সালমান আজ না খেয়েই বেরিয়েছে। এটাতো আর বাড়ি নয় যে মাকে বলবে ‘মা, আজ আমার একটু আগে বের হতে হবে, খেতে দাও’। এটা মেস। এখানে কাকে বলবে? বুয়া প্রায়ই দেরী করে আসে, আড়মোড়া ভেঙ্গে তার রান্না করতে করতেই ক্লাসের সময় পার হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়ে যায়। যেদিন একটু আগে বের হতে হয় সেদিনের সকালের খাওয়া বাদ। এতে অবশ্য সালমানের খুব একটা কিছু হয় না। মাঝে মাঝে গ্যাস জমে পেট ব্যাথা করে এই যা। এটা মোটামুটি তার অভ্যাসের মধ্যেই চলে আসছে।
আজকে ক্লাসের আগে তার মিছিল আছে। অপশক্তি স্বৈরাচারীর বিরুদ্ধে মিছিল। ইসলাম ও ইসলামী নেতৃত্ব রক্ষা করার আন্দোলনের মিছিল। তাই যথারীতি সে না খেয়েই বেরিয়েছে। বন্ধুদের সাথে নিয়ে সে মিছিলে যোগ দেয়। মিছিল শুরু হওয়ার কিছুক্ষনের মধ্যেই পুলিশ গুলি ছুঁড়ে। পুলিশ এখন খুব আক্রমানত্মক। লাঠিচার্জ কিংবা কাঁদানো গ্যাসের কোন বালাই নেই। সরাসরি গুলি। তাও কোন ফাঁকা গুলি নয়। বুক বরাবর। মিছিলের সামনে থাকা সালমান প্রথম শিকার পুলিশের। বুকে গুলির আঘাতে লুটিয়ে পড়ে সে। সে একা নয়, অনেকে। তার অন্যান্য সহকর্মীরা অনেককে উদ্ধার করে নিয়ে যেতে পারলেও সালমান সহ সাত জনকে উদ্ধার করতে পারেনি।
কিছুক্ষন পর পুলিশ তাদের থানায় তুলে নিয়ে আসে। এসেই শুরু করে অত্যাচার। চিৎকার আর আর্তনাদে পুরো থানাটা যেন জাহান্নাম হয়ে উঠে। সাতটা গুলিবিদ্ধ মানুষের উপর ভাংতে থাকে এক একটা লাঠি। একজন পুলিশ মারতে মারতে ক্লান্ত হয়ে গেলে অপরজন শুরু করে। এভাবে পালাক্রমে চলছেই। রক্তের নহর বইতে থাকলো থানায়। একটা পুলিশতো দ্রুত হাঁটতে গিয়ে রক্তে পিছলিয়ে পড়ে গেলো। ঘন লাল রক্তে সেও রঞ্জিত হয়ে গেলো। হো হো করে হেসে উঠলো তার সহকর্মী অন্যান্য পুলিশেরা। রাগে লাল হয়ে গেলো সে। তার সব রাগ গিয়ে পড়লো উলট পালট কুন্ডলি পাকিয়ে থাকা সাতটি রক্তাক্ত দেহের উপর। কি যেন খুঁজতে লাগলো সে। কিছুক্ষন পর পাশের রুম থেকে নিয়ে এলো একটা লোহার পাইপ। এলোপাথাড়ি মারতে শুরু করলো সে। সালমানরা শুধু আল্লাহকে ডেকেই চলছে। কয়েক মিনিটের মধ্যে বিকট শব্দ করে কবির নামে এক সহকর্মীর হাত ভেঙ্গে যায়। কবজি আর কনুইয়ের মাঝখান থেকে ঝুলতে থাকে তার রক্তাক্ত হাত। এ এক বিভীষিকাময় দৃশ্য।
বুকে, পেটে গুলি খাওয়া সালমানের শুধু নিঃশ্বাসটাই বাকী আছে। তার কাছে মনে হচ্ছে সে এখনই আল্লাহর কাছে চলে যাবে। মনে মনে নিজেকে প্রস্তুত করে। অদ্ভুত এক প্রশান্তি তার মনে ভর করে। কত কিছু যে কল্পনা করছে সে। সারা জীবনের কথা মনে করার চেষ্টা করে। কিছু কিছু অন্যায়ের কথা মনে হতেই সে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছে। পুলিশের ক্রমাগত পিটুনি তাকে স্পর্শ করে না। সে আছে তার মত করে আনন্দে। মালিকের সাথে মিলিত হবার আনন্দ। বহু আকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছে সে। এতটুকু কষ্ট হচ্ছে না তার। এমন সময় সে বুঝতে পারলো তাকে গাড়িতে তুলছে পুলিশেরা।
কিছুক্ষনপর মৃতপ্রায় সাতটি মানুষকে পুলিশ হাসপাতালে নিয়ে আসে। ডাক্তাররা দ্রুত চিকিৎসা দেয়ার চেষ্টা করেন। সবাইকে প্রাথমিক চিকিৎসা ও ব্যান্ডেজ করে প্রথমে রক্ত বন্ধের ব্যবস্থা করলেন। তারপর একের পর এক পরীক্ষা করতে থাকলেন কার অবস্থা বেশী খারাপ। কাকে সবার আগে অপারেশন করতে হবে। পরিক্ষা নিরীক্ষার পর জানা গেলো সালমানের কন্ডিশন সবচেয়ে খারাপ। ডাক্তার তাকে বললেন,
- তুমি দ্রুত তোমার আত্মীয়দের খবর দাও। তোমার আত্মীয় কেউ কি এসেছেন?
- আমার কোন আত্মীয় স্বজন এই শহরে থাকে না। আর থাকলেও আমি তাদের ডেকে কষ্ট দিবো না। আমি তো আমার কোন ক্ষতি করিনি। তাছাড়া আমার কোন এক্সিডেন্টও হয়নি।
- তোমার অভিভাবকের সাইন ছাড়াতো আমরা তোমার অপারেশন করতে পারবো না। পরে কোন সমস্যা হলে আমাদের উপর দায় পড়বে।
- (পুলিশদের দেখিয়ে) আপনাদের উপর দায় পড়বে কেন? তারা আমাকে গুলি করেছে। তারপর আমাকে আবার কোন কারণ ছাড়া এক ঘন্টা পিটিয়েছে। দায় হলে তাদের হবে। আর আমার এখানে কোন অভিভাবক নেই। আমার অভভাবক একমাত্র আল্লাহ্।
- আল্লাহ্ তো আর সাইন দিবেন না। এখন আমরা কি করবো?
- (পুলিশদের দেখিয়ে) ওদেরকে বলুন সাইন করতে।
পুলিশও সাইন করতে অস্বীকৃতি জানালো। এরপর সালমান বললো আমাকে দিন আমিই সাইন করি। কিন্তু ডাক্তাররা বললো প্রথম কথা তোমার সাইন করার শক্তি নেই। আর দ্বিতীয়ত তোমার সাইন কাজে আসবে না। এরপর ডাক্তার সার্জারির প্রধান ডাক্তার প্রবীর কুমারকে জানালো। তিনি সব শুনে বললেন, আচ্ছা তাকে নিয়ে এসো। অপারেশনতো করতে হবে।
ডাঃ প্রবীর কুমার সালমানকে দেখেই চমকে উঠলেন। আরে এতো সেই ছেলে। তিনি তাকে চিনেন। মাস ছয়েক আগের কথা, একদিন রাত দুটোয় হঠাৎ তার বাসায় কলিংবেলের শব্দ। তিনি বের হয়ে দেখলেন একটা শীর্ণকায় ছেলে। দরোজা খুলে দিলেন। সে ঘরে ঢুকেই সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়লো। ডাঃ প্রবীর তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিলেন এবং বুঝতে পারলেন দীর্ঘক্ষন না খেয়ে থাকার কারণে ভীষন দূর্বল হয়ে পড়ছে। অল্পক্ষন পরই তার জ্ঞান ফিরলো। সে অপরাধী ও কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে ডাক্তার প্রবীরের দিকে তাকালো। ডাক্তার তাকে উঠালেন এবং বসালেন। তার কোন কথা শোনার আগেই তাকে খেতে দিতে বললেন তার স্ত্রীকে। সে খাওয়া দাওয়া শেষ করলে তাকে জিজ্ঞাসা করলেন কী বৃত্তান্ত? তুমি কি কর? এত রাতেই বা কোথা থেকে?
সব শুনে ডাঃ প্রবীর বললেন, আমি তোমাকে আগে থেকেই জানতাম। প্রসূনের মুখে তোমার এত গল্প শুনেছি যে তোমার সব বিষয় মোটামুটি জানি। সালমান অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে
- কোন প্রসূন?
- কেন তোমার ক্লাসমেট প্রসূন। সে আমার ছেলে। ঐ তো ঐদিকের রুমে ঘুমুচ্ছে।
সালমানের মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠছে। ডাক্তার প্রবীর সাহেব তাকে রাজনীতি করতে বারণ করছিলেন। কিন্তু এগুলো কিছুই তার কানে যাচ্ছিল না। সকাল দশটা থেকে পুলিশ তার পেছনে লাগছে। তার মেস ঘেরাও করেছে। কিন্তু কৌশলে বের হয়েছে। সারা শহর নিজেও ঘুরেছে পুলিশদেরও ঘুরিয়েছে। সে যে কোথাও গিয়ে বসবে তার ব্যবস্থা নেই। রাস্তার রাস্তার মোড়ে মোড়ে পাহারা বসানো। খাবার দোকানগুলোতে গোয়েন্দারা বসে আছে। তাই সে অগত্যা টিকতে না পেরে এই ডাক্তারের বাসায় নক করেছে। কিন্তু সে বুঝতে পারেনি তারা হিন্দু। সে একটু আগে মজা করে মুরগী দিয়ে ভাত খেয়েছে। তার ক্লাসমেট প্রসূনের নাম বলাতে সে বুঝতে পারলো সে কতটা ভুল করেছে। ওনারা কষ্ট পেতে পারেন তাই সে আঙ্কেল বমি আসছে এই কথা বলেই সে ওয়াশরুমে চলে গেলো। গলায় হাত দিয়ে সব বমি করে দিলো।
অন্য কেউ না বুঝলেও ডাক্তার বুঝলেন এটা সালমান ইচ্ছে করেই করেছে। অমুসলিমদের জবাই করা মুরগী মুসলিমদের খাওয়া বারণ এটাও জানা রয়েছে তার। তিনি কিছুই বললেন না কিন্তু শ্রদ্ধাবোধ জন্ম নিল ছোট্ট এই ছেলেটির প্রতি। কতটা একনিষ্ঠ তার আদর্শের প্রতি। তারপর সে ওয়াশ রুম থেকে বের হলে তাকে এক গ্লাস দুধ দিলেন। যে ছেলে সারাদিন না খাওয়ার পর যা খেয়েছে তাও বিসর্জন দিতে পারে শুধু আদর্শের জন্য সে সাধারণ কোন ছেলে নয়। তার ছেলে প্রসূনের মুখে তার শুধু প্রশংসাই শুনেন। সারাদিন পুলিশের সাথে দৌড়াদৌড়ি, তার সংগঠনের কাজ সব করেও সে ক্লাসের ফার্স্ট। প্রসূন ও সালমান দুজনই চট্টগ্রাম কলেজ থেকে এবার HSC পরিক্ষার্থী।
এক মুহুর্তে সব মনে পড়ে গেলো ডাক্তারের। তিনি দ্রুত অপারেশনের ব্যবস্থা করলেন। পরিস্থিতি খুবই নাজুক। তারপরও বলা চলে অপারেশন সাকসেসফুল। তিনটি বুলেট এক্সরে রিপোর্টে ধরা পড়ছিলো। তিনটাই তিনি বের করতে পেরেছেন। অপারেশন থিয়েটার থেকে বের হয়েই ছেলে প্রসূনকে ফোন করেছেন এবং বলেছেন সালমানের কথা। ততক্ষণে প্রসূন ও তার বন্ধুরা সবাই জেনেছে। সালমানের বাবা-মাও রওনা হয়েছেন গ্রাম থেকে।
অপারেশনের আটচল্লিশ ঘণ্টা পার হওয়ার পরও সালমানের জ্ঞান ফিরছে না। সবাই খুব টেনশনে। সালমানের বাবা সিজদায় পড়ে আছেন আছেন। আর মা ছোটাছুটি করছেন অপারেশন থিয়েটারের সামনের বারান্দায়। কেঁদে বুক ভাসিয়ে দিচ্ছেন তারা। সালমানের আন্দোলনের সঙ্গীরাও আছে দূরে দূরে। পুলিশের কারণে তারা সামনে আসতে পারছে না। তবে সালমানের মায়ের সাথে যোগাযোগ রাখছে। সবার খাবার দাবার ঔষধ তারাই সরবরাহ করছে। বায়ান্ন ঘন্টা পর তার জ্ঞান ফিরেছে। আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হচ্ছিল। খুবই দূর্বল হয়ে পড়েছে। হঠাৎ তলপেটে সে প্রচন্ড ব্যাথা অনুভব করছে। ডাক্তাররা আসলেন এবং এক্সরে করালেন। আরো দুটো বুলেটের অস্তিত্ব দেখা গেল সেখানে। আবার অপারেশন করতে হবে।
এক অপারেশনের ধাক্কাই সে নিতে পারেনি। এখন অন্য অপারেশন একেবারেই সম্ভব না। আবার ওদিকে বুলেটদুটো থাকার কারণে ভেতরে ইনফেকশন হয়ে গিয়েছে। অপারেশন না করলে মৃত্যু প্রায় নিশ্চিত। ডাক্তাররা রিস্ক নিয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন অপারেশনই করতে হবে। সালমানের বাবা-মা কে পুরো কন্ডিশন বুঝালেন ডাঃ প্রবীর। তারাও মত দিলো। সবাই বুঝতে পারলো হয়তো সালমানকে আর পাওয়া যাবে না।
একে একে সবাই অপারেশন থিয়েটারে প্রবেশ করলো। সালমানের বাবা, মা, ডাক্তাররা, নার্স, সহকর্মীরা সবাই। সালমান তাদের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো। জান্নাতি সে হাসি। ডাঃ প্রবীর একজন জুনিয়র ডাক্তারকে কাগজ কলম নিয়ে লিখতে বললেন। আর সালমানের দিকে তাকিয়ে কন্ঠকে খুব স্বাভাবিক রেখে বললেন, বাবা সালমান, তোমার শরীরে আরো দুটো বুলেট আছে সেগুলো বের করতে হবে। তোমার অবস্থা খুব নাজুক। আমরা জানিনা ভবিষ্যতে কি হবে। তবে তুমি আশঙ্কামুক্ত নও। এখানে সবাই আছেন। তুমি যদি কাউকে কিছু বলার থাকে তবে বলতে পারো। তোমার ক্ষতির জন্য কারা দায়ী তাদের কথা তুমি বলে যাও।
সালমান তার মাকে ইশারায় ডাকলো। মা কতদিন তুমি আমাকে আদর কর নাই, দোষ আমার আমি বাড়ি যেতে পারিনি। আমাকে একটু আদর করবে? মা জড়িয়ে ধরলো শুয়ে থাকা সালমানকে । মা-ছেলের সাথে কান্না করতে লাগলো সবাই। ডাক্তার তাদের ছাড়িয়ে নিলেন। এবার সে বাবাকে ডেকে বললো আমার কিছু ঋণ আছে, শোধ করে দিবে? বাবা বললো, কি ঋণ আমাকে বল। আমি অবশ্যই শোধ করে দিব। বাবা ঋণটা তোমার কাছেই। তুমি কষ্ট করে রোজগার করে আমার জন্য পাঠাতে। আমি তোমার কোন আশাই পূরণ করতে পারিনি। আমার ঋণটা মাফ করে দাও।
তারপর তার এক সহকর্মীকে কাছে ডেকে বললো, আমার বিছানার নিচে ৫০০ টাকা আছে এগুলো সোহাগ ভাইকে দিবে। আর কিছু ভাউচার আর বিগত মাসগুলোর হিসাব আমার টেবিলের ড্রয়ারে আছে। দয়া করে সেগুলোও সোহাগ ভাইকে দিবে। আর আমাকে মাফ করে দিও ভাই। সবাইকে বলিও যেন আমাকে মাফ করে দেয়। এবার ডাক্তারকে ইশারা করে বলে লিখুন।
আমি সালমান বলছি আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী না। আল্লাহ্ তায়ালা যদি মনে করেন আমাকে তার সান্নিধ্যে নিয়ে যাবেন তাহলে এটা আমার জন্য পরম পাওয়া। যারা আমাকে গুলি করেছে আমাকে মেরেছে তারা না বুঝে এসব করেছে। তারা যদি আমাদের বুঝতো তাহলে তারা এই জঘন্য কাজ কখনোই করতো না। এই অপরাধ আমাদের, আমরা এদেশের মানুষকে ভালোভাবে বুঝাতে পারিনি। আমাদের সীমাবদ্ধতার জন্য আজ এই অবস্থা। আমার প্রতি যারা নির্যাতন করেছে আমি তাদের ক্ষমা করে দিলাম। আল্লাহ্ আমাদের সবাইকে ক্ষমা করে দিন।
সবার চোখে অশ্রু। সবাই কাঁদছে। পুলিশগুলো সহ। হঠাৎ ডাঃ প্রবীর এক পুলিশের কলার চেপে ধরে বলতে লাগলেন, কেমনে পারলে? কেমনে পারলে এই ফেরেশতার মত ছেলেকে গুলি করতে? বলে কাঁদতে লাগলেন। পুলিশগুলোও চোখ মুছতে লাগলো।
একে একে সবাইকে ডাক্তার প্রবীর অপারেশন থিয়েটার থেকে বের করে দিলেন। আরেকজন ডাক্তার সংজ্ঞাহীন করার ইঞ্জেকশন নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন সালমানের দিকে।
২৫/২/২০১৬
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন