শুধু ইসলামী রাষ্ট্র নয়, যে কোন রাষ্ট্রেই নেতৃত্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই নেতৃত্ব নির্বাচনে সর্বাধিক যোগ্য ব্যক্তিকেই বাছাই করা জরুরী।
আল্লাহ্ তায়ালা সূরা ইমরানের ১৫৯ আয়াতে নেতার গুণাবলী বর্ণনা করেছেন ১। কোমল হৃদয় সম্পন্ন ২। অনুসারীদের ত্রুটিকে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখা। ৩। পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ। ৪। দৃঢ় সংকল্প ৫। আল্লাহ্র উপর ভরসা রাখা।
নেতার গুণাবলী সম্পর্কে আরো বলেছেন আরো বলেছেন, লুকমান ২৩, তাওবা ১২৮, আশ শোয়ারা ২১৫, আহকাফ ৩৫।
নেতৃত্বের পরই নেতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে কর্তৃত্ব প্রদান। মানে যোগ্য ব্যক্তিদের কে তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব প্রদান।
এই ব্যাপারে রাসূল সঃ বলেন, যে সেনাবাহিনীতে এমন ব্যক্তিকে নেতা নির্ধারণ করলো, যার চাইতে সেনাবাহিনীতে আরো যোগ্যতর ব্যক্তি রয়েছে, সে আল্লাহ্ ও তার রাসূলের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করলো। বিশ্বাসঘাতকতা করলো মুসলিমদের সাথে। (আল হাকিম)
এখানে স্বজনপ্রীতি পুরোপুরি অগ্রহণযোগ্য।
ওমর ফারুক রাঃ বলেন, যে মুসলিমদের কোন ব্যাপারে (নির্বাহী) দায়িত্ব পেয়ে এমন ব্যক্তিকে কর্মকর্তা নিযুক্ত করে, যার সঙ্গে তার স্নেহের সম্পর্ক আছে। কিংবা সে তার স্বজন। তবে সে আল্লাহ্ ও তার রাসূল এবং মুসলিমদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করলো। (শরিয়তী রাষ্ট্রব্যবস্থাঃ ইবনে তাইমিয়া)
কর্তৃত্ব বা নেতৃত্ব চাওয়ার বিষয় নয়। আর যে তা চাইবে সে সবচেয়ে বেশী অযোগ্য।
একদা রাসূল সঃ দরবারে কিছু লোক উপস্থিত হয়ে তাঁর পক্ষ হতে শাসন কতৃত্ব প্রাপ্তির অনুরোধ জানালো। জবাবে রাসূল সঃ বললেন, যারা স্বেচ্ছায় কর্তৃত্ব চায়, আমরা এমন লোককে কোন কিছুরই কর্তৃত্ব দেই না। (বুখারী ও মুসলিম)
কল্যাণমুখী রাষ্ট্রের স্বরুপঃ ০১ রাষ্ট্রের কর্তৃত্বে যারা থাকবে তাদের প্রধানত কাজ হবে দায়িত্বের ব্যাপারে সজাগ থাকা।
সূরা মায়েদায় ১০৫ নং আয়াতে আল্লাহ্ তায়ালা বলেন, হে মুমিন গণ! তোমরা নিজেদের দায়িত্বের ব্যাপারে সচেতন থাকো। তোমরা সঠিক পথে থাকলে গোমরাহ ব্যক্তিরা তোমাদের ক্ষতি করতে পারবে না।
কর্তা ব্যাক্তিরা হবে আমানতদার, বিশ্বস্ত, তাকওয়ার গুনে আলোকিত। তারা পার্থিব সামান্য চাহিদার বিনিময়ে হক্কুল্লাহকে কখনোই বিসর্জন দেবে না। তারা তাদের মন থেকে অবশ্যই মানুষের ভয় সম্পূর্ণ বের করে দিবে।
আল্লাহ্ তায়ালা বলেন, তোমরা মানুষকে ভয় করো না বরং আমাকে ভয় করো এবং সামান্য তুচ্ছ মূল্যের বিনিময়ে আমার আয়াত বিক্রি করা পরিহার করো। আল্লাহর নাযিল করা আইন অনুযায়ী যারা ফায়সালা করে না তারাই কাফের। (সূরা মায়েদাঃ ৪৪)
সব ধরণের সিদ্ধান্ত কিংবা ফয়সালা আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসূলের প্রদর্শিত বিধান অনুযায়ী হতে হবে। নতুবা কর্তা ব্যক্তিদের জাহান্নামী হতে হবে।
এই সম্পর্কে রাসূল সঃ বলেন, শাসক ও বিচারকদের তিন ভাগে ভাগ করা হবে। এর মধ্যে দু’ভাগই জাহান্নামী হবে, এক ভাগ হবে জান্নাতি। অতঃএব যে ব্যক্তি সত্য কে অনুধাবন করে ন্যায়বিচার করবে সে জান্নাতী হবে। (আহলুস সুন্নাহ)
কর্তা ব্যক্তিরা কখনোই ভীরু, পাপাচারী এবং নিষ্ঠুর হবে না।
হযরত ওমর রাঃ এই দোয়া সবসময় করতেন, হে আল্লাহ্ তোমার কাছে পাপাচারীর নিষ্ঠুরতা এবং ভীরুর অক্ষমতা থেকে পানাহ চাই।
কুরআনের নির্দেশনা অনুযায়ী মুসলিম শাসকের ৪টি কাজ
১। নামাজ কায়েম করা ২। যাকাত আদায় ও বন্টন ৩। সৎ কাজের আদেশ ৪। অসৎ কাজের নিষেধ।
ওমর রাঃ ইসলামী রাষ্ট্রের বিভিন্ন এলাকায় নিয়োজিত কর্মচারী ও গভর্ণরদের উদ্দেশ্যে যে সরকারী ফরমান লিখে পাঠাতেন সেগুলো তে লেখা থাকতো, “আমার কাছে তোমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল নামাজ। যে ব্যাক্তি নামাজের হেফাযত করলো সে দ্বীনের হেফাযত করলো। যে নামাজ নষ্ট করলো সে অন্যান্য কাজও বেশী নষ্ট করবে। ” আল্লাহ্র রাসূল বলেন, “নামাজ হচ্ছে দ্বীনের স্তম্ভ”।
প্রশাসনিক কর্মকর্তারা যখন এই স্তম্ভটির হেফাযত করবে তখন নামাজ তাকে অশ্লীলতা এবং সকল গর্হিত কাজ ও দূর্ণীতি থেকে রক্ষা করবে। অন্যান্য ইবাদতের কাজেও নামাজ সহায়তাকারী হবে।
আল্লাহ্ তায়ালা বলেন “নিশ্চয়ই নামাজ সকল প্রকার অশ্লীলতা ও খারাপ কাজ হতে দূরে রাখে।” এই ব্যাপারে আল্লাহ্ আরো বলেছেন সূরা বাকারার ১৪৫ ও ৫৩ নং আয়াতে। কল্যাণমুখী রাষ্ট্রের স্বরুপঃ ০২
ইসলামী রাষ্ট্রের আয়ের উৎস গুলো নিন্মরুপ।
১। অর্থ সম্পদ ও গবাদি পশুর যাকাত ২।সদাকাতুল ফিতর ৩। কাফফারাহ ৪। ওশর ৫। খারাজ ৬। গণীমতের মাল ও ফাই ৭। জিজিয়া ৮। খনিজ সম্পদের আয় ৯। নদী ও সমুদ্র হতে প্রাপ্ত সম্পদের এক-পঞ্চামাংশ ১০। ইজারার অর্থ ১১। মালিক ও উত্তরাধিকারহীন সম্পদ ১২। আমদানী ও রফতানী শুল্ক ১৩। রাষ্ট্রের মালিকানা ও কর্তৃত্বধীন জমি, বন ব্যবসায় ও শিল্পের মুনাফা ১৪। শরীয়াহ মোতাবেক আরোপিত কর ১৫। বন্ধু রাষ্ট্রসমূহের অনুদান ও উপটৌকন। ১৬। ইনফাক ফি সাবিলিল্লাহ।
যে সমস্ত খাতে বায়তুলমালের অর্থ ব্যয়ের সুস্পষ্ট বিধান রয়েছে সেগুলি হচ্ছে :
১। রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারি কর্মচারীদের বেতন ২। বন্দী ও কয়েদীদের ভরণ-পোষণ ৩। ইয়াতিম শিশুদের প্রতিপালন ৪। অমুসলিমদের আর্থিক নিরাপত্তা ৫। করযে হাসানা প্রদান এবং ৬। সামাজিক কল্যাণ
বেতন নির্ধারণ সম্পর্কে উমর ফারুক (রা) এর গৃহীত নীতি এ প্রসঙ্গে সবিশেষ মনোযোগের দাবী রাখে। সে নীতিতে মূখ্য বিচার্য বিষয় ছিল একজন ব্যক্তি-
১। ইসলামের জন্যে কি পরিমাণ দু:খ ভোগ করেছে। ২। ইসলাম প্রচারের ব্যাপারে কতখানি অগ্রসর হয়েছে ৩। ইসলাম প্রতিষ্ঠার কতখানি কষ্ট স্বীকার করেছে ৪। ইসলামী জীবন যাপনের জন্যে প্রকৃত প্রয়োজন কতখানি এবং ৫। কতজন লোকের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব তার উপর অর্পিত রয়েছে।
কল্যাণমুখী রাষ্ট্রের স্বরুপঃ ০৩
ইসলামী রাষ্ট্রে শ্রমিকদের অবস্থান।
রাসূল সঃ মজুরদের অধিকার সম্বন্ধে বলেন- “তারা তোমাদের ভাই আল্লাহ্ তাদের দায়িত্ব তোমাদের উপর অর্পণ করেছেন। কাজেই আল্লাহ যাদের উপর এরূপ দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়েছেন তাদের কর্তব্য হলো তারা যে রকম খাবার খাবে তাদেরকেও সেরকম খাবার দেবে, তারা যা পরিধান করবে তাদেরকে তা পরাবার ব্যবস্থা করবে। যে কাজ করা তাদের পক্ষে কষ্টকর ও সাধ্যতীত তা করার জন্যে তাদেরকে কখনও বাধ্য করবে না। যদি সে কাজ তাদের দিয়েই করাতে হয় তা হলে সে জন্যে তাদের প্রয়োজনীয় সাহায্য অবশ্যই করতে হবে। (বুখারী)
অন্যত্র রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শ্রমিকদের সম্পর্কে বলেছেন, শ্রমিককে এমন কাজ করতে বাধ্য করা যাবে না, যা তাদেরকে অক্ষম ও অকর্মণ্য বানিয়ে দেবে। (তিরমিয)
তাদের উপর ততখানি চাপ দেওয়া যেতে পারে, যতখানি তাদের সামর্থ্যে কুলায়। সাধ্যাতীত কোন কাজের নির্দেশ কিছুতেই দেওয়া যেতে পারে না। (মুয়াত্তা, মুসলিম)
মজুরদের বেতন, উৎপাদিত পণ্যে তাদের অংশ ইত্যাদি সম্পর্কে তিনি সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন- মজুরের মজুরী তার গায়ের ঘাম শুকাবার পূর্বেই পরিশোধ কর। (ইবনে মাজাহ, বায়হাকী)
মজুরকে তার কাজ হতে অংশ দান কর। কারণ,আল্লাহ মজুরকে কিছুতেই বঞ্চিত করা যেতে পারে না। (মুসনাদে আহমদ বিন হাম্বল)
উপরোক্ত হাদীসসমূহ হতে যেসব মূলনীতি পাওয়া যায় সেগুলোই রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রবর্তিত মানবিক শ্রমনীতি। সংক্ষেপে এগুলো হচ্ছে-
১। উদ্যোক্তা বা শিল্প মালিক মজুর-শ্রমিককে নিজের ভাইয়ের মতো মনে করবে।সহোদর ভাইয়ের মধ্যে যে সম্পর্ক বিদ্যমান থাকে এ ক্ষেত্রেও সে রকম সম্পর্ক থাকবে।
২। অন্ন বস্ত্র-বাসস্থান প্রভৃতি মৌলিক প্রয়োজনের ক্ষেত্রে শ্রমিক ও।মালিক উভয়ের মান সমান হবে। মালিক যা খাবে ও পরবে শ্রমিককেও তাই খেতে ও পরতে দেবে।
৩। সময় ও কাজ উভয় দিক দিয়েই শ্রমিকদের সাধ্য মতো দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে, তার বেশী নয়। শ্রমিককে এত বেশী কাজ দেওয়া উচিৎ হবে না যাতে সে ক্লান্ত ও পীড়িত হয়ে পড়ে। এত দীর্ঘ সময় পর্যন্ত তাকে শ্রম দিতে বাধ্য করা যাবে না, যার ফলে সে অক্ষম হয়ে পড়ে। শ্রমিকের কাজের সময় নির্দিষ্ট হতে হবেএবং বিশ্রামের সুযোগ থাকতে হবে।
৪। যে শ্রমিকের পক্ষে একটি কাজ করা অসাধ্য তা সম্পন্ন হবে না এমন কথা ইসলাম বলে না। বরং সে ক্ষেত্রে আরও বেশী সময় দিয়ে বা বেশী শ্রমিক নিয়োগ করে তা সম্পন্ন করা যেতে পারে।
৫। শ্রমিকদের বেতন শুধুমাত্র তাদের জীবন রক্ষার জন্যে যথেষ্ট হলে হবেনা। তাদের স্বাস্থ্য, শক্তি ও সজীবতা রক্ষার জন্যে ন্যূনতম প্রয়োজনীয় ব্যয়ের ভিত্তিতেই বেতন নির্ধারণ করতে হবে।
৬। উৎপন্ন দ্রব্যের অংশবিশেষ বা লভ্যাংশের নির্দিষ্ট অংশও শ্রমিকদের দান করতে হবে।
৭। শ্রমিকদের কাজে কোন ত্রুটি-বিচ্যুতি ঘটলে তাদের প্রতি অমানুষিক আচরণ বা নির্যাতন করা চলবে না। বরং যথাযথ সহানুভূতি পূর্ণ ব্যবহার করতে হবে। ৮। চুক্তিমত কাজ শেষ হলে অথবা নির্দিষ্ট সময় অতিবাহিত হলে শ্রমিককে দ্রুত মজুরী বা বেতন পরিশোধ করতে হবে। এ ব্যাপারে কোন ওজর-আপত্তি বা গাফলতি করা চলবে না।
৯। পেশা বা কাজ নির্বাচন করার ও মজুরীর পরিমাণ বা হার নির্ধারণ সম্পর্কেও দর-দস্তর করার পূর্ণ স্বাধীনতা ও অধিকার শ্রমিকের রয়েছে। বিশেষ কোনকাজে বা মজুরীর বিশেষ কোন পরিমাণের বিনিময়ে কাজ করতে জবরদস্তি করা যাবে না।
১০। কোন অবস্থাতেই মজুরদের অসহায় করে ছেড়ে দেওয়া চলবে না। তারা অক্ষম ও বৃদ্ধ হয়ে পড়লে পেনশন বা ভাতার ব্যবস্থা করতে হবে। এ উদ্দেশ্যে বায়তুলমালের তহবিল ব্যবহৃত হতে পারে।
কল্যাণমুখী রাষ্ট্রের সরূপঃ ০৪
শিক্ষা ব্যবস্থা কীরূপ হবে?
১) ইসলামী আক্বীদাকে ভিত্তি করে শিক্ষানীতি প্রণয়ন করতে হবে। পাঠ্যসূচি এবং শিক্ষাদান-পদ্ধতি এমনভাবে সাজাতে হবে যাতে এ ভিত্তি থেকে যে কোন ধরনের বিচ্যুতি প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে। [ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে শিক্ষা সম্পর্কিত শরিয়া নিয়মকানুন ইসলামী আক্বীদা থেকে উৎসারিত এবং এদের প্রত্যেকের শরীয়া প্রমাণাদি বিদ্যমান থাকবে।
২) ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থার উদ্দেশ্য হবে চিন্তা এবং স্বভাবগত দিক থেকে ইসলামী ব্যক্তিত্ব গঠন করা। সুতরাং এই নীতির উপর ভিত্তি করে কারিকুলামের বিষয়সমূহ নির্ধারণ করতে হবে।
৩) শিক্ষার লক্ষ্য হবে ইসলামী ব্যক্তিত্ব তৈরি করা এবং তাদেরকে জীবনের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান সম্পর্কিত ইসলামী জ্ঞান সরবরাহ করা। এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে শিক্ষাদান-পদ্ধতি ঠিক করতে হবে এবং এ লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করে ফেলে এমন যে কোনো পদ্ধতিকে প্রতিরোধ করতে হবে।
৪) গবেষণালব্ধ বিজ্ঞান যেমন- গণিত (বা পদার্থবিদ্যা) এবং সাংস্কৃতিক জ্ঞান (যেমন আইনশাস্ত্র, সাহিত্য, ইতিহাস)- এ দুটোর মধ্যে পার্থক্য থাকতে হবে। গবেষণালব্ধ বিজ্ঞান এবং এর সাথে সম্পর্কিত অন্যান্য বিষয়াদি প্রয়োজনের সাথে সঙ্গতি রেখে শিক্ষাদান করতে হবে এবং শিক্ষার কোন পর্যায়েই এটা বাধাগ্রস্ত করা যাবে না। অন্যদিকে সাংস্কৃতিক জ্ঞানকে প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক পর্যায়ে একটা নির্দিষ্ট নীতির মাধ্যমে শিক্ষাদান করতে হবে যাতে এটা ইসলামী চিন্তা এবং নিয়মকানুনের সাথে সাংঘর্ষিক না হয়। এছাড়া এই সাংস্কৃতিক জ্ঞানকে বিজ্ঞানের অন্যান্য বিষয়ের মতো উচ্চশিক্ষার অন্যান্য পর্যায়েও এমনভাবে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা থাকতে হবে যাতে সেটা শিক্ষানীতির এবং শিক্ষার উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুতি প্রদর্শন না করে।
৫) ইসলামী সংস্কৃতিকে অবশ্যই শিক্ষাব্যবস্থার সমস্ত পর্যায়ে শিক্ষাদান করতে হবে। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে চিকিৎসা, প্রকৌশল বা পদার্থবিদ্যা পাশাপাশি বিভিন্ন ইসলামী জ্ঞানের জন্য ডিপার্টমেন্ট খুলতে হবে।
৬) শিল্পকলা (Arts) এবং হস্তশিল্প (crafts) যদি বাণিজ্য, নৌযানবিদ্যা বা কৃষিবিদ্যার সাথে সম্পর্কিত হয়, তবে সেগুলো কোনরকম বাধা বা শর্ত ছাড়াই শিখা হবে। কিন্তু কখনো কখনো শিল্পকলা এবং হস্তশিল্প সংস্কৃতির সাথে সম্পর্কিত হতে পারে এবং জীবন সম্পর্কে একটি নির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গিও দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে।
৭) রাষ্ট্রের একটিমাত্র নির্দিষ্ট শিক্ষাসূচি (কারিকুলাম) থাকবে এবং এটি বাদে অন্যকোন কারিকুলামের শিক্ষাদান অনুমোদন করা যাবেনা।
৮) বিদেশী রাষ্ট্র কর্তৃক পরিচালিত না হলে বেসরকারি স্কুলের অনুমোদন দেওয়া হবে যদি এসব স্কুল রাষ্ট্রের কারিকুলাম গ্রহণ করে, রাষ্ট্রেও শিক্ষানীতির আওতায় প্রতিষ্ঠিত হয় এবং রাষ্ট্রের শিক্ষানীতির লক্ষ্যকে যথাযথভাবে সম্পাদন করে। এসমস্ত স্কুলসমূহে নারী এবং পুরুষ একত্রে রাখা যাবেনা- এটা শিক্ষক বা শিক্ষার্থী উভয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এসমস্ত স্কুল নির্দিষ্ট কোন ধর্ম, মাযহাব, বংশ বা বর্ণের জন্য প্রতিষ্ঠিত হতে পারবেনা।
৯) যেসমস্ত বিষয় জীবনের মূলধারার জন্য প্রয়োজনীয়, সেগুলো নারী এবং পুরুষ প্রত্যেক নাগরিককে শিক্ষাদান করা রাষ্ট্রের অত্যাবশ্যকীয় কর্তব্য। প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক স্তরে বিনামূল্যে এ শিক্ষার ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের জন্য বাধ্যতামূলক। রাষ্ট্র তার সাধ্যমতো সবার জন্য বিনা বেতনে উচ্চশিক্ষার সুযোগ তৈরির চেষ্টা করবে।
১০) স্কুল এবং বিশ্ববিদ্যালয় তৈরির পাশাপাশি রাষ্ট্র জ্ঞানের বিস্তার মান্নোয়নের জন্য বিভিন্ন উপকরণ; যেমন- লাইব্রেরি এবং লাইব্রেরি সরবরাহ করবে যাতে জ্ঞানের বিভিন্ন শাখা যেমন ফিকহ, হাদীস, কুরআনের তাফসীর এবং চিন্তা, চিকিৎসা, প্রকৌশল ও রসায়ন প্রভৃতি নিয়ে যারা গবেষণা করতে আগ্রহী তারা যেন উদ্ভাবন এবং আবিষ্কারে সক্ষমতা লাভ করতে পারে। এর ফলে পর্যাপ্ত পরিমাণে মুজতাহিদ, মানসম্পন্ন বৈজ্ঞানিক এবং উদ্ভাবক তৈরি হবে।
কল্যাণমুখী রাষ্ট্রের স্বরুপঃ ০৫
খিলাফত রাষ্ট্র অমুসলিমদের যে অধিকারগুলো বিশেষভাবে বাস্তবায়ন করে তা হচ্ছেঃ
১. খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থানের অধিকারঃ
খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থানের মৌলিক চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে খিলাফত রাষ্ট্র মুসলিম-অমুসলিম সকল নাগরিককে সমানভাবে বিচার করে। মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে রাষ্ট্রের প্রত্যেকটি নাগরিকের এ তিনটি মৌলিক চাহিদা পূরণ খিলাফত রাষ্ট্রের উপর অবশ্য পালনীয় কর্তব্য। এক্ষেত্রে ইসলাম সামগ্রিকভাবে মুসলিম-অমুসলিম সকল নাগরিককে নিশ্চয়তা দেয়। কারণ রাসূল (সাঃ) বলেনঃ
“তিনটি বস্তু ছাড়া আদম সন্তানের আর কিছুর অধিকার নেই। তাহলোঃ বসবাসের জন্য একটি ঘর, দেহ ঢাকার জন্য কিছু বস্ত্র এবং কিছু রুটি ও পানি।”
এখানে ‘আদম সন্তান’ বলতে মুসলিম-অমুসলিম সকলকে বোঝানো হয়েছে। খলিফা ওমর (রাঃ) মিসরের গভর্ণর আমর ইবনুল আসকে (রাঃ) লেখা এক চিঠিতে বলেছেনঃ
“কসম আল্লাহর, আমার ভয় হয় তোমার শাসনাধীন এলাকার দূরতম কোণায় যদি একটি উট অবহেলায় মারা পড়ে তবে কিয়ামতের দিন আমাকে এরও জবাবদিহি করতে হবে।”
২. ধর্মপালন বা বিশ্বাসের অধিকারঃ
ইসলামী রাষ্ট্র কখনও কোন অমুসলিমকে নিজের ধর্মপালনে বাধা দেয়না। কিংবা জোর করে ইসলাম গ্রহণ করতে বাধ্য করেনা। পবিত্র কুরআন এ ব্যাপারে পরিষ্কার ঘোষণা দিয়েছেঃ-
“দ্বীন গ্রহণের ব্যাপারে কোন জোর-যবরদস্তি নেই।” (আল-বাকারাঃ ২৫৬)
স্যার থমাস তাঁর বইতে উল্লেখ করেছেন “আমাদের এমন কোন তথ্য জানা নেই যে, খিলাফত শাসন চলাকালীন ইসলামী কর্তৃপক্ষ কিংবা কোন সংগঠন কোন অমুসলিমকে জোর করে মুসলমান বানানোর প্রচেষ্টা চালিয়েছে কিংবা খৃীষ্টানদেরকে উত্যক্ত করার কোন পরিকল্পনার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে।” তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, “যদি এমনটি হতো- তাহলে রাজা ফার্ডিনেন্ড এবং রাণী ইসাবেলার নিষ্ঠুর পদক্ষেপের দরুণ যেমন স্পেন মুসলিম শূণ্য হয়ে পড়েছিল এবং সাড়ে তিন শত বছর যাবত বৃটেনে ইয়াহুদীদের কোন নিবাস ছিল না, তেমনি জেরুজালেমও খৃষ্টান ইয়াহুদী শূন্য হয়ে যেত।”
৩. জান-মালের নিরাপত্তাঃ
খিলাফত রাষ্ট্রে একজন মুসলমানের মতই একজন অমুসলিম মুআ‘হিদের জীবন পবিত্র ও সুরক্ষিত থাকে। আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বলেনঃ-
“যদি কোন ব্যক্তি কোন মু’আহিদকে হত্যা করে তবে সে জান্নাতের ঘ্রাণও পাবেনা। যদিও চল্লিশ বছরের দূরত্ব থেকেই জান্নাতের ঘ্রাণ পাওয়া যায়।” (বুখারী শরীফ)
তিনি আরো বলেন- সাবধান! কেউ যদি কোন মু’আহিদের প্রতি যুলুম করে কিংবা তার অধিকার হতে কিছু কমিয়ে দেয়, অথবা তার সাধ্যাতিত কোন কাজ তার উপর চাপিয়ে দেয়, বা তার স্বতস্ফূর্ত অনুমতি ছাড়া তার কোন সম্পদ নিয়ে নেয়- তাহলে আমি কিয়ামত দিবসে তার বিরুদ্ধে মামলা করব এবং সে মামলায় জিতব।” (আবু দাউদ)
রাসূল (সাঃ) এর যুগে এক মুসলিম ব্যক্তি অপর এক অমুসলিমকে হত্যা করলে বিচারে তিনি হত্যাকারী মুসলিম ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ড দেন এবং তা কার্যকর করেন।
৪. বিচার প্রাপ্তির অধিকারঃ
পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছেঃ-
“যখন তোমরা মানুষের মাঝে বিচার কার্য পরিচালনা করবে তখন ন্যায়পরায়ণতার সাথে বিচার করবে। আল্লাহ্ তোমাদেরকে যে উপদেশ দেন তা কতই না উত্তম।” (সুরা নিসাঃ ৫৮)
অন্য আয়াতে ইয়াহুদীদের প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তাঁর রাসুলকে নির্দেশ দিয়েছেন এই বলে যেঃ
“যদি ফয়সালা করেন তবে ন্যায়ভাবে ফয়সালা করুন। নিশ্চয় আল্লাহ্ সুবিচারকারীকে ভালবাসেন।” (মায়িদাঃ ৪২)
খিলাফতের ইতিহাসে এমন অনেক অবিস্মরনীয় বিচারের ঘটনা ঘটেছে যা একদিকে ন্যায়বিচারের ভান্ডারকে করেছে সমৃদ্ধ অন্যদিকে সর্বকালের অমুসলিমদের জন্য হয়ে আছে অনুপ্রেরণার উৎস। আলোচনা দীর্ঘ না করার স্বার্থে শুধুমাত্র একটি দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করছি। সপ্তম শতাব্দির ঘটনা। তখন খিলাফতের মসনদ অলংকৃত করে আছেন মহাবীর হযরত আলী (রাঃ)। একজন ইয়াহুদী নাগরিক খলীফা আলীর (রাঃ) একটি ঢাল চুরি করলে বিষয়টি বিচারালয়ে উত্থাপিত হয়। তখন কাজী অর্থাৎ বিচারক খলীফাকে তার পক্ষে স্বাক্ষী উপস্থিত করতে বলেন। হযরত আলী তাঁর পুত্রকে স্বাক্ষী হিসাবে হাজির করেন। বিচারক মামলাটি খারিজ করে দেয় এই বলে যে, কোন পিতার পক্ষে পুত্রের স্বাক্ষী গ্রহণযোগ্য নয়। ন্যায় বিচারের এই চমৎকারিত্য দেখে ইয়াহুদী লোকটি দারুণভাবে অভিভূত হয় এবং চুরির কথা স্বীকার করে নিজেই মুসলমান হয়ে যায়। এমন অনেক ঘটনা খোদ রাসূল (সাঃ) এর জীবনেও ঘটেছে। যেখানে অমুসলিমরা নিজেদের ধর্মীয় নেতার কাছে না গিয়ে মুকাদ্দমা নিয়ে ইসলামের আদালতে এসেছে এই আশায় যে এখানেই পাওয়া যাবে প্রকৃত ন্যায় বিচার। আমরা আশা করি, ইসলামের এই ইনসাফ ভিত্তিক শাসন ব্যবস্থা এদেশের অমুসলিমদেরকে আশ্বস্ত করবে এবং ইসলাম সম্পর্কে জানার আগ্রহকে তীব্র করবে। আর অপপ্রচারকারীদের চেহারাকে করবে মলিন।
৫. শিক্ষার অধিকারঃ
একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র হওয়ার লক্ষ্যে খিলাফত রাষ্ট্র তার নাগরিকদেরকে শিক্ষিত করে তুলবে। নাগরিকগণ তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী বিজ্ঞান, ব্যবসা, আইন, শিল্পকলার মত যেকোন শাখায় উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। রাসূল (সাঃ) বদরের যুদ্ধে বিভিন্ন রকম মুক্তিপণের বিনিময়ে যুদ্ধবন্দিদের মুক্তি দিয়েছিলেন। তার মধ্যে একটি ছিল একজন শিক্ষিত যুদ্ধবন্দির মুক্তিপণ হিসেবে দশজন মুসলিমকে শিক্ষাদান।
৬.অর্থনৈতিক অধিকারঃ
খিলাফত রাষ্ট্র মুসলমানদের তুলনায় অমুসলমানদের অনেক বেশী সুবিধা দিয়ে থাকে। কারণ মুসলমানদের যাকাত নামক একটি বিশেষ কর দিতে হয় যা অমুসলিম ব্যক্তি বা কোম্পানীকে দিতে হয়না। এমন আরও কিছু বিষয় আছে যা মুসলিম নাগরিকদের উপর বর্তায় কিন্তু অমুসলিমদের উপর বর্তায় না। এখানে আরও উল্লেখ্য যে, অমুসলিমদের কাছ থেকে নাগরিক নিরাপত্তা বাবৎ যে জিযিয়া আদায় করা হয় তার হার মুসলমানদের যাকাতের হারের চেয়ে অনেক কম। রাসূল (সাঃ) বলেনঃ
“যে ব্যক্তি কোন মুআহিদের উপর জুলুম করবে; তার শক্তির বাইরে খারাজ ও জিযিয়া ধার্য করবে কেয়ামতের দিন আমি তার গর্দান পাকড়াও করব।”
৭. নাগরিক ও সামাজিক অধিকারঃ
অমুসলিমরা খিলাফত রাষ্ট্রের বিশেষ সম্মানিত নাগরিক। তারা সবসময় নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ জীবন-যাপন করবে।
সকল মুসলমান তাদের সাথে সৎ ও বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিবেশীসুলভ আচরণ করতে বাধ্য থাকবে। আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বলেনঃ
“যে ব্যক্তি কোন চুক্তিবদ্ধ অমুসলিমের ক্ষতি করল সে যেন আমাকে ক্ষতিগ্রস্থ করল।”
কল্যাণমুখী রাষ্ট্রের স্বরুপঃ ৬
ইসলামের বিচার ব্যবস্থা:
যে কোন বিষয়ে ইসলামের সিদ্ধান্ত বা রায় কে বাধ্যতামূলকভাবে প্রয়োগ করাকে ইসলামের বিচার ব্যবস্থার মূলনীতি হিসাবে গ্রহণ করা হয়েছে। এটি নিম্নলিখিত দায়িত্বগুলো পালন করবে:
১) জনগণের মধ্যে বিরোধ নিষ্পত্তি;
২) সামাজিক অধিকারের জন্য ক্ষতিকর সবকিছু প্রতিহত করা;
৩) জনগণ এবং সরকারের (যথা- খলীফা, ওয়ালী’র ইত্যাদির) মধ্যে উদ্ভুত বিরোধ নিষ্পত্তি করা।
ইসলামের জন্মলগ্ন থেকেই আদালত এবং বিচার ব্যবস্থা বিদ্যমান রয়েছে যা ইসলামের আইনের মৌলিক উৎস যথা- কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা এবং কিয়াস দ্বারা পরিবেষ্টিত (নিয়ন্ত্রিত)।
একজন প্রধান বিচারক নিয়োগের মাধ্যমে বিচারিক অঙ্গনের কাঠামো প্রতিষ্ঠা করা হয়, যিনি অন্যান্য সকল বিচারক নিয়োগ এবং স্তর/ কার্য পরিধি নির্ধারণের দায়িত্ব পালন করেন।
ইসলামের তিন ধরণের বিচারকের অস্তিত্ব : ১. কাযী-উল্-খুসুমাত - কাযী উল খুসুমাত পারিবারিক আইন, চুক্তি আইন, ক্রিমিনাল আইন ইত্যাদি ব্যাপারে বিচারকার্য পরিচালনা করেন।
২. কাযী-উল্-মুহতাসিব - কাযী উল মুহতাসিব ব্যবসা পরিদর্শক, অসামাজিক কার্যকলাপ বিরোধী পরিদর্শক, পরিবেশ ও স্বাস্থ্য পরিদর্শক তথা জনস্বার্থ দেখাশুনাকারী বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। কাযী মুহতাসিবের রায় প্রদান করার জন্য কোন বিচারালয় প্রয়োজন হয় না। তিনি যেকোন সময়ে যেকোন জায়গায় অপরাধ সনাক্ত করতে পারলে সাথে সাথে সেখানেই রায় প্রদান করে তা পুলিশের সাহায্যে বাস্তবায়ন করতে পারেন।
৩. কাযী-উল্-মাযালিম - কাযী-উল-মাযালিম খলীফা থেকে শুরু করে শাসকগোষ্ঠীর যেকোন ব্যক্তির যে কোন ধরণের অন্যায় আচরণের ব্যাপারে আইনী কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেন। তিনি বাদি ছাড়াই নিজে উদ্যোগী হয়ে রাষ্ট্রের যে কোন দোষী ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করে বিচারকার্য পরিচালনা করতে পারেন। খলীফার বিরুদ্ধে মামলা চলাকালীন সময়ে এই আদালতের বিচারককে পদচ্যুত করা যাবেনা।
বিচার প্রাপ্তির নিশ্চয়তা
· ইসলামী রাষ্ট্রে শরিয়াহ্ অনুযায়ী বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা । যেহেতু খিলাফত রাষ্ট্রে বিচার ব্যবস্থা স্বাধীন, সেহেতু বিচার বিভাগ জনগণের উপর ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে করে।
· খিলাফত রাষ্ট্রের বিচার ব্যবস্থা নিরপেক্ষ ও দুর্নীতিমুক্ত। বিচারকের অন্যায়ের ব্যাপারে ইসলাম কঠোর হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেছে। এজন্য বিচারকগণ শরীয়াহর প্রত্যেকটি আইন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করবেন এবং পরিপূর্ণ দায়িত্ববোধ থেকে কর্তব্য পালন করেন।
· খিলাফত রাষ্ট্রের বিচার ব্যবস্থায় দীর্ঘসূত্রিতার কোন অবকাশ নাই। নির্দিষ্ট অপরাধের জন্য নির্দিষ্ট আইন বিদ্যমান থাকায় দ্রুত বিচার কার্যক্রম এই শাসন ব্যবস্থার একটি গতিশীল দিক।
· বিচার প্রাপ্তি সহজলভ্য করার উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে প্রতিটি নাগরিকের জন্য ন্যূনতম সরকারী ফি নির্ধারণ ও নিশ্চিতকরণ করা হয়ে থাকে।
· বিচার প্রাপ্তির নিশ্চয়তা বিধানের লক্ষ্যে খিলাফত রাষ্টের বিচার ব্যবস্থা রাষ্ট্রের প্রান্তিক পর্যায় পর্যন্ত প্রতিটি নাগরিকের হাতের নাগালের মধ্যে নিয়ে যাওয়া খলিফার দায়িত্ব। তাই জনগণকে বিচার প্রাপ্তির জন্য অযথা হয়রানিমূলকভাবে এদিক ওদিক ছোটাছুটি করে আর্থিক, শারীরিক ও মানসিক কষ্ট স্বীকার করতে হয় না।
কল্যাণমুখী রাষ্ট্রের স্বরুপঃ ৭
ইসলামের শাস্তির ব্যবস্থা: (নিজাম আল উকুবাত)
ইসলামের শাস্তির ব্যবস্থা তথা দন্ডবিধি হচ্ছে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার দয়ার প্রমাণ এবং ইসলামের সৌন্দর্য্য। দন্ডবিধির মূলনীতি সমূহ নিম্নরূপ:
১) একজন মুসলিম (পুরুষ বা নারী) তার প্রত্যেকটি কাজের জন্যই দায়িত্বশীল। শরীয়াহতে যে সকল অপরাধের শাস্তি নির্দিষ্ট করা আছে তা রাষ্ট্র কার্যকর করবে। সমাজকে রক্ষা করে শুধুমাত্র এই কারণেই এই নীতি গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং শরীয়াহ্ আদালতের মাধ্যমে কোন অপরাধের শাস্তি হয়ে গেলে ঐ একই অপরাধের জন্য আখিরাত তথা পরকালের শাস্তি থেকে পরিত্রাণ পাওযা যায়।
২) দন্ডবিধির নীতি হল “শাস্তিকে যথাসম্ভব নিবৃত্ত করা”, যেহেতু শাস্তির কঠোরতা নিবৃত্তির প্রাথমিক কাজ করে। কোন প্রমাণের অংশ বিশেষ ও যদি সন্দেহজনক হয় তা শাস্তি নিবৃত্ত করবে। যখন রাসূল (সাঃ) এর নিকট কোন লোক এসে তাদের অপরাধ স্বীকার করে তাদের উপর শাস্তি কার্যকর করার আবেদন জানাতো তখন রাসূল (সাঃ) শাস্তি প্রয়োগ করা হতে নিজেকে সরিয়ে রাখতে কিভাবে চেষ্টা করতেন তা সীরাতে বর্ণিত আছে। তিনি (সাঃ) বলেছেন, “একজন নিরপরাধীকে শাস্তি প্রদান করার চেয়ে একজন অপরাধীকে মুক্তি দেয়া উত্তম।” একজন ইমামের জন্য ভুলক্রমে একজনকে শাস্তি দেয়ার চেয়ে ভুলক্রমে একজনকে ক্ষমা করা উত্তম।”
৩) ইসলাম পাঁচটি বিষয় সংরক্ষণ করে যা জিম্মিদের (অমুসলিম নাগরিক) ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। রাসুল (সাঃ) বলেছেন, “যে কোন জিম্মির ক্ষতি করলো, সে যেন আমারই ক্ষতি করলো।” তাছাড়া ইসলামী রাষ্ট্রের মধ্যে সকল নাগরিককে সমান দৃষ্টিতে দেখা হয় এবং এক্ষেত্রে কোনরূপ বৈষম্য বৈধ নয়।
ইসলামের দন্ডবিধি চার ভাগে বিভক্ত:
১) হুদুদ: এই শাস্তি হচ্ছে “আল্লাহর (সুবহানাহুতা ওয়া তা’আলা) অধিকার এবং তা কেউ ক্ষমা করতে পারে না।” ছয়টি ক্ষেত্র এর অন্তর্ভূক্ত:
ক) অবিবাহিত পুরুষ/ নারীর ব্যভিচার: (১০০ দোররা বা চাবুকের আঘাত), বিবাহিত পুরুষ/ নারীর ব্যভিচার: (পাথর নিক্ষেপ করে হত্যা), সমকামিতা: (মৃত্যুদন্ড)।
খ) অপবাদ দেওয়া, সম্মান নষ্ট করা, মিথ্যা কথা প্রচার করা এবং উড়ো খবর রটানো (৮০ দোররা)।
গ) চুরি (হাত কাটা)
ঘ) মদ পান করা এবং নেশা করা (৮০ দোররা)
ঙ) দুই দল মুসলিম দ্বারা আইন লঙ্ঘন এবং রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আইন লঙ্ঘন। যথাঃ খলীফা আবু বকর (রাঃ) এর সময় মুরুতাদদের যাকাত অস্বীকার করার বিষয়।
চ) মুরতাদ, অর্থাৎ কোন মুসলিম ইসলাম ত্যাগ করা (মৃত্যুদন্ড)।
২) আল-জিনায়াত: “ব্যক্তির অধিকার এবং ক্ষমা করারও অধিকারী”। মূলতঃ হত্যাকান্ড সংক্রান্ত ঘটনাগুলো হতে পারে তা বেআইনীভাবে কিংবা দূর্ঘটনাবশতঃ, এবং নিহত ব্যক্তির স্বজন বা পরিবারের দিয়তের বিনিময়ে ক্ষমা করার অধিকার এই ক্ষেত্রের অন্তর্ভূক্ত।
ক) যে ব্যক্তি উদ্দেশ্যমূলকভাবে খুন করে তার ক্ষেত্রে দিয়ত হচ্ছে ১০০ উটের সমপরিমাণ যার মধ্যে ৪০টি হতে হবে গর্ভবতী।
খ) যদি কোন ব্যক্তি অনিচ্ছাকৃতভাবে কাউকে খুন করে সেক্ষেত্রে তার দিয়ত হচ্ছে ১০০ উটের সমপরিমাণ।
ইমাম আন-নাসায়ী তার বর্ণিত হাদীসে উল্লেখ করেন যে, শরীরের প্রত্যেকটি অঙ্গের জন্য দিয়ত রয়েছে, যেমন চোখের জন্য রক্ত পণ হচ্ছে ৫০টি উটের সমপরিমাণ।
৩) আল-তা’জির: এটি হচ্ছে “সমাজের অধিকার”। যা কিছু সমাজের দৈনন্দিন জীবনে প্রভাব ফেলে তা এই ক্ষেত্রের অন্তর্ভূক্ত, যেমন- রাস্তায় দাঁড়িয়ে চিৎকার-চেচাঁমেচি করা বা রাস্তায় আবর্জনা ফেলা ইত্যাদি। রাষ্ট্রই এই ধরণের অপরাধের শাস্তি নির্ধারণ করে।
৪) আল-মুখালাফাত: এটি হচ্ছে “রাষ্ট্রের অধিকার”। এই ক্ষেত্রের অন্তর্ভূক্ত বিষয়ে রাষ্ট্র নিজেই নিয়ম/ আইন তৈরী করে থাকে। যেমন- রাস্তায় গাড়ির গতিসীমা অতিক্রম, যেখানে গাড়ি রাখার নিয়ম নেই সেখানে রাখা ইত্যাদি।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন