১১ মার্চ ইসলামী ছাত্রশিবিরের শহীদ দিবস। ১৯৮২ সালের এই দিনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ চত্বর শহীদ সাব্বির হামিদ, আইয়ুব ও জাব্বারের রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল। ১৯৭৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ইসলামী ছাত্রশিবিরের যাত্রা শুরুর পর এই দিনে বাংলাদেশে ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের প্রথম শহীদ হওয়ার গেীরব অর্জন করেন শহীদ সাব্বির আহমদ। শহীদ আবদুল হামিদ, আইয়ুব আলী, আবদুল জাব্বারের পথ ধরে দুইশত ছাব্বিশ জন শহীদের নজরানা পেশ করেছে এই সংগঠন।
সব ধরনের জুলুম ও নিপীড়ন থেকে মানুষের মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যে আল্লাহর দ্বীন কায়েমের দৃঢ়প্রত্যয় নিয়ে বাংলাদেশে কাজ করে চলছে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির। শত বাধার প্রাচীর ডিঙিয়ে যারা নিরলস নিত্যদিন কাজ করে চলছে, যারা এগিয়ে চলছে আন্দোলন-সংগ্রামে, অত্যাচার-নির্যাতন, জেল-জুলুম ও জীবনদান যাদের নিত্যসঙ্গী, অপরিসীম ত্যাগ আর কুরবানির বিনিময়ে যারা কাঙ্ক্ষিত সফলতা অর্জনের পথে এগোচ্ছে নিত্যদিন, তাদেরই সংগঠন ছাত্রশিবির।
যা হয়েছিল এই দিনে...
১১ মার্চ, ১৯৮২। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাগত সংবর্ধনা অনুষ্ঠান। আগের দিন ১০ মার্চ, বুধবার। সেদিন থেকেই মূলত শিবিরের এই কর্মসূচিকে বানচালের একটি হীন ষড়যন্ত্র শুরু হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে উদীয়মান শক্তি হিসেবে শিবিরকে সহ্য করতে পারল না বাতিলপন্থীরা। ১১ তারিখের অনুষ্ঠানের প্রচারের কাজে ব্যস্ত শিবিরকর্মীদের ওপর হঠাৎ করে চড়াও হলো ছাত্র ইউনিয়নের একদল দুষ্কৃতকারী। শিবিরকর্মীদের হাত থেকে প্রচারপত্র কেড়ে নিলো। প্রচারকার্য বন্ধ করার জন্য বল প্রয়োগ করতে লাগলো। কিন্তু ধৈর্য ও সহনশীলতার মাধ্যমে পরিস্থিতির মোকাবেলা করলেন শিবিরকর্মীরা। এতে আহতও হলেন কয়েকজন।
১১ মার্চ সকাল থেকেই নবাগত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের জন্য জোর প্রস্তুতি চলছিল। সকাল ৮টা থেকেই প্রশাসনিক ভবনের পশ্চিম চত্বরে শিবিরের নবীনবরণের ডাকে সাড়া দেয় হাজার তরুণ-যুবকের দল। ছাত্রজনতার ঢল নামে নীল প্যান্ডেলের সম্মুখপানে। ৯টায় পবিত্র কুরআন তেলাওয়াতের প্রাণকাড়া সুমধুর বাণী দিয়ে নবীনবরণ শুরু হতে যাচ্ছে। অনুষ্ঠানস্থলের অদূরে শহীদ মিনারে শিবিরের কর্মসূচির সাথে একই সময়ে একটি সাংঘর্ষিক কর্মসূচির আয়োজন করেছিল দুষ্কৃতকারীরা। তারা লাঠি, রামদা, বল্লম, হকিস্টিক ও রড নিয়ে জমায়েত হয়েছিলো। কেবল শিবিরের প্রোগ্রাম বানচালের জন্যই এ কর্মসূচি। পূর্বপরিকল্পিতভাবে তথাকথিত ছাত্র পরিষদের ব্যানারে এ সমাবেশের আয়োজন করেছিল ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রলীগ, বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নসহ অন্যরা। ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃত্বে তারা ছোট ছোট গ্রুপে বিভক্ত হয়ে বারবার গোলযোগ বাধাতে চেষ্টা করে। প্রতিবারই শিবিরকর্মীরা তাদের চেষ্টা ব্যর্থ করে দেন। এরমধ্যে বাইরে থেকে তারা কয়েকটি বাস বোঝাই করে পাঁচ-ছয়শত সশস্ত্র সন্ত্রাসী এনে শিবিরকর্মীদেরকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। তাদের হাতে ছিল রামদা, ভোজালি, ছোরা, বল্লম, হকিস্টিক ও লোহার রড। হিংস্র হায়েনার মত তারা শিবিরকর্মীদের ওপর অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ছাত্র ইউনিয়নের হেলাল, ছাত্রমৈত্রীর সভাপতি শিশির, ছাত্রলীগের রানা, আজাদ, সাকুর, ফজলে হোসেন বাদশা, করীম শিকদার, কাদের সরকার জাসদের ফিরোজ প্রমুখ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ক্যাডারদের নেতৃত্বে অসহায় নিরস্ত্র শিবিরের নেতা কর্মীদের ওপর জঘন্যতম হামলা চালায়! নবীন বরণ হয়ে যায় পন্ড। অস্ত্রবাজ, খুনী, নেশাখোরদের হকিস্টিক, রামদা, কিরিচ চাইনিজ কুড়ালের জঘন্য আক্রমণের শিকারে পরিণত হয় মজলুম শিবির নেতা কর্মীরা। ক্ষত-বিক্ষত রক্তাক্ত অবস্থায় হয়ে যায় দিশেহারা।
বীভৎস দৃশ্য, করুণ-বেদানবিধূর প্রতিচ্ছবি সারা ক্যাম্পাস জুড়ে। তবু ভিসি ও প্রক্টর মনিরুজ্জামান রক্তমাখা আহত নিরস্ত্র অসহায় শিবিরের বুকফাঁটা আর্তনাদ মর্মস্পর্শী করুণ দৃশ্যাবলী ফ্যাল ফ্যাল করে অবলোকন করছে। শত জনতার বিবেক ফেটে চৌচির হলেও তাদের বিবেকে পড়েনি কোন বেদনার রেখাপাত। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস। সেদিন পুলিশ ভিসির অনুমতির অপেক্ষায় ছিল। শিক্ষক, ছাত্র কারও অনুরোধেও পুলিশকে হস্তক্ষেপ করতে দেয়নি। ফলে রক্তের লাল বর্ণে মতিহারের সবুজ চত্বর হয় রঞ্জিত! সে যেন রক্তের হোলিখেলা!
নিরূপায়, অসহায়, নিরস্ত্র শিবির নেতা-কর্মীরা ক্যাম্পাস থেকে মেইনগেট দিয়ে বের হয়ে চলে আসছে। আঘাতে আক্রমণে ৭০/৮০ জন মারাত্মক আহত, ক্ষত-বিক্ষত অবস্থায় দৌড়াতে আর পারছে না! মুখে শুধু আল্লাহ বাঁচাও শব্দ ছাড়া কোন আওয়াজ নেই। শহীদ সাব্বির, হামিদ, আইয়ুব ও জব্বার শহরের দায়িত্বশীল হলেও নবীনবরণ অনুষ্ঠান বাস্তবায়নে তারা ছিলেন সদা তৎপর। বিশ্ববিদ্যালয় ও শহরের আন্দোলন একই সূত্রে গাঁথা তাই শহর থেকেই শিবির নির্মূল করার জঘন্য নীলনকশা তৈরি করেছিল বাম নেতারা। পূর্বপরিকল্পিতভাবেই হামলা পরিচালনা করেছিল তারা। আবারো তাদের চতুর্মুখী হামলায় আর আক্রমণে কান্না আর কান্নার রোল! আর্তনাদ আর আকাশ ফাটা চিৎকারে বাতাসও ভারী হয়ে যাচ্ছে।
আল্লাহর রাহে শিবিরের প্রথম নজরানা
এমনি মুহূর্তে বেলা সাড়ে ১১ টার দিকে শহীদ জোহার মাজারের সামনে শিবির নেতা, উপশহরের কৃতি সন্তান সাব্বিরের ওপর নারকীয় হামলা চালায়। রড-কিরিচ-রামদার শত শত আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত রক্তাক্ত অবস্থায় তাকে রাজশাহী মেডিক্যালে ভর্তি করা হলো। মুয়াজ্জিনের কণ্ঠে আজানের পাশাপাশি করুণ সুরে ভেসে এলো সাব্বির আর নেই! জোহরের নামাজ পড়তেও পারলেন না শিবিরের সর্বপ্রথম শহীদ হিসেবে জান্নাতুল ফিরদাউসের জামায়াতে প্রভুর কাছে হাজির হয়ে গেলেন।
শত শত নেতাকর্মী আহত আর রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আছে। শত জনতার সম্মুখে বিএনসিসির সামনে শিবিরে নেতা আব্দুল হামিদের মাথার নিচে ইট রেখে অনেক ইট আর রড দ্বারা আঘাত করলে মগজ ছিটকে বের হয়ে যায়। রাজশাহী কলেজ থেকে আরবি অনার্স পরীক্ষা দেয়া আর হলো না। শহীদ আবদুল হামিদের রক্তমাখা বেদনার প্রতিচ্ছবি প্রতিক্ষণ প্রাণে দোলা দেয়। মনে পড়লেই হৃদয়ে জাগে শিহরণ! কিন্তু পাষাণ নিষ্ঠুরদের হাতও কাঁপেনি। যদিও কেঁপেছিল খোদায়ী আরশ। শহীদ সাব্বিরের শোকে মূহ্যমান আবাল বৃদ্ধবনিতা এক শহীদের বেদনায় শোকাহত জনতার প্রাণে মাত্র ৮/১০ ঘণ্টার মধ্যেই শহীদ আবদুল হামিদের শাহাদাত চতুর্দিকে বাতাসের মত ছড়িয়ে পড়লো।
১১ মার্চের বেদনার আধার ভেদ করে ১২ মার্চের সোনালি সূর্য উদিত হলো। মাত্র ৩৫ ঘণ্টার ব্যবধানে আহত চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১২ মার্চ প্রভুর ধ্যানে পাড়ি দিলেন শহীদ আইয়ূব। উদ্ভিদ পরীক্ষায় অনার্স না হলেও শাহাদাতের মর্যাদায় হলেন উদ্ভাসিত। শহীদ সাব্বির, হামিদ যেমন শহর শাখার জোন সভাপতি ছিলেন তেমনি শহীদ আউয়ুবও ছিলেন শহর শাখার অফিস সম্পাদক। তাঁর হাসিমাখা চাহনি, অপূর্ব ওয়াল রাইটিং আর মায়াবী চেহারা বেদনার প্রতিচ্ছবি আজও ডাকে বারে বার। তিনিও চলে গেলেন ওপারে সুন্দর ভুবনে। প্রতিদিন সূর্য ফেরে শুধু ওরা ফেরে না...?
দীর্ঘদিন আহত অবস্থায় চিকিৎসাধীন থাকলেন রসায়ন বিভাগের মেধাবী ছাত্র আবদুল জাববার। কিছুটা সুস্থ হয়ে বাড়ি যান। প্রায় গান গেয়ে সান্ত্বনা খুঁজতেন এভাবে আমাকে শহীদ করে সেই মিছিলে শামিল করে নিও. ‘আমার যাবার সময় হলো দাও বিদায়।' তার প্রাণের আকুতি ৯ মাস পর ২৮শে ডিসেম্বর প্রভুর দরবারে কবুল হলো। তিনিও শাহাদাতের পিয়ালা পান করলেন। শহীদ সাবিবর, হামিদ, আইয়ুবের মত শহীদ জাববারের শাহাদাতেও পারলো না কেউ অশ্রু নিবারণ করতে। শহীদ আর অগণিত আহত, ক্ষত-বিক্ষত রক্তমাখা প্রতিচ্ছবি সত্যিই বেদনাবিধুর!
দীর্ঘদিন আহত অবস্থায় চিকিৎসাধীন থাকলেন রসায়ন বিভাগের মেধাবী ছাত্র আবদুল জাববার। কিছুটা সুস্থ হয়ে বাড়ি যান। প্রায় গান গেয়ে সান্ত্বনা খুঁজতেন এভাবে আমাকে শহীদ করে সেই মিছিলে শামিল করে নিও. ‘আমার যাবার সময় হলো দাও বিদায়।' তার প্রাণের আকুতি ৯ মাস পর ২৮শে ডিসেম্বর প্রভুর দরবারে কবুল হলো। তিনিও শাহাদাতের পিয়ালা পান করলেন। শহীদ সাবিবর, হামিদ, আইয়ুবের মত শহীদ জাববারের শাহাদাতেও পারলো না কেউ অশ্রু নিবারণ করতে। শহীদ আর অগণিত আহত, ক্ষত-বিক্ষত রক্তমাখা প্রতিচ্ছবি সত্যিই বেদনাবিধুর!
সেদিনের শহীদদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
শহীদ সাব্বির আহমেদ
সব ধরনের জুলুম ও নিপীড়ন থেকে মানুষের মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যে আল্লাহর দ্বীন কায়েমের দৃঢ়প্রত্যয় নিয়ে বাংলাদেশে কাজ করে চলছে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির। শত বাধার প্রাচীর ডিঙিয়ে যারা নিরলস নিত্যদিন কাজ করে চলছে, যারা এগিয়ে চলছে আন্দোলন-সংগ্রামে, অত্যাচার-নির্যাতন, জেল-জুলুম ও জীবনদান যাদের নিত্যসঙ্গী, অপরিসীম ত্যাগ আর কুরবানির বিনিময়ে যারা কাক্সিক্ষত সফলতা অর্জনের পথে এগোচ্ছে নিত্যদিন; তাদেরই একজন শহীদ সাব্বির আহমদ।
ব্যক্তিগত পরিচয়
মো: সাব্বির আহমদ। সোনালী ব্যাংকের সাবেক নাইট গার্ড মো: জামিল খানের ছয় সন্তানের মধ্যে সবার বড় ছিলেন শহীদ সাব্বির আহমদ। রাজশাহীর বোয়ালিয়া থানার অন্তর্গত উপশহরে আবাসিক এলাকায় তাদের বাড়িটি ছিল এ/২২ নম্বর। পুরাতন ধরনের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ছিমছাম বাড়িতে বসবাসরত পরিবারে সাব্বির ছিলেন তখন ১৮ বছরের পরিশ্রমী আর প্রাণবন্ত তরুণ।
শিক্ষাজীবন
পরিবারের দারিদ্র্যের মধ্যেও যেহেতু তিনি নিজের লক্ষ্যে পৌঁছবার বিষয়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন, সুতরাং অর্থকড়ির যোগান দিতে কলমের কালি তৈরির প্রকল্পসহ প্রসাধনী দ্রব্যের ব্যবসা করতেন। নিজের পড়াশোনার খরচ নিজেই বহন করতেন শহীদ। দৈনিক সর্বোচ্চ দু’তিন ঘণ্টা সময় পেতেন পড়াশোনার জন্য। তারপরও কৃতিত্বের সাথে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন ১৯৭৯ সালে।
সাংগঠনিক জীবন
আল্লাহর ঘোষণা, “জান্নাতের বিনিময়ে আল্লাহ মুমিনদের জান ও মালকে খরিদ করে নিয়েছেন।” (সূরা তাওবা : ১১১) এই ঘোষণা নত মস্তকে মেনে নিয়ে আল্লাহর পথে নিজের জান ও সম্পদকে বিকিয়ে দেয়ার চূড়ান্ত শপথ নেয়ার জন্য ছাত্রশিবিরের পতাকাতলে আসেন সাব্বির আহমদ। ইসলামী ছাত্র-আন্দোলনে যোগ দেয়ার সাথে সাথে তিনি নিজেকে গড়ে তোলেন আদর্শবান ছাত্র হিসেবে, এবং দাওয়াতি কাজে নিজেকে সক্রিয় করেন। নিজের মেধা, মননশীলতা, সচ্চরিত্র অবলম্বন করে প্রাণপ্রিয় সংগঠনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের দৃঢ়সঙ্কল্প নিয়ে এগিয়ে যান তিনি। পর্যায়ক্রমে সংগঠনের কর্মী, সাথী অতঃপর সদস্যপ্রার্থীর স্তরে উন্নীত করেন নিজেকে। মানুষের মুক্তি ও স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি তাঁকে সদস্য হিসাবে চূড়ান্ত শপথ গ্রহণ করতে দেয়নি। উপশহর এলাকার দায়িত্বশীল থাকার সময় এলাকার শিশু, কিশোর, যুবক, বৃদ্ধ নির্বিশেষে সবার মাঝে অত্যন্ত মিষ্টভাষী হিসেবে পরিচিতি অর্জন করেছিলেন তিনি।
জানাজা ও দাফন
শহীদের গর্বিত পিতা মো: জামিল খান নিজেই পুত্রের জানাজা নামাজের ইমামতি করেন। হাত ওঠান আল্লাহর দরবারে। শহীদ পুত্রের কবুলিয়াতের এবং আহত কর্মীদের সুস্থতার জন্য দোয়া করলেন দুই চোখের পানি ছেড়ে। পরে নগরীর টিকাপাড়া গোরস্থানে চিরদিনের জন্য তাঁকে দাফন করা হয়।
পিতার অনুভূতি
অশ্রুসিক্ত পিতা মহান আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করে বলেছিলেন, “হে আল্লাহ, এমন ছেলের পিতা হওয়ার গৌরবে আমি তোমার দরবারে শোকর আদায় করছি। আমার ছেলের শাহাদাত কবুল করে নাও।”
অনুকরণীয় ও অনুসরণীয়
কৈশোরে আল্লাহর রাসূল (সা) যেমন সমাজের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় ‘হিলফুল ফুজুল’ নামক ক্লাব গঠন করে সমাজসেবায় আত্মনিয়োগ করেন, সেই রাসূলের (সা) আদর্শের অনুসারী শহীদ সাব্বিরও উপশহরের সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলার স্বার্থে সুপ্রতিষ্ঠিত ‘অনুসন্ধান’ ক্লাবের সদস্য হয়ে সমাজসেবায় ভূমিকা রাখেন। সদা চঞ্চল ও পরিপাটি কিশোর শহীদ শুধু আদর্শবান ছাত্র নয়, একজন খেলোয়াড় ও সংগঠক হিসাবেও অনেক পুরস্কার অর্জন করেন। সমাজের কারো সাথে কোনো বিষয় নিয়ে সামান্যতম কোনো কথা কাটাকাটি করেননি তিনি। তবে সত্য প্রতিষ্ঠার সৈনিক হিসেবে ন্যায়ের উচ্চারণে অত্যন্ত দৃঢ় ছিলেন। শহীদ সাব্বির অন্যের উপকার করার জন্য অত্যন্ত আগ্রহী ছিলেন, অন্যের সেবা করে আনন্দ পেতেন তিনি। আড়ম্বরহীন জীবনযাপন করতেই পছন্দ করতেন শহীদ।
শহীদ সাব্বির নিজের যা কিছু ছিলো অর্থকড়ি-সহায় সম্পত্তি; সবকিছু কাজে লাগিয়ে দ্বীনের দাওয়াতে ব্যস্ত ছিলেন আজীবন। বায়তুলমাল থেকে খরচ করার মত খাত থাকা সত্ত্বেও শুধু বায়তুলমালের কঠোর হিসাব দিতে হবে আল্লাহর কাছে সেই অনুভূতি থেকে খরচ করেননি। নেতৃত্বের আনুগত্যে তিনি আন্তরিক ছিলেন। জীবনের শেষ দিনটিতে সংগঠনের পক্ষ থেকে তাঁকে বলা হয়েছিল যে সকাল ন’টা চল্লিশের গাড়িতে ক্যাম্পাসে যেতে হবে। বাড়ির সব জরুরি কাজ শেষ করে খেতে বসে দেখলেন মা এখনো রুটি ভাজা শেষ করতে পারেননি। তাড়াহুড়ো করে চুলোর ওপর থেকে দুটো রুটি খেয়ে ক্যাম্পাসে রওনা দেন। সাব্বির জানতেন না এটাই আল্লাহর তরফ থেকে দুনিয়ার সর্বশেষ রিজিক। শহীদ সাব্বির দ্বীনের দাওয়াতি কাজসহ অন্যান্য কাজ আঞ্জাম দিয়ে যেটুকু অবসর পেতেন তা কুরআন তিলাওয়াত আর জিকির করে কাটাতেন। যারা আল্লাহর দাসত্ব কবুল করেছে তারা জিকিরের মধ্য দিয়েই তাদের সময় কাটান।
ইসলামী আদর্শের উজ্জ্বল প্রতীক শহীদ আব্দুল হামিদ
শহীদ আব্দুল হামিদ ইসলামী আদর্শের উজ্জ্বল প্রতীক হিসেবে তাঁর প্রাত্যহিক আচরণ, চালচলন, কথাবার্তায় ইসলামের সুমহান শান্তির অকপট দীপ্তিতে ভাস্বর ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই শহীদ আব্দুল হামিদ মহান প্রভুর কাছে সঁপে দিয়েছিলেন নিজেকে। ইসলামী অনুশাসনের প্রতি প্রবল ঝোঁক ও আন্তরিকতা পরিলক্ষিত হয়েছে শৈশব থেকেই। আদর্শ মুমিনের বাস্তব প্রতিচ্ছবি হিসাবে পঞ্চম শ্রেণীতে অধ্যয়নকালেই নিয়মিত নামাজ পড়তেন। শুধু তাই নয়, বাড়ির সবাইকে এবং পাড়া-প্রতিবেশী ও সহপাঠীদের সবাইকে নামাজ পড়ার জন্য আহ্বান জানাতেন। ছোটবেলা থেকেই তাঁর চোখে-মুখে ছিল ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার সোনালি স্বপ্ন। সে জন্য ছোটবেলা থেকেই বিভিন্ন জায়গায় তিনি বক্তব্য রাখতেন।
ইসলামের জন্য নিবেদিতপ্রাণকর্মী শহীদ আব্দুল হামিদ ইসলামের জন্য কাজ করে সবসময় মানসিক প্রশান্তি লাভ করতেন। কৈশোরেই তিনি ইসলামী জলসার জন্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে টাকা সংগ্রহ করতেন। গ্রামের মানুষকে ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য গ্রামে ইবতেদায়ি মাদ্রাসাও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এখনও সে মাদ্রাসা আছে। মাদ্রাসার নাম সৈয়দপুর শহীদিয়া মাদ্রাসা। তাঁর স্মৃতিতে সৈয়দপুরে একটি শহীদিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং শহীদ আব্দুল হামিদ স্মৃতি পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। মুয়ামালাতের ক্ষেত্রে তাঁর জীবন ছিল সামগ্রিকভাবেই প্রশ্নহীন। স্বাভাবিক চাহিদা হিসেবে যখন যা জুটতো তাতেই তিনি সন্তুষ্ট থাকতেন, এক্ষেত্রে কখনো বাড়াবাড়ি করেননি। তিনি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন জীবন পছন্দ করতেন। উন্নত ও মননশীল রুচিবোধসম্পন্ন্ ব্যক্তি হিসেবে জীবনকে সাজিয়ে গুছিয়ে রেখে চলাফেরা করার চেষ্টা করতেন। তিনি তাঁর কক্ষকে এবং পড়ার টেবিল সব সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখতেন। বাড়িতে তিনি ফল-ফুলের গাছ লাগিয়ে বাড়ির সৌন্দর্য রক্ষার চেষ্টা করতেন। এ ব্যাপারে পাড়া-প্রতিবেশীকেও উদ্বুদ্ধ করতেন। আল্লাহর একান্ত বান্দা হিসেবে শহীদ আব্দুল হামিদ ইসলামী অনুশাসন মেনে চলার মাধ্যমেই তাঁর চরিত্রকে উন্নত ও মাধুর্যপূর্ণ করে তুলেছিলেন। পোশাক-পরিচ্ছদের ক্ষেত্রেও তাঁর ব্যতিক্রম ঘটেনি। তিনি সব সময় পায়জামা-পাঞ্জাবি পরিধান করতেন। জীবনে কোনো দিন দাড়ি কাটেননি। বলা যায় যে, তাগুতি সমাজের ছোঁয়া তাঁকে বিন্দুমাত্রও টলাতে পারেনি। সেজন্য এলাকার সুধীজন ও সর্বস্তরের মানুষের কাছে তিনি অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে সক্ষম হয়েছিলেন। ছোট ভাইদের প্রতি তাগিদ দেয়া ছিল তাঁর নিত্যনতুন ঘটনা। সৈয়দপুর ছিল চোর-ডাকাতের ভয়ে ভীত একটি এলাকা। আব্দুল হামিদ দুর্দান্ত সাহসিকতার সাথে চোর-ডাকাত থেকে নিজ গ্রামকে মুক্ত রাখার চেষ্টা চালান। ছোট ভাইদের ঘুমপাড়িয়ে সবার পরে তিনি ঘুমাতেন। ইসলামী আন্দোলনের জন্য তাঁর আত্মত্যাগ সমাজ, তাঁর পরিবার ও পিতা-মাতার গর্ব হিসেবে মর্যাদা পেয়েছেন। তাঁর শাহাদাতের পর তাঁর কথা যখনই তাঁর পিতার মনে পড়ত তখনই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতেন। এর মাত্র তিন বছর ব্যবধানে সেই পিতাও পরপারে পাড়ি জমান। শহীদের মেজ ভাই একবার তাঁর আব্বাকে স্বপ্নে দেখেছিলেন এবং কথা হয়েছিল। তাঁর আব্বা বলেছিলেন, ‘আমি তোমার বড় ভাইয়ের জন্যই কবরে খুব শান্তিতে আছি। শহীদের পিতা হিসেবে মহান রাব্বুল আলামিন তাঁকে সম্মানিত করেছেন, এ সুরত তাঁরই ইঙ্গিত বহন করে।’
আজও স্বপ্ন দেখেন শহীদের মা
শহীদের মা হামিদা বেগমের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তার সাথে তো আমার প্রায়ই কথা হয়।’ একদিন বাড়ির পাশের গাছের ডাল ভেঙে হামিদা বেগমের পায়ে পড়লে পা ফুলে যায়। ব্যথায় কষ্ট পেতে থাকেন। ঠিক সে সময় শহীদ আব্দুল হামিদ এসে বললেন, ‘মা, এভাবে কষ্ট করছেন কেন?’ ঘটনা জেনে তিনি পায়ে তিনটি ফুঁ দেন। পরদিন থেকে পা আগের মতো সুস্থ হয়ে যায়। এভাবেই আরেক দিন স্বপ্নে এসে তাঁর প্রিয় বাবা কতদিন আগে মারা গেছে এবং ভাইদের কে কী অবস্থায় আছে তা জানতে চান।
ঠিক এভাবেই একদিন স্বপ্নে মাকে নানীর বাড়ি বেড়িয়ে নিয়ে আসেন। মায়ের শারীরিক খোঁজ-খবরের সাথে সাথে আত্মীয়-স্বজনদের কে বেঁচে আছে আর কে মারা গেছে তা জানতে চান। এমনিভাবে আরো একদিন স্বপ্নে আব্দুল হামিদ এলে মা তাঁর কাছে জানতে চাইলেন, তুমি কোথা থেকে এসেছ? তিনি বললেন, আমি ভালো আছি। আমাকে নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।
আরেকদিন তাঁর মা স্বপ্ন দেখলেন, বাড়ির পাশের রাস্তা দিয়ে বেশ কয়েকজন যুবক যাচ্ছেন। তাদের মধ্যে আব্দুল হামিদও রয়েছেন।
শহীদের মা হামিদা বেগম তাঁর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে আরোও বলেন, বড় ছেলে আব্দুল হামিদের কথা মনে পড়লে এখনো খাওয়া-দাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। কত আদরের ছেলে ছিল সে! ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদেরকে আমি নিজের ছেলের মতো মনে করি। তাদের প্রতি আমার অনুরোধ, আব্দুল হামিদের রেখে যাওয়া অসমাপ্ত কাজ তারা সাফল্যের দ্বার প্রান্তে পৌঁছে নিতে যেন আন্তরিক প্রচেষ্টা চালায়।
শাহাদাতের পূর্বে শহীদের কথা
গুণ্ডাবাহিনী যখন তাঁকে উপর্যুপরি আঘাত করছিল আর বলছিল, বল শালা আর শিবির করবি কি না, শিবির না করলে তোকে ছেড়ে দেব। তখন খুনিদের কথা শুনে শহীদ আব্দুল হামিদ বলেছিলেন, ‘আমি যে সত্য পেয়েছি, আমি যে আলো পেয়েছি, ইসলামের পথ পেয়েছি, তা থেকে আমি দূরে থাকতে পারবো না।’
সন্তানহারা পিতা-মাতার অবস্থা
শাহাদাতের পূর্বে তাঁর পিতা-মাতা দু’জনই সুস্থভাবে, সুখে শান্তিতে জীবনযাপন করছিলেন। পুত্রশোককে ভুলতে না পেরে তিন বছর পর শহীদের শ্রদ্ধেয় পিতা জনাব নাসির উদ্দিন ইন্তেকাল করেন। আর জনমদুঃখী মাতা হামিদা বেগম সন্তানহারা ব্যথা নিয়ে এখনো দুঃসহ জীবনযাপন করছেন।
শহীদের ছোটভাই, শিক্ষক ও প্রতিবেশীর প্রতিক্রিয়া
ছোটভাই ফয়জুর রহমান বলেন, আব্দুল হামিদের উত্তরসূরিদের কাছে আশা করি তারা ইসলাম প্রতিষ্ঠার কাজ ত্বরান্বিত করবে। এভাবেই ঢাকাসহ সারাদেশে ইসলামের সুশীতল বাতাস বইবে। প্রতিকূল সংস্কৃতি বিরাজমান থাকায় কৌশল অবলম্বনের মাধ্যমে ইসলামী সংস্কৃতি বিকাশের ক্ষেত্রে বাস্তবভিত্তিক পরামর্শ দেন। ভাইয়ের কথা মনে পড়লে ইসলামের পথে তিনি শহীদ হয়েছেন মনে করে নিজেকে সান্ত্বনা দেন।
আব্দুল হামিদের মাদ্রাসার শিক্ষক আবুল হুদা মোহাম্মদ আবদুল হাদী বলেন, সে খুব ভাল ছিল। তাঁর আচার-আচরণ, শিক্ষকদের সাথে তাঁর ব্যবহার ছিল অতুলনীয়। জুনিয়র-সিনিয়র সবার সাথে তাঁর আচরণ ছিল অনুকরণীয়। সে তো শাহাদাত বরণ করেছে।
প্রতিবেশী শফিউর রহমান বলেন, সে খুব ভালো ছেলে ছিল। আচার-আচরণ, মানুষের সাথে তাঁর ব্যবহার ছিল চমৎকার। তাঁর মেজভাই, ছোটভাই, পাড়া-প্রতিবেশীদের একটাই মাত্র প্রত্যাশা, শহীদ আব্দুল হামিদের উত্তরসূরিরা যেন তাঁর রেখে যাওয়া আন্দোলনের অসমাপ্ত কাজ সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যেতে যথাযথ প্রচেষ্টা চালায়।
চেতনায় চির অম্লান শহীদ আইয়ুব আলী
পদ্মাবিধৌত হযরত শাহ মখদুম (রহ)-এর পুণ্য স্মৃতিবিজড়িত উত্তরবঙ্গের রাজশাহী প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের এক অনন্য লীলাভূমি। এই শহরে অনুকূল পরিবেশের দরুন বেশ কতগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে রাজশাহী সরকারি কলেজ অন্যতম। জীবনে বড় হওয়ার এক পরম স্পৃহা নিয়ে রাজশাহী কলেজে ভর্তি হন মেধাবী ছাত্র আইয়ুব আলী। কিন্তু বড় হয়ে আলো ফোটানোর আগেই বাতিলের হামলায় নিভে যায় তাঁর জীবনপ্রদীপ।
জন্ম ও বংশ পরিচয়
শহীদ আইয়ুব আলী চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গার ডাউকি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মুহাম্মদ আইজুদ্দিন। আট ভাই-বোনের মধ্যে আইয়ুব আলী ছিলেন সবার বড়।
শিক্ষাজীবন
শহীদ আইয়ুব আলীর শিক্ষাজীবন শুরু হয় বাদেমাজ্ ুস্কুলে। তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন। প্রাইমারি শিক্ষা শেষ করে তাঁকে আলমডাঙ্গা পাইলট হাইস্কুলে ভর্তি করা হয়। এখানে দশম শ্রেণী পর্যন্ত প্রতিটি ক্লাসে প্রথম হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। এসএসসি পরীক্ষার সময় অসুখ থাকার দরুন দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন তিনি। এসএসসি পাস করার পর তিনি আলমডাঙ্গা ডিগ্রি কলেজে ভর্তি হন। এ কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় দ্বিতীয় বিভাগে পাস করেন। অতঃপর রাজশাহী কলেজে উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগে সম্মান শ্রেণীতে ভর্তি হন। শাহাদাতের সময় তিনি এ কলেজেরই ছাত্র ছিলেন।
ব্যক্তিজীবনে শহীদ আইয়ুব আলী
ছোট্টকাল থেকেই আইয়ুব আলী ছিলেন অত্যন্ত সৎ ও অমায়িক। ছোটবেলার একটি ঘটনা, আইয়ুব আলীর বয়স তখন মাত্র আড়াই বছর। মায়ের সঙ্গে বেড়াতে গিয়েছিলেন নানার বাড়ি। বায়না ধরেছিলেন আখ খাবেন। উপেক্ষা করতে পারলেন না মা। দেখিয়ে দিলেন তাঁর নানার আখক্ষেত। জমির কাছেই তাঁর ছোট নানা বসা ছিলেন। আইয়ুব আলী আখ নিয়ে বাড়ি ফিরলেন। কিন্তু আখ নিতে গিয়ে যা ঘটলো তার বর্ণনা করেন তাঁর নানা : ‘ও আইয়ুবের মা, তোমার আইয়ুব আখ আনতে মাঠে গেছে। আমি ওকে আখ দিতেই সে বলল, আমি আমার নানার জমির আখ নেব। বাধ্য হয়ে ভাইয়ের জমি থেকে আখ দিলাম।’ আনুগত্যশীল আইয়ুব কেন খাবে পরের জমির আখ? মনে হয় শহীদেরা এমনই নিষ্পাপ থাকে প্রভুর তত্ত্বাবধানে। শহীদ জননী তাঁর শাহাদাতের পর স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘সেই শাসনের পর থেকে আইযুব কেন, তাঁর কোনো ভাই-ই আজ পর্যন্ত পরের জিনিস না বলে স্পর্শ করা শেখেনি।’
সংগঠনে আগমন
ছোটবেলা থেকেই আইয়ুব আলী ছিলেন অত্যন্ত ধর্মভীরু। ষষ্ঠ শ্রেণী থেকেই তিনি নিয়মিত নামাজ পড়তেন। আলমডাঙ্গা ডিগ্রি কলেজে অধ্যয়নকালে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের পতাকাতলে আসেন। সংগঠনে যোগ দেয়ার পর থেকেই তিনি নিয়মিত কুরআন-হাদিস অধ্যয়ন করতেন। ছাত্রদের ইসলামী আন্দোলনের দাওয়াত দিতেন। পরিবার ইসলামী আন্দোলনের অনুকূলে না থাকলেও শহীদ আইয়ুব আলী ইসলামী আদর্শের একনিষ্ঠ অনুসারী হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলেন। ইসলামী আন্দোলনের প্রত্যেকটি কাজ তিনি একাগ্রচিত্তে পালন করার চেষ্টা করতেন। শাহাদাতকালে তিনি সংগঠনের সাথী ছিলেন।
শাহাদাতের ইচ্ছা পোষণ
শহীদ আইয়ুব আলী ইসলামী আন্দোলনের কাজে নিজেকে যখন সম্পৃক্ত করেছেন তখনও তাঁর পরিবার নামাজ-কালাম ঠিকমত পড়তেন না। একদিন পাশের বাড়ির মকবুল হোসেন মুন্সী তাঁর পিতাকে এসে বলল, ‘আইয়ুব যে পথে নেমেছে তাতে ওকে ঠেকিয়ে না রাখতে পারলে তো মুশকিল! কারণ চারদিকে বিরোধিতা।’ এরই প্রেক্ষিতে আইয়ুবের পিতা ছেলেকে ডেকে বললেন, ‘তুমি তো এপথে নেমেছ। কিন্তু কবে যে তোমাকে মেরে ফেলে!’ তখন আইয়ুব বললেন, ‘আল্লাহর পথে এসে মরাও ভালো। আপনি লেখাপড়া শেখাতে পারেন কিন্তু মৃত্যু তো ঠেকাতে পারেন না।’
অন্য একদিন শহীদ আইয়ুব আলী তাঁর পিতাকে বলেছিলেন, ‘মানুষের মত মানুষ হয়ে আমাদের দুনিয়া থেকে যাওয়া উচিত।’ তাঁর কথা শুনে পিতা বললেন, ‘আমরা তো মানুষই, আবার কী রকম মানুষ হতে বলছো?’ পিতার কথা শুনে তিনি বলেছিলেন, ‘যে মানুষ মারা গেলে সবাই কাঁদে আর সে হাসে।’
শাহাদাতের পর শহীদের মাতা-পিতার প্রতিক্রিয়া
মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এসে শহীদ আইয়ুবের অবস্থা দেখে ডুকরে কেঁদে ফেলেন তাঁর পিতা। শোকাহত পিতার কণ্ঠে চিৎকার উঠলো- কী অপরাধ ছিল আমার ছেলের? আমি ওর মাকে গিয়ে কী বলব? ওর মা তো এ খবর শুনে বাঁচবে না!
প্রধান শিক্ষকের দৃষ্টিতে আইয়ুব
তাঁর স্কুলের প্রধান শিক্ষক মো: মোজাম্মেল হক বলেন, আইয়ুব ছিল খুবই মেধাবী ও বিনম্র ছাত্র। সে সকলের সাথে ভালো ব্যবহার করত। আমার সকল ছাত্রকে যদি একটি গোলাপের বাগানের সাথে তুলনা করা হয়, তবে সে বাগানের সেরা গোলাপ ছিল আইয়ুব আলী।
বিভিন্ন মহলের প্রতিক্রিয়া
১৩ তারিখ পত্রপত্রিকায় এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে প্রায় সব কটি রাজনৈতিক দল, বিভিন্ন সংগঠন ও বুদ্ধিজীবী মহল বিবৃতি দিয়েছিল। সম্পাদকীয় লেখা হলো নারকীয় হত্যাকাণ্ডের ভয়াবহতা উল্লেখ করে। পত্রিকার পাতায়, মিছিলে, প্রতিবাদ সভায় সর্বত্র হত্যাকাণ্ডের জন্য বিশেষভাবে দায়ী রাবি’র ভিসি’র অপসারণ ও যারা এ নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে বর্বর পৈশাচিকতার পরিচয় দিয়েছে তাদের শাস্তির দাবি উঠলো, দাবি উঠলো ‘খুনিদের ফাঁসি চাই’। দায়সারা গোছের একটি শাস্তি হয়েছিলও বটে কিন্তু আদালতের সেই শাস্তি আর কার্যকর হয়নি।
প্রতিবছর ফিরে আসে ১১ মার্চ। সেই সাথে ফিরে আসে আইয়ুব আলীর শাহাদাতের কথা। দেশের তৌহিদী জনতার মনের পর্দায় ভেসে থাকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রক্তে রঞ্জিত মতিহার চত্বর। কাফেলার সৈনিকগণ এই শাহাদাত থেকে শিক্ষা নেয় সামনে এগিয়ে যাওয়ার, থমকে না দাঁড়ানোর। শহীদদের রক্ত রঞ্জিত পথ ধরেই এগিয়ে যাবে এ শহীদি কাফেলা। এটাই হোক আমাদের প্রত্যাশা।
শহীদ আব্দুল জব্বার
এ দুনিয়ার বুকে আল্লাহর কালিমাকে বিজয়ী করার জন্য যুগে যুগে কিছু মানুষ নিজেদের প্রাণ অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছেন। দক্ষিণ এশিয়ার ছোট্ট এই দেশ বাংলাদেশেও এমন মানুষেরা ছিলেন, আছেন। শহীদি কাফেলা বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের কিছু ত্যাগী প্রাণ সবুজ-শ্যামল এই জমিনে ইসলামের সুমহান আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য নিজেদের প্রাণ উৎসর্গ করেছেন। তাঁদের মধ্যে শহীদ আব্দুল জব্বার এক বিরল দৃষ্টান্ত। তিনি বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের চতুর্থ শহীদ।
ব্যক্তিগত পরিচয় ও শিক্ষাজীবন
তিনি নওগাঁ জেলার ধামইরহাট থানার চকময়রাম গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মো: জমির উদ্দিন। আব্দুল জব্বারের পরিবারের সদস্য সংখ্যা ছিল ১০ জন, তার মধ্যে ভাই-বোন ছিল ৬ জন। ভাই-বোনদের মাঝে তিনি ছিলেন সবার বড়। তিনি চকময়রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা লাভ করেন চকময়রাম উচ্চবিদ্যালয় থেকে। এরপর নওগাঁ নিউ গভ. ডিগ্রি কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। তারপর তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগে অনার্সে ভর্তি হন। শাহাদাতের সময়ে তিনি রসায়ন বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাংগঠনিক মানের দিক দিয়ে তিনি একজন কর্মী ছিলেন।
১৯৮২ সালের ১১ মার্চ। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এ দিনটি হতে পারতো একটি প্রাণোচ্ছল দিন। এ দিন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের উদ্যোগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নবাগত ছাত্রদের সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়েছিল। সংবর্ধনায় যোগদানের জন্য নবাগত ছাত্রদের মধ্যে সাড়া পড়ে গেল। নবীন ছাত্রদের হৃদয়ের মণিকোঠায় ইসলাম ও ইসলামী আদর্শের বিজয় মেনে নেয়ার মতো পাত্র ছিল না ছাত্রলীগ, ছাত্রমৈত্রী ও ছাত্র ইউনিয়নের দুর্বৃত্তরা। কিন্তু নৈতিক শক্তি ও জনসমর্থনে দুর্বল এসব সংগঠন আদর্শিকভাবে ছাত্রশিবিরের মোকাবেলা করতে সাহস পাচ্ছিল না। ওদিকে বসে থাকার মতো ধৈর্যও তাদের ছিল না। মরণকামড় বসাতে হবে ছাত্রশিবিরের ওপর। তাই অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে সম্মিলিতভাবে আক্রমণ চালায় ছাত্রশিবিরের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে। মুহূর্তের মধ্যে হাসি আর আনন্দের পরিবর্তে মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয় পুরো ক্যাম্পাস। গুলি, বোমা, চাপাতি প্রভৃতি দিয়ে ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীদের ওপর চললো সভ্যতার নৃশংসতম বর্বরতা। মুহূর্তেই থেমে গেল কয়েকটি তাজা প্রাণ। সেদিন দুর্বৃত্তদের আক্রমণের শিকার হয়ে অনেকে দীর্ঘদিন যাবৎ মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের মেধাবী ছাত্র আব্দুল জব্বার তাঁদের একজন। ১১ মার্চ, ১৯৮২; ছাত্রলীগ, ছাত্র মৈত্রীর সন্ত্রাসীরা তাঁর বুকের পাঁজরগুলো মর্মান্তিকভাবে থেঁতলে দেয়। অনেকদিন ধরে চিকিৎসা করালেও পৃথিবীতে এমন কোনো চিকিৎসক ছিলেন না যিনি তাঁকে আগের মতো সুস্থ করে দিতে পারেন।
দেশের প্রখ্যাত সব চিকিৎসক ব্যর্থ হলেন আব্দুল জব্বারের চিকিৎসায়। আহত আব্দুল জব্বার অসহ্য ব্যথার দরুন পরবর্তীতে আর কোনো পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেননি। শেষে মায়ের ছেলে মায়ের কোলেই প্রত্যাবর্তন করেন। আল্লাহর কাছে যাঁর জন্য উত্তম আবাসস্থলের ব্যবস্থা রয়েছে, ক্ষণিকের এই পৃথিবীর মায়া তাঁকে ধরে রাখতে পারে না। তেমনি আব্দুল জব্বারকেও ধরে রাখা যায়নি। মায়ের স্নেহ, বাবার ভালোবাসা, পরিবারের বন্ধন, জগতের মায়া সব কিছু ছিন্ন করে ২৮ ডিসেম্বর, ১৯৮২ সালে আব্দুল জব্বার পৌঁছে যান তাঁর পরম প্রভুর দরবারে (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন)।
সাংগঠনিক জীবন
শহীদ আব্দুল জব্বার ছেলেবেলায় সংগঠনের সাথে পরিচিত ছিলেন না। তিনি নিউ গভ. ডিগ্রি কলেজে থাকাকালে আওয়ামী ছাত্রলীগের সমর্থক ছিলেন। কিন্তু তিনি নিয়মিত নামাজ পড়তেন এবং নামাজের প্রতি খুবই যত্নশীল ছিলেন। শহীদ আব্দুল জব্বারের আল্লাহর সাথে গভীর সম্পর্ক ছিল সেটা বোঝা যেত তাঁর উঠা-বসা ও চলাফেরার মাধ্যমে। নামাজ অনেকক্ষণ ধরে পড়তেন এবং মসজিদে অবস্থান করতেন। বিভিন্ন সময়ে আলাপ-আলোচনার মধ্যে আল্লাহর প্রতি গভীর ভালোবাসার পরিচয় পাওয়া যেত। যদিও তিনি তখন আওয়ামী ছাত্রলীগের সমর্থক ছিলন। তিনি সব সময় সমাজের দুস্থ মানুষের কথা বলতেন এবং বেশ চিন্তাভাবনা করতেন আর বলতেন, এই সমাজ পরিবর্তনের জন্য একদল কর্মীবাহিনীর দরকার যারা করতে পারে এই সমাজের পরিবর্তন। তিনি প্রায়ই একটি প্রবাদ বলতেন, ‘পৃথিবীটা বড় কঠিন, পৃথিবীকে জানা খুব কষ্ট এবং পৃথিবীর মানুষকে চেনা খুব কঠিন।’
শহীদ আব্দুল জব্বার ১৯৮০ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগে ভর্তি হন। প্রথমে তিনি রানীনগর হামিদ বাড়ির একটি মেসে অবস্থান করতেন। পরবর্তীতে তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু আব্দুল খালেকের আহবানে আমীর আলী হলের ১১৭ নম্বর কক্ষে তাঁর বন্ধুর সাথে অবস্থান করতে থাকেন। তাঁর বন্ধু আগেই সংগঠনের দাওয়াত পেয়ে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের ছায়াতলে চলে আসেন। শহীদ আব্দুল জব্বার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি অবস্থায়ও প্রথমদিকে ছাত্রলীগের সমর্থক ছিলেন। কিন্তু তাঁর বন্ধু আব্দুল খালেক সংগঠনের সাথে জড়িত হলেও তাদের মাঝে সম্পর্কের তেমন কোনো অবনতি হয়নি। আব্দুল খালেকের রুমে থাকা অবস্থায় কোনো দিন তিনি তাঁকে শিবিরের কথা বলেননি। হলে আসার পর অন্য কর্মীদের ব্যবহারের ফলে শিবিরের পতাকাতলে আসেন আব্দুল জব্বার। তারপর তিনি বলতেন, ‘আমি অনেক আগে থেকে এ ধরনের সংগঠনের কথা চিন্তা করতাম, যারা পারবে সমাজের কুসংস্কারপূর্ণ কাঠামোর পরিবর্তন করে একটি আদর্শবাদী নতুন সমাজ গড়তে। শিবিরের ভেতর এ ধরনের গুণাবলিসম্পন্ন কর্মীবাহিনী দেখতে পাওয়া যাচ্ছে।’ যে ছেলেটি এতদিন শিবিরের কথা শুনতে পারতেন না, সে-ই বলতে লাগলেনÑ এতদিন শিবির থেকে দূরে থেকে বড় ভুল করেছি। সংগঠনে আসার পর থেকে তিনি এত দ্রুতগতিতে অগ্রসর হয়েছিলেন যে, সবার চোখে তিনি অনুপ্রেরণার লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি কয়েক মাসের মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলি অর্জন করতে সক্ষম হন। তিনি সবার সাথে বন্ধুসুলভ ভালোবাসা গড়ে তুলেছিলেন। তাঁর মাঝে যে বৈশিষ্ট্যটি বেশি লক্ষ্য করা গিয়েছিল সেটা হচ্ছে নেতৃত্বের প্রতি চরম আনুগত্য ও পরস্পরের প্রতি উদার ও বন্ধুত্বসুলভ আচরণ। তিনি সংগঠন এবং সংগঠনের ভাইদের এত ভালোবাসতেন যে, তাঁর ব্যবহারের মাধ্যমে তা ফুটে উঠত। তবে সেটা বেশিদূর অগ্রসর হতে পারেনি। এভাবে কিছুদিন যেতে না যেতেই অকালে ঝরে পড়লেন তিনি। ১৯৮২ সালের ১১ মার্চ একদল উগ্র ও রক্তপিপাসু কুচক্রীর হাতে গুরুতর আহত হন। এই অবস্থায় তিনি প্রায় দশ মাস চরম যন্ত্রণার মধ্যে দিন কাটান। দশ মাসের মধ্যে তিনি প্রায় নয় মাস হলে ছিলেন এবং একমাস মাত্র বাড়িতে ছিলেন। বুকে গুরুতর আঘাত লাগার কারণে চলাফেরা করতে পারতেন না। প্রায় সময় বিছানায় শুয়ে থাকতেন। এ অবস্থায়ও তিনি বাড়ি যাননি, বাড়ি যাওয়ার কথা বললে বলতেন যে, ‘বাড়িতে আমার ভালো লাগে না, সংগঠনের ভাইদের দেখে শান্তি পাই।’ তাঁর এ কথায় বোঝা যায় সংগঠন এবং সংগঠনের ভাইয়েরা তাঁর কাছে কত আপন ছিল।
শহীদ আব্দুল জব্বারের আহত অবস্থার একটি স্মরণীয় ঘটনা
আহত অবস্থায় হলে থাকাকালে তাঁর বন্ধু আব্দুল খালেক তাঁর দেখাশোনা করতেন। একদিন তাঁর বন্ধু সংগঠনের কাজে বাইরে গিয়েছিলেন। তিনি রুমে এসে দেখেন আব্দুল জব্বার রুমে নেই। রুমের এক বড় ভাইকে জিজ্ঞাসা করা হলো আব্দুল জব্বার কোথায়? তিনি জবাব দিলেন আব্দুল জব্বারকে কিছুক্ষণ আগে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি। তাঁর বুকের ব্যথার কারণে চলাফেরা করতে পারত না, তাই সবাই উদ্বিগ্ন। বন্ধু খালেক ও আরো কয়েকজনে খোঁজাখুঁজি শুরু করলেন। কোথাও তাঁকে পাওয়া যায়নি। তখন রাত প্রায় সাড়ে নয়টা। তারা খোঁজাখুঁজির একপর্যায়ে মসজিদে গেলেন এবং দেখতে পেলেন অন্ধকারের ভেতর মসজিদের এককোণে দুই হাত তুলে বসে ক্রন্দন করছেন তিনি। আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করছেন এই বলে, ‘হে আল্লাহ! আমি তো অপরাধ করিনি, আমি তো কারো ক্ষতি করিনি, কেন তারা আমার এ অবস্থা করলো? না, আমার অপরাধ আমি ঈমান এনেছি এবং ইসলামী সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়েছি। হে আল্লাহ! তুমি এই সংগঠনকে শক্তিশালী কর। তুমি এই জমিনে তোমার দ্বীনকে বিজয়ী করে দাও এটাই আমার কামনা আর এটাই বাসনা।’ এই ঘটনা থেকে বুঝা যায় তিনি দ্বীনকে কতটা ভালোভাবে বুঝেছিলেন এবং দ্বীনের প্রতি তাঁর কতটা ভালোবাসা।
আর একদিনের ঘটনা, শহীদ আব্দুল জব্বার বুকের ব্যথায় ছটফট করছেন, তখন তাঁকে তাঁর বন্ধু বললেন, তোর খুব কষ্ট হচ্ছে তাই না? তখন তিনি উত্তর দেন, কষ্ট নারে কষ্ট না, এই তো আমার আত্মতৃপ্তি। আমার আত্মতৃপ্তি এই জন্য যে, আমি মহান পরাক্রমশালী আল্লাহর ওপর ঈমান এনেছি। ইসলামের দুশমনরা আমাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। এতো আমার চাওয়া, এতো আমার পাওয়া। শাহাদাত মুুমিন জীবনের কাম্য, তাইতো আমার কামনা, আমার বাসনা ছিল। এইভাবে কঠিন যন্ত্রণার মাঝে জীবন অতিবাহিত হতে থাকে, কিন্তু কোনো দিন তাঁর মাঝে কোনো হতাশা দেখা যায়নি। শহীদ আব্দুল জব্বার ভাই সকল ইসলামী কর্মী ভাইয়ের আদর্শের প্রতীক হয়ে আছেন।
জানাজা ও দাফন
পরিবারের আশা-ভরসার আশ্রয়স্থল আব্দুল জব্বারের বিয়োগব্যথায় চকময়রামের আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। শাহাদাতের সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে রাজশাহী ও নওগাঁর প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শহীদের সাথীরা এবং শোকাভিভূত জনতা শহীদের বাড়িতে এসে ভিড় করে। সেখানে জানাজা নামাজ শেষে চকময়রামপুর গ্রামে পারিবারিক কবরস্থানে আব্দুল জব্বারকে দাফন করা হয়।
শহীদ হওয়ার পূর্বে তাঁর স্মরণীয় বাণী
ইসলামী আন্দোলনের অগ্রপথিক শহীদ আবদুল মালেক সমাজের পরিবর্তন নিয়ে ভাবতেন। অন্যায় এবং কুসংস্কারপূর্ণ সমাজকে কিভাবে পরিবর্তন করা যায় সেই ভাবনায়-ই লিপ্ত থাকতেন। আর তাঁর অগাধ বিশ্বাস ছিল তারুণ্যনির্ভর দল বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরই এ ঘুণে ধরা সমাজে পরিবর্তন আনতে পারবে। শহীদ আব্দুল জব্বার কবি নজরুলের “আমার যাবার সময় হলো দাও বিদায়.....” এই গানটি বেশি গাইতেন। বন্ধুরা তাঁকে এই গান গাওয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলতেন, ‘আর কতদিন বাঁচবো! কখন যে ঝরে পড়ব কেউ জানে না।’
পারিবারিক কাজে সহযোগিতায় আব্দুল জব্বার
শহীদ আব্দুল জব্বারের পরিবারের প্রধান পেশা ছিল কৃষি। তিনি পড়াশোনায় যেমন নিয়মিত ছিলেন, তেমনি পরিবারের সকল কাজে সাহায্য করতেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাড়ি এলে নিজ হাতে শাক-সবজির চাষ করতেন। পারিবারিক কৃষিকাজে কৃষকদের সাথে কাজ করতেন, আর প্রচুর মাছ ধরতেন।
শাহাদাতের পর শহীদের পিতার প্রতিক্রিয়া
শহীদ আব্দুল জব্বারের পিতা মো: জমির উদ্দিন ছিলেন অত্যন্ত ধৈর্যশীল ও আল্লাহভীরু মানুষ। তাই তিনি পুত্রকে হারিয়ে ধৈর্যহীন না হয়ে অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে বলেছিলেন, ‘আমার ছেলে ইসলামের পথে শহীদ হয়েছে এতে আমার কোন দুঃখ নেই। আল্লাহর কাছে দোয়া করি আল্লাহ যেন তাঁকে শহীদ হিসেবে কবুল করে নেন।’ পরবর্তীতে শোকাহত বাবা পুত্রশোকে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং তিনি প্যারালাইজড হয়ে যান। অবশেষে পুত্রশোকে তিনিও পরলোকগমন করেন।
মায়ের প্রতিক্রিয়া
বড় ছেলের শাহাদাত বরণের সাথে সাথে শহীদ জননী সকিনা বিবি কান্না শুরু করে দেন। অনেক কষ্টে তিনি ধৈর্য ধারণ করেন। আল্লাহর কাছে তিনি দোয়া করেন তিনি যেন তাঁকে একজন শহীদ হিসেবে কবুল করে নেন।
ভাইয়ের প্রতিক্রিয়া
শহীদ আব্দুল জব্বারের ছোটভাই জিল্লুর রহমান বলেন, সংগঠনের নেতাকর্মীরা যেন ইসলামী আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য সম্পর্কে সজাগ থাকে। এমন কোনো কাজ করা ঠিক নয় যা সংগঠনের সুনাম ক্ষুণœ করবে।
দীর্ঘ চৌদ্দ’শ বছর আগে হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর মাধ্যমে হেরা গুহায় যে জ্যোতি বিচ্ছুরিত হয়েছিল, সেই জ্যোতিকে নিঃশেষ করে দেয়ার জন্য সেইদিন থেকেই অপচেষ্টা চলছে। কিন্তু ইসলামের ত্যাগী কিছু সৈনিকের কারণে সেই অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। এতে প্রাণ দিতে হয়েছে অনেককেই। শহীদ আব্দুল জব্বার তাঁদের অন্যতম। তিনি ইসলামের জন্য প্রাণ দিয়ে আমাদের অনুকরণীয় আদর্শে পরিণত হয়ে আছেন। আমরা তাঁর কাছ থেকে অনেক উৎসাহ পেতে পারি।
আজো কাঁদায়
৮২ সালের ১১ মার্চের নারকীয় ঘটনায় জুলুম নির্যাতন আর আহতদের হৃদয়বিদারক করুণ দৃশ্যের অবতারণায় শোকের ছায়া নেমে আসে। সবার বিবেক স্তব্ধ হয়ে যায়। পত্রিকা, রেডিও, টিভি প্রচার মিডিয়াসহ সর্বমহলে এই নৃশংসঘটনা ব্যাপকভাবে আলোচিত হয় ধারাবাহিকভাবে! ফলে শিবিরের প্রতি বিবেকবানদের মানবিক সহানুভূতি আলৌকিকভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে। সরকারি বেসরকারি হাজার জনতার উপচেপড়া ভিড় আর আহতদের ক্ষত-বিক্ষত দেহ গগনবিদারী আহাজারির দৃশ্যাবলী অবলোকন করে কেউ পারেনি অশ্রু নিবারণ করতে।
ছাত্রনেতা মামুনের সাতদিন পরও জ্ঞান ফেরেনি। উন্নত চিকিৎসা আর অমানবিক ঘটনার জন্য তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তারও ছুটে যান রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। তিনিও তীব্র প্রতিবাদ ও ঘৃণা প্রকাশ করেন। আর অজ্ঞান মামুনের উন্নত চিকিৎসার জন্য সরকারি হেলিকপ্টার যোগে ঢাকা সামরিক-হাসপাতালে পাঠানোর নির্দেশ দেন। রাষ্ট্রপতির মহতি উদ্যোগ এবং শিবিরের নেতা কর্মীদের ত্যাগ কুরবানি সর্বোপরি শাহাদাতের ঘটনা শিবিরের ইতিহাসে সর্বপ্রথম নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। ইসলামী ছাত্রশিবির এই ১১ মার্চকে শহীদ দিবস হিসেবে পালন করে আসছে।
১৯৮২ সালের ১১ মার্চ যেই আলো নিভিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল তা আজ লাখো তরুণের পথের দিশা। শত জুলুম, নির্যাতন উত্তাল তরঙ্গমালার এক সাগর রক্ত পেরিয়ে আল্লাহর দ্বীনের বান্দারা আজ মিলিত হয়েছে ইসলামী ছাত্রশিবিরে। লাখো নাবিক আর পথহারা যুবকের দল ভিড় জমাচ্ছে এই কাফেলা বিপ্লবী মিছিলে। শত শত বেদনার প্রতিচ্ছবি ইসলামী আন্দোলনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে আছে।
তথ্যসূত্রঃ স্মৃতি অমলিন এবং ছাত্রশিবিরের ওয়েবসাইট
#11MarShahidDibosh
#11Mar #ShahidDibosh
তথ্যসূত্রঃ স্মৃতি অমলিন এবং ছাত্রশিবিরের ওয়েবসাইট
#11MarShahidDibosh
#11Mar #ShahidDibosh
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন