বাংলাদেশের মানুষ সাধারণত ধর্মপ্রিয়। এখানে তাই বামদের ভালো অবস্থান কখনোই হয়নি। তারা তাই ছলে বলে কৌশলে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছে। বাংলাদেশের সাথে পাকিস্তানী সামরিক জান্তাদের স্বৈরাচারীর কারনে সৃষ্টি হওয়া দূরত্বকে কাজে লাগিয়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্নে বিভোর ছিল। তাদের এই স্বপ্নকে কাজে লাগিয়েছে ভারত। ভারত ৭১ এর আগে পরাজিত হওয়া যুদ্ধের শোধ নিতে মরিয়া ছিল। আর তাছাড়া আজন্মশত্রু দেশকে বিপদে ফেলা তাদের গুরুত্বপূর্ণ প্রজেক্ট ছিল। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা “র” এর প্রথম প্রজেক্ট ছিল পাকিস্তান ভাগ।
ভারত এদেশীয় রুশপন্থী বামদের কাজে লাগিয়ে তাদের সেই প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করে। আওয়ামীলীগে লুকিয়ে থাকা সিরাজুল আলম খান ছিলেন এই প্রজেক্ট বাস্তবায়নের মূল হোতা। তিনি একেক পর এক ছাত্রলীগের নানান কর্মকান্ড দিয়ে পাকিস্তান ভাগের জন্য মুজিবকে প্ররোচিত করতে থাকেন। কিন্তু মুজিব পাকিস্তান ভাগের ব্যাপারে একেবারেই অমত করেছিলেন।
অমত না করার কোন কারণও নেই। কারণ সত্তরের নির্বাচনে “ভোটের বাক্সে লাথি মার/ বাংলাদেশ স্বাধীন করো” বলে শ্লোগান তুলে চীনপন্থী বাম নেতা ভাসানী তার রাজনৈতিক ক্যরিয়ার, জনগণের আস্থা সবই নষ্ট করেছেন। এর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে মুজিবের ব্যাপক জনসমর্থন বাড়ে। মুজিব জনগণের পালস বুজতে পেরেছেন। তাই বামদের ফাঁদে পা দেননি। আর তাছাড়া গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলে মুজিবের জন্যই লাভ, তার পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। পাকিস্তানে যে অল্পকয়দিন গনতন্ত্র ছিল তার বেশিরভাগ সময়ে ক্ষমতায় ছিল বাঙ্গালীরাই।
এবার আসি তাজউদ্দিন প্রসঙ্গে। বেসিক্যলি তাজউদ্দিন সাহেব রুশপন্থী বাম ছিলেন। এই ব্যাপারে কমরেড তোয়াহা বলেন, এছাড়া তাজউদ্দীন পূর্বাপর কমিউনিস্ট পার্টির সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। যদিও তাজউদ্দীন বাহ্যত: আওয়ামী লীগ করতেন কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আমাদের সাথেই জড়িত ছিলেন। পার্টির সিদ্ধান্তেই তাকে আওয়ামী লীগে রাখা হয়। একবার সম্ভবত: '৬২ সালের দিকে তিনি জেল থেকে বের হয়ে আমাদের বললেন 'আর ছদ্মনামে (অর্থাৎ আওয়ামী লীগে) কাজ করতে আমার ভালো লাগছে না। আমি নিজ পার্টিতেই কাজ করবো।' তখন কেউ কেউ মনে করলো, 'থাক না আমাদের একজন আওয়ামী লীগে আছে, সেখানেই কাজ করুক না।' পরে অবশ্য পার্টিতে এ নিয়ে আলোচনাও হয়েছিল কিন্তু তাজউদ্দীনকে প্রত্যক্ষভাবে পার্টিতে নেয়া হয়নি। আমার মতে সেটা ছিল ভুল সিদ্ধান্ত। তবে তাজউদ্দিন আওয়ামী লীগে থেকেও আমাদের জন্য কাজ করেছেন। আওয়ামী লীগের সব তথ্য আমাদের সরবরাহ করেছেন। ইন্ডিয়াতে গিয়ে অসম-চুক্তি করার পরই তার মাঝে একটা বিক্ষিপ্তভাব এসে যায়। এরপর তিনি কিছুটা যেন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। তবে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর যখন আমরা তাকে তাঁবেদার সরকারের প্রধানমন্ত্রী মনে করতাম, তখনও তিনি আমাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেছেন। (বারান্দার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে) প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে একবার এ বারান্দায় বসে আমার সাথে আলাপ করে গেছেন। ভুল-শুদ্ধ যখন যা করেছেন সবই এসে আমাদের কাছে অকপটে বলেছেন।
তথ্যসূত্রঃ ভাষা আন্দোলন : সাতচল্লিশ থেকে বায়ান্ন / মোস্তফা কামাল
১৯৭১ সালে তার কাজ ছিল কেবল ইন্ডিয়ান এজেন্ডা বাস্তবায়ন করা। উপপ্রেসিডেন্ট নজরুল ইসলামকে দিয়ে অসম ৭ দফা চুক্তি করে বাংলাদেশ বিক্রীর ব্যবস্থা করে ভারতে নিশ্চিন্ত জীবন যাপন করেছেন। এই বিষয়ে ৯ নং সেক্টর কমান্ডার মেজর আবদুল জলিল বলেছেন দেশের শান্তিপ্রিয় জনগনকে হিংস্র দানবের মুখে ঠেলে দিয়ে কোলকাতার বালিগঞ্জে একটি আবাসিক এলাকার দোতলা বাসায় প্রধানমন্ত্রী তার মন্ত্রীসভা সহকারে নিরাপদে তাস খেলছিলেন দেখে আমি শুধুই বিস্মিত হইনি, মনে মনে বলেছিলাম ধরনী দ্বিধা হও।
তথ্যসূত্রঃ অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা/ মেজর জলিল, পৃঃ ৪৪
১৭ই এপ্রিল নতুন প্রবাসী সরকার গঠনের ঘোষনা দিয়ে দেশের মানুষকে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়ে তিনি কিভাবে নিশ্চিন্ত ছিলেন তা আমরা বুঝতে পারবো যদি ভারত সরকারের সাথে তার চুক্তিগুলো একটু পড়ি।
১- মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যারা যুদ্ধ করেছে তারাই দেশ স্বাধীন হলে প্রশাসনে নিয়োগ পাবে। বাকীরা চাকরীচ্যুত হবে। যে শূন্যপদ সৃষ্টি হবে তা ভারতীয় প্রশাসনিক কর্মকর্তা দ্বারা পূরণ করা হবে।
২- বাংলাদেশ ও ভারতের সশস্ত্র বাহিনী মিলে যৌথ কমান্ড গঠন করে যুদ্ধ পরিচালনা করা হবে। ভারতের সেনাপ্রধান উক্ত যৌথ কমান্ডের প্রধান হবেন। তার কমান্ড অনুসারেই যুদ্ধে শামিল হওয়া বা যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
৩- স্বাধীন বাংলাদেশের কোন নিজস্ব সশস্ত্র বাহিনী থাকবেনা।
৪- আভ্যন্তরীন আইন-শৃংখলা রক্ষার জন্য মুক্তিবাহিনীকে কেন্দ্র করে প্যারামিলিটারি বাহিনী প্রতিষ্ঠা করা হবে।
৫- দুই দেশের মধ্যে মুক্ত বাজার ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে। কিন্তু সময়ে সময়ে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে বানিজ্য নীতি নির্ধারণ করা হবে।
৬- বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ভারতীয় সেনাবাহিনী অনির্ধারিত সময়ের জন্য বাংলাদেশে অবস্থান করা হবে।
৭- বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশ আলোচনা করে একই ধরণের পররাষ্ট্র নীতি ঠিক করবে।
তথ্যসূত্রঃ বাংলাদেশে স্বাধীনতা যুদ্ধে "র" এবং "সি আই এ"/ মাসুদুল হক, পৃঃ ৮১
তাজউদ্দিন আহমদ এ চুক্তি স্বাক্ষর করার জন্য চাপ দিতে থাকেন সৈয়দ নজরুল ইসলামকে। নজরুল ইসলাম সাহেব নিরুপায় হয়ে এই চুক্তি স্বাক্ষর করে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন।
তথ্যসূত্রঃ বাংলাদেশে 'র'/ আবু রুশদ
দুঃসময়ের কথাচিত্র সরাসরি/ ড. মাহবুবুল্লাহ ও আফতাব আহমেদ।
ভারতপ্রীতি তাজউদ্দিনকে প্রায় অন্ধ করে ফেলেছিল। সে কি আসলে আলাদা রাষ্ট্র চেয়েছিল নাকি ভারতের তত্ত্বাবধানে কোন অঙ্গরাজ্য চেয়েছিল এটা সহজেই অনুমান করা যায় তার কার্যক্রম দেখে। ১৯৭২ সালের ১লা জানুয়ারি এক আদেশবলে বাংলাদেশের মুদ্রামান ৬৬ ভাগ হ্রাস করা হয়। অথচ সে সময় বাংলাদেশের মুদ্রামান ছিল ভারত থেকে বেশি। তাজউদ্দীন দু'দেশের মুদ্রামানের বিনিময় হারের সমতা চেয়েছিলেন। লাগামহীন মুদ্রাস্ফীতির ফলে দ্রব্যমূল্য বেড়ে গিয়েছিল হু হু করে। অর্থনীতির ওপরও প্রভাব পড়েছিল। ৭৩- ৭৪এ দূর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল। যদিও দূর্ভিক্ষের পারিপার্শ্বিক অনেক কারণ ছিল, তবে এটাও বড় একটি কারণ।
তথ্যসূত্রঃ
ভয় পেয়ে রিপোর্ট করা থেকে বিরত থাকলাম/২২ মার্চ ২০১৬ মতিউর রহমান চৌধুরী/ দৈনিক মানবজমিন
ভয় পেয়ে রিপোর্ট করা থেকে বিরত থাকলাম/২২ মার্চ ২০১৬ মতিউর রহমান চৌধুরী/ দৈনিক মানবজমিন
৭১ এর পুরো বিষয়টা অনুধাবন করতে শেখ মুজিবের সময় লাগেনি। দেশে এসে ক্ষমতা গ্রহন করেই উপরোক্ত চুক্তি ভেঙ্গে দেয়ার চেষ্টা করেন। তিনি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেন তাজউদ্দিনের প্রতি। যে কয়টা দিন মুজিব ক্ষমতায় ছিলেন সে কয়টা বছর তাজউদ্দিন শেখ মুজিবের কাছে ঘেঁষতে পারেনি। তাজউদ্দিনের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলে রুশপন্থী সমাজতন্ত্রীরাও। আওয়ামীলীগে ঘাপটি মেরে থাকা বামরা মুজিবের অপশাসনে ও অত্যাচারে বিরক্ত হয়ে আরেকটি সংগঠন জাসদ গঠন করার সময় তাজউদ্দিনের বাড়িতে সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে গোপন আলোচনায় বসেন। সেখানে তাজউদ্দিন মুজিবের বিরুদ্ধে যেতে সাহস করেনি। বলেছিল আমি মুজিবের বিরুদ্ধে যেতে পারবোনা, আমার সেই সাহস নেই। তবে তোমাদের আমি সর্বাত্মক সাহায্য করবো।
এরপর জাসদ গঠন হলো। জাসদের উপর মুজিবের নির্যাতন ক্রমেই সকল সীমা অতিক্রম করছিলো। এছাড়া রক্ষীবাহিনীর অত্যাচার, জুলুম, সন্ত্রাসী জনগণকে মুজিবের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলে। তাই একমাত্র বিরোধী হিসেবে জাসদের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। জাসদের উত্থানে আরো ভয়ানকভাবে ক্ষেপে গিয়ে মুজিব জাসদের উপর অত্যাচারের স্টীমরোলার চালাতে থাকেন। জাসদ এসব কিছুর পেছনে তাজউদ্দিনকে সন্দেহ করে। সেনাবাহিনী, জনতা, জাসদ এই ত্রিপক্ষীয় জনরোষে মুজিব হত্যার ষড়যন্ত্র দানা বাঁধতে থাকে। এরই ফলশ্রুতিতে ৭৫ সালে খুন হন মুজিব। সেই সাথে নির্মমভাবে খুন হন তাজউদ্দিনসহ চার নেতা। বামপন্থী সেনা অফিসাররাই খুন করে বাম চিরজীবন আদর্শ লালন করা তাজউদ্দিনকে।
তথ্যসূত্রঃ জাসদের উত্থানপতনঃ অস্থির সময়ের রাজনীতি / মহিউদ্দিন আহমদ।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন