ভার্সিটিতে থাকাকালে আমরা একসাথেই খাবার খেতাম। ছাত্রপ্রতিনিধি থাকার কারণে ১টা থেকে ২টা ব্রেকের সময়টা অনেকটা দৌড়ের উপরে থাকতে হতো, অমুকের এটা তমুকের সেটা ইত্যাদি দেখতে গিয়ে লাঞ্চের সময় একেবারেই পেতামনা। দু’টো বাজার দশমিনিট আগে হুড়মুড় করে সহপাঠী বন্ধুদের আড্ডায় গিয়ে দেখতে পেতাম তারা আমার জন্য কিছু খাবার রেখে দিয়েছে। এক পাতেই খাবার খেতাম হিন্দু-মুসলিম সব। কেউ কাউকে আলাদা চোখে দেখার সময়ই পেতামনা। অথচ একেকজন একেক ধর্মের একেক রাজনৈতিক মতাদর্শের। নিজেদের মধ্যে যে এসব নিয়ে মাঝে মধ্যে ঝগড়া হতো না তা নয়। মাঝে মধ্যে খুব তর্ক হত। কিন্তু কিছু সময় পর আবার সবাই একসাথে আড্ডা দিয়েছি।
আরো ছোটবেলায় তপনদের সাথে ফুটবল খেলতাম, জগদীশের সাথে মার্বেল খেলতাম, অর্পনাদির বাগান ছিল, আমারও বাগান ছিল। কোন সমস্যায় পড়লে, গাছে কোন পোকা দেখা গেলে অথবা কোন কোন পরামর্শের জন্য অর্পনাদির কাছে ছুটে যেতাম। তিনিও আমাকে বহুদিন বলে যেতেন, ওরে আমার বাগানে আজ একটু পানি দিস আমার ফিরতে দেরী হবে। অপুদার ছিল কবুতর। আমারও অল্পস্বল্প ছিল। অপুদা ছিলেন আমার গুরু। এমন না যে আমাদের পরিবার ধর্ম-কর্ম করতোনা। বরং একটু বেশীই করতো। অথচ আমাদের পরিবারের কাউকে দেখিনি হিন্দু বলে কাউকে হিংসা করতে এবং আমার গুরুজনরা কখনোই অন্য ধর্মের মানুষদের সাথে মিশতে মানা করেন নি। শুধু তাই নয় বাবার বন্ধু আমার শিক্ষক শেখর স্যার কোনদিন নামাজ পড়তে না দেখলে কান ধরে মসজিদে পাঠাতেন।
এই গল্পগুলো শুধু আমার না, বাংলায় আবহমান কাল ধরেই তা চলে আসছে। এদেশ সম্প্রীতির, সৌহার্দের। এখানে সবাই মিলেমিশে থাকা অসাধারণ একটা ব্যাপার। ভারত মহাদেশে বার বার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সৃষ্টি হলেও আমাদের অংশে ছোঁয়া ব্যাপকভাবে কখনোই ঘটেনি। শুধু ধর্মীয় সম্প্রীতি নয় রাজনৈতিক সম্প্রীতিও ছিল সুন্দর। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের লোকেরা নিজেদের মধ্যে আড্ডা দেয়া, ব্যবসা করা, আত্মীয়তা খুব সাধারণ ব্যাপার ছিল।
কিন্তু আজকে? আজকে বিষয়টা এমন এক অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে যেখানে আওয়ামীলীগের একজন বিএনপির একজনের সাথে আত্মীয়তা বা ব্যবসা করা দূরে থাক একসাথে বসে এক কাপ চা খেলে তা নিউজ হয়ে যায়। আরে, এটাও কি সম্ভব! একাসাথে বসে চা! মনে হয় যেন বিরাট অপরাধ করে ফেলেছেন তারা। নিজ নিজ দলের লোকেরা তাদের সন্দেহ করে। দালাল, গুপ্তচর ইত্যাদি উপাধি পায়। এখন কেউ কাউকে সহ্য করতে চায় না। পারে না।
এর কারণ হিসেবে আমি প্রথমে বলবো অনলাইন জগত। অনলাইনে আমি প্রথম দেখেছি এক ধর্মের লোকজন অন্য ধর্মের সম্মানের বিষয়গুলো নিয়ে বিশ্রী ও অশ্লীল কথা বলতে, এক রাজনৈতিক দলের লোক অন্য দলগুলোর সম্মানিত মানুষদের নিয়ে ব্যাঙ্গ করতে। প্রথমে শুধুমাত্র ব্লগগুলোতে সীমাবদ্ধ থাকলেও পরবর্তিতে ফেসবুক ও ইউটিউবের প্রসারের সাথে সাথে তা ছড়িয়ে পড়েছে সমগ্র মানুষের মধ্যে।
দ্বিতীয় বিষয় শুধুমাত্র রাজনৈতিক কারণে একটি ফ্যাসিবাদী আন্দোলনের উত্থান হয় এই দেশে, যার নাম গণজাগরণ মঞ্চ। “বিচার চাই না, ফাঁসী চাই” দাবীতে ঘৃণা আর হিংসার মাত্রা ছড়িয়েছে নতুন করে। এদের বিরুদ্ধেও গঠিত হয় হিফাযত। ঘৃণা তার সকল মাত্রা ছড়িয়ে যায়। কিছুদিন আগের কথা। এক সিনিয়র ভাইয়ের বিয়ে, সব ঠিকঠাক ছিল। এর মধ্যে আবিষ্কৃত হয় তিনি একদা শাহবাগে গিয়েছেন আর সেলফি তুলে তা ফেসবুকে আপলোড করেছেন। ব্যাস নাস্তিক উপাধি পেয়ে বিয়েটা ভেঙে গেলো। মেয়ের আত্মীয়-স্বজনকে যতই বুঝানো হলো, না, সে নাস্তিক না, নিয়মিত নামাজ পড়ে। কিন্তু কিছুই ধোপে টিকেনি। শাহবাগ মানেই নাস্তিক! অপরদিকে তারাও ছড়িয়েছে দাঁড়ি, টুপি, ইসলাম মানেই জঙ্গী, সন্ত্রাসী, বোমাবাজ।
আওয়ামীলীগ এই ঘৃণা ছড়িয়ে দিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার চেষ্টা করেছে। অথচ তা করতে গিয়ে পুরো দেশে অসহিষ্ণুতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে দিয়েছে। এর দীর্ঘমেয়াদী ফলাফল দেখা যাচ্ছে এখন পুরো সমাজে। আওয়ামীলীগ ও অঙ্গসংগঠনগুলো হত্যা-সন্ত্রাসকে এতটাই সহজ ও স্বাভাবিক করে দিয়েছে এখন তাদের কোন সংঘর্ষে কেউ না মরলে তা নিউজ হয়না। গর্ভের বাচ্চা গুলিবিদ্ধ হওয়ার মত ঘটনাও বাংলাদেশে ঘটে। কোন ছাড়াই বাচ্চা শিশুকে গুলি করে আইন প্রণেতা। এই আইন প্রণেতাদের কাছ থেকে আসলে কেমন আইন বের হবে তা সহজেই অনুমেয়।
আইন-শৃংখলা বাহিনীকে এমন এক পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে সরকার এখন পুলিশ র্যাব মানুষকে গ্রেফতার করে বিএনপি করার অপরাধে বা জামায়াত শিবির করার অপরাধে। কিছুদিন আগে DMP এর ফেসবুক পেইজে দেখলাম জামায়াতের পাঁচজনকে তারা আটক করেছে। জব্দ করেছে জামায়াতের লিফলেট, বই, চাঁদা আদায়ের রশিদ। অবস্থা বুঝেন! আগে এদের এরেস্ট করার জন্য বোমা ককটেল নাটক করলেও এখন আর তার প্রয়োজন হয়না। একটা লোক বিরোধী দল করাই অপরাধ।
আর পক্ষান্তরে আওয়ামীলীগের লোক কোন অপরাধ করলেও শুধু আওয়ামীলীগ করার জন্য তার অপরাধ মাফ। যদি একটা ঘটনা মারাত্মক মিডিয়া কাভারেজ পায় তখন কিছু লোক গ্রেফতার হয়। অসহিষ্ণুতা যে কত ভালোভাবে ছড়িয়েছে তা বুঝার জন্য খুব একটা কষ্ট করতে হবেনা। সারাদিনের খবরগুলোর উপরগুলোর উপর চোখ বুলালেই হবে। সরকার একটা জেনারেশন তৈরী করছে যারা অপেক্ষা করছে কোনভাবে সরকারের পতনের। এই কথাটা অবশ্য আওয়ামীলীগও জানে। এই পরিমান অপরাধ তারা করেছে ক্ষমতায় না থাকলে কারো পিঠের চামড়া থাকবে না।
আমি বলছিনা এই ধরণের ঘটনা আগে কখনোই ঘটেনি। আগেও ঘটেছে তবে এত ব্যপকতা কখনোই পায়নি। আর এর সুযোগ নিচ্ছে বিদেশী গোয়েন্দারা। বিশেষ করে “র”। একের পর এক জঙ্গীগোষ্ঠী তৈরী করছে। এটাও নতুন নয়। আগেও তারা এই দেশে জেএমবি তৈরী করেছে। কিন্তু তৎকালীন মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় ও সরকারের আন্তরিকতায় ভেস্তে যায় ঐ সময়ের পরিকল্পনা। বাংলাদেশ হয় একমাত্র রাষ্ট্র যারা তাদের জঙ্গীদের নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছিলো। কিন্তু এই বিষয়টার কাউন্টার এট্যাক করতেও দেরী হয়নি। ৫৭ জন আর্মি অফিসারকে প্রাণ দিতে হয়েছে। এটা আপনারা সবাই জানেন।
এখন ভারতের “র” পাশাপাশি নতুন করে যোগ দিয়েছে সিআইএ। তারাও চায় বাংলাদেশকে জঙ্গী রাষ্ট্র হিসেবে প্রমাণ করতে। আইএস নিয়ে আসার সব পরিকল্পনাই করছে সিআইএ। নতুন নতুন সহিংসতা, অসহিষ্ণুতা ছড়াচ্ছে সবাই। বাংলাদেশ হয়তো বরণ করতে যাচ্ছে আফগানিস্তান, ইরাক বা সিরয়ার মত ভাগ্য।
আসুন আমরা একটু সহিষ্ণু হই। দেশকে গড়ি। বিদেশীদের ব্যাপারে সাবধান হই। অবশ্য এই ব্যাপারে যাদের সবচেয়ে বেশী ভূমিকা রাখার কথা সে সরকারই অসহিষ্ণুতা কে উস্কে দিচ্ছে। আমাদের এই সুন্দর দেশে অসুন্দরের চর্চা আমরা বন্ধ করবো। আল্লাহ আমাদের দেশকে রক্ষা করুন।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন