- ও বাবা বাইর হও না, আর কতক্ষন?
- মা'রে একটু শান্তিমত গোসল কইরতে দাও
- এই এক্কান কতা দুই ঘন্টা ধরি কইতে আছস।
- গত সাত মাসে এত হানি হাই ন গোসল কইরবার লাই। আইতেছি আর দুই মিনিট
- কত আগে খানা বাড়ি রাখছি, অন বেক জুড়াই গেছে
মা জাহানারা বেগমের আনন্দের সীমা নাই। তার আদরের ছোট ছেলে রফিক গত পরশু জেলখানা থেকে বের হয়েছে। না, কোন দাগী আসামী নয় রফিক। ইন্টার ২য় বর্ষের ছাত্র। স্থানীয় সরকারি কলেজে পড়ে। অভাবের সংসারে সবকিছু ছাপিয়ে এসএসসি-তে সে A+ পেয়েছিল। তার অপরাধ সে ইসলামী আন্দোলন করে। স্বৈরাচারীর নাগপাশ ছিন্ন করতে চায়। আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ও জনগণের প্রতিনিধিত্ব ভিত্তিক সমাজ চায়। কিন্তু তার চাওয়াতো স্বৈরাচারী সরকারের কাছে পছন্দ হবেনা, হয়ও নি। একদিন কলেজ থেকে ফেরার পথে একদল পুলিশ তাকে তুলে নিয়ে যায়।
তারপর সে কি কান্ড। তারা তো স্বীকারই করেনা। রফিকের বাবা নেই। বড় ভাই বিদেশ। জাহানারা বেগম অসহায় হয়ে দিগ্বিদিক ছুটতে থাকেন। কেউ জানেনা তার ছেলে কোথায়। পরবর্তীতে স্থানীয় কিছু সাংবাদিকের সাহায্যে তিনি আবিষ্কার করেন তার ছেলে থানায়ই আছে। তবে পুলিশ স্বীকার করছেনা। সবার কথা শুনে বুঝতে পারলেন তার আদরের ছেলে রফিককে তারা আর বাঁচতে দিবেনা। খুন করবে ক্রসফায়ারের নামে।
সহসা জাহানারা বেগম চিৎকার করে উঠেন। ওসির পা ধরে ভিক্ষা চাইতে থাকেন তার ছেলেকে। তার করুণ আকুতিতে বরফ গলতে শুরু করলো বর্বর ওসির। জাহানারা বেগম বলতে থাকেন “আঁর হোলা যদি অপরাধ করি থায় তয় জেল দেন আজীবন জেল, তবুও হোলা আঁর চোখের সামনে থাক। হেতেরে মারিয়েন না”। পুলিশ মায়ের কথায় রাজী হয় তবে এজন্য বিসর্জন দিতে হয় বড় ছেলে শফিকের বিয়ের জন্য একটু একটু জমানো সব টাকা। ঘরের একমাত্র দুধেল গাই। বন্ধক দিতে হয় সব জমি। এরপরেও জাহানারা বেগমের ওই বর্বর ওসির প্রতি সে কি কৃতজ্ঞতা।
সাত মাস আগের কথাগুলো মনে হলো জাহানারা বেগমের। আজ তার খুশির সীমা নাই। অথচ এই খুশির মধ্যেও যেন মনে কিছু একটা খচ খচ করছে। রফিক কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছে পরশুদিন। বের হয়ে সে বাড়িতে আসেনি। বাড়িতে আসা নিরাপদ না। স্বৈরাচারী পুলিশেরা তাকে বাড়িতে থাকতে দিবেনা এই কথা সে জানতো। কিন্তু জাহানারা বেগম তাকে ডেকেছে শুধু একবেলা খাবার তাকে খাওয়াবে প্রাণভরে। এজন্য কতদিন থেকে কত আয়োজন করে রেখেছে।
রফিকের প্রিয় গরুর গোশত কিনেছে। মুরগীর বাচ্চা, কবুতরের বাচ্চা, বড় কাতল মাছ, সন্দেশ কত কিছুর যে আয়োজন হয়েছে। ঘাটের সামনের দোকান থেকে আধাসের সুগন্ধি চাল এনেছে। পাশের ঘর থেকে দু’সের দুধ এনেছে। এটা সেটা করে প্রায় বিশ পদ খাবার তৈরী করেছেন জাহানারা। এত খুশির দিন তার জীবনে খুব কমই এসেছে। রফিক তো আসতেই চায় নি, বলেছে আর ক’টা দিন সবুর কর। পরিস্থিতি ভালো হলে আসবো। কিন্তু মায়ের মন তর সয়নি। রফিককে আসতে বলে কেঁদেই দিয়েছে। অগত্যা রফিকও চলে এসেছে মায়ের কাছে একবেলা খাবার খেতে।
- হ্যাঁ রে তোদের ওখানে খুব মাইরতো না?
- না মা মারতো না, তবে অন্য বিষয়ে কষ্ট হতো, যেমন ধরো গোসলের পানি নেই, ওযুর পানি খুব কম, খাবারগুলো বিস্বাদ। ওখান মানুষগুলো সব ভালো না। মদ গাঁজা খায়, খারাপ কথা বলে। অপরিষ্কার।
ছেলে মন দিয়ে খাবার খাচ্ছে। এটা ওটা তুলে নিচ্ছে। যে কোন মায়ের কাছে এর চাইতে তৃপ্তিদায়ক দৃশ্য আর হতে পারেনা। জাহানারা বেগম সেই দৃশ্য থেকে একটুও বঞ্চিত হতে চাননা। পাশে বসে রফিকের পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন তিনি। এমন সময় ঘরের সামনে গাড়ির শব্দ। জাহানারা বেগম একটু উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করলেন। অতটুকুই।
ততক্ষণে সব পুলিশ গট গট করে নেমে ঘিরে ফেলেছে ওদের মা-ছেলেকে। জাহানারা বেগম কিছু একটা বলার চেষ্টা করছেন কিন্তু গুলির শব্দে তা গুলিয়ে গেলো। জাহানারা তাকিয়ে দেখেন গোশতের বাটির উপর লুটিয়ে পড়েছে রফিক। মুখে এক চিলতে হাসি।
ঘন লাল রক্তে উপচে উঠেছে গোশতের বাটি। কাতল মাছের বড় মাথাটা যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে খাবার প্লেটের উপর। ঘটনার আকস্মিকতায় সেও ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে আছে।
আবারো গাড়ির শব্দ। হানাদাররা চলে যাচ্ছে। কয়েক মুহুর্ত কাঁদতে ভুলে গেছেন জাহানারা। গাড়ির শব্দে সম্বিৎ ফিরে পেলেন। আর্তনাদ করে উঠলেন। সহস্র বছরের আর্তনাদ। এই আর্তনাদ চলে আসছে রাসূল সঃ এর যুগ থেকে। বেলাল রাঃ, সুমাইয়া রাঃ, ইয়াসির রাঃ তারও আগে গর্তওয়ালাদের আর্তনাদ। হযরত যাকারিয়া আঃ সহ অনেকের আর্তনাদ।
বাংলাদেশেও এই আর্তনাদ নতুন নয়, মালেক, সাব্বির, হামিদ, আইয়ুব......
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন