপাশি হিন্দুত্ববাদ প্রবেশ করানো হয়। এরপরে যতগুলো শিক্ষা কমিশন হয়েছে তার কোনোটাই পাশ্চাত্য ও সেক্যুলার শিক্ষানীতি থেকে বের হতে পারেনি। জিয়া, এরশাদ ও খালেদা জিয়ার শাসনামলে এই হিন্দুত্ববাদ কিছুটা দূর হলেও ২০০৯ সালে কবির চৌধুরীর শিক্ষানীতি পুনরায় হিন্দুত্ববাদ ঢুকিয়ে মুসলিম পরিচয়কে মুছে দিতে চাইছে।
এদেশের মুসলিমরা ইংরেজদের থেকে স্বাধীনতা অর্জন করেও এখন পর্যন্ত ১৭৫৭ সালের পরাজয়ের গ্লানি টেনে বেড়াচ্ছে। দেশের সীমারেখা পরিবর্তন হয়েছে, উপনিবেশিক ও অত্যাচারী এদেশ ছেড়ে চলে গেছে কিন্তু আমাদের বাংলাদেশী ও মুসলিম হিসেবে স্বতন্ত্র শিক্ষানীতি প্রণয়ন করতে সক্ষম হইনি। ইংরেজদের পাশ্চাত্য শিক্ষানীতির সাথে হিন্দুত্ববাদ যুক্ত করে এক আত্মঘাতী জগাখিচুড়ী শিক্ষা কার্যক্রম চলছে বাংলাদেশে।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান আমল থেকেই সেক্যুলার শিক্ষা বাদ দিয়ে বাংলার স্বর্ণযুগ মুসলিম শাসনামলের মতো জাগতিক ও ধর্মীয় শিক্ষার সমন্বয়ে সমন্বিত শিক্ষার জন্য আন্দোলন করে যাচ্ছে। ১৯৬৯ সালে ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কারের চেষ্টা চালান। শিক্ষা কীরূপ হবে এই নিয়ে ঢাবিতে একটি বিতর্কসভার আয়োজন করা হয়। জামায়াতের ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতা আব্দুল মালেক ইসলামের আলোকে শিক্ষা ব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর জন্য বলিষ্ঠভাবে বক্তব্য রাখেন। তাঁর যুক্তিপূর্ণ বক্তব্যে সেক্যুলার শিক্ষার পক্ষে থাকা লোকদের বক্তব্যগুলো অসার ও অবৈজ্ঞানিক প্রমাণিত হয়। এই বক্তব্য দেয়ার অপরাধে ঢাবির প্রাণরসায়ন বিভাগের ছাত্র আব্দুল মালেককে সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করে ঢাবি ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন।
আমরা এখনো সেই অবৈজ্ঞানিক ও অযৌক্তিক সেক্যুলার শিক্ষাব্যবস্থায় থাকায় আমাদের জাতি গঠনে আমরা পিছিয়ে পড়েছি। আমাদের সন্তানেরা ইউরোপে যাওয়াটাকেই সফলতা জ্ঞান করে। একটা গোলামী মানসিকতা তৈরি হয়েছে। পড়ালেখার উদ্দেশ্য হয়েছে চাকুরি করা ও যেকোনো ভাবে টাকা উপার্জন। গবেষণা উঠেই গেছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে। নিজস্ব সংস্কৃতিকে পশ্চাতপদ মনে করে বিজাতীয় সংস্কৃতিতে গা ভাসিয়ে দিয়েছি। আত্মমর্যাদা ও আত্মবিশ্বাস হারিয়ে এক উদ্বাস্তু জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছি। শিক্ষিতদের অধিকাংশই দুর্নীতির সাথে যুক্ত হয়েছে। সেক্যুলার শিক্ষা আমাদের ভালো মানুষ হতে শেখায় না। যা আমাদের জাতীয় মেরুদণ্ডকে ধ্বসিয়ে দিয়েছে।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে টু দ্য পয়েন্ট প্রস্তাবনা সব শিক্ষা কমিশনকেই দিয়েছে। এই নিয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও একটি প্যারালাল একটি শিক্ষা বোর্ড চালু করেছে জামায়াত। শুধু তাই নয়, জামায়াতের শিক্ষা বোর্ড প্রস্তাবিত পাঠ্যক্রমের আলোকে পাঠ্যপুস্তক তৈরি করেছে। এসব সিলেবাস ও পাঠ্যপুস্তককে ইমপ্লিমেন্ট করার জন্য জেলাভিত্তিক স্কুল ও মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছে। এছাড়া ছাত্রসংগঠন ছাত্রশিবির বিকল্প শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্কুল ও মাদরাসার ছাত্রদের মধ্যে জ্ঞানের সমন্বয় করছে। আলোকিত মানুষ তৈরির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা না পাওয়ায় উদ্যোগটি বার বার ব্যহত হচ্ছে। এর মধ্যে আরো দুঃখজনক ব্যাপার হলো গত এক দশকে এই সকল স্কুলের প্রায় সবই সরকার দখল করে নেয়।
যাই হোক এদেশে জামায়াত বা কথিত মওদুদীবাদ হলো ইসলামের ঢাল। এই ঢাল যেদিন হারিয়ে যাবে বা পথ হারাবে সেদিন ঈমান নিয়ে এদেশে বসবাস করা কঠিন হয়ে যাবে। এবং তা হচ্ছে।
আপনারা দেখেছেন কিছুদিন আগে ঢাবিতে ৭২ টি পূজা মন্ডপে স্বরসতী পূজা হয়েছে। জবিতে ৩৬ টি। এভাবে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্বরসতী পূজা হয়েছে। অথচ সকল উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ইফতার মাহফিল নিষিদ্ধ হয়েছে।
শেখ হাসিনার ক্ষমতা দখল হয়েছে ক্রমান্বয়ে। যুদ্ধ করে নয়। আর শেখ মুজিব ক্ষমতা দখল করেছে যুদ্ধ করে। মূর্তি পূজারীরা যুদ্ধ করে শেখ মুজিবকে ক্ষমতায় এনেছে। তাই শেখ মুজিবের একশন ছিল দ্রুত। শেখ মুজিব ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েই হাজার হাজার ইসলামপন্থী রাজনীতিবিদ, আলেম ওলামা, ইমাম, মুয়াজ্জিন ও মাদরাসা শিক্ষকদের হত্যা করেছে। ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। যে সকল প্রতিষ্ঠানের নামের মধ্যে ইসলাম ও মুসলিম লেখা ছিল সব প্রতিষ্ঠান থেকে ইসলামকে উতখাত করেছে। কওমি মাদরাসাগুলো বন্ধ করে দিয়েছে।
পরবর্তীতে বাধ্য হয়ে চালু করলেও শেখ মুজিব আলিয়া ও কওমি উভয় মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের ডিগ্রীর স্বীকৃতি বাতিল করে দিয়েছে। রেডিও টেলিভিশনে সালাম, হামদ, নাতসহ সকল ইসলামী কালচারকে উতখাত করেছে। ইসলামের বিরুদ্ধে এমন কোনো ষড়যন্ত্র বাকী ছিল না যা শেখ মুজিব করেনি। মুসলিমের দেশ মূর্তি দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছিল। মূর্তি পূজারীদের নেতা ইন্দিরা গান্ধীর অনুসারী শেখ মুজিব আমাদের ঈমান নষ্ট করার কাজ করেছেন। আল্লাহ তায়ালা তাকে জাহান্নামে লাকড়ি বানিয়ে দিন। আমিন।
এই দেশকে সেই অবস্থা থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য জামায়াত জীবন বাজি রেখে কাজ করেছিল। ইসলামী রাজনীতির অধিকার প্রতিষ্ঠা ও মুসলিম দেশে মুসলিমদের কালচার প্রতিষ্ঠার সব চেষ্টা করেছে। শিক্ষা ব্যবস্থায় অবদান রেখেছে। আলাদা পাঠ্যবই, শিক্ষা বোর্ড করে শতাধিক স্কুল, শতাধিক মাদরাসা স্থাপন করেছে। ইসলামী ব্যাংকিং চালু করেছে। ইসলামী সংস্কৃতি উন্মেষ ঘটিয়েছে। বাংলায় ইসলামী সাহিত্যের বিশাল ভান্ডার জনতার সামনে খুলে দিয়েছে। যাকাত ম্যানেজমেন্ট শিখিয়েছে। লাখো মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দিয়েছে।
জামায়াতের রাজনীতিতে ব্যাক করাটা ভালোভাবে নেয়নি মূর্তি পূজারীরা। তার সাথে যুক্ত হয়েছে পশ্চিমা বিশ্ব। ২০০১ সালে পশ্চিমাদের মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ 'ওয়ার অন টেরর'-এ যুক্ত হয়নি বাংলাদেশ। এর খেসারত দিতে হয়েছে জামায়াত ও বিএনপি। মূর্তি পূজারীরা ও পশ্চিমারা এদেশের আওয়ামী লীগকে নিয়ে আমাদের দেশ দখল করে নিয়েছে।
তাই শেখ হাসিনা তার বাবা শেখ মুজিবের মতো দ্রতই আমাদের ঈমানের ওপর হামলা করেনি বা করতে পারেনি। ধীরে ধীরে করেছে। ইসলামী রাজনীতি বন্ধ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, মাদরাসাগুলোতে অনৈসলামিক কালচারের চর্চা, ইসলামী ফাউন্ডেশনে নাচ গান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে মুসলিম মেয়েদের পর্দা করতে না দেওয়া, বোরকা নিয়ে শেখ হাসিনার বাজে মন্তব্য, মাদ্রাসা নিয়ে জয়ের বক্তব্যসহ শত শত আওয়ামী মন্ত্রী ও নেতাদের ইসলাম বিরোধী বক্তব্য নিয়মিতভাবে তারা দিয়ে আসছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে গরুর গোশত খাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা, ইফতার মাহফিলে নিষেধাজ্ঞা, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শত শত পূজা মন্ডপ বানানো, হিন্দুদের হোলি উৎসব চালু, ইফতার মাহফিলে হামলাসহ নানবিধ ইসলামবিরোধী কাজ করে যাচ্ছে আওয়ামী সরকার। সামনে আজান বন্ধ করলেও অবাক হওয়ার মতো কিছু থাকবে না।
যারা আওয়ামী লীগ করেন তারা নিজের দিকে তাকান।
আপনারা জামায়াতের বিরোধীতা করতে গিয়ে আল্লাহর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। যদি পরকালে বিশ্বাস রাখেন তবে আওয়ামী লীগ করা ছাড়েন। হাসিনার কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন। নতুবা জাহান্নামের জ্বালানী হওয়ার প্রস্তুতি নিন।
একইসাথে যারা ইসলামের নামে জামায়াতকে দমন করার সকল চক্রান্ত করছেন, আপনারাও জেনে নিন কার সাথে লড়ছেন! ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা মূর্তি পূজারীরাই জামায়াতকে শত্রু মনে করে। খেয়াল করে দেখবেন আকাবিরে দেওবন্দসহ দেওবন্দী মাদরাসাকে মূর্তি পূজারীরা শত্রু জ্ঞান করে না। যাস্ট ভেবে দেখবেন। আপনাদের নসিহত করার দৃষ্টতা দেখাতে চাই না। আল্লাহ আপনাদের বিবেকের রুদ্ধ দ্বার খুলে দিন। হেরার আলোয় উদ্ভাসিত করে দিন।
২৬ মার্চ, ২০২৪
মোদিবিরোধী আন্দোলন || ২০২১ || ২৬ মার্চ - ২৮ মার্চ
২০২১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আগমনকে কেন্দ্র করে সারা বাংলাদেশ জুড়ে বিক্ষোভ আন্দোলন শুরু হয়। এটিই বাংলাদেশে মোদিবিরোধী আন্দোলন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। গুজরাটের মুসলিম গণহত্যা, বাবরি মসজিদ ইস্যু, পাশাপাশি ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমানদের উপর ক্রমাগত নির্যাতন, মুসলিমদের নাগরিকত্ব বাতিলের ষড়যন্ত্র ইত্যাদি অপরাধকে সামনে রেখে বাংলাদেশের মানুষ মোদিকে অতিথি হিসেবে দেখতে চায়নি। এছাড়াও বাংলাদেশ থেকে সকল কাঙ্ক্ষিত সুবিধা নিলেও মোদি সরকার বাংলাদেশকে প্রাপ্য অধিকার দিতে রাজি নয়।
এদিকে বাংলাদেশের সরকার জনগণের সরকার নয়। তারা হিন্দুত্ববাদের দয়ায় টিকে রয়েছে। তাই তাদের বাংলাদেশের কোনো অধিকার নিয়েই চিন্তা ছিল না। বাংলাদেশের জন্য কোনো অধিকারই তাদের দরকার নেই। তারা শুধু ক্ষমতায় টিকে থাকলেই হলো।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলছেন, 'মোদি আসছেন এতেই আমরা খুশি, তিস্তা নিয়ে আলোচনা এবার না'। আরো বলেছেন, 'আমরা যেটা চাই সেটা হচ্ছে, এই যে একটি আনন্দ উৎসব, আমাদের এই বড় উৎসবে সবাই এসেছে, আমরা তাতেই আনন্দিত। এটাই তো আমাদের বড় পাওয়া, আর কী চান আপনি? আপনাকে কে কাপড় দিল, ভাত দিল ওইটা নিয়ে বেশি চিন্তিত, ওইগুলা আমরা ম্যানেজ করব। তিস্তা চুক্তি বাস্তবায়ন হয়নি তাদের সমস্যা আছে। আমরা বুঝি, আমরা বোকা নই।' ডিএমপির ভারপ্রাপ্ত কমিশনার (পুলিশের বিশেষ শাখার প্রধান) মো. মনিরুল ইসলাম হুশিয়ার করেন, 'ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশে আগমনকে সামনে রেখে যারা মোদিবিরোধী মিছিল-মিটিং করছে কিংবা করবে তাদের বিরুদ্ধে পুলিশ শক্তভাবে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে'। তিনি রাষ্ট্রের 'সম্মান' বাচানোর জন্য জনগণকে 'স্যাক্রিফাইস' করার আহ্বান জানান।
মুসলিম গণহত্যা ও নির্যাতন এবং হিন্দুত্ববাদী দৃষ্টিভঙ্গির জন্য মোদীকে অভিযুক্ত করে নরেন্দ্র মোদীর বাংলাদেশ সফরের বিরোধীতা করে আসছিল হেফাজতে ইসলাম ও এর সমর্থক গোষ্ঠীরা। শুক্রবার ২৬ মার্চ, ২০২১ তারিখে বাংলাদেশের ৫১তম স্বাধীনতা দিবস অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ঢাকায় পৌছান ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তার ঢাকায় আগমন উপলক্ষ্যে সেদিন জুমার নামাজের পর বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ প্রাঙ্গণে বিক্ষোভ ও সহিংসতা দেখা দেয় যা পরে সারা দেশে ছড়িয়ে পরে।
আওয়ামী লীগের সমর্থকরা বায়তুল মোকাররম মসজিদের সামনে বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলা করেছিল তখনই মূল সংঘাতটি শুরু হয়। এর ফলে উভয় পক্ষের মধ্যেই সহিংস সংঘর্ষ শুরু হয়ে যায়। এই ঘটনার পর দেশের বেশ কিছু জেলায় সহিংসতা ছড়িয়ে পরে। হেফাজতে ইসলাম যখন ২৬ মার্চ ২০২১ তারিখে বাইতুল মোকাররম মসজিদে বিক্ষোভ করছিল তখন পুলিশ ও আওয়ামীলীগ বাইতুল মোকাররমে হামলা চালিয়েছে। মসজিদের সমস্ত গেইট অবরুদ্ধ করে গুলি, টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে। আওয়ামী লীগ ও পুলিশ মসজিদে ঢুকে মুসল্লি ও বিক্ষোভকারীদের পিটিয়ে রক্তাক্ত করে। প্রায় ৪৫০+ মানুষ আহত হয়।
পুরো মসজিদ রক্তে ভেসে যায়। বেশি খারাপ অবস্থা হয় বাইতুল মোকাররমে দক্ষিণ গেইটে থাকা মুসল্লিদের। ২০২১ সালের ২৬ মার্চ আওয়ামী লীগ মুসলিমদের পিটিয়ে নিশ্চিত করে এই স্বাধীনতা মুশরিকদের স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতায় ইসলামপন্থীদের কোনো অংশ নেই।
বাইতুল মোকাররমে নৃশংশ হামলার প্রতিবাদে সারাদেশে ধর্মপ্রাণ মুসল্লি ২৬ তারিখ বিকেলেই বিক্ষোভ মিছিল করে। সারাদেশের প্রায় সকল স্থানেই পুলিশ আওয়ামী লীগের সাথে মুসলিমদের সংঘর্ষ হয়। তবে বেশি খারাপ অবস্থা হয় চট্টগ্রাম ও ব্রাহ্মনবাড়িয়ায়। চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে ছাত্ররা বায়তুল মোকাররমের এই সহিংসতার প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে ভূমি অফিসের সামনে সমাবেশ করে। এ সময় পুলিশ সমাবেশে হামলা চালায় ও গুলি করে। পুলিশ নির্বিচার গুলি ছুঁড়লে অর্ধ শতাধিক মুসলিম গুলিবিদ্ধ হন ও ৪ জন শাহদাতবরণ করেন। ব্রাহ্মনবাড়িয়াতে মুসলিমদের বিক্ষোভে পুলিশ গুলি করে একজনকে হত্যা করে।
পুলিশ ও আওয়ামী লীগ মিলে সারাদেশে ৫ জনকে খুন ও সহস্রাধিক মানুষকে পিটিয়ে রক্তাক্ত করার প্রতিবাদে ২৭ মার্চ হরতালের ডাক দেয় হেফাজতে ইসলাম। সারাদেশে মুসলিমরা মুশরিকদের নেতা মোদি ও আওয়ামীলীগের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ অব্যাহত রাখে। এই অব্যাহত বিক্ষোভের মধ্যেও খুনী ও হিংস্র মোদিকে নিয়ে এদেশের শাপলা গণহত্যাসহ বহু গণহত্যার মূল হোতা শেখ হাসিনা অনুষ্ঠান করছিল।
২৭ তারিখ হরতালের সমর্থনে সারাদেশের সব জেলায় বিক্ষোভ করে মুসলিমরা। কিন্তু ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এমপি উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরীর নির্দেশে পুলিশ ও ছাত্রলীগ মুসলিমদের ওপর তান্ডব চালায়। দফায় দফায় হামলা চালায় 'জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুসিয়া' মাদ্রসায়। এই দিন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আরো ৮ জন শাহদাতবরণ করেন। ঢাকায়, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জে ব্যাপক সংঘর্ষ হয় মুসলিম ও আওয়ামী লীগের মাঝে।
সরকার সারাদেশে বিজিবি মোতায়েন করে। সংঘর্ষের মধ্যে মোদি ঢাকা ত্যাগ করে। হেফাজতে ইসলাম ২৮ তারিখও হরতাল ঘোষণা করে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৯ জনকে শহীদ করার প্রতিক্রিয়ায় মুসলিমরা আওয়ামী অফিস ও শেখ মুজিবের মূর্তি ভেঙ্গে দেয়। ২৮ তারিখও পুলিশ মুসলিমদের হত্যা করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। ২৮ মার্চ আরো ৫ জন মুসলিমকে গুলি করে হত্যা করে পুলিশ। হাজার হাজার পুলিশ পুরো ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরকে অবরুদ্ধ করে ফেলে। অঘোষিত কারফিউ জারি করে মুশরিক প্রশাসন। আহতদের মধ্যে থেকে ২৯ মার্চ ১ জন ও ৩০ মার্চ ১ জন শাহদাতবরণ করেন।
মোদিবিরোধী আন্দোলনে মোট ২০ জন মুসলিম শাহদাতবরণ করেন। আহত হন দুই সহস্রাধিক। সারাদেশে পুলিশ গ্রেপ্তার করে ২০ হাজারেরও বেশি মুসলিমকে। এই আন্দোলনে চট্টগ্রামে ৪ জন ও বাকী ১৬ জন শহীদ হন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। এজন্য তৌহীদি জনতা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাম পরিবর্তন করে শহীদবাড়িয়া করার প্রস্তাব করেন। এমপি মোকতাদির এই গণহত্যায় মূখ্য ভূমিকা পালন করে।
২০২৪ সালে পাতানো ডামি নির্বাচন করে পুনরায় মুশরিকবন্ধু শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসীন হয়। মুসলিমদের হত্যা করার পুরস্কার হিসেবে উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরীকে বাংলাদেশের গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রী করা হয়।
যারা শাহদাতবরণ করেন
১. শহীদ রবিউল ইসলাম
২৬ মার্চ, '২১ || চট্টগ্রাম
২. শহিদ মেরাজুল ইসলাম
২৬ মার্চ, '২১ || চট্টগ্রাম
৩. শহীদ নাসরুল্লাহ
২৬ মার্চ, '২১ || চট্টগ্রাম
৪. শহিদ ওহিদুল ইসলাম
২৬ মার্চ, '২১ || চট্টগ্রাম
৫. শহিদ মোঃ আশিক মিয়া
২৬ মার্চ, '২১ || শহীদবাড়িয়া
৬. শহীদ মাও. হোসাইন আহমদ
২৭ মার্চ, '২১ || শহীদবাড়িয়া
৭. শহীদ মুহাম্মদ কাউসার
২৭ মার্চ, '২১ || শহীদবাড়িয়া
৮. শহীদ বাদল মিয়া
২৭ মার্চ, '২১ || শহীদবাড়িয়া
৯. শহীদ হাফেজ জুবায়ের আহমদ
২৭ মার্চ, '২১ || শহীদবাড়িয়া
১০. শহীদ মুশাহিদ মিয়া
২৭ মার্চ, '২১ || শহীদবাড়িয়া
১১. শহিদ হাফেজ কাউসার
২৭ মার্চ, '২১ || শহীদবাড়িয়া
১২. শহীদ মুহাম্মদ ফয়সল
২৭ মার্চ, '২১ || শহীদবাড়িয়া
১৩. শহীদ জহিরুল ইসলাম
২৭ মার্চ, '২১ || শহীদবাড়িয়া
১৪. শহীদ মোহাম্মদ আশিক
২৮ মার্চ, '২১ || শহীদবাড়িয়া
১৫. শহীদ মুহাম্মদ আল আমিন
২৮ মার্চ, '২১ || শহীদবাড়িয়া
১৬. শহীদ হাদিস মিয়া কালন
২৮ মার্চ, '২১ || শহীদবাড়িয়া
১৭. শহীদ ফয়সাল
২৮ মার্চ, '২১ || শহীদবাড়িয়া
১৮. শহীদ লিটন মিয়া
২৮ মার্চ, '২১ || শহীদবাড়িয়া
১৯. শহীদ কামাল উদ্দিন
২৯ মার্চ, '২১ || শহীদবাড়িয়া
২০. শহীদ মু. রাফিন মিয়া
৩০ মার্চ, '২১ || শহীদবাড়িয়া
১৮ মার্চ, ২০২৪
মওদূদীবাদের স্বরূপ উদ্ঘাটন || পর্ব ০৪
পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর মুসলিম লীগ ইংল্যান্ডের পরামর্শ অনুযায়ী দেশকে সেক্যুলার বানাতে চেয়েছিল। কিন্তু রুখে দাঁড়িয়েছে কথিত মওদূদীবাদের লোকেরা। অন্য সব ঘরানার আলেমদের সাথে নিয়ে ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন শুরু করে। এর ফলাফল হিসেবে পাকিস্তান ইসলামিক রিপাবলিকে পরিণত হয়। তারই ধারাবাহিকতায় পাকিস্তানে সুদ বন্ধ হয়। শরিয়াহ কোর্ট চালু হয়।
ইংরেজ আমলে তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় কাদিয়ানীরা নানান সরকারি চাকুরি অংশ নেয়। পাকিস্তান গঠনের পর কাদিয়ানীদের উচ্চপদস্থ আমলা ও সেনাবাহিনী অফিসাররা পাকিস্তানের হর্তা কর্তা হয়ে কাদিয়ানী মতবাদের প্রচার প্রসার করতে থাকে। খতমে নবুয়তের মতো বেসিক বিষয়ে দ্বিমত করে মুসলিম থাকা যায় না। মুসলিমদের রাষ্ট্রে কাদিয়ানীদের এই প্রভাব সম্পর্কে সতর্ক করেন মওদূদী। কথিত মওদূদীবাদের অনুসারীরা পাকিস্তানকে কাদিয়ানীদের হাত থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছিল। সেই চেষ্টায় মওদূদী ফাঁসীর দড়ির কাছাকাছি চলে গিয়েছিল।
১৯৫৭ সাল। আওয়ামীলীগ তখন পাকিস্তানের ক্ষমতায়। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। পাকিস্তানে সংবিধান পাশ হয়। পাকিস্তানকে ইসলামিক রিপাবলিক ঘোষণা দেয়। আওয়ামীলীগ থেকেই এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু হয়। কমিউনিস্ট ভাসানী কাগমারিতে সম্মেলন আহবান করে। নিজ দলের নেতা সোহরাওয়ার্দিকে তিনি দুইটি কারণে সালাম জানিয়ে বিদায় দেওয়ার কথা বলেন। ১. পাক-মার্কিন সিয়োটা চুক্তি। ২. পাকিস্তানকে ইসলামিক রিপাবলিক ঘোষণা।
ভাসানী গণ্ডগোল লাগিয়ে দিলো। সারা পাকিস্তানে বামভাবাপন্ন রাজনীতিবিদেরা পরিস্থিতি ঘোলাটে তৈরি করলো। গভর্ণর জেনারেল ইসকান্দর মীর্জাও সোহরাওয়ার্দির বিপক্ষে গেল। এক পর্যায়ে ভাসানী বেশ কয়েকজন এমপিকে নিয়ে আওয়ামীলীগ ভেঙ্গে দিল। তাতে সোহরাওয়ার্দি সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়ে ফেলে পদত্যাগ করতে বাধ্য হলো। ঘোর রাজনৈতিক সংকট তৈরি হলো। এর মধ্যে ক্ষমতাসীন হলো সেনাপ্রধান আইয়ুব খান। সে সামরিক শাসন শুরু করলো ও গণতান্ত্রিক পাকিস্তানের বিদায় ঘটলো। ভাসানীসহ বামপন্থীরা আইয়ুবকে সাপোর্ট করলো।
পরবর্তীতে মানুষের নেতা নির্বাচন অধিকার ফিরিয়ে আনার মাওলানা মওদূদী আবার রাস্তায় নামলেন। সকল দলকে একত্র করে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে কন্ঠ উচ্চকিত করলেন। ১৯৬১ সালে আইয়ুব জামায়াতকে নিষিদ্ধ করে। তারপরও থেমে যায় নি কথিত মওদূদীবাদীরা। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হয় কাশ্মীর ইস্যুতে। সেসময় আইয়ুব দেশ রক্ষায় মওদূদীর দ্বারস্ত হয়। মওদূদী আইয়ুবের অনুরোধে সংকটকালে দেশ রক্ষায় পাকিস্তানের রেডিওতে সকল জনগণ ও রাজনীতিবিদদের এক হতে বলেন। কথিত মওদূদীবাদীরা উম্মাহ চেতনায় মুসলিমদের জাগ্রত দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ করে। কিন্তু যুদ্ধ শেষে আইয়ুব আবারো তার হীন ও নীচ খেলা খেলতে থাকে।
দীর্ঘ সংগ্রামের মাধ্যমে, বিশেষ করে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামী জমিয়তে তলাবার ছাত্রদের অপরিসীমের ত্যাগের মধ্য দিয়ে আইয়ুবের পতন হয়। ১৯৭১ সালে ভারতীয় মুশরিকদের সহায়তায় পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে থাকা কিছু বাঙালি গাদ্দার। আর এর রাজনৈতিক নেতৃত্বে ছিল আওয়ামী লীগ।
১৯৭১ সালে শেখ মুজিব দেশ স্বাধীন করে ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এদেশের ইসলামপন্থীদের ওপর ভয়াবহ দুর্যোগ নেমে আসে। এটা অনুমিত ছিল। কারণ মুসলিম জাতীয়তাবাদের ইস্যুতে সৃষ্টি হওয়া পাকিস্তানকে ভাঙতে দিতে চায়নি সকল ধর্মপ্রাণ মুসলিম। ১৮ ডিসেম্বর যুদ্ধাপরাধ শুরু করে মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় সেনাবাহিনী। বিশেষত কাদের সিদ্দিকীর অধীনে কাদেরিয়া বাহিনী ও জেনারেল ওবানের অধীনে মুজিব বাহিনী। ঢাকা ও তার আশপাশের মুসলিম লীগের নেতা কর্মী, নেজামে ইসলামের নেতা কর্মী, জামায়াতে ইসলামের নেতা-কর্মী, কমিউনিস্ট পার্টির নেতা-কর্মী, ন্যাপের নেতা-কর্মী, মসজিদ্গুলোর ইমাম মুয়াজ্জিন, কওমী মাদ্রাসার শিক্ষক ও সিনিয়র ছাত্রদের পল্টন ময়দানে জমায়েত করা হতো। তারপর তাদের বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হতো। এটা কোনো গোপন ঘটনা ছিল না। এটি ছিল খুবই প্রকাশ্য এবং দেশি-বিদেশী সাংবাদিকদের সামনে চলে বেসামরিক নাগরিক হত্যা। এদের অপরাধ ছিল তারা পাকিস্তান ভেঙে যাক এটা চায়নি।
একইসাথে ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশের সব ক্যান্টনমেন্ট দখলে নিয়ে সেখানের অস্ত্র, গোলাবারুদ ও অন্যান্য সম্পদ লুটপাট করে। এটাও ছিল যুদ্ধাপরাধ। বিরোধী মতের রাজনৈতিক নেতাদের বাড়ি ঘর দখল ও লুটপাটের আয়োজন করে মুক্তিবাহিনী। এ সবই ছিল যুদ্ধাপরাধ। যে মুহাজিররা ১৯৪৭ সালে ভারতের বিহার থেকে নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলায় এসেছিল তাদের মধ্যে অনেকে মুক্তিবাহিনীর অত্যাচারে আবার ভারতে পাড়ি জমান। এ এক জিল্লতির জীবন ছিল। বিহারীরা ফিরে যেতে পারলেও এদেশের ইসলামপন্থীদের পালানোর জায়গা ছিল না বললেই চলে। সেসময়ের বেশ কয়েকজন ভিকটিমের সাথে কথা বলে জানতে পেরেছি তারা নির্যাতনের মুখে তাদের নিজ জেলা থেকে পালিয়ে দূরের জেলায় পালিয়ে থেকেছে।
শুধু যে ইসলামপন্থীরা আক্রান্ত হয়েছে তা নয়। মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারা ইসলাম বেশ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। তারা ইসলামের প্রতি আক্রোশ দেখিয়েছে। যে সকল প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার নামে ইসলাম ও মুসলিম ছিল সেগুলো থেকে তারা ইসলাম ও মুসলিম শব্দ বাদ দিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় জাহাঙ্গীরনগর মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মুসলিম বাদ দেওয়া হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোগো থেকে 'রাব্বি জিদনি ইলমা' ও কুরআনের চিহ্ন বাদ দেওয়া হয়েছে। নজরুল ইসলাম কলেজ থেকে ইসলাম বাদ দিয়েছে। পাবনার সেরা কলেজ ইসলামিয়া কলেজকে বুলবুল কলেজে পরিণত করা হয়েছে। এভাবে সারা বাংলাদেশে সব স্থান ইসলাম ও মুসলিমকে উৎখাত করা হয়েছে। কওমী মাদ্রাসাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রী ও শিক্ষিকাদের বোরকা নিষিদ্ধ করে শাড়ি পড়তে বাধ্য করা হয়েছে। এই কারনে বহু ছাত্রী একাত্তর পরবর্তীতে বিদ্যালয়ে শিক্ষা নিতে যায় নি।
সংবিধান প্রণয়ন করে বাংলাদেশে ইসলামী রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এখানে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার এই যে, নেজামী ইসলামী ও জামায়াতে ইসলামী এই দুইদলই ছিল সেসময় ইসলামী রাজনীতির ধারক ও বাহক। এদের নিষিদ্ধ করা হয় নাই যে, তারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেছিলেন। বরং তাদের এইজন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে যে, তারা ইসলামী রাজনীতি করেন। সেসময় মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতাকারী ন্যাপ (মুজাফফর), মনি সিং এর কমিউনিস্ট পার্টি, জাতীয় দল, কৃষক শ্রমিক পার্টি, পূর্ব-পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি, পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টি এবং কৃষক শ্রমিক সমাজবাদী দল এই দলগুলোকে নিষিদ্ধ করা হয়নি। সুতরাং এটা নিশ্চিত করে বলা যায়, মুক্তিযুদ্ধের যারা কুশীলব তাদের মূল আক্রোশ ছিল ইসলামের সাথে। এই সাধারণ ব্যাপার সেসময়ের সকল ইসলামী রাজনীতিবিদ বুঝেছিলেন এবং তারা এজন্যই মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেছিলেন। সেসময়ের অনেক মুসলিম না বুঝে মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিলো এটা তাদের ব্যর্থতা ও অদূরদর্শিতা ছিল। আল্লাহ তায়ালা তাদের ক্ষমা করুন।
সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও বিরাট পরিবর্তন এনেছে মুক্তিযোদ্ধারা। তারা রেডিও টেলিভিশনে বিসমিল্লাহ, সালাম দিয়ে শুরু করা বাদ দিয়ে সুপ্রভাত, শুভকামনা ইত্যাদি প্রতিস্থাপন করেছে। রেডিওতে কুরআন তিলওয়াত বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ইসলামী একাডেমি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এই ইসলামী একাডেমীকেই তিনবছর পরে ইসলামী ফাউন্ডেশন নামে চালু করা হয়েছে। ১৯৭৫ সালের পটপরিবর্তনের মধ্য দিয়ে আবার পুনরায় রেডিও টেলিভিশনে সালাম, বিসমিল্লাহ, আযান ও কুরআন তেলওয়াত শুরু হয়েছিল।
মুজিব পরিবেষ্টিত ছিলেন তাজউদ্দিনদের মতো এক ঝাঁক কমিউনিস্ট দ্বারা। তার ফলে মুজিবের শাসনামলের শুরুর দিকে সমস্ত ইসলামবিরোধী কাজের জোয়ার শুরু হয়েছিল। সংবিধান থেকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র বাদ পড়েছে। মূলনীতি থেকে আল্লাহর ওপর বিশ্বাস বাদ দেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে কমিউনিজম, সেক্যুলারিজমের মতো ইসলাম ও ধর্ম বিদ্বেষী মতবাদকে। ক্ষমতায় থেকে ইসলামপন্থা দমনে সব কাজ করেছেন শেখ মুজিব। যখন জাসদ গঠিত হয় এবং বামপন্থীদের সাথে সরকারের চরম বিরোধ শুরু হয় তখন মুজিব কোনঠাসা হয়ে থাকা ইসলামপন্থীদের কাছে টানতে থাকেন তার শক্তি বৃদ্ধি করার জন্য। তবে অবশ্যই তিনি ইসলামী রাজনীতিকে প্রশ্রয় দেননি। তিনি শুধুমাত্র অরাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের অনুমতি দিয়েছেন। তাবলীগের প্রসার করার চেষ্টা করেছেন। কওমীদের শুধুমাত্র মাদ্রাসার গণ্ডির মধ্যে থেকে পড়ালেখার কাজ করার সুযোগ দিয়েছেন।
এই কঠিন অবস্থায় মওদূদীবাদের অনুসারীরা থেমে থাকে নি। কথিত মওদূদীবাদ ছাড়া বাকীরা সবাই ইসলামী রাজনীতি আর চালু হবে না এই মর্মে ঐক্যমত পোষণ করে ইসলামী রাজনীতি থেকে দূরে চলে গেছেন। কিন্তু মওদূদীবাদ মুসলিম থামতে দেয়নি। মওদূদীবাদ ছিল এদেশের ইসলামের ঢাল। কথিত মওদূদীবাদই ইসলামকে বাংলাদেশে পুনরায় জাগিয়ে তুলেছে।
১৯৭১ সালে মুজিবের কর্মকান্ডের পর আরবরা আমাদের ত্যাগ করেছিল। জামায়াতের কর্মীরা মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের জন্য জায়গা করে নিয়েছে। পুরো মুসলিম বিশ্বের সাথে বাংলাদেশ যোগাযোগ স্থাপন করিয়ে দিয়েছে। মুজিবের মৃত্যুর পর ইসলামকে দ্রুতই রাজনীতির মূল ট্র্যাকে নিয়ে এসেছে। সারা দেশে প্রতিটি জেলায় স্কুল কলেজ ও ও মাদ্রাসা স্থাপন করে বাংলার সন্তানদের মন ও মগজে ইসলামকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছে। বাংলার মুসলিমদের মধ্যে ইসলামী সংস্কৃতি পুনরায় স্থাপন করার কাজ হাতে নিয়েছিল।
চলবে ...
১১ মার্চ, ২০২৪
মওদূদীবাদের স্বরূপ উদ্ঘাটন || পর্ব ০৩
না, কোনো পক্ষই সন্তুষ্ট হতে পারে নি। ১৯৩২ সালে মওদূদী যখন ইসলামের মূল ব্যাপারটা মানুষের সামনে তুলে ধরলেন, তখন ইংরেজ, মুশরিক ও মুসলিমদের বিভিন্ন গোষ্ঠী সবার কাছেই তিনি চক্ষুশূলে পরিণত হলেন।
মওদূদী যখন ইসলামের ব্যাখ্যা দিলেন তখন আলিয়া মাদ্রাসা ও পাশ্চাত্য শিক্ষাব্যবস্থার অধীন উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বেশ সাড়া পড়ে যায়। যেহেতু তিনি পত্রিকায় লিখে ও বই লিখে তাঁর চিন্তার প্রচার করতে লাগলেন সেহেতু শিক্ষিত সমাজে তার গ্রাহক বেড়ে যায়। আল্লামা ইকবালের মতো বড় ব্যক্তিরাও তাঁর লেখার ভক্ত হয়ে পড়েন।
মওদূদীর লেখায় মুসলিম ছাত্ররা হারানো ঐতিহ্য ফিরে পাওয়া ও ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃতি থেকে নিজেকে মুক্ত করার আশা খুঁজে পায়। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররা মাওলানা মওদূদীকে বক্তব্য দেওয়ার জন্য আহবান করে। লেখালেখির সাথে এবার যুক্ত হলো মওদূদীর বক্তব্য। তাঁর বক্তব্যও ছিল তাঁর লেখার মতো দুর্দান্ত। ছাত্ররা মুগ্ধ হয়ে তার বক্তব্য লিখে নিতেন এবং তা ছাপিয়ে প্রচার করতেন।
ধীরে ধীরে মওদূদীর ভক্ত সংখ্যা বাড়তে থাকলো। সেই সাথে যুক্ত হলো আল্লামা ইকবালের স্নেহধন্য সাহায্য। যদিও আল্লামা ইকবাল মুসলিম লীগ করতেন তদুপরি তিনি গোড়া থেকেই মক্কায় আল্লাহর রাসূল যেই কাফেলার সূচনা করেছেন সেরকম একটি কাফেলা গঠনের তাকিদ দেন।
এরমধ্যে দেওবন্দী নেতা হুসাইন আহমদ মাদানী মুসলিমদের মিসগাইড করার জন্য ভূমির ভিত্তিতে জাতীয়তা অর্থাৎ উপমহাদেশে হিন্দু-মুসলিম একজাতি এই ধরণের একটি ক্যাম্পেইন চালু করেন। তিনি মুশরিকদের পক্ষাবলম্বন করে এই ধরণের অবস্থান নেন। আমরা তো শোলাকিয়ার ইমাম ফরিদ উদ্দিন মাসুদকে দেখেছি, যিনি আল্লাহ তায়ালা ও নবী সা.-কে বিশ্রী গালি দেওয়া শাহবাগীদের সাথে কাতারবন্দী হয়েছেন। সুতরাং হুসাইন আহমদ মাদানীর চরিত্র বুঝতে আমাদের কষ্ট হওয়ার কথা না।
মওদূদী তাঁর পত্রিকায় মাদানীর ভুলভাল ক্যাম্পেইনের বিরুদ্ধে কথা বলেন। তাঁর ধারাবাহিক লেখায় হুসাইন মাদানীর পান্ডিত্যের দূর্গ ধ্বসে যায়। মাদানীর দল দুইভাগ হয়ে যায়। মাওলানা শাব্বির আহমদ উসমানীর নেতৃত্বে নতুন দল গঠিত হয় জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম নামে। জ্ঞানে ও বক্তব্যে না পেরে মাদানীর অনুসারীরা মওদূদীর বিরুদ্ধে ফতওয়ার কামান ছুটিয়ে দিয়েছিল। মওদূদী মুসলিমদের মধ্যে তাজদিদী আন্দোলন শুরু করেছিলেন। মুসলিমদের মূল টেক্সট থেকে জ্ঞান আহরণের আহবান জানিয়েছেন। মাদানীর অনুসারীরা এটাকেই মওদূদীবাদ হিসেবে ট্যাগিং করেছে এবং মওদূদী ও তার ভক্তদের কাফির ফতওয়া দিয়েছে।
শুধু তাই নয়, মওদূদীকে কাফির প্রমাণের জন্য যত মিথ্যা কথা সম্ভব তত কথাই বলেছে। আমি হুসাইন মাদানীর অনুসারী মাদ্রাসা হাটহাজারীতে গিয়েছিলাম। সেখানের লাইব্রেরিতে একটা পুরো আলমিরাই ছিল জাকির নায়েকের বিরুদ্ধে লেখা বই দিয়ে ভর্তি। আপনি অবাক হবেন লম্বা দাড়ি ও শুভ্র পোষাক পরিহিত লোকেরা ডা. জাকিরের বিরুদ্ধে নির্লজ্জ মিথ্যা অভিযোগ এনে তাকে কাফির প্রমাণ করার অপচেষ্টা করেছে। এই পার্টি মনে হয় সওয়াবের উদ্দেশ্যে কনফিডেন্সের সাথে মিথ্যা কথা তৈরি করে ও প্রচার করে।
মওদূদী-মাদানী পাল্টাপাল্টি বক্তব্যে মওদূদীর জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়। শিক্ষিত সমাজে মাওলানা মওদূদীর গ্রহনযোগ্যতা বাড়তে থাকে। অবশেষে ১৯৪১ সালে মওদূদীর নেতৃত্বে জামায়াতে ইসলামী গঠিত হয়। সাইয়েদ মওদূদী মুসলিমদের আলাদা রাষ্ট্র গঠনের প্রশ্নে মুসলিম লীগের পক্ষে কলম ধরলেও উনি মুসলিম লীগে যুক্ত হননি। কারণ মুসলিম লীগের নেতৃত্বে যারা ছিলেন তারা ইসলামী রাষ্ট্রের জন্য উপযুক্ত ব্যক্তি ছিলেন না। তাদের মধ্যে ব্যক্তিগতভাবে ফরজ ওয়াজিব, হালাল, হারামের বালাই ছিল ছিল না।
আমরা প্রথমেই শুরু করেছিলাম গরু দিয়ে। আবার একটু গরুতে ফিরে আসি। ১৭৫৭ সালে আমরা আমাদের সংস্কৃতি পালনের অধিকার হারিয়ে ফেলি। সেই অধিকার ফিরে পাওয়ার জন্য পাকিস্তান আন্দোলন শুরু হয়। আমরা মুশরিক ও ইংরেজদের থেকে বাঁচার জন্য রাজনৈতিক সংগ্রাম শুরু করি। এই সংগ্রামের মূল নেতা ছিলেন জিন্নাহ। আর তাত্ত্বিক নেতা ছিলেন মওদূদী।
১৯৪৭ সালে আমরা যুগপৎভাবে ইংরেজ ও মুশরিকদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করি। প্রায় দুইশ বছর পর এদেশের মানুষ পুনরায় ভূমির মালিকানা পেয়েছিলো। জমিদারী প্রথার বিলুপ্ত হয়। আমরা প্রজা থেকে নাগরিক হয়ে উঠলাম। নিজের নেতা নিজেরাই নির্ধারণের সুযোগ পেলাম। আমরা আগে ঊনমানুষ ছিলাম। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট থেকে আমরা পরিপূর্ণ অধিকার সমৃদ্ধ মানুষে পরিণত হলাম।
পাকিস্তানের স্বাধীনতা তথা এই অঞ্চলের মানুষের স্বাধীনতার জন্য জিন্নাহ ও মুসলিম লীগের অবদান কোনোভাবেই অস্বীকারের উপায় নেই। আমরা আমাদের পুরো জীবনের বন্দনা দিয়েও তাদের ত্যাগ ও প্রচেষ্টার উপকারের কৃতজ্ঞতা শেষ করতে পারবো না। আমার পরিবার উপমহাদেশের যে অংশে বসবাস করতেন তা মুশরিকদের অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
আমাদের পরিবার হিন্দুস্থান থেকে পাকিস্তানে চলে আসে। যারা আসেনি তারা জানে পাকিস্তান আমাদের জন্য কত বড় নিয়ামত ছিল। আমরা আবার বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার বলে গরু কুরবানী করতে পেরেছি। আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের তামাদ্দুন, আমাদের মুয়ামেলাত আমরা ফিরে পেয়েছি। আজকে হিন্দুস্তানে গরুর গোশত আছে এই সন্দেহে পিটিয়ে মুসলিমদের হত্যা করা হয়। গত শুক্রবার দিল্লীতে জুমুআর নামাজের সময়ে সিজদারত মুসল্লিদেরকে পুলিশ লাথি মারতে থাকে। আর কতবার যে গণহত্যার মুখোমুখি হয়েছে মুসলিমরা তা গণনা করার অবস্থায় নেই।
১৯৪৭ সালের পরেও পাকিস্তানেও তুর্কির মতো দুঃখজনক ঘটনা ঘটে। মোস্তফা কামাল পাশা ব্রিটিশদের থেকে তুর্কি জাতিকে উদ্ধার করে। স্বভাবতই মুসলিমরা ভেবেছিল তিনি আবার প্রচলিত খিলাফত ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবেন। কিন্তু খিলাফতের কফিনে শেষ পেরেকটি মারেন তিনি। খিলাফত ব্যবস্থাকে নিষিদ্ধ করে সেক্যুলার তুরস্ক গঠন করেন। একই ব্যাপার ঘটিয়েছেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। পাকিস্তান আন্দোলনের সময় ব্রিটিশ আমলে জিন্নাহ যখন বিভিন্ন জনসভায় যেতেন তখন তিনি বুক পকেটে থাকা ছোট্ট একটি কুরআনের কপি বের দেখিয়ে বলতেন, এটিই হবে পাকিস্তানের সংবিধান। কুরআনের ভিত্তিতেই চলবে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র।
যখন থেকে পাকিস্তান প্রস্তাব হয়েছে তখন থেকেই মুসলিম লীগের নেতারা বলতেন পাকিস্তান একটি ইসলামী রাষ্ট্র হবে। পাকিস্তানের পক্ষে থেকে মুসলিম লীগের এই দাবিকে সঠিক মনে করতেন না গত শতাব্দির পৃথিবী বিখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদূদী। তিনি ১৯৪০ সালে এই বিষয়ে একটি লেকচার দেন যা পরে বই আকারে ছাপা হয়েছে। বইটির নাম ইসলামী হুকুমাত কিস্তারা কায়েম হতি হ্যায়। সেখানে তিনি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় যোগ্যতা ও পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করেন। এর পরের বছর তিনি প্রস্তাবিত পাকিস্তানকে ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য একটি সংগঠন কায়েম করেন, যার নাম জামায়াতে ইসলামী।
পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হওয়ার পর মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ পাকিস্তানের সংবিধান একটি সেক্যুলার সংবিধান হবে বলে ধারণা দেন। শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করতে গিয়ে তারা আলোচনা শুরু করেন পাকিস্তানের জন্য বৃটিশ পার্লামেন্টারি সিস্টেম উপযোগী, না আমেরিকান প্রেসিডেনশিয়াল সিস্টেম, তা নিয়ে। এতে ক্ষিপ্ত হয় ইসলামপন্থী মানুষরা।
১৯৪১ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও জামায়াতে ইসলামী রাজনীতিতে ভূমিকা রাখতে শুরু করে ১৯৪৮ সাল থেকে। আর সেটি ছিল ইসলামী শাসনতন্ত্রের দাবি নিয়ে। ১৯৪৮ সনের এপ্রিল মাসে করাচির জাহাংগীর পার্কে জামায়াতে ইসলামীর প্রথম রাজনৈতিক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রধান বক্তা ছিলেন কথিত মওদূদীবাদের প্রবক্তা সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদূদী। তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক-নির্দেশনামূলক বক্তব্য পেশ করেন। বক্তব্যে তিনি পাকিস্তানের জন্য শাসনতন্ত্র প্রণয়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত গণপরিষদের প্রতি চারটি দফার ভিত্তিতে 'আদর্শ প্রস্তাব' গ্রহণ করার উদাত্ত আহ্বান জানান।
দফাগুলো হচ্ছে
১। সার্বভৌমত্ব আল্লাহর। সরকার আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে দেশ শাসন করবে।
২। ইসলামী শরীয়াহ হবে দেশের মৌলিক আইন।
৩। ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক আইনগুলো ক্রমান্বয়ে পরিবর্তিত করে ইসলামের সাথে সংগতিশীল করা হবে।
৪। ক্ষমতা প্রয়োগ করতে গিয়ে রাষ্ট্র কোন অবস্থাতেই শরীয়াহর সীমা লংঘন করবে না।
এই দাবীগুলো নিয়েই জামায়াতে ইসলামী ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন শুরু করে।
১৯৪৮ সনের ১১ই সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের স্থপতি মুহাম্মাদ আলী জিন্নাহ মৃত্যুবরণ করেন। গভর্ণর জেনারেল হন ঢাকার নওয়াব পরিবারের সন্তান খাজা নাজিমুদ্দিন। প্রধানমন্ত্রী পদে বহাল থাকেন লিয়াকত আলী খান। এই সময় থেকে প্রধানমন্ত্রী সর্বোচ্চ শাসকের ভূমিকায় থাকেন। লিয়াকত আলী খান সরকার ১৯৪৮ সনের ৪ অক্টোবর ইসলামী শাসনতন্ত্রের মুখপাত্র সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদূদীকে নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করে। প্রায় ২০ মাস জেলে রাখার পর ১৯৫০ সনের ২৮ মে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়।
১৯৫০ সনের শেষের দিকে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেন যে দেশের আলিম সমাজ যদি সর্বসম্মতভাবে কোন শাসনতান্ত্রিক প্রস্তাব উপস্থাপন করে, গণপরিষদ তা বিবেচনা করে দেখবে। প্রধানমন্ত্রী ভেবেছিলেন যে, বহুধাবিভক্ত আলিম সমাজ এই জটিল বিষয়ে কখনো একমত হতে পারবে না এবং কোন সর্বসম্মত প্রস্তাবও পেশ করতে পারবে না।
১৯৫১ সনের জানুয়ারি মাসে জামায়াতে ইসলামীর উদ্যোগে করাচিতে সারা দেশের সকল মত ও পথের ৩১ জন শীর্ষ আলিম একটি গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ে একত্রিত হন। সভাপতিত্ব করেন বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ সাইয়েদ সুলাইমান নদভী। সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদূদী একটি খসড়া পেশ করেন। আলাপ-আলোচনার পর চূড়ান্ত হয় একটি মূল্যবান দলিল 'ইসলামী শাসনতন্ত্রের ২২ দফা মূলনীতি।'
দফাগুলো ছিলো নিন্মরুপ:
১. দেশের সার্বভৌমত্বের মালিক আল্লাহ।
২. দেশের আইন আল-কুরআন ও আসসুন্নাহ ভিত্তিতে রচিত হবে।
৩. রাষ্ট্র ইসলামী আদর্শ ও নীতিমালার উপর সংস্থাপিত হবে।
৪. রাষ্ট্র মা‘রুফ প্রতিষ্ঠা করবে এবং মুনকার উচ্ছেদ করবে।
৫. রাষ্ট্র মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর সাথে ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্য সম্পর্ক মজবুত করবে।
৬. রাষ্ট্র সকল নাগরিকের মৌলিক প্রয়োজন পূরণের গ্যারান্টি দেবে।
৭. রাষ্ট্র শারীয়াহর নিরিখে নাগরিকদের সকল অধিকার নিশ্চিত করবে।
৮. আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে কাউকে শাস্তি দেওয়া যাবে না।
৯. স্বীকৃত মাযহাবগুলো আইনের আওতায় পরিপূর্ণ দ্বীনি স্বাধীনতা ভোগ করবে।
১০. অমুসলিম নাগরিকগণ আইনের আওতায় পার্সোনাল ল' সংরক্ষণ ও পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা ভোগ করবে।
১১. রাষ্ট্র শারীয়াহ কর্তৃক নির্ধারিত অমুসলিমদের অধিকারগুলো নিশ্চিত করবে।
১২. রাষ্ট্রপ্রধান হবেন একজন মুসলিম পুরুষ।
১৩. রাষ্ট্রপ্রধানের হাতে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব অর্পিত হবে।
১৪. রাষ্ট্রপ্রধানকে পরামর্শ প্রদানের জন্য একটি মাজলিসে শূরা থাকবে।
১৫. রাষ্ট্রপ্রধান দেশের শাসনতন্ত্র সাসপেন্ড করতে পারবেন না।
১৬. সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে রাষ্ট্রপ্রধানকে পদচ্যুত করা যাবে।
১৭. রাষ্ট্রপ্রধান তার কাজের জন্য মজলিসে শূরার নিকট দায়ী থাকবেন এবং তিনি আইনের ঊর্ধ্বে হবেন না।
১৮. বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগ থেকে স্বাধীন হবে।
১৯. সরকারী ও প্রাইভেট সকল নাগরিক একই আইনের অধীন হবে।
২০. ইসলামবিরোধী মতবাদের প্রচারণা নিষিদ্ধ হবে।
২১. দেশের বিভিন্ন অঞ্চল একই দেশের বিভিন্ন প্রশাসনিক ইউনিট বলে গণ্য হবে।
২২. আলকুরআন ও আসসুন্নাহর পরিপন্থী শাসনতন্ত্রের যেই কোন ব্যাখ্যা বাতিল বলে গণ্য হবে।
এই নীতিমালা বিপুল সংখ্যায় লিফলেট আকারে ছাপিয়ে সারা দেশে ছড়ানো হয়। এর পক্ষে জনমত সৃষ্টির জন্য সারা দেশে বহুসংখ্যক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ইসলামী শাসনতন্ত্রের পক্ষে প্রবল জনমত সৃষ্টি হতে থাকে। আবার জামায়াতের দাবির বিরুদ্ধেও কেউ কেউ অবস্থান নেন। মুসলিম লীগ নেতারা কৌশলী অবস্থান নেন। তারা ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানকে দেখতে চান না। তবে তারা তা স্পষ্ট করেননি।
প্রকাশ্যে ইসলামী শাসনতন্ত্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন বিভিন্ন আঞ্চলিক নেতারা। এর মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের মাওলানা(!) আব্দুল হামিদ খান ভাসানীও ছিল অন্যতম। তিনি তো পাকিস্তানকে সেক্যুলার হিসেবেও দেখতে চাইতেন না। তিনি মাওবাদী কম্যুনিজম প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। ইসলামী শাসনতন্ত্র বাস্তবায়ন হলে কম্যুনিজম প্রতিষ্ঠা কঠিন হয়ে যাবে বলে তিনি মনে করতেন।
আমরা প্রথম দুই পর্বে আলোচনা করেছি মওদূদী কে? আর মওদূদীবাদ কী? এই পর্বে খানিকটা আলোচনা করেছি মওদূদীবাদের প্রভাব। আগামী পর্বগুলোতে থাকলে এই অঞ্চলে কথিত মওদূদীবাদের ভূমিকা।
সাথে থাকুন। চলবে...।
মওদূদীবাদের স্বরূপ উদ্ঘাটন || পর্ব -০২
আগের পর্বে বলেছিলাম ইংরেজ আমলে অশিক্ষা, কুশিক্ষা আর কুসংস্কার মুসলিম সমাজে ছেয়ে গেছে। এই অবস্থার সুযোগ নেয় কিছু ধুরন্ধর মুসলিম নামের ধর্ম-ব্যবসায়ী। তারা স্থানে মাজার ও আখড়া স্থাপন করে। ইসলামকে তারা পীরের জন্য খাদ্যের ব্যবস্থা করা, পানি পড়া আর গানের তালে নেচে গেয়ে জিকির করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ করে ফেললো।
ইংরেজরা ও স্থানীয় হিন্দুরা মুসলিমদের এই বিবর্তনকে স্বাগত জানায়। ধর্ম ব্যবসায়ীরাও তাদের ব্যবসাকে লাল করার করার জন্য নতুন নতুন বিদআত চালু করতে লাগলো। ইংরেজ ও মুশরিকরা বুঝতে পারে এই ইসলাম তাদের জন্য কল্যাণকর। এই ইসলাম দিয়ে তারা মূল ইসলামকে প্রতিস্থাপন করার চেষ্টা করছিল।
আপনারা খেয়াল করলে দেখবেন, শহীদ মাওলানা মীর নিসার আলী তিতুমীর ও হাজী শরিয়ত উল্লাহর আন্দোলনে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলো মুসলিমদেরই একটা অংশ। তারাই মুশরিকদের আনুকূল্য পেতে ইংরেজদের কোর্টে মাওলানা তিতুমীর ও হাজী শরীয়ত উল্লাহর বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার মামলা করেছিলো। একই ঘটনা বাংলাদেশের কথিত মওদুদীবাদের ধারক নিজামী মুজাহিদদের বেলায়ও ঘটেছে। তাদের বিরুদ্ধেও ধর্ম অবমাননার মামলা করে ফাঁসীতে দড়ি পর্যন্ত টেনে নিয়ে গেছে মাজার পূজারী নামমাত্র মুসলিমেরা। মূলকাজ করেছে মুশরিক ও তাদের দোসররা, অপর্যাপ্ত মুসলিমরা তাদের হেল্প করেছে।
যাই হোক, আমরা মওদূদীবাদে ফিরে আসি। মওদূদী এই অবস্থা দেখে কলম ধরলেন। এটা ১৯৩২ সালের কথা। তাঁর বয়স তখন মাত্র ২৯ বছর। তিনি দেখলেন তাঁর বয়সী শিক্ষিত যুবকেরা ইসলামের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না। নাচা-গানার সহিত জিকিরে আবৃত ইসলাম দিয়ে দেশ শাসন করা যায় না, এটা তারা নিশ্চিতভাবে বুঝেছিল। নাচা-গানার বাইরে আলিয়া ও কওমি ধারার মাদরাসা শিক্ষা প্রচলিত ছিল। যার মাধ্যমে ব্যক্তিপর্যায়ে ইসলাম শেখা গেলেও রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলামের স্বরূপ উদাঘাটিত হয় না।
মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থা সেক্যুলার শিক্ষা-ব্যবস্থারই আরেকটি রূপ। এই শিক্ষার ফলে মুসলিমরা বুঝতে পারে, দুনিয়া চালানো তাদের কাজ নয়, রাজনীতিতে অংশ নেওয়া তাদের কাজ নয়। দুনিয়া মানবরচিত আইনেই চলবে। এটা পরিবর্তন তাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। তাই শিক্ষিত মুসলিম যুবকেরা এমনকি মাদরাসা শিক্ষিতরাও পশ্চিমা পুঁজিবাদের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছিলো। এর চাইতেও আগ্রাসীভাবে মুসলিম শিক্ষিত সমাজে ছড়িয়ে পড়ে কম্যুনিজইম। মুসলিম যুবকেরা নাস্তিক ও কমিউনিস্ট হয়ে যাচ্ছিল।
মুসলিমদের এই দুরাবস্থার মধ্যেই মওদূদী তাঁর চেষ্টা শুরু করেন মাত্র ২৯ বছর বয়সে। মওদূদী যখন লেখালেখি শুরু করেন তখন সবাই বলতো অমুক পীরে এই বলেছেন, অমুক মুরুব্বি এই বলেছেন, অমুক আলেম এই বলেছেন আপনি নতুন কথা বললে হবে?
তখন মওদূদী বলেন, আমাদের সরাসরি কুরআন পড়তে হবে। সরাসরি হাদিস পড়তে হবে। আল্লাহর নির্দেশনা মানতে হবে। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ছাড়া কাউকেই বিনা প্রশ্নে আনুগত্য করা যাবে না। অমুকের কথা যদি আল্লাহর রাসূলের সাথে ও আল্লাহর বিধানের সাথে না মিলে তাহলে তার কথা মানা যাবে না। এটাই ছিল মওদূদীবাদের মূল প্রিন্সিপ্যাল।
মওদূদী দেখেছেন, মুসলিমদের সামনে ইসলামের স্বরূপ উন্মোচিত নেই। একেক টাইপের মুসলিমদের কাছে ইসলাম একেকরকম। ইসলাম বলতে কী বুঝায় ও ইসলামের সঠিক তত্ত্ব সবার সামনে উপস্থাপন করার জন্য তিনি একটি বই লিখেন 'রিসালায়ে দ্বীনিয়াত' নামে। বইটিতে তিনি ইসলামের স্বরূপ উপস্থাপন করেছেন। এই বইটি উপমহাদেশে ব্যাপক সাড়া ফেলে। পৃথিবীর সকল প্রধান ভাষাসহ প্রায় ২৩ টি ভাষায় বইটি অনুবাদ হয়।
বইটি সবচেয়ে ভালো ভূমিকা রাখে আফগানিস্তানে। ১৯৬০ সালের পর থেকে আফগানিস্তানের মানুষ পার্শ্ববর্তী সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাবে কম্যুনিস্ট হতে শুরু করে। এই বইটি তাদেরকে কম্যুনিজম থেকে ফিরিয়ে আনতে সহায়তা করে। আর এই বই নিয়ে আফগানিস্তান চষে বেড়িয়েছেন তৎকালীন কাবুল ভার্সিটির শিক্ষক ও পরবর্তিতে আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট শহীদ বুরহান উদ্দিন রব্বানী।
বাংলায় 'রিসালায়ে দ্বীনিয়াত' বইটি অনুবাদ হয় 'ইসলাম পরিচিতি' নামে। অনুবাদ করেন সৈয়দ আব্দুল মান্নান। আন্তর্জাতিক দায়ি বিলাল ফিলিপ্স বলেছেন তাঁর ইসলামের দিকে আসার জন্য দুইটি বই ভূমিকা রেখেছে। এর মধ্যে একটি হলো রিসালায়ে দ্বীনিয়াত।
বইটিকে মাওলানা মওদূদী রহ. ৭ টি চ্যাপ্টারে ভাগ করেছেন।
১ম অধ্যায়ের নাম 'ইসলাম'
এই অধ্যায়ে মাওলানা কেন ইসলাম নাম দেওয়া হয়েছে, ইসলামের অর্থ, এর তাৎপর্য আলোচনা করেছেন। পাশাপাশি কুফর কী? কুফরের তাৎপর্য কী? এই আলোচনা করেছেন। অধ্যায়ের শেষে কুফর তথা ইসলামকে অস্বীকার করার কুফল ও ইসলামের কল্যাণ নিয়ে আলোচনা করেছেন।
২য় অধ্যায়ের নাম 'ঈমান ও আনুগত্য'
এই অধ্যায়ে তিনি প্রথমে আনুগত্যের জন্য জ্ঞান ও প্রত্যয়ের প্রয়োজন এটা নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি বলেছেন, মানুষ ততোক্ষন পর্যন্ত আল্লাহ তা’য়ালার আনুগত্য করতে পারে না, যতোক্ষণ না সে কতগুলো বিশেষ জ্ঞান লাভ করে এবং সে জ্ঞান প্রত্যয়ের সীমানায় পৌঁছে। সবার আগে মানুষের প্রয়োজন আল্লাহর অস্তিত্ব সম্পর্কে পূর্ণ প্রত্যয় লাভ। কেননা আল্লাহ আছেন, এ প্রত্যয় যদি তার না থাকলো, তা হলে কি করে সে তার প্রতি আনুগত্য পোষণ করবে?
এরপর তিনি ঈমানের পরিচয় নিয়ে আলোচনা করেছেন এবং এর ভিত্তিতে মানুষকে চারভাগে ভাগ করেছেন। এরপর তিনি জ্ঞানর্জনের মাধ্যম তথা ওহি নিয়ে নিয়ে আলোচনা করেছেন। এই অধ্যায়ের শেষে তিনি ঈমান বিল গায়েবের আলোচনাও করেছেন।
৩য় অধ্যায়ের নাম নবুয়্যত
এখানে মাওলানা মওদূদী নবুয়্যত নিয়ে আলোচনা করেছেন। নবুয়্যতের মূলতত্ত্ব ও এর পরিচয় কথা বলেছেন। নবীর আনুগত্য ও তাদের ঈমানের ব্যাপারে আলোচনা করেছেন। এরপর তিনি নবীদের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস আলোচনা করেছেন। তাদের সাথে মানুষের বিভিন্ন আচরণেরও বর্ণনা দিয়েছেন। নবী হিসেবে মুহাম্মদ সা.-এর প্রমাণ ও নবুয়তের ভূমি হিসেবে আরবকে বেছে নেওয়ার যৌক্তিকতা তুলে ধরেন। সবশেষে মুহাম্মদ সা. যে শেষ নবী সে বিষয়ে আলোচনা করেন।
৪র্থ অধ্যায়ের নাম 'ঈমানের বিবরণ'
এখানে মাওলানা মূলত কালেমা তাইয়েবার তাৎপর্য উল্লেখ করেন। এই প্রসঙ্গে বলেন, এ কালেমা-ই হচ্ছে ইসলামের বুনিয়াদ-যা দিয়ে এক কাফের এক মুশরিক ও এক নাস্তিক থেকে মুসলিমের পার্থক্য নির্ধারিত হয়। এ কালেমার স্বীকৃতি ও অস্বীকৃতি দ্বারা এক মানুষ ও অপর মানুষের মধ্যে বিপুল পার্থক্য রচিত হয়। এ কালেমার অনুসারীরা পরিণত হয় এক জাতিতে এবং অমান্যকারীরা হয় তাদের থেকে স্বতন্ত্র জাতি। এর অনুসারীরা দুনিয়া থেকে শুরু করে আখেরাতে পর্যন্ত উন্নতি, সাফল্য ও সম্মানের অধিকারী হয় এবং অমান্যকারীদের পরিণাম হচ্ছে ব্যর্থতা অপমান ও পতন। কালেমা তাইয়েবা সম্পর্কে একটি চমৎকার আলোচনা আছে এই অধ্যায়ে। সাথে ঈমানের অন্যান্য বিষয় যেমন রাসূল, কিতাব, ফেরেশতা, আখিরাত, তাকদির ইত্যাদি নিয়েও আচোলনা করেছেন মাওলানা মওদূদী।
৫ম অধ্যায়ের নাম 'ইবাদত'
এখানে মাওলানা ইবাদতের হাকিকত ও গুরুত্ব উল্লেখ করেন। সেই সাথে সালাত, সাওম, যাকাত, হজ্ব ও জিহাদ নিয়ে আলোচনা করেন। জিহাদ ও জিহাদের পরিব্যপ্তি নিয়ে এখানে একটি সুন্দর আলোচনা রয়েছে।
৬ষ্ঠ অধ্যায়ের নাম 'দ্বীন ও শরিয়ত'
এখানে মাওলানা দারুণভাবে দ্বীন ও শরিয়তকে বুঝিয়েছেন। দ্বীন ও শরিয়তের পার্থক্য নির্দেশ করেছেন। শরীয়ত জানাত মাধ্যম নিয়ে আলোচনা করেছেন। ফিকাহ ও এর ডেবলেপমেন্ট নিয়ে কথা বলেছনে। সবশেষে তাসাউফ নিয়ে আলোচনা করেছেন। ফিকহ ও তাসাউফের মধ্যে সম্পর্ক সূচিত করেছেন।
৭ম ও শেষ অধ্যায়ের নাম 'শরীয়াতের বিধি-বিধান'
এই অধ্যায়ে মাওলানা দারুণভাবে শরিয়তে সবার অধিকার ও কর্তব্য নিয়ে আলোচনা করেছেন। মাওলানা বলেন, শরীয়াত হচ্ছে একটি চিরন্তন বিধান। এর কানুন সমূহ কোন বিশেষ কওম ও কোন বিশেষ যুগের প্রচলিত রীতিনীতি ও ঐতিহ্যের উপর গড়ে ওঠেনি, বরং যে প্রকৃতির ভিত্তিতে মানুষ সৃষ্ট হয়েছে, সেই প্রকৃতির নীতির বুনিয়াদেই গড়ে ওঠেছে এ শরীয়াত। এ স্বভাব-প্রকৃতি যখন সকল যুগে সকল অবস্থায় কায়েম রয়েছে, তখন এরই নীতির বুনিয়াদে গড়া আইনসমূহ ও সর্ব যুগে সর্ব অবস্থায় সমভাবে কায়েম থাকবে।
এই বইটি পড়লে ইসলামের ব্যাপারে সম্যক জ্ঞান অল্পতেই গোছানোভাবে জানা সম্ভব। ইসলাম কী? কেন? কীভাবে? ও কী চায়? সব জানা সহজ হয়ে যাবে। যারা এখনো পড়েননি বইটি পড়ে দেখুন। আপনার দিগন্ত উন্মোচন হয়ে যাবে। ইসলামের ব্যাপারে জোরালো আস্থা তৈরি হবে। একইসাথে মওদূদীবাদের মূল চিত্র আপনার সামনে পরিষ্কার হয়ে যাবে।
চলবে...