১.
কবির ক্লাসের মধ্যম মানের ছাত্র। কয়েকদিন ক্লাসে আসছে না সে। এই বিষয়টা নজর এড়ায়নি অধ্যাপক নুরুল ইসলাম সাহেবের। অধ্যাপক সাহেবের ছেলেপুলে নেই। ইসলামীয়া কলেজের সব ছাত্রকেই উনি সন্তানের মত করে দেখেন। বাজারে মুরগী কিনতে গিয়েই দেখা কবিরের সাথে। হাতে দুটো মুরগী। বিক্রী করার জন্যই এনেছে বোধহয়। কিন্তু স্যারকে দেখে সহসা এমন ভাব করলো যেন সে মুরগী দুটো কিনেছে। অধ্যাপক সাহেব সব বুঝেও না বুঝার ভান করলেন।
তাকে ডেকে বললেন, তুমি কয়দিন কলেজে যাচ্ছ না। ঘটনা কি? কবির আমতা আমতা করে বললো স্যার,ফরম ফিলাপের টাকা যোগাড় হয় নি। পরীক্ষা আগামী বার দেব। অধ্যাপক সাহেব বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে। মুরগী দুটোতো বেশ সুন্দর। শোন আমার জরুরী কাজ আছে এই বলে তাকে এক হাজার টাকা গুঁজে দিয়ে বললো, তুমি আবার দুটো কিনে নিও। তোমারগুলো আমাকে দিয়ে দাও। এই বলে তিনি তার হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে হাঁটা শুরু করলেন। বললেন কাল ক্লাসে এসে বাকী টাকা দিয়ে যাবে।
বাসায় থাকতে পারেন না অধ্যাপক সাহেব। তিনি জামায়াত করেন। তাই পুলিশ সর্বদা তাড়িয়ে বেড়ায়। একবার গ্রেপ্তারও করেছিলো। মাস চারেকের মত ছিলেন কারাগারে। আজ তিনি বাসায় যাচ্ছেন, তাই অনেক বাজার করলেন। বাসায় গিয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকলেন। তাঁর স্ত্রী তাঁকে প্রায় ঠেলে ঘর থেকে বের করে দেন কারণ যে কোন সময় পুলিশ চলে আসবে। স্ত্রীকে সালাম জানিয়ে অধ্যাপক সাহেব একটি বাজারের একটি ভাঙ্গা দোকানের দিকে যাচ্ছেন। সেখানেই তিনি পালিয়ে থাকেন।
২.
কবিরের আর্থিক দৈন্যতার কথা তিনি আগে থেকেই জানতেন। তাকে কয়েকবার সহযোগিতা করতে চেয়েছেন। কিন্তু কবিরের প্রবল আত্মসম্মান বোধ থাকায় তিনি পারেন নি। তাই কবিরকে বাকী টাকা ফেরত দিতে বলে ক্লাসে ডেকে নিয়ে আসছেন। যথারীতি কবির ক্লাসে আসলো, কবিরকে বুঝিয়ে তিনি পরীক্ষা দিতে রাজী করালেন। টাকার ব্যবস্থা করলেন তিনি। আর খুব শক্ত করে বলে বিষয়টি যাতে কেউ না জানে।
প্রায় মাসখানেক অধ্যাপক সাহেব বাসায় যেতে পারেন নি, পুলিশের সমস্যা তো আছেই তাছাড়া এই মাসে ওনার কাজের চাপও ছিল বেশী। আগে কখনোই তিনি বাইরে খেতেন না। দুপুরের খাবারও বাসা থেকে নিয়ে যেতেন। অথচ সেই নুরুল ইসলাম সাহেব গত এক মাস বাসায় আসেন নি। মিসেস নুরুল ইসলাম এই নিয়ে খুব চিন্তায় থাকেন। ইচ্ছে করে অধ্যাপক সাহেবের খাবার রান্না করে পাঠিয়ে দিতে। কিন্তু নিরাপত্তা জনিত কারণে পারা যায় না।
মিসেস নুরুল ইসলাম খুব চাপাচাপি করে একদিন বিকেলে ডেকে নিয়ে আসলেন তাকে। বললেন কি খাও না খাও। একটা দিন ভালো-মন্দ খাও। জমানো অনেক কথা বলতে বলতে রাত হয়ে গিয়েছে অনেক বেশী। তাই অধ্যাপক সাহেব আজ বাসায় থেকে গেলেন। মধ্যরাতে দরজায় লাথির শব্দে ঘুম ভাঙ্গলো।
৩.
যেখানে বাঘের ভয়, সেখানে রাত হয়। কথাটাই ঠিক। যেদিন তিনি বাসায় সে দিনই পুলিশ আসলো। হাতে হাতকড়া পরিয়ে থানায় নিয়ে গেলো। তখন রাত দুটো। মিসেস নুরুল ইসলাম পুলিশের গাড়ির সাথে সাথে চললেন CNG তে চড়ে। থানায় ওসির আর শুধু পা ধরা বাকী। অনুনয় করতে থাকলেন ছেড়ে দেয়ার জন্য। অবশেষে পুলিশ বলে আপনার কাছে কত আছে? হাতে খুব বেশী টাকা ছিল না তাই সব স্বর্ণালংকার নিয়ে আসলেন। অন্তত সাত ভরি তো হবেই।
ওসি সাহেব বললেন ঠিক আছে আমাদের কিছু জিজ্ঞাসা আছে ওনার কাছে। জিজ্ঞাসা শেষ হলে ওনাকে ছেড়ে দেব। কাল সকাল সাতটায় দুই লাখ টাকা ক্যাশ নিয়ে আসবেন। স্বর্ণ গুলো রেখে যান। খুব খুশী হলেন মিসেস। এবার অন্তত কারাগারে যেতে হচ্ছে না।
ওসির রুম থেকে বের হয়ে কাস্টোডিতে অধায়পক সাহেব কে দেখতে এসে দেখলেন তিনি নোংরা মেঝেতে একটি পানির বোতলের উপর মাথা রেখে দিব্যি ঘুমাচ্ছেন। গায়ে অজস্র মশা মনের সুখে কামড়াচ্ছে। তিনি ডাক দিয়ে উঠালেন।
- আচ্ছা তোমার কখনোই কোন দুঃচিন্তা হয় না? এমন পরিবেশে কেউ ঘুমাতে পারে?
- (হেসে বললেন) শোন আমি আমার ভাগ্য রবের কাছে ছেড়ে দিয়েছি। তিনি থাকতে আমার চিন্তা কিসের?
এরপর মিসেস নুরুল ইসলাম ওসির সাথে হওয়া সব কথা বললেন তাকে। তিনি তার স্ত্রীকে বললেন কে বলেছে তোমাকে এসব করতে। পুলিশকে বিশ্বাস কুরতে নেই। তুমি সব অলংকার নিয়ে বাসায় যাও। আর তাছাড়া আমি একটু আগে খুব ভালো স্বপ্ন দেখেছি।
৪.
বাকী রাতের মধ্যেই মিসেস নুরুল ইসলাম প্রতিবেশীদের আত্মীয়দের মাধ্যমে টাকা যোগাড় করে ফেললেন। তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ে অনেক কাঁদলেন আল্লাহর কাছে। সকালে নিজে নাস্তা তৈরী করলেন। যাতে থানা থেকে এসেই অধ্যাপক সাহেব কে নাস্তা দেয়া যায়। তারপর বের হওয়ার আগে TV টা একটু অন করলেন। স্ক্রলে বড় বড় করে লিখা “জামায়াত নেতা অধ্যাপক নুরুল ইসলাম পুলিশের সাথে বন্দুকযুদ্ধে নিহত”
মিসেস ইসলাম দৌড়ে গেলেন থানায়, সেখানে মরদেহ নেই। চলে গেছে হাসপাতালে। মর্গের সামনে কিছুক্ষন একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিলেন। তারপর গগনবিদারী চিৎকার করে লাশের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বললেন, আমি! আমি খুন করেছি তোমাকে। আমাকে তুমি ক্ষমা কর নি। সারা জীবনের শাস্তি তুমি দিয়ে গেলে। আমি তোমাকে বাসায় ডেকে এনেছি। বেঁহুশ হয়ে পড়লেন মিসেস।
জানাজা শেষে কবির ছুটে আসলো কফিনের কাছে। ঈমাম সাহেবের কাছ থেকে মাইক নিয়ে বললো, আমরা সবাই স্যার কে চিনি। তিনি যদি সন্ত্রাসী হন তবে পুরো দেশ সাক্ষী থাকো আমি কফিন ছুঁয়ে শপথ নিলাম আমিও স্যারের মত সন্ত্রাসী হলাম।
একে একে হাজার হাজার জনতা সবাই অশ্রুসিক্ত নয়নে শপথ নিল আমরাও স্যারের মত সন্ত্রাসী হয়ে গেলাম। হে পুলিশ, আমাদের গুলি কর। আমরা সবাই মরার জন্য প্রস্তুত।