১.
পুলিশ অফিসার হিসেবে বেশ নাম-ডাক ওসি নিজাম উদ্দিনের। সরকারের নেক নজরে আছেন তিনি। কারণ সরকারের যে কোন নির্দেশ পালনে তিনি বেশ পটু। তার চাইতেও বেশী পটু তিনি শিবির পেটানোতে। তিনি সব সময় নিজেকে বলেন শিবিরের যম। মেজাজ সবসময় খিটখিটে থাকলেও আজ তিনি বেশ খুশি। কারন তার ছোট ছেলে SSC তে A+ পেয়েছে। সবাইকে মিষ্টি খাওয়াচ্ছেন তিনি।
শামীম আহমেদ। রাষ্ট্রবিজ্ঞান অনার্স ৩য় বর্ষের ছাত্র। সরকারি কলেজের ছাত্রশিবিরের সেক্রেটারী। পালিয়ে কলেজে ঢুকতে ও বের হতে হয়। কারন ওসি নিজাম। যে কোন মূল্যে গ্রেপ্তার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি। শামীম রাতে নিজের মেসে তো থাকতেই পারে না, আত্মীয় স্বজন কারো বাড়িতেই থাকতে পারে না। আজ এই কর্মীর বাসায় তো কাল ঐ কর্মীর বাসায়।
কলেজের দুজন সাধারণ কর্মীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। উদ্দেশ্য শামীমের অবস্থান জানা। প্রচন্ড নির্যাতন করে। প্রথমে লাঠিপেটা, তারপর বাঁশডলা। বাঁশডলা মানে হচ্ছে হাত দুটো উপরে তুলে হাতকড়া পরিয়ে চিৎ করে শোয়ানো হয়। তারপর ঘাড়ের নিচে হাতের উপরে একটা লাঠি রেখে চারজন পুলিশ এর উপর দাঁড়ায়। এতে কর্মী দুজনের হাতের কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে। প্রচন্ড নির্যাতনে তারা বারবার রক্তবমি করছে ও বেহুঁশ হয়ে পড়ছে।
এভাবে নিজাম আরো দশ বারোজন শিবির কর্মীকে আটক করে। হতাশ নিজাম উদ্দিন। সে কারো মুখ থেকে কোন তথ্য বের করতে পারলো না। ক্রোধান্বিত হয়ে সর্বশেষ সে আটককৃত দুজন কে পায়ে গুলি করে পঙ্গু করে দেয়।
২.
অঝোরে কাঁদতে থাকে শামীম। অপরাধ বোধ তাকে গ্রাস করে। তার জন্য তার একের পর এক সহকর্মীদের নির্যাতন সইতে হচ্ছে। পঙ্গু হয়ে যাওয়া দুই ভাইয়ের গ্রামের বাড়িতে যায় সে মায়েদের সান্তনা দিতে। কিসের সান্তনা দিবে সে নিজেই কেঁদে কূল পাচ্ছে না। উল্টো তারাই শামীমকে সান্তনা দিচ্ছে। শামীম তার উর্ধ্বতনকে বারবার বলে থানায় সে আত্মসমর্পন করবে। কিন্তু উর্ধ্বতনের কড়া নির্দেশ, এমনটি করা যাবে না।
হতাশ নিজাম নতুন চাল চালে। সোজা সে শামীমের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে তার বিধবা মাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে আসে। এবার শামীমকে থানায় যেতে বলে তার দায়িত্বশীলেরা। ওসি নিজামের মুখে বিদ্রুপের হাসি ফুটে উঠে। তুই আমারে অনেক কষ্ট দিয়েছিস। এর মূল্য তোরে দিতে হবে। এত সহজে তোর মাকে ছাড়ছি না। পঞ্চাশ হাজার লাগবে। টাকা নিয়ে আয়, তোরে রেখে তোর মাকে ছেড়ে দেব। সন্ধ্যার মধ্যে আসবি। কোন চালাকি করবি না। বলে পকেট থেকে একটা পুটলিমত কিছু একটা বের করে বলে এই দেখ হেরোইন। তোর মাকে মাদক মামলা দিয়ে দেব। বুঝিস।
পৃথিবীতে শামীমের আছে ঐ কেবল মা। কোন ভাই বোন নেই। পিতা গত হয়েছেন শামীমের ছোটবেলায়। বাবার কোন স্মৃতিই তার মনে নেই। এই মা আজ বন্দি। কিছুই মাথায় আসছে না তার। খুব দ্রুত টাকা যোগাড় করে থানায় আসে। থানার বাইরে তার সহকর্মীরা দাঁড়িয়ে আছে। তাদের প্রানপ্রিয় শামীম ভাই হয়তো আর কোনদিন তাদের সাথে মিলিত হতে পারবে না। অজানা ভবিষ্যত কারোই জানা নেই। কেবল আল্লাহর উপর ভরসা করে পাঠিয়ে দিচ্ছে।
শামীমের মা বের হলেই অন্যান্য সহকর্মীরা তার মাকে নিয়ে পালিয়ে যায়। শামীম বলে গিয়েছে মা কে যেনো লুকিয়ে রাখা হয়। কারণ পাষন্ড নিজাম হয়তো তার থেকে কথা বলার অস্ত্র হিসেবে আবার মাকে ধরে নিয়ে আসতে পারে।
নির্যাতনের আর কোন পন্থা বাদ রাখেনি নিজাম। এক এক করে প্লাইয়ার্স দিয়ে সব নখ তুলে ফেলা, বাঁশডলা, পিঠে সিগারেটের আগুন, হাতুড়ি দিয়ে বাম হাত থেঁতলে দেয়া। দু কানে টানা কারেন্ট শক দেয়া চোখে লবণ মরিচ ইত্যাদি সব করে নিজামরা হাঁপিয়ে উঠেছে। তবুও বের করতে পারে নি অন্যান্য দায়িত্বশীলদের নাম বা ঠিকানা। বার বার হুমকি দিচ্ছে ক্রসফায়ারে মেরে ফেলবে।
শামীমের মুখ থেকে আল্লাহ ছাড়া আর কোন শব্দই বের হয় নি। উহ কিংবা আহও না। টানা পাঁচদিনের এই নির্যাতনে কেঁদেছে অনেক পুলিশ সদস্যও। অনেকে নিজামকে বলেছে, স্যার ছেড়ে দেন, মনে হয় কিছু জানে না। জানলে সব বলে দিত। আপনি যেভাবে পিটিয়েছেন সেভাবে কোন জানোয়ারকে পিটালে সেও এতক্ষনে কথা বলা শুরু করে দিত।
হাল ছাড়লেন না নিজাম। বললেন ওয়াটার ট্রিটমেন্ট দিতে হবে। না বলে কই যাবে। অসুস্থ শামীমকে চেয়ারে বসিয়ে চেয়ারের সাথে বাঁধা হলো। চেয়ার উল্টে ফেলে দেয়া হল। নাক মুখ গামছা দিয়ে বেঁধে দেয়া হল। তারপর তার মুখের উপর পানি ঢালা হল। যতক্ষন পানি দেয়া হয় ততক্ষন শামীমের মনে হয় সে পানিতে ডুবে যাচ্ছে। ফুসফুস ফুলে ফেটে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছে। বেদনায় নীল হয়ে যাচ্ছে তার মুখ। দাঁতে দাঁত চেপে শুধু সে বলতে থাকলো হাসবুন আল্লাহ ওয়া নে’মাল ওয়াকীল, নে’মাল মাওলা, ওয়া নে’মান নাসির।
ব্যর্থ হয়েছেন নিজাম সাহেব। শামীমের মুখ থেকে কোন কথা বের করতে পারেন নি। তাকে কয়েকটি বিস্ফোরক মামলা দিয়ে কোর্টে চালান করে দিচ্ছেন। এই সময় শামীম ইশারায় নিজামকে ডাকলো। কাছে আসলে বললো, জানিনা বাঁচবো কিনা। যদি বেঁচে থাকি আমি এর প্রতিশোধ নেব ইনশাল্লাহ। ক্রোধে আগুন হয়ে শামীমের বাম গালে কঠিন একটি চড় দিলেন।
৩.
নিজাম সাহেবের বড় দুই ছেলেই নেশাগ্রস্থ। কয়েকবার মাদক নিরাময় সেন্টারে দিয়েও উপকার পাননি। পড়াশোনা তারা ঠিকভাবে কোন সময়ই করে নি। ছোট ছেলে একটু আধটু পড়াশোনায় ছিল তবে এ প্লাস পাওয়ার মত নয়, অথচ সে ছেলে A+ পেয়ে বসলো। তাই তিনি অনেক খুশি। তার মনে খটকাও লাগে। কারন এই ছেলে হটাৎ পরীক্ষার ৬ মাস আগ থেকে ভালো হয়েছে। পড়াশোনা শুরু করেছে। তার আগে সে বইয়ের কাছেও ঘেঁষতো না। তার বড় দুই সন্তানও গত কয়েক মাসে ধীরে ধীরে প্রকৃতস্থ হয়ে উঠছে। আচরণ ধীরে ধীরে ভালো হচ্ছে। নিজাম সাহেব তার তিন ছেলেকে নিয়ে নতুন করে আবার স্বপ্ন দেখতে শুরু করলেন। আর ছোট ছেলের ব্যাপারে তার চিন্তা তাকে ব্যারিস্টার বানাবেন।
হঠাৎ ছোট ছেলের কথায় চিন্তায় ছেদ পড়ে। বাবা তুমি না বলেছিলে যিনি আমার ভালো রেজাল্টের জন্য সবচেয়ে বেশী কষ্ট করেছেন তাকে নিয়ে আসতে। তিনি এসেছেন। নিজাম সাহেব ব্যস্ত হয়ে বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ চল।
থমকে গেলেন নিজাম সাহেব। আরে! এ যে শামীম।
--শামীম তুমি?
-- জ্বি নিজাম সাহেব আমি। কথা দিয়েছিলাম প্রতিশোধ নেব। নিলাম। আপনার তিন ছেলেকে মানুষ করার চেষ্টা করেছি। তারা আর আপনার মত অমানুষ না।
অন্য দুই ছেলে একসাথে বলে উঠলো, বাবা আমাদের ক্ষমা কর। আমরা এতদিন নানা অন্যায় করেছি। তোমাকে কষ্ট দিয়েছি। আমরা ভুলের মধ্যে ছিলাম। শামীম ভাই আমাদের চোখ খুলে দিয়েছেন।
কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো হতবিহ্বল নিজাম সাহেবের চোখ থেকে।
উত্তম প্রতিশোধ
উত্তরমুছুন