খাবার টেবিলে আশরাফ সাহেব। সাথে মসজিদের হুজুর-খাদেম সহ তিনজন লোক। কোতোয়ালী থানার ওসি তিনি। হুজুরদের সাথে খাওয়া-দাওয়া করার কারণে এটা মনে করার দরকার নেই তিনি ধার্মিক লোক। আপাদমস্তক অসৎ তিনি। মাসে একদিন ফকির-মিসকিন-হুজুরদের খাইয়ে তিনি তার পাপ কাটান। এই পাপ কাটানোর সিস্টেমটা তার আবিষ্কার নয়। তার দাদা ও বাবাকেও সে দেখেছে এভাবে পাপ কাটাতে।
ইদানিং তিনি তার দুই ছেলেকে নিয়ে ভীষন চিন্তিত। তারা না করে পড়াশোনা, না শুনে কারো কথা। তিনিও তার বাল্যকালে বাবা-মায়ের অবাধ্য ছিলেন ঠিক কিন্তু এতটা বেয়াড়া ছিলেন না। ইদানিং তাদের বিরুদ্ধে অহরহ ইভটিজিং এর অভিযোগ আসছে। আরো উদ্বেগজনক খবর হল নেশার সাথে জড়িত হয়ে পড়ছে। পাড়ালেখার তো হদিসই নেই। বাসায় তাদের প্রাইভেট টিউটর টিকে না। এক মাস পড়িয়েই তারা চলে যায়। আশরাফ সাহেব একের পর এক টিউটর ঠিক করেন আর তার ছেলেরা কিভাবে টিউটরকে তাড়ানো যায় সেই ব্যবস্থা করে।
খেতে খেতে ওসি সাহেব মসজিদের ঈমামকে বললেন, আমাকে একটা ভালো ছেলে দিন, যে আমার এই দুই ছেলেকে নিজের ভাইয়ের মত দেখাশোনা করবে। ঈমাম সাহেব বললেন শিক্ষক তো আর কম দিলাম না। কিন্তু তাদের অত্যাচারে কে এখানে পড়াবে বলুন! ছেলেদের কথা ভালোভাবেই জানেন ঈমাম সাহেব কারণ তিনি তাদের আরবী পড়ান। তিনিও অনেক চেষ্টা করেছেন তাদেরকে লাইনে আনার জন্য। কিন্তু বিধিবাম, কিছুতেই কিছু হয়নি। ঈমাম সাহেব কিছুক্ষন ভেবে বললেন একটা নতুন ছেলেকে দেখেছি। তাকে বলে দেখি সে হয়তো পারবে। তার মধ্যে প্রচুর ধৈর্য্য দেখেছি।
পরদিন ঈমাম সাহেব ফজরের নামাজ পড়ে মসজিদ থেকে বের হতেই দেখা হল সাকিবের সাথে। সাকিব এই এলাকায় এসেছে বেশীদিন হয় নি। এই দুই কি তিন মাস। গ্রামের ছেলে, ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে তাই শহরে আসা। ঈমাম সাহেব অবাক হয়ে লক্ষ্য করেছেন এই কয় দিনে সে এলাকার ছেলেদের মধ্যে নিজেকে ভীষন জনপ্রিয় করে তুলেছে।সাকিবকে ঈমাম সাহেব ওসি সাহেবের ছেলেদের পড়ানোর কথা বললেন। সাকিব রাজী হল।
২.
ওসি সাহেবের দুই ছেলে। সাজিদ আর সাঈদ। সাকিব তাদের সম্পর্কে আগে জেনে নিয়েছিলো। তাই সে এক সপ্তাহ কোন পড়াশোনার কথাই বলেনি। কেবল গল্পগুজব করেছে। এদিক-সেদিক ঘুরতে যায়। জগতের যে আরেকটি পিঠ আছে তা দেখানোর চেষ্টা করে। তাদের নিয়ে বস্তিতে যায়। মানুষের দূর্দশা দেখায়। হাসপাতালে যায় মানুষের কষ্ট অনুধাবন করতে শেখায়। আস্তে আস্তে তাদের সাথে সম্পর্ক বাড়াতে লাগলো। সাজিদ- সাঈদ দেখলো সাকিব কোন টিউটর নয়, যেন তাদের কোন বন্ধু।
আশরাফ সাহেব খুব অবাক হলেন তার দুই ছেলের পরিবর্তন দেখে। মাসখানেকের মধ্যেই কেমন যাদুর মতন দুই ছেলেকে কন্ট্রোল করে ফেললো সাকিব। ওরা যে শুধু পড়াশোনা করে তা নয়, তারা এখন নিয়মিত নামাজ পড়ে। সাকিবকে তিনি সম্মানের চোখে দেখতে লাগলেন। এরমধ্যে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির দিন দিন অবনতি হচ্ছে। আশরাফ সাহেব অবাক হয়ে দেখলেন রাজাকারদের ফাঁসীর বিরুদ্ধে এই দেশের টগবগে তরুণরা প্রাণ পর্যন্ত দিচ্ছে। কঠিন নির্যাতনেও ওদের দমাতে পারছেন না তারা। তারা যেন মার খাওয়ার জন্য বারবার মিছিল করছে।
সাকিব ইতিমধ্যে ওসি সাহেবের পরিবারের সদস্য হয়ে উঠলো। ওসি সাহেব হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। তিনি পুলিশের চাকুরীতে জয়েন করার পর অনেকেই বলেছে পুলিশের ছেলে মানুষ হয় না। সাকিবের প্রতি তিনি অনেক কৃতজ্ঞ। তিনি প্রায়ই রাতে সাকিবকে খেয়ে যেতে বলেন।
একদিন খেতে খেতে সাকিবকে বললেন, আচ্ছা ছেলেরা এভাবে রাজাকারদের জন্য জীবন দিচ্ছে কেন? সাকিব কিছুক্ষন তার দিকে তাকিয়ে ছিল। এরপর নাতিদীর্ঘ একটা বক্তব্য দিয়ে দিল। ওসি সাহেব অবাক হয়ে শুনছিলেন। তিনি এতদিন ভাবতেই পারতেন না স্বাধীনতা বিরোধীদেরও যুক্তি থাকতে পারে। এত অকাট্য যুক্তি! দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন তোমার যুক্তির বিরুদ্ধে আমার বলার যোগ্যতা নাই। তুমি আবার এগুলার সাথে জড়িত না তো? সাকিব সেদিন কোন উত্তর দেয়নি।
৩.
সরকার ঘোষণা দিয়েছে, শিবির দেখামাত্রই গুলি করতে হবে। যারা করতে পারবে তাদেরই কেবল প্রমোশন। আশারাফ সাহেব যেন এমন একটি ঘোষনার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। খুশিতে তার মুখ চকচক করতে লাগলো। আশরাফ সাহেব বহুদিন বহু অফিসার কে ঘুষ দিয়ে আসছেন তারপরেও প্রমোশন হচ্ছে না। তিনি প্রমাদ গুনলেন। এবার তার প্রমোশন হবেই। তিনি গুলি চালাবেন। একেবারে বুক বরাবর। প্রমোশন তাকে পেতেই হবে!
রাতে ঘুমাতে যাওয়ার সময় বেশ খুশি ওসি সাহেব। কালই তিনি ঘটনাটা ঘটাবেন। কাল শিবিরের হরতাল। মিছিলে তিনি গুলি করবেন। সকালে কাকডাকা ভোরেই মিছিল শুরু হলো। তিনি এসআই দের বললেন গুলি চালাও। তারা গুলি চালালো ফাঁকা। তারপরও মিছিল থামছেনা।
তিনি তার পাশে থাকা এস আই থেকে রাইফেল কেড়ে নিলেন। তাক করলেন মিছিলের যুবকদের বুক বরাবর। ঠা ঠা ঠা টানা দশ রাঊন্ড। তিন জন যুবক লুটিয়ে পড়লো। হাসি ফুটে উঠলো ওসি সাহেবের মুখে। লাশের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন মনে করলেন না।
থানায় এসে নতুন অভিযানের পরিকল্পনা করছেন। এক এস আই জানালো, স্যার দুজন মারা গেছে একজন জীবিত আছে তাকে চিকিৎসা দেব? গালি দিয়ে উঠলেন তিনি ...... পুত শিবিরের জন্য কিসের চিকিৎসা? বাসা থেকে বারবার ফোন দিচ্ছে। নানান ঝামেলায় ও ব্যাস্ততায় তা ধরতে পারছেন না।
বিকেলে বাসায় গেলেন। দেখলেন তার স্ত্রী কাঁদছেন। সব শুনে বুঝতে পারলেন তিনি আজ হত্যা করেছেন সাকিবকে। বিমূঢ় হয়ে গেলেন। দৌড়ে গেলেন হাসপাতালে। দেখলেন তার দুই ছেলে ধস্তাধস্তি করছে পুলিশের সাথে। তিনি পৌঁছতেই দেখেন নিচে পড়ে আছে সাকিব। এখনো বেঁচে আছে। তার দুই ছেলে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে চাচ্ছে কিন্তু অন্যান্য পুলিশ তা দিচ্ছে না।
এরপর দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করলেন। অনেক চেষ্টা করলেন, কিছুতেই কিছু হল না। আশরাফ বলতে লাগলেন আমি শুধু আমার ছেলেকে কে গুলি করে হত্যা করি নি, তিলে তিলে হত্যা করেছি।
কাঙ্খিত প্রমোশন হয়েছে আশারাফ সাহেবের। সাহসী পুলিশ অফিসারের পদক যখন গ্রহন করছিলেন, তখন তিনি দেখতে পেলেন পেছন থেকে দৌড়ে আসছে রক্তমাখা সাকিব। হাতে দুইটা রেজাল্ট কার্ড। বলছে দেখুন আঙ্কেল আমার দুই ভাই কত ভালো। তারা দুজনই ফার্স্ট হয়েছে।
পুনশ্চঃ আশরাফ সাহেব এখন হেমায়েতপুর। চিকিৎসার উর্ধ্বে তিনি।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন