নুহার বয়স দু’ বছর। খুব পাকা পাকা কথা বলে। বাবার সাথে দুনিয়ার গল্প করে। প্রশ্ন করে জর্জরিত করে। বাবা আশিক সাহেব চা-পোষা মানুষ। অফিসের কেরানীর চাকুরি করে খুব দ্রুত ছুটে আসে মেয়ের কাছে। মেয়ের শত আবদার রক্ষা করাই যেন তার একমাত্র কাজ। ঐ কাজে এত শান্তি পান তিনি যা ভাষায় বর্ণনা করার মত না। মেয়েটিও বাবার জন্য পাগল। তিনি না খাওয়ালে সে খাবেই না। দাদী কিংবা ফুফি কারো হাতেই না। বাবা হাত না বুলালে সে খাবে না।
মেয়েটা পাশে না থাকলে মাঝে মাঝে আশিক সাহেবের মন আনচান করে উঠে। অফিসে প্রায়ই আশিক সাহেবের এমন হয়। তিনি আর টিকতে পারেন না, দৌড়ে বাসায় আসেন। এসে হয়তো দেখেন মেয়েটা দুপুরের খাবার খেয়ে ঘুমুচ্ছে অথবা আপন মনে খেলছে। বাবুটার মাথায় আলতো হাত বুলিয়ে, কপালে একটু করে চুমু দিয়ে তিনি আবার তার কাজে ফিরে যান। এই মেয়েটিই মাঝে মধ্যে আশিক সাহেবকে পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন প্রশ্ন করে বসে। বাবা, আমার মা কে তুমি কি করেছ? সবার মা আছে, আমার মা নাই কেন? আশিক সাহেব কোন উত্তর দিতে পারেন না। ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকেন। কখনো অন্য কিছু বলে প্রসঙ্গ এড়াতে চান। আবার মাঝে মধ্যে নিজেকেই সান্তনা দিতে পারেন না তিনি। মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদেন। মেয়েটিও বাবার সাথে কিছুই না বুঝে কাঁদে।
এখন থেকে বছর নয় আগে আশিক সাহেবের বিয়ে হয় শিরিনের সাথে। শিরিনের মামার পরিচিত ছিল আশিক সাহেব। তিনিই প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলেন। সবকিছু দেখে শুনে শিরিনের বাবা বিয়েটা নাকচই করে দিলেন। কারণ আশিক সাহেব গরিব মানুষ। সে নিজেই খেতে পায়না শিরিনকে কি খাওয়াবে? শিরিনের মামার এক কথা, মানুষটা গরিব হলেও ভালো। চরিত্রবান। এমন ছেলে এখন পাওয়া সহজ নয়। আশিক সাহেব বলেন, আমি আর্থিক দিক দিয়ে গরীব হতে পারি কিন্তু মনের দিক দিয়ে কখনোই নই। আমি ডালভাত খাই, মাস শেষে জমানো টাকা খুব একটা থাকেনা। আমাকে আল্লাহ যা দিয়েছেন তাতে দু’জনের হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। এ সরল কথাগুলোই মনে ধরে শিরিনের। সে গোঁ ধরে বিয়ে যেন আশিক সাহেবের সাথেই হয়।
অবশেষে সবকিছু ভালোয় ভালোয় সম্পন্ন হলো। সুন্দর সংসার আশিক-শিরিনের। এর মধ্যেও ছিল কিছুটা অপ্রাপ্তি। যা দুজনকেই প্রায় সময় বিষাদে আচ্ছন্ন করে রাখে। তাদের কোন সন্তান ছিল না। কত ডাক্তার-কবিরাজ দেখালেন। আল্লাহর কাছে চাইলেন। কিছুতেই কিছু যেন হবার নয়। অবশেষে তাদের বিয়ের সাত বছরের মাথায় আল্লাহ তাদের দিকে মুখ তুলে চাইলেন। শিরিন জানালো, তাদের সন্তান হচ্ছে। আশিক সাহেব অতি টানাটানির সংসারে দশ কেজি মিষ্টি কিনে বিতরণ করলেন, অভাবীদের খাওয়ালেন। শত শত টাকা ফকির-মিসকিনকে দান করলেন।
আস্তে আস্তে সন্তানের জন্মের সময় ঘনিয়ে আসলো। সবকিছু ঠিকঠাক চলছিলো। হঠাৎ একদিন শিরিনের ভীষন পেইন শুরু হয়। শিরিনকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হলো। বাচ্চার হার্ট সাউন্ড পাওয়া যাচ্ছে না। ডাক্তাররা সিদ্ধান্ত দিলেন, এখনি সিজার করতে হবে। দুই ব্যাগ রক্ত লাগবে। আশিক সাহেব ব্যস্ত হয়ে পড়েন। রক্ত যোগাড় করার জন্য চারদিকে ফোন করেন। এদিকে শিরিনের অবস্থাও দ্রুত খারাপ হচ্ছে। শিরিনের রক্তের গ্রুপ বি নেগেটিভ পরিচিত কারো কাছেই রক্ত পাওয়া যাচ্ছে না। এদিকে অপারেশন শুরু করা যাচ্ছে না। ডাক্তাররা একটি ব্লাড ব্যাংকের সাথে যোগাযোগ করে দিলেন। সেখানে বি নেগেটিভ রক্ত পাওয়া গেলো। আশিক সাহেব গেলেন রক্ত আনতে। ডাক্তাররাও অপারেশন শুরু করে দিলেন নিশ্চিন্তে।
আশিক সাহেব স্থানীয় জামায়াতের ইউনিট সেক্রেটারী। স্বৈরাচারী আওয়ামী সরকারের পুলিশ সবসময় তাকে খুঁজে বেড়ায়। আশিক সাহেবের মনে খুব আস্থা, যেহেতু তিনি কখনো কারো ক্ষতি করেন নি তাই তার কিছু হবে না। এলাকাবাসী সবসময় তার পাশে থাকবে। আশিক সাহেব যেভাবে এলাকাবাসীদের যে কোন প্রয়োজনে পাশে থাকেন, এলাকাবাসীও তাকে সেভাবে ভালবাসে। তাই অন্যান্য নেতৃবৃন্দের মত তিনি আত্মগোপনে থাকতেন না। তাকে কয়েকবার আটক করার জন্য পুলিশ এসেছিলো। কিন্তু এলাকার সাধারণ মানুষের প্রতিরোধের মুখে তাকে আটক করা যায় নি।
পুলিশ আগে থেকে আশিক সাহেবকে ফলো করছিলো। তিনি যখন ব্লাড ব্যংক থেকে রক্ত নিয়ে বের হলেন তখনই তাকে আটক করে থানায় নিয়ে গেল। আশিক সাহেব অনেক অনুনয় করলেন। তার কোন কথা শোনা হয় নি। হাসপাতাল, তার স্ত্রী, রক্ত সব কথা বললেন কিন্তু নরপিচাশ কোন পুলিশ তার কথা শুনলো না। নীতিতে অটল আশিক সাহেব কখনোই কারো সামনে মাথা নত করেন না। সেই আশিক সাহেব হঠাৎ ওসির পা জড়িয়ে ধরলেন, বললেন স্যার প্লিজ আপনি আমাকে ছাড়ার দরকার নেই, দয়া করে এই রক্তের ব্যাগটি হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করুন। আমি আপনার কাছে চির কৃতজ্ঞ থাকবো। ওসি কষে লাথি মারে আশিক সাহেবকে। হতচকিত হয়ে ছিটকে পড়েন তিনি। পুলিশ এক ঝটকায় আশিক সাহেব থেকে কেড়ে নিল রক্তের ব্যাগ। ছুঁড়ে ফেলে দিল পাশের নর্দমায়। আশিক সাহেব স্তম্ভিত হয়ে পড়েন। বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন। কিছুই বলতে পারেন না। কেবল নোনা জল ছেড়ে প্রভুর দরবারে প্রার্থনা করতে থাকেন তার প্রাণপ্রিয় স্ত্রীর আর সন্তানের জন্য।
এদিকে ডাক্তাররা অত্যন্ত অবাক হচ্ছেন। শিরিনের অবস্থা খুবই খারাপ। অথচ আশিক সাহেব রক্ত নিয়ে এখনো ফিরছেন না। আশিক সাহেবের মা ওটির সামনে দৌড়াদৌড়ি করছেন, কি করবেন বুঝতে পারছেন না। একদিকে ডাক্তার তাড়া দিচ্ছে। অন্যদিকে আশিকের ফোন নাম্বার বন্ধ। ইতিমধ্যে হাসপাতাল কাঁপিয়ে নবজাতক জানান দিল সে পৃথিবীতে এসেছে। জ্ঞানহারা শিরিন হঠাৎ জেগে উঠলো, ডাক্তার কে কাছে ডেকে ফিস ফিস করে বললো, বাবুটাকে আমার কাছে দিন। শিরিন নার্স থেকে বাবুটাকে নেয়ার চেষ্টা করলো কিন্তু পারলো না। বাবুর দিকে তাকিয়ে অশ্রু ছেড়ে দিয়ে বললো, তোর বাবাকে পুলিশ নিয়ে গেছে। আমি চলে যাচ্ছি আল্লাহর কাছে। তুই ভালো থাকিস।
ব্যাস অতটুকুই। আবার জ্ঞান হারালো শিরিন। আশিক সাহেবের মা অনেক চেষ্টা করে রক্ত আবার যোগাড় করলেন। কিন্তু ততক্ষনে অনেক দেরী হয়ে গেলো। শিরিনের ঘুম আর কখনোই ভাংলো না। ডাক্তার অবাক হলেন শিরিনের কথাগুলো শুনে। আশিককে কখন পুলিশ নিয়ে গেল কেনইবা নিয়ে গেল? কিছুই বুঝতে পারেন না তিনি। শিরিন তার বাবুটাকে যে কথাগুলো বলেছিলো সেগুলো ডাক্তার আশিক সাহেবের মাকে জানালেন। তিনি অত্যন্ত অবাক হলেন, জরুরী খবর নিয়ে জানলেন সত্যিই আশিক থানায়।
রাত এগারোটার দিকে থানায় বাবুটাকে নেয়া হল, আশিক সাহেবের দিকে তাকিয়ে বাবুটা সেদিন যেন কেঁদে কেঁদে বহু প্রশ্ন করেছিলো। আশিক সাহেব সেদিন কোন উত্তর দিতে পারেন নি। আজও না। আজও তিনি পারেন না নুহার কঠিন প্রশ্নটার জবাব দিতে...
#দুঃসময়ের_গল্প
#দুঃসময়ের_গল্প
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন