১৯৭১ সালে নিহতদের মধ্যে যারা বুদ্ধিজীবী হিসেবে চিহ্নিত এরকম আছেন প্রায় ৩৬ জন। এদের মধ্যে আঠার জন ১৪ই ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেছেন। বাকীরা এর আগেই মৃত্যুবরণ করেছেন। আর এর পরে বাহাত্তরের ত্রিশে জানুয়ারী হারিয়ে যান জহির রায়হান।
আসুন নতুন করে জেনে নিই কারা ১৪ই ডিসেম্বরের খুনি। বাংলাদেশে ঘটা করে পালন করা হয় শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। অথচ এই দিন যারা নিহত হলেন তারা কেন নিহত হলেন? কি তাদের রাজনৈতিক পরিচয়? এই খবর আমরা কেউ রাখছি না।
তাদের কে হত্যা করেছে এটা বলার আগে আমি যারা বাংলাদেশের ইতিহাস রচনা করেছেন তাদের কাছে কয়েকটি প্রশ্ন রাখতে চাই,
১. ১৪ই ডিসেম্বর যারা নিহত হলেন মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ নয় মাস তাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ভূমিকা কি ছিল?
২. তারা কি তাদের কর্মস্থলে নিয়মিত গিয়েছিল?
৩. ঢাকা শহর পাকিস্তানীদের নিয়ন্ত্রণে যতদিন ছিল ততদিন কি তারা ঢাকায় লুকিয়ে বা আত্মগোপনে থাকতেন?
৪. তারা ১৪ ই ডিসেম্বরের আগে কি কোন জিজ্ঞাসাবাদ বা গ্রেফতারের মুখোমুখি হয়েছেন?
৫. তাদের রাজনৈতিক পরিচয় কি ছিল?
যারা সত্যের মুখোমুখি হতে চায় না, তারা কখনো এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে যাবেন না। তারা একটা গথবাঁধা গল্প বলবেন। এবং দাবী করবেন এদের আল বদর বাহিনীর সহযোগিতায় পাকিস্তানীরা হত্যা করেছিল।
১ নং প্রশ্নের উত্তর হল, যারা সেদিন নিহত হলেন তারা সবাই পাকিস্তান সমর্থক ছিলেন। অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী নেতৃত্বে ৫৫ জন একটি বিবৃতিতে পাকিস্তানের ঐক্যের পক্ষে তাদের দৃঢ় অবস্থান ব্যক্ত করেন।
তথ্যসূত্রঃ
১. একাত্তরের ঘাতক ও দালালেরা কে কোথায়?- মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশ কেন্দ্র, ফিফথ এডিশান
২. চরমপত্র- এম আর আখতার মুকুল।
২য় প্রশ্নের উত্তর হল তারা নিয়মিত তাদের কর্মস্থলে গিয়েছেন। প্রবাসী সরকারের ১৮ দফা নির্দেশনামার ১ম দফাই তারা অমান্য করেছেন। এটা শুধু যারা নিহত হয়েছেন তারা নয়, ঢাকা ভার্সিটির সব টিচারই এই নির্দেশ অমান্য করেছেন কারণ তারা সবাই পাকিস্তানপন্থী ছিলেন।
তথ্যসুত্রঃ
১. দুঃসময়ের কথাচিত্র সরাসরি, ড. মাহবুবুল্লাহ ও আফতাব আহমেদ
২. চরমপত্র- এম আর আখতার মুকুল।
৩. প্রধানমন্ত্রী হত্যার ষড়যন্ত্র- কাদের সিদ্দিকী, আমার দেশ ২৭/৯/১১ এবং ১১/১০/১১
৩ নং প্রশ্নের উত্তর হল, যেহেতু তারা প্রতিদিন নিজ নিজ কর্মস্থলে গিয়ে পাকিস্তান সরকারের সেবা করতেন সুতরাং তাদের আত্মগোপনে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না।
৪ নং প্রশ্নের উত্তর হল, তারা ১৪ই ডিসেম্বরের আগে গ্রেফতার কিংবা জিজ্ঞাসাবাদ হওয়ার কোন ঘটনা কেউ কোন গ্রন্থে উল্লেখ করেন নি। তাই আমরা ধরে নিতে পারি তারা এরকম ঘটনার মুখোমুখি হন নি। আর যেহেতু তারা পাকিস্তান সমর্থক ছিলেন তাই তারা গ্রেফতার হওয়ার কোন সম্ভাবনা নাই। যুক্তি অন্তত তাই বলে।
৫ নং প্রশ্নের উত্তর, তাদের রাজনৈতিক পরিচয় হল তারা সবাই পিকিংপন্থী বাম। এর মধ্যে শহীদুল্লাহ কায়সার, মুনীর চৌধুরী নেতাগোচের ছিলেন। পিকিং বা চীনপন্থী বামরা ছিল পাকিস্তানপন্থী।
তথ্যসুত্রঃ
১. একাত্তরের ঘাতক ও দালালেরা কে কোথায়?- মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশ কেন্দ্র, ফিফথ এডিশান
২. চরমপত্র এবং
৩. বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধ- এম আই হোসেন।
এবার আসুন তাদের কে হত্যা করেছে তা নিয়ে আলোচনায় আসা যাক।
সিপিবি ৩১.০৮.৭১ তারিখে তাদের রাজনৈতিক যে শত্রুর তালিকা করেছে সেখানে বলেছে “মনে রাখতে হইবে চীনের নেতারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করিতেছে ও আমাদের শত্রুদের সাহায্য করিতেছে। দেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতাকারী এসব চীনপন্থীদের সম্পর্কে হুশিয়ার থাকিতে হইবে”।
তথ্যসূত্রঃ
বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধ- এম আই হোসেন।
যশোর কুষ্টিয়া অঞ্চলে পিকিংপন্থী কমরেড আব্দুল হক, কমরেড সত্যেন মিত্র, কমরেড বিমল বিশ্বাস ও কমরেড জীবন মুখার্জীর নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর বিপক্ষে যুদ্ধ করেন।
তথ্যসূত্রঃ
আমি বিজয় দেখেছি, এম আর আখতার মুকুল।
কমিউনিস্টদের মটিভেশন ক্লাসে এরকমও বলা হতো, একজন রাজাকারকে যদি তোমরা ধর, তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে, তাকে নানাভাবে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করবে। বারবার করবে এরকম। এতেও যদি কাজ না হয়, প্রয়োজনে শারীরিক নির্যাতনও করবে। যত পারো তথ্য সংগ্রহ করবে এবং পরে কারাগারে নিক্ষেপ করবে। আর যদি কোন চীনপন্থীকে ধর তাহলে সাথে সাথে প্রাণসংহার করবে।
তথ্যসূত্রঃ
দুঃসময়ের কথাচিত্র সরাসরি, ড. মাহবুবুল্লাহ ও আফতাব আহমেদ।
দুঃসময়ের কথাচিত্র সরাসরি, ড. মাহবুবুল্লাহ ও আফতাব আহমেদ।
কাজী জাফর ও রাশেদ খান মেননের দল সহ পিকিংপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা ও কর্মীদের নিধন করা হবে বলে মুজিব বাহিনীর কর্মীরা হুমকি দিয়েছে। এই কারণে তারা পালিয়ে থাকতেন।
তথ্যসূত্রঃ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ- ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া।
আমি এখানে যে তথ্যগুলো উপস্থাপন করেছি তাতে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে, যারা নিহত হয়েছেন তাদের পরিচয় ও যারা তাদের শত্রু তাদের পরিচয়। সুতরাং পাকিস্তানীরা তাদের কেন হত্যা করবে এটা আমার মাথায় আসছে না। আমি মনে করি কোন সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষের মাথায় তা আসতে পারে না।
আর ১৪ই ডিসেম্বর ঢাকার নিয়ন্ত্রণ কোনভাবেই পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর হাতে ছিল না। রাজাকাররা তো আরো আগেই পালিয়েছে। ১২ ডিসেম্বরের মধ্যেই ঢাকার পুরো নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় ভারতীয় সেনাবাহিনী। ১৩ তারিখ আত্মসমর্পনের সিদ্ধান্ত হয়। সহজেই অনুমেয়, ১৪ই ডিসেম্বরের কোন হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত হওয়ার ক্ষমতাই ছিল না পাকিস্তানী হানাদারদের।
সমীকরণ খুবই সোজা। “র” নিয়ন্ত্রিত মুজিব বাহিনীই সংঘটিত করেছে এই নিষ্ঠুর হত্যাকান্ডের। পাকিস্তানের সমর্থক ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতাকারী ঐসব বুদ্ধিজীবী বামপন্থী নেতাদের হত্যা করতে সহযোগীতা করেছে রুশপন্থী বামেরা। এখানেই শেষ নয়। একে একে সকল পাকিস্তানপন্থীদের তারা হত্যা করে।তারা গণহত্যা চালায় বিহারী ক্যম্পে ও মসজিদে মসজিদে। পরে এই মুজিব বাহিনীর সাথে ধ্বংসযজ্ঞে যোগ দেয় কাদের সিদ্দীকী।
তথ্যসূত্রঃ
১. দ্যা ডেড রেকনিং, শর্মিলা বসু।
২. অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা, মেজর এম এ জলিল।
৩. বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধ, এম আই হোসেন।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর যাতে পিকিংপন্থী কম্যুনিজম এ দেশে প্রতিষ্ঠিত হতে না পারে সে পরিকল্পনা আগেই প্রণয়ন করে RAW এক ঢিলে দুই পাখি মেরেছে। অর্থাৎ প্রথমত পিকিংপন্থী বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে মাওবাদী কম্যুনিজমের উত্থানকে রোধ করেছে। দ্বিতীয়ত এর দায়দায়িত্ব রাজাকার আল-বদরদের উপর চাপিয়ে ইতিহাসে পরিষ্কার থেকেছে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর যাতে পিকিংপন্থী কম্যুনিজম এ দেশে প্রতিষ্ঠিত হতে না পারে সে পরিকল্পনা আগেই প্রণয়ন করে RAW এক ঢিলে দুই পাখি মেরেছে। অর্থাৎ প্রথমত পিকিংপন্থী বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে মাওবাদী কম্যুনিজমের উত্থানকে রোধ করেছে। দ্বিতীয়ত এর দায়দায়িত্ব রাজাকার আল-বদরদের উপর চাপিয়ে ইতিহাসে পরিষ্কার থেকেছে।
আসুন কিছু খ্যাতিমান লেখকের কিছু লিখা হুবুহু পড়ি। হয়তো এতে আপনার কনফিউশন আরো ক্লিয়ার হবে।
"... যুদ্ধকালে, যুদ্ধ পরবর্তী এমনকি আজো বাংলাদেশে পত্রিকার হেডলাইন মার্কা চমকপ্রদ যেসব লোমহর্ষক হত্যাকান্ডের খবর আসে তার উৎস সুদূরে। ১৯৭১-এর দুর্দিনের দুর্যোগে ছাফসুতরা রাজনীতিক ভাল মানুষেরা ভারতে বসে কার বুদ্ধিতে কি করেছিলেন তার খোঁজ নিলে থলির অনেক বিড়াল বেড়িয়ে আসবে।
এমন কালো তালিকা কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এমনি আরো জীবন্ত নজির আছে। বাংলাদেশ ম্যাপ আঁকা প্রবাসী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্যাডে এমন দালাল হত্যা তালিকা ৮ নং সেক্টর 'ই' কোম্পানির ক্যাপ্টেন পান। তালিকার নিচে পথে কোথাও যেন সে পত্র খোলার আলামতের মত কিছ সন্দেহ করেন ক্যাপ্টেন। ব্যাপারটি সেক্টর কনফারেন্সে উঠতেই অন্যান্য কোম্পানি কমান্ডারগণ পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করেন। বেরসিক ঠোঁটকাটা ক্যাপ্টেন। প্রফেসর সফিক রাসরি সেক্টর কমান্ডারকে প্রশ্ন করেন কে এই দালাল। মেজর মঞ্জুর ব্যাপার শুনে কাঁচুমাচু। সরাসরি সেক্টর কমান্ডারকে প্রশ্ন কে এই ঘাতক-দালাল নির্মূলের প্রণেতা? কারুরই কোন সদুত্তর নেই। ১৯৭১-এর দুর্দিনের তথ্যনিষ্ঠ সত্য উদ্ধারে এসবের সত্য উদঘাটন আবশ্যক। অন্যথায় অনাগত ভবিষ্যতের জাতীয় দুর্দিনে জাতি আত্মহননে শেষ হবে। আসল শত্রু থাকবে ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
মুক্তিযুদ্ধ তখন প্রচন্ডতার উত্যুঙ্গ শিখরে। ৮ নং সেক্টর 'ই' কোম্পানি সদর তখন হাকিমপুর আজাদ পত্রিকাখ্যাত মলানা আকরম খাঁ- র বাসস্থান হাকিমপুর। বেনাপোল-সাতক্ষীরার মাঝামাঝি ভাদিয়ালি-কাকডাঙ্গা আমার অপারেশন এলাকা। পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণার ঐতিহাসিক হাকিমপুরে বসে সিল গালা মারা খাম খুলে ডাক দেখছি। অকস্মাৎ একি দেখি। এ যে বাঙালি হত্যার তালিকা। প্রবাসী সরকারের তৎকালীন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পত্র। প্যাডের কোণায় বাংলাদেশ ম্যাপের মনোগ্রাম। আমার কোম্পানি এলাকার আশি জনের হত্যাপর্ব তালিকা। অবাক করা ব্যাপার তালিকা শেষে কারুরই স্বাক্ষর নাই।
তালিকার দুচারজনকে চিনি। বাংলাদেশের গভীর অভ্যন্তরে সশরীরে ব্যক্তিগতভাবে তদন্ত করে কারু বিরুদ্ধেই বাংলাদেশ বিরোধী, মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী কোন সুনির্দিষ্ট চার্জ পাওয়া যায় নি। ভিন্নতর রাজনৈতিক দলের হলেই দালাল হবে, এমন কোন কথা নেই। পরে জেনেছি এমন তালিকা অনেকের কাছে গেছে। কিন্তু কে এর হোতা তার নিদর্শন মিলেনি।
... ৮নং সেক্টর মুজিব বাহিনীর ভিতরের রহস্য জানতে চায়। ক্যাপ্টেন প্রফেসর সফিককে নির্দেশ দেওয়া হয় তাদের মধ্যে ইনফিলট্রেট করার জন্য। তাদের মাঝে ছদ্মবেশে গিয়েও প্রফেসর ধরা পড়েন। নির্দলীয় বিধায় প্রাণে বাঁচলেন তিনি, তবে যাবার সময়ে প্রফেসরসুলভ কিছু নীতিবাক্য রেখে এলেন বন্ধুদের জন্য। যশোর কেশবপুর থানার ধানদিয়া গ্রামের মুজিব বাহিনী নেতা রফিক। যুদ্ধে কপালে গুলি লাগে। কপালের গুলির দাগ তার আজন্মের বিজয় তিলক। এই রফিকের হাতে যুদ্ধের শুরুতে গ্রেনেড তুলে দেন ক্যাপ্টেন সফিক। কপালে গুলি লেগে রক্ষা পেয়ে তার গুরুবাক্য স্মরণ হয়। প্রফেসরের সান্নিধ্যে এলেন স্বেচ্ছায়। শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে যুদ্ধাহত ক্যাপ্টেন সফিক অলৌকিক ভাবে বেঁচে উঠলেন। এবার দুই আহত একত্র হলেন। মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচা রফিক অধ্যাপকের নিকট সত্য লুকানোর জন্য ক্ষমা চেয়ে নিলেন। ভারতীয় আর্মির হাতে মুজিব বাহিনীর নৃশংসতার প্রশিক্ষণের ব্যাপার জানান ক্যাপ্টেনকে। তার প্রতি নির্দেশ ছিল, "বাংলাদেশের ভিতরে গিয়ে আবালবৃদ্ধবণিতা খুন করে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম কর। ব্রিজ।পাইলন উড়াও। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন কর। যেখানে বাঁধা পাবে, মুজিব বিরোধী, আওয়ামী লীগ বিরোধী, মুজিব বাহিনী বিরোধী, ভারত বিরোধীকে নির্বিচারে খুন করবে। মুক্তিযুদ্ধের হাইকমান্ডের বাইরে বাংলাদেশের ভিতরে যারা যুদ্ধ করে তাদের হত্যা কর।"
যশোর মনিরামপুরে বাংলাদেশ বিমানের গেরিলা যোদ্ধা ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট ফজলুল হক হত্যার নির্দেশ পায় মুজিব বাহিনী। কে মুজিব বাহিনীকে এই নির্দেশ দেয়েছে জানতে চাইলে তরুণ মুজিব বাহিনী সদস্য জানান তারা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ পেয়েছেন। কোন অদৃশ্য হাত যে আওয়ামী লীগের তল্পিবাহক, ভারতের শুভাকাঙ্খী নয় এবং মুজিব বাহিনী বিরোধী বাংলাদেশের ভেতরে যুদ্ধরত এমন যে কোন কমান্ডার হত্যায় তারা যে উদ্যত তার স্পষ্ট নিদর্শন পেলাম। ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট ফজলুল হক বামপন্থী এটাই তার অপরাধ। কি মুজিব বাহিনী কি অন্যান্য তরুণ বাঙালি মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপ, কর্তার ইচ্ছায় কর্ম থেকে বিরত থেকেছে তাদের স্বদেশ প্রেমের কারণে। তারা অকুস্থলে যুদ্ধরত কমান্ডারদের সাহস ও নেতৃত্বের গুণে বিমুগ্ধ ছিলেন, শত্রু-চক্রান্ত ফাঁস করে দেন।
ঢাকার অভ্যন্তরে যুদ্ধ করে অবসরপ্রাপ্ত বাঙালি ক্যাপ্টেন আবদুল হালিম প্রবাসী সরকারের শত্রু তালিকাভুক্ত হন। ক্যাপ্টেন আবদুল হালিম ইউওটিসি (পরবর্তীকালে বিএনসিসি)-তে ক্যাপ্টেন সফিকের ব্যাটালিয়ান কমান্ডার ও সামরিক প্রশিক্ষক ছিলেন। তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করা ও একাধিকজনের প্ররোচনায় মুক্তিযুদ্ধের সময়কার প্রবাসী সরকার তাকে ভুল বুঝে। তিনি মূলত: ছিলেন বামপন্থী। মস্কোর সাহায্য প্রাপ্তির আশা হইতে আওয়ামী লীগ যতই বামপ্রীতি দেখাক, বাস্তবে তাদের সইতে ছিল নারাজি॥"
- কর্নেল (অব:) মোহাম্মদ সফিক উল্লাহ, বীর প্রতীক / একাত্তরের রণাঙ্গণ : গেরিলাযুদ্ধ ও হেমায়েত বাহিনী॥ [ আহমদ পাবলিশিং হাউস - মার্চ, ২০০৪ । পৃ: ২১৯-২২০ । ২৬৫-২৬৭ ]
"... আমরা একটি জীপে করে কলকাতা থেকে রওয়ানা হলাম দিনাজপুর-ঠাকুরগাঁও এলাকার দিকে। আমরা সরাসরি এলাম ৬ নম্বর সেক্টর এলাকা তেঁতুলিয়ায়, যার দায়িত্বে ছিলেন উইং কমান্ডার এম. কে. বাশার। তার হেডকোয়ার্টার তখন ছিলো তেঁতুলিয়ায়। আমরা তেঁতুলিয়া থেকে শুরু করলাম। তেঁতুলিয়া ঘুরে সেখান থেকে আসলাম ইসলামপুরে। ইসলামপুরে ঠাকুরগাঁও এবং দিনাজপুরের অনেক আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী এবং এমপি ছিলেন। আমি ইতোপূর্বে ইসলামপুরে ওদের সঙ্গেই ছিলাম। কাজেই সকলকেই আমি চিনতাম। সন্ধ্যায় ইসলামপুরে যখন পৌঁছলাম তখন আমার ছোট ভাই, সেও একজন মুক্তিযোদ্ধা, যে আমার সঙ্গেই সীমান্ত অতিক্রম করেছিলো, তাকে এবং আমার ছোট ভাইয়ের বন্ধুকে খোঁজ করলাম। তাদের সঙ্গে দেখা হলো। দেখলাম যে, তারা খুবই ক্ষুব্ধ হয়ে রয়েছে। জিজ্ঞাসা করলাম কি হয়েছে। ওরা দু'জন বললো যে, ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন ক্যাপ্টেনের আন্ডারে তাদেরকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো এবং তাদেরকে বলা হলো কয়েকজন নির্দিষ্ট মানুষকে হত্যা করার জন্য। অথচ আমরা জেনেছি যে, এরা পাকিস্তানিদের সঙ্গে ছিলো না বা বাংলাদেশ বিরোধী কোনো কাজও করেনি। লোকগুলোকে হত্যা করা হলো এবং সেই সঙ্গে লুটতরাজও চালানো হলো। ওরা আরো জানালো যে, বাংলাদেশের নিরাপরাধ লোকদের মারার জন্য তারা এখানে আসেনি। সে কারণে তারা ফিল্ড ছেড়ে চলে এসেছে। এ ঘটনা জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের দিকের। আমরা কেবল চুপ করে শুনলাম সব॥"
- উইং কমান্ডার (অব:) এস আর মীর্জা (সাক্ষাৎকার)
- দিনাজপুরে মুক্তিযুদ্ধ / সম্পা : মোহাম্মদ সেলিম ॥ [ সুবর্ণ - মার্চ, ২০১১ । পৃ: ১০৩ ]
"... সাম্প্রতিককালে জহির রায়হান নিরুদ্দেশ হওয়া নিয়ে নতুন তথ্য শোনা গেছে। বলা হয়েছে - পাকিস্তানি হানাদার বা অবাঙালিরা নয়, মুক্তিযোদ্ধাদের একটি অংশই জহির রায়হানকে খুন করেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের এ অংশটির লক্ষ্য ছিল - বাংলাদেশকে স্বাধীন করা এবং সঙ্গে সঙ্গে বামপন্থী বুদ্ধিজীবিসহ সামগ্রিকভাবে বামপন্থী শক্তিকে নি:শেষ করে দেয়া। এরা নাকি বামপন্থী বুদ্ধিজীবিদের হত্যার একটা তালিকা প্রণয়ন করেছিল। এদের ধারণা এ তালিকাটি জহির রায়হানের হাতে পড়েছিল। জহির রায়হানও জানত তার জীবন নিরাপদ নয়। তবুও সে ছিল ভাইয়ের শোকে মূহ্যমান। তাই শহীদুল্লাহ কায়সারের নাম শুনেই সে ছুটে গিয়েছিল মিরপুরে তারপর আর ফিরে আসেনি। এ মহলই তাকে ডেকে নিয়ে খুন করেছে।
তাহলে কোনটি সত্য? জহির রায়হানকে কারা গুম করেছে? পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীরা, আল বদর, আল শামস্, না রাজাকার? নাকি মুক্তিবাহিনীর একটি অংশ? স্পষ্ট করে বললে বলা যায় - মুক্তিবাহিনীর এ অংশটি মুজিব বাহিনী।
১৯৭১ সালে প্রবাসী স্বাধীন বাংলা সরকারের অজান্তে গড়ে ওঠা মুজিব বাহিনী সম্পর্কে অনেক পরস্পরবিরোধী তথ্য আছে। বিভিন্ন মহল থেকে বারবার বলা হয়েছে, এ বাহিনী গড়ে উঠেছিল ভারতের সামরিক বাহিনীর জেনারেল ওবান-এর নেতৃত্বে। এ বাহিনী নাকি মিজোরামে ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে মিজোদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে। এদের নাকি দায়িত্ব ছিল - রাজাকার, শান্তি কমিটিসহ বাংলাদেশের সকল বামপন্থীদের নি:শেষ করে ফেলা। মুজিব বাহিনী সম্পর্কে এ কথাগুলো বারবার লেখা হচ্ছে। কোন মহল থেকেই এ বক্তব্যের প্রতিবাদ আসেনি। অথচ দেশে মুজিব বাহিনীর অনেক নেতা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে আছেন। তারা কোন ব্যাপারেই উচ্চবাচ্চ্য করছেন না। তাদের নীরবতা তাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত বক্তব্যই প্রতিষ্ঠিত করছে এবং সর্বশেষ জহির রায়হানের নিখোঁজ হবার ব্যাপারেও মুজিব বাহিনীকেই দায়ী করা হচ্ছে॥"
- নির্মল সেন / আমার জবানবন্দি ॥ [ ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ - ফেব্রুয়ারি, ২০১২ । পৃ: ৪০৫-৪০৬ ]
"... ভারতে অবস্থিত মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং শিবিরগুলোও ছিল নানান কুকর্মে লিপ্ত আওয়ামী নেতৃত্বের জন্য হুমকি স্বরূপ। তাই সচেতনভাবেই তারা ট্রেনিং শিবিরগুলো এড়িয়ে চলত। এ সকল ট্রেনিং শিবিরে অবস্থান করত সাধারণ জনগণের সন্তান, যাদের ভারতের অন্যত্র কোন ধরনের আশ্রয় ছিল না। যারা হোটেল, কিম্বা আত্মীয়-স্বজনদের কাছে আশ্রয় খুঁজে পেয়েছে তারা আর মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং শিবিরের ধারে-কাছেও ভেড়েনি, অংশগ্রহণ করাতো দুরেই থাক।
এ ধরনের সুবিধাভোগীগের নিয়ে সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম ভাগে ভারতীয় স্পাই সংস্থা ‘র’ (RAW) মেজর জেনারেল ওভানের মাধ্যমে ‘মুজিব বাহিনী’ নামে একটি বিশেষ বাহিনী গঠনে হাত দেয়। এই বাহিনীতে বাংলাদেশ ছাত্র লীগের অবস্থাসম্পন্ন সদস্যরাই কেবল অন্তর্ভুক্ত ছিল। এদের ট্রেনিং পরিচালনা করা হয় ভারতের ‘দেরাদূন’ শহরে। তাদের জন্য বিশেষ সুবিধে এবং অন্যান্য আরাম-আয়েসের সুব্যবস্থা ছিল। ‘মুজিব বাহিনী’ গঠন ছিল বাংলার সাধারণ জনগণের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা মুক্তিযোদ্ধাদের বিকল্প ব্যবস্থা। ‘মুজিব বাহিনীর’ মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণের পুর্বেই যুদ্ধ শেষ হয়ে যায়। তাদের দুর্ভাগ্য বা সৌভাগ্যই বলা চলে যে, সাধারণ মানুষের মুক্তিযুদ্ধে তাদের রক্ত ঝরাতে হয়নি। তাদের অভিজাত রক্ত সংরক্ষিত করা হয়েছিল স্বাধীনতা পরবর্তীকালে সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের রক্ত ঝরানোর লক্ষ্যে॥"
- মেজর (অব:) এম এ জলিল / অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা ॥ [ কমল কুঁড়ি প্রকাশন - ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ । পৃ: ৩৯-৪১ ]
"... ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানী বাহিনী ভারতীয় বাহিনীর কাছেই আত্মসমর্পণ করেছিলো, যদিও ভারতীয় সেনানায়ক জেনারেল অরোরা ছিলেন যৌথ ভারতীয় ও বাঙলাদেশী বাহিনীর প্রধান। সেই আত্মসমর্পণ চুক্তি স্বাক্ষরের সময় বাঙলাদেশী মুক্তিবাহিনীর রাজনৈতিক প্রতিনিধি ও সেনাবাহিনী প্রধানরা অনুপস্থিত ছিলেন। দুই একজন উপস্থিত থাকলেও তাদের সে উপস্থিতির গুরুত্ব পেছনে দাঁড়িয়ে উঁকিঝুঁকি মারার বেশী ছিল না।
এই হলো আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধ, যদিও এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে হাজার হাজার কৃষক-শ্রমিক ও মধ্যবিত্ত মুক্তিযোদ্ধা সে সময় নিজেদের মতো করে যুদ্ধ করেছিলেন এবং আত্মাহুতি দেওয়া, পঙ্গু হওয়া, জীবিকার সংস্থান হারিয়ে বিপন্ন জীবন যাপন সব কিছুই করেছিলেন। এদিক দিয়ে তাদের মুক্তিযুদ্ধ এবং আত্মাহুতির সাথে মুক্তিযুদ্ধের তথাকথিত নেতৃত্বের 'মুক্তিযুদ্ধ' ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের কোন সামঞ্জস্য ছিলো না।
এ বিষয়টি ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা RAW-এরও জানা ছিলো। এ কারণে তারা মুজিব বাহিনী নামে একটি ফ্যাসিস্ট সংগঠন দাঁড় করাবার চেষ্টা করেছিলো। যে বাহিনী কোন লড়াই করেনি, যার একমাত্র কাজ ছিলো কম্যুনিস্ট, বামপন্থী প্রভৃতির বিরুদ্ধেই শুধু নয়, এমনকি তাজউদ্দীনের বিরুদ্ধেও চক্রান্ত করা। এই মুজিব বাহিনীতে যেসব উপাদান ছিলো ১৯৭১ সালের পর তারাই বাঙলাদেশে প্রাধান্যে এসেছিলো। এরা যে শুধু অর্থনীতি ও রাজনীতির ক্ষেত্রেই দুর্বৃত্তসুলভ আচরণ করেছিল তাই নয়, সাধারণভাবে সংস্কৃতি ক্ষেত্রেও এসবের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে তারা সৃষ্টি করেছিলো এক ধরণের দুর্বৃত্ত সস্কৃতি। এটাই স্বাভাবিক। কারণ মানুষ যেভাবে জীবিকা অর্জন করে তার সাথে সামঞ্জস্য রেখেই গঠিত হয় মানুষের জীবনের অন্যান্য দিক।
এদেশের এই সংস্কৃতিই যেহেতু বাঙলাদেশের প্রধান সংস্কৃতি সে জন্য এই সংস্কৃতির দোর্দন্ডপ্রতাপ এবং অনিয়ন্ত্রিত প্রচারই দেখা যায় বাঙলাদেশের পত্রপত্রিকা, রেডিও, টেলিভিশনসহ সব রকম প্রচার মাধ্যমে, তাদের দ্বারা সংগঠিত সাংস্কৃতিক এবং অন্যান্য অনুষ্ঠানে। মধ্য শ্রেণীর শিক্ষিত ব্যক্তি ও বুদ্ধিজীবিদের সব থেকে সুবিধাভোগী অংশটিই হলো এই সংস্কৃতির মূল ধারক ও বাহক॥"
- বদরুদ্দীন উমর / নির্বাচিত প্রবন্ধ ॥ [ অন্যপ্রকাশ - ফেব্রুয়ারী, ২০০০ । পৃ: ৭৬-৭৭ ]
"... সুপরিকল্পিতভাবে সৃষ্ট প্রতিবিপ্লবী মুজিব বাহিনী একাত্তুর সালে তার (শেখ মুজিবুর রহমানের) পক্ষ হয়ে প্রতিনায়কের ভূমিকা পালন করেছে। এই বিকল্প বাহিনীর সেই ষড়যন্ত্রী রাজনীতির অন্যতম হাতিয়ার মুজিববাদের তথাকথিত ভাবদর্শন, তত্ত্ব। ভাষা ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসের নির্লজ্জ বিকৃতি এই একই পরিকল্পনার অংশবিশেষ।
মুজিববাদ ও মুজিব বাহিনীর কাহিনী আজো ইতিহাসে অনুল্লিখিত। এই প্রতিবিপ্লবী তত্ত্ব ও সংগঠন শুধুমাত্র ব্যক্তি শাসন কায়েম করবার জন্যই সৃষ্টি করা হয়নি, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের সমর্থনপুষ্ট সম্প্রসারণবাদী আধিপত্যকে নিরঙ্কুশ করবার জন্য উদ্ভাবন করা হয়েছিল। স্বাধীনতা পরবর্তীকালের রক্ষীবাহিনী মুজিববাদ ও মুজিব বাহিনীরই সাংগঠনিক রূপ।
মুজিববাদ ও মুজিব বাহিনীর সৃষ্টির মূল লক্ষ্য ছিল ত্রিবিধ।
ক) মুক্তিযুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে মুক্তিবাহিনীর ক্রমবর্ধমান শক্তি ও আধিপত্যকে খর্ব করা,
খ) গেরিলাযুদ্ধের মাধ্যমে সৃষ্ট দেশপ্রেমিক বিপ্লবী সামাজিক শক্তির মোকাবেলা করা এবং
গ) প্রয়োজনবোধে শেখ মুজিবুর রহমানের অবর্তমানে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করা।
প্রথম দুটো কারণের জন্য মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে মুজিব বাহিনীর তীব্র দ্বন্ধ সৃষ্টি হয়েছিল এবং তৃতীয় কারণের জন্য সম্প্রসারণবাদের বশংবদ মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্ব ও প্রশাসনের সঙ্গেও সংঘাত সৃষ্টি হয়েছিল।
একটি বিশেষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত 'এলিট ফোর্স' সৃষ্টির ইতিহাস আরও বিচিত্র। মুজিব বাহিনীর নেতৃবৃন্দের পরিকল্পনা অনুযায়ী শেখ মুজিবুর রহমানের স্বহস্তে লিখিত পত্রের উপর ভিত্তি করে এবং তারই নির্বাচিত উত্তরাধীকারীদের নেতৃত্বে এই রাজনৈতিক বাহিনী গঠন করা হয়। এখানে উল্লেখ্য যে, দেরাদুনে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এই বিশেষ প্রতিবিপ্লবী সংগঠন জেনারেল ওসমানীর নেতৃত্বে পরিচালিত মুক্তিবাহিনী, এমনকি তাজউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে গঠিত মুজিবনগর সরকারেরও নিয়ন্ত্রণাধীনে ছিল না। জনৈক ভারতীয় সেনাপতির প্রত্যক্ষ পরিচালনায় সংগঠিত তথাকথিত মুজিব বাহিনীর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য, সাংগঠনিক কাঠামো এবং ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতে এ কথাই নি:সন্দেহে প্রমাণ করে যে, জাতীয় মুক্তির আন্দোলনের সঙ্গে এই বাহিনীর মৌলিক বিরোধ ছিল। বিরোধের সম্ভাব্য কারণ আমি আগেই উল্লেখ করেছি। যদি শেখ মুজিবুর রহমানের পত্রের কথা সত্যি হয়ে থাকে তবে এ কথাও প্রতীয়মান হয় যে, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উদ্দেশ্যের সঙ্গে মুজিব বাহিনীর গভীর যোগসূত্র রয়েছে॥"
- এনায়েতুল্লাহ্ খান / শেখ মুজিবের উত্থান পতন
তথ্যসূত্র : ফ্যাক্টস এন্ড ডকুমেন্টস : বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড / অধ্যাপক আবু সাইয়িদ ॥ [ চারুলিপি - জুলাই, ২০১০ । পৃ: ১৯৩-২০০ ]
"... শেখ ফজলুল হক মণি গ্রুপের মুখ্য লড়াই হয়ে দাঁড়ায় বামপন্থী নির্মূল করা, পাকিস্তান সেনাবাহিনী নয় এবং আগস্ট মাসে শেখ ফজলুল হক মণি গ্রুপ বাংলাদেশে প্রবেশ করেই শুরু করে দেয় বামপন্থী নির্মূল অভিযান। সম্মুখ যুদ্ধে না নেমে তারা বেছে নেয় গুপ্তহত্যা প্রক্রিয়া। কোথাও কোথাও নেমে পড়ে সরাসরি লড়াইয়ে। শুধু বামপন্থী নির্মূলই নয়, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যুদ্ধরত মুক্তি বাহিনীর বিরুদ্ধেও অস্ত্র তুলে ধরে তারা। এমন কী মুজিব বাহিনীর সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক, হাসানুল হক ইনু গ্রুপের বামপন্থী চিন্তাচেতনার অনুবর্তী সহযোদ্ধাদেরও হত্যা করে নির্দ্বিধায়।
... কেবল বামপন্থী মুক্তিযোদ্ধা এবং কখনো কখনো মুক্তি বাহিনীর সদস্যরাই শেখ ফজলুল হক মণি গ্রুপের আক্রমণের লক্ষ্য ছিল না, নিজেদের বাহিনী তথা মুজিব বাহিনীর ভেতরকার সমাজতন্ত্রকামীরাও তাদের আক্রমণের তালিকায় এসে যায়। যুদ্ধ চলাকালীন দেশের বিভিন্ন এলাকায় দু'গ্রুপের মধ্যে গোলাগুলি বিনিময় হয়। হত্যাকান্ড ঘটাতে পেছপা হয় না শেখ ফজলুল হক মণি গ্রুপ।
... 'র'-এর হয়ে যুদ্ধ চলাকালীন শেখ ফজলুল হক মণি এবং তার গ্রুপ বামপন্থী ও মুজিব বাহিনীর সমাজতন্ত্রকামীদের নির্মূলে যে অভিযানে নামে, স্বাধীনতার পর তা সম্প্রসারিত হয় তার ব্যক্তি উচ্চাভিলাষ চরিতার্থে। নেমে পড়েন অভিযানে বেসরকারি সশস্ত্র বাহিনী আওয়ামী যুবলীগ তৈরি করে। 'র' সৃষ্ট 'মুজিববাদ' নামক অদ্ভুত 'বাদ' প্রতিষ্ঠার শ্লোগানকে করা হয় হাতিয়ার।
... স্বাধীনতা যুদ্ধ যখন চলছিল, সে সময় মুজিব বাহিনী যে হত্যাকান্ড পরিচালনা করে, তার সঙ্গে আবদুল হকের 'বিপ্লবী' বাহিনীর হত্যাকান্ডের মূলগত কোন পার্থক্য নেই। তবে এরা হত্যা করেছে নিরস্ত্র সাধারণ মানুষকে আর শেখ ফজলুল হক মণি গ্রুপের মুজিব বাহিনী হত্যা করেছে 'র'-এর প্ররোচনায় তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ স্বাধীনতা যোদ্ধাদের। কিন্তু তাদের মাধ্যমে 'র'-এর পক্ষে পুরো পরিকল্পনা কার্যকর করা সম্ভব হয়ে ওঠে না মুজিব বাহিনীর বেশিরভাগ অংশের সমাজতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক চেতনার অনুবর্তী হয়ে পড়ার কারণে - যাদের নেতৃত্বে ছিলেন সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক এবং হাসানুল হক ইনুরা॥"
- বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে র এবং সিআইএ / মাসুদুল হক॥ [মীরা প্রকাশন - ফেব্রুয়ারী, ২০০১। পৃ: ১০৫-১১০ ]
তথ্যসূত্র কৃতজ্ঞতাঃ কায় কাউস
তথ্যসূত্র কৃতজ্ঞতাঃ কায় কাউস