তখন ভার্সিটিতে নতুন ভর্তি হয়েছি। হলে রুমমেট দুজনই ছিল সিনিয়ার। আমি পুরোদস্তুর ইসলামী আন্দোলনের কর্মী হওয়ায় আমাদের রুমে বেশীরভাগ আড্ডা রাজনৈতিক আড্ডায় পরিণত হতো। রুমমেটদের একজন ছিল বিএনপি ঘেঁষা অন্যজন কট্টর লীগ সমর্থক। একদিন লীগ সমর্থক সিনিয়ার ভাইটি বললেন “তুমি বেশী ফাল পাইড়ো না, তোমার আর কিসের ইসলামী আন্দোলন, তুমি বাপ-দাদার গোলামীই করতাছো। তোমার বাপ-মাও জমাতি তুমিও জমাতি।”
ঐ কথা শুনে আমি থমকে গিয়েছিলাম। চিন্তা করে দেখলাম, আমি তো অন্য কোন ইসলামী সংগঠন করার নিয়তে কখনো ভাবি নি। শুধু তাদের দোষ খুঁজেছি। নতুন ভাবনার দুয়ার খুলে গেলো। অন্যকোন সংগঠন শিবিরের চাইতেও সহীহ হতে পারে। প্রথমে দায়িত্বশীলদের সাথে আলোচনা করলাম। তারা কিছু ইনফরমেশন দিলেন অন্য ইসলামী দল সম্পর্কে। সব নেগেটিভ ইনফরমেশন।
সন্তুষ্ট হতে পারলাম না। মনে মনে ভাবলাম ইনফরমেশন গুলোতো ভুলও হতে পারে। অতঃএব ঐ দলগুলোর সাথে মিশতে হবে। তাদের বই পড়তে হবে তাদের জানতে হবে। একটি নোটবুক ক্রয় করলাম। একে একে সব দলগুলোর নাম লিখলাম। ঘুরতে লাগলাম জেলায় জেলায়। টার্গেট সত্যানুসন্ধান। প্রতিটি দলের বৈশিষ্ট্য লিখি। সর্বশেষ মন্তব্য করি কেন আমি এই দলের সাথে যুক্ত হবো না।
মোটামুটি সব দল সম্পর্কে নোট করা শেষ। ২০১১ সালে অনুসন্ধান মোটামুটি শেষ বলে ঘোষনা করি। আলহামদুলিল্লাহ সারা বাংলাদেশে জামায়াত-শিবিরের চাইতে অধিকতর ভালো কোন সংগঠন পাই নি। সেই সাথে প্রশান্তি অনুভব করি। অন্তত আল্লাহ সুবহানাল্লাহু তায়ালা আমাকে এইমর্মে পাকড়াও করবেন না যে, আমি বাপ-দাদার গোলামী করেছি। প্রত্যেকটি সংগঠনের ব্যাপারে উত্তর তৈরী করেছি কেন আমি তাদের সাথে নেই।
এই কাজটি করতে গিয়ে শিবির সম্পর্কে আস্থা আরো বেড়েছে। দারূন একটি ব্যাপার আবিষ্কৃত হয়েছে। শিবির আসলে একটি মধ্যমপন্থী দল। তাই বলে আমি এই দাবী করছি না শিবিরই একমাত্র সহীহ দল কিংবা শিবিরের কোন ভুল নাই।
আমি আমার গবেষনায় তিনটি বিষয় কে সামনে রেখেছি।
১. আকীদা।
২. বিপ্লবের পদ্ধতি।
৩. নেতৃত্ব কাঠামো।
আকীদার ক্ষেত্রে আমার বিবেচনায় পাশ করেছে অনেকগুলো সংগঠন। যাদের আকীদা আমার কাছে সহীহ মনে হয় নি, তাদের পরবর্তী দুটো বিষয় নিয়ে আমি আর জানার চেষ্টা করি নি।
বিপ্লবের পদ্ধতি মানে ইসলামী রাষ্ট্র কিভাবে নির্মিত হবে এই প্রশ্নে আমি আদর্শ হিসেবে গ্রহন করেছি রাসূলের (সঃ) সীরাতকে। রাসূল (সঃ) তিনটি কাজ করেছেন।
১. অগ্নি পরীক্ষার মাধ্যমে ১৩ বছর ধরে সেক্টর ভিত্তিক লোক তৈরী করেছেন যারা ইসলামী রাষ্ট্রকে ইসলামী আদর্শ মোতাবেক চালাতে পারবেন।
২. দাওয়াতী কাজের মাধ্যমে গনমানুষের মন-মানসিকতা পরিবর্তনের চেষ্টা করেছেন, যাতে তারা আল্লাহর সার্বভৌমত্ব মেনে নেয়। ইসলামের সুমহান আদর্শ মেনে নেয়।
৩. নেতা হিসেবে নিজেকে আদর্শের মডেল হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। অর্থাৎ নিজেকে ইসলামের জীবন্ত রুপ দিয়েছেন।
এই বিপ্লবের পথের ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে অন্যান্য দলগুলো কোন না কোন অংশে চরমপন্থা অবলম্বন করেছে। যেমন কেউ শুধু দাওয়াত নিয়ে চরমপন্থি হয়ে আছে, কেউ সেক্টর গুলোর মধ্যে সেনাবাহিনী নিয়ে চরমপন্থা করছে, কেউ সামাজিক কাজ নিয়ে চরমপন্থা করছে। কেউ আবার নেতা নিয়ে চরমপন্থা করছে। একমাত্র ভারসাম্য দল পেলাম জামায়াত, যে সব সেক্টর নিয়ে কাজ করছে।
নেতা আদর্শের মডেল হবেন, এই ব্যাপারে সব দলেই ঘাটতি আছে, এমনকি জামায়াতেও এই ঘাটতি আমার চোখে পড়েছে।
তৃতীয় যে বিষয় নেতৃত্ব কাঠামো। অসাধারণ একটা সিস্টেম ডেবেলপ করেছে জামায়াত-শিবির। যাতে নেতৃত্বের প্রতি লোভীদের অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা যায়। আর অন্যান্য দলের ক্ষেত্রে এই বিষয়ে একেবারেই হ-য-ব-র-ল অবস্থা। সর্বস্তরের নেতৃত্ব নিয়ে আস্থাহীনতা জামায়াত-শিবির ছাড়া প্রায় সব দলেরই প্রধান সমস্যা।
শিবিরের আছে অনন্য কিছু বৈশিষ্ট্য যা শিবিরকেকে তার লক্ষ্য অর্জনকে সহজ করে দিচ্ছে।
১. শিবিরের বিপ্লবী দাওয়াত।
শিবির দুনিয়াবী কোন উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে মানুষকে আহ্বান করে না। দুনিয়ার কোন সফলতার লোভ দেখায় না। একান্ত পরকালীন সাফল্যের কথা সামনে নিয়ে আসে, যেভাবে আল্লাহর রাসূল দাওয়াত দিয়েছেন।
২. ইসলামী সমাজ গঠনের উপযোগী ব্যক্তিগঠন পদ্ধতি।
শিবির মনে করে ব্যক্তিগঠনের জন্য তিন ধরণের যোগ্যতা লাগবে। এক, ঈমানী যোগ্যতা। দুই, ইলমী যোগ্যতা। তিন, আমলী যোগ্যতা। যোগ্যতা হাসিলে কঠোর প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করেছে সংগঠনটি।
৩. ইসলামী ছাত্রশিবিরের তৃতীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটি একটি তাকওয়া ভিত্তিক সংগঠন। শিবির কোন লোককে দায়িত্ব প্রদানকালে তাকওয়ার বিষয়টি সামনে রাখে।
৪. শিবিরের অনন্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে “নেতৃত্ব সৃষ্টির পদ্ধতি”। অসাধারণ এই পদ্ধতিতে নেতৃত্ব বা পদলোভীদের কোন স্থান নেই।
৫. শিবিরের অর্থের উৎস শিবিরের দায়িত্বশীল, কর্মী এবং শুভাকাংখীরা। শিবির বাইরের অন্য কারো অর্থে চলে না। কারো ক্রীয়ানক হিসেবে কাজ করে না।
৬. বিরোধীদের প্রতি শিবিরের আচরণ।
শিবির তার বিরোধীদের মধ্যে যারা অশালীন ও অভদ্র ভাষা প্রয়োগ করে তাদের করুণার পাত্র মনে করে। শিবিরের দাওয়াত আদর্শ ও কর্মসুচীর বিরুদ্ধে বেচারাদের কিছু বলার সাধ্য নেই বলে বেসামাল হয়ে গালাগালি করে মনের ঝাল মেটানোর চেষ্টা করে। শিবির তাদের হিদায়াতের জন্য দোয়া করে।
আর যারা মিথ্যা সমালোচনা করে অপবাদ দেয়, শিবির প্রয়োজন মনে করলে সেই সমালোচনা যুক্তি দিয়ে খন্ডন করে।
আর তাছাড়া শিবির এও বিশ্বাস করে, মুমিনের দুনিয়ার জীবনে ব্যর্থতা হল আল্লাহর আনুগত্য করতে না পারা। আর কোন কিছুকেই ব্যর্থতা মনে করে না। দুনিয়ার জীবনের কষ্ট, নির্যাতন, অত্যাচার অথবা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অনুকূলে থাকা সবগুলোকেই শিবির পরীক্ষা বলেই গণ্য করে।
আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে সিরাতুল মুস্তাকীমের পথে রাখুন। আমিন।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন