২১ মার্চ, ২০১৬

ভারতের পানি আগ্রাসন: নির্যাতিত বাংলাদেশ


কাগজে কলমে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। কিন্তু প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের সাথে এর সম্পর্ক আসলে তা পুরোপুরি মীন করেনা। এদেশের পররাষ্ট্রনীতির মূল লক্ষ্য “সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে শত্রুতা নয়”। এ মূলনীতির ভিত্তিতে সকলের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন ও সহাবস্থানে বাংলাদেশ আন্তরিকভাবে বিশ্বাসী। কিন্তু বাংলাদেশের সাথে ভারত কখনই সেরকম আন্তরিক সুপ্রতিবেশী ও বন্ধুসুলভ মনোভাব দেখায়নি। বরং এদেশের জন্মলগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত আমাদের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, জাতীয় নিরাপত্তা, রাজনীতি ও অর্থনীতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভারত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে একের পর এক আগ্রাসন নীতি চালিয়ে যাচ্ছে। স্বাধীনতার পর থেকে যুদ্ধাস্ত্র ও খুলনার পাটকলগুলোর যন্ত্রাংশ লুণ্ঠন থেকে শুরু করে তিন বিঘা করিডোর, বেরুবাড়ি, দক্ষিণ তালপট্টি দখল, ফারাক্কাবাঁধ নির্মাণ, সীমান্ত সন্ত্রাস, চোরাচালান, নির্বিচারে নিরীহ নাগরিক ও কৃষকদের পাখির মত গুলি করে হত্যা, পুশ ইন, সীমান্ত রেখা অতিক্রম করে বাংলাদেশের ভেতরের নদীর চর ও কৃষি জমি দখল করা, ফসল কেটে নিয়ে যাওয়া, আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করে নৌ ও সমুদ্র সীমালঙ্ঘন, মাদক পাচার, স্বর্ণ চোরাচালান দেশের ভেতরে গুপ্তচর নিয়োগ ইত্যাদি গুরুতর সমস্যা সৃষ্টি করে একের পর এক বাংলাদেশকে ক্ষত-বিক্ষত করে তুলছে।

ফারাক্কা বাঁধ :
নদীমাতৃক বাংলাদেশে ছোটবড় সব মিলিয়ে ২০০টিরও বেশি নদ-নদী রয়েছে। এছাড়াও, ছড়া, নদী, খাল-বিল, হাওড়-বাওড় ইত্যাদি রয়েছে অসংখ্য। এসব নদীর মধ্যে ৫৭টি হল আন্তর্জাতিক নদী যার মধ্যে ৫৪টির উৎস তিব্বত (চীন), নেপাল, ভুটান ও ভারত থেকে। বাকি ৩টি এসেছে মিয়ানমার থেকে । বাংলাদেশের অবস্থান ভাটি অঞ্চলে হওয়ায় উজানে যে কোন ধরনের পানি নিয়ন্ত্রণের প্রত্যক্ষ প্রভাব বাংলাদেশই ভোগ করবে। কিন্তু সেদিকে দৃষ্টিপাত না করে কোলকাতা বন্দরের নাব্যতা বৃদ্ধির অজুহাতে ভারত পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার রাজমহল ও ভগবানগোলার মাঝে ফারাক্কা নামক স্থানে এক মরণবাঁধ নির্মাণ করে। এই বাঁধের অবস্থান চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার পশ্চিম সীমানা থেকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার (১১ মাইল) উজানে গঙ্গা নদীর ওপর। ১৯৬১ সালে এর মূল নির্মাণ কাজ হাতে নেয়া হয় যা ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বর মাসে শেষ হয়। ১৯৭৫ সালে ২১ এপ্রিল থেকে ২১ মে এই ৪১ দিনের জন্য অস্থায়ী ও পরীক্ষামূলকভাবে ফারাক্কা বাঁধটির সকল ফিডার ক্যানেল চালু করে। কিন্তু প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে নির্দিষ্ট সময়ের পর থেকে এটা ভারত আজ পর্যন্ত বন্ধ করেনি। ১৯৭৭ সালের চুক্তিতে কিছুটা সফলতা থাকলেও ১৯৯৬ সালের ৩০ বছর মেয়াদি চুক্তির সফলতা কাগজ-কলমেই সীমাবদ্ধ থাকে। কারণ এর গ্যারান্টি ক্লজ বা অঙ্গিকার অনুচ্ছেদ না থাকায় বাস্তবে ফলাফল প্রায় শূন্য। এই শত্রুভাবাপন্ন মনোভাবের কারণে আমাদের মত একটি ঘনবসতিপূর্ণ কৃষিনির্ভর দেশ আজ বিপন্ন। বিপন্ন এদেশের নদী, মাটি, কৃষি, বনজ সম্পদ, বন্যপ্রাণী, পাখি, মৎস্য ও পরিবেশ। এই জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ ধ্বংসের প্রধান কারণ ফারাক্কা বাঁধ। এই বাঁধের প্রভাবে দেশের মানচিত্র থেকে প্রায় ২০টি নদী মুছে গেছে এবং প্রায় ১০০টি নদীর মরণদশা (পত্রপত্রিকার তথ্য অনুযায়ী)। আর বাকিগুলোর বুকে চর জেগে ইতোমধ্যে জনবসতি শুরু হয়েছে এবং একই নদী একাধিক ক্ষুদ্র ধারায় প্রবাহিত হচ্ছে। স্রোত না থাকায় এদেশের নদীগুলোর তলদেশে পলি জমে এর উচ্চতা বেড়ে যাওয়া ও নদীসংখ্যা কমে যাওয়ায় প্রতি বছর অত্যধিক নদীভাঙনের কারণে শত শত কোটি টাকার সম্পদ বিনষ্ট হচ্ছে। এর ওপর আবার ব্যয়বহুল ও দীর্ঘমেয়াদী আন্ত:নদী সংযোগ প্রকল্প!


ভারতের আন্ত:নদী সংযোগ প্রকল্প :
ভারত আগামী ৫০ বছরের ক্রমবর্ধমান পানির চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র এবং এর সকল অববাহিকার নদ-নদীর পানি বাঁধ, জলাধার ও সংযোগ খালের মাধ্যমে প্রত্যাহার করে ভারতের বিভিন্ন রাজ্য ঘুরে দক্ষিণের কাবেরী নদী পর্যন্ত টেনে নেবে এবং রাজস্থানের থর মরুভূমিসহ ঐ সকল রাজ্যের খরাপীড়িত অঞ্চলে পানি সরবরাহের জন্য যে মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে এটাই River Linking Project বা আন্ত:নদী সংযোগ প্রকল্প। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতের এই “রিভার লিংকিং প্রজেক্ট” এ ব্যয় হবে প্রায় ২শ’ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ লক্ষ্যে ইতোমধ্যেই আন্ত:নদী সংযোগের ক্ষেত্রে দু’বার সমীক্ষার কাজ সম্পন্ন করেছে।
এই প্রকল্পের আওতায় ৩৮টি ছোট-বড় নদীর পানিপ্রবাহকে ৩০টি আন্ত:সংযোগ খালের মাধ্যমে ফারাক্কা বাঁধের ভেতর দিয়ে যুক্ত করা হবে এবং এধরনের সংযোগ ঘটিয়ে ৭৪টি জলাধারে পানি সংরক্ষণ করে পানিপ্রবাহ ভারতের উত্তর, পশ্চিম ও দক্ষিণাঞ্চলের খরাপ্রবণ রাজ্যগুলোতে বণ্টন করে কৃষিকাজে ব্যবহার করা হবে। ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার পানি প্রবাহ পশ্চিমবঙ্গের উড়িষ্যা হয়ে দক্ষিণ ভারতের অন্ধ্র প্রদেশ ও কর্ণাটক দিয়ে তামিলনাড়ু পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হবে। গঙ্গার পানি পৌঁছবে উত্তর প্রদেশ, হরিয়ানা, রাজস্থান এবং গুজরাটে। উভয় দিকের প্রবাহ প্রায় ১০ হাজার কিলোমিটার ঘুরিয়ে আবার একত্রে আনা হবে। তাছাড়া ৯টি বড় এবং ২৪টি ছোট ড্যামের সমন্বয়ে ৪টির মাস্টারপ্লান তৈরি করতে নেপাল ও ভূটানের সহযোগিতা কামনা করা হয়েছে। পুরো প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্যে গত ২৮/০৬/০৬ তারিখে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত বৈঠকে সুবর্ণরেখা-মহানন্দা (৩৭৩ কিলোমিটার), গঙ্গা-দামোদর-সুবর্ণরেখা (৩৯৩ কিলোমিটার), ফারাক্কা-সুন্দরবন (৬০৩ কিলোমিটার) এবং যোগীগোপা-তিস্তা-ফারাক্কা (৪৪০ কিলোমিটার) পর্যন্ত সংযোগের কথা পুনর্ব্যক্ত করেছে (সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ৩০/০৬/০৬)। এই আন্ত:নদী সংযোগ প্রকল্পের সাথে বাংলাদেশের জন্য আর একটি ভয়াবহ ও বিপজ্জনক মরণফাঁদ টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্প। এই প্রকল্প এলাকা সিলেট শহর থেকে ২০০ কিলোমিটার (১২৪ মাইল) এবং সিলেটের জকিগঞ্জের অমলসাদ সীমান্ত থেকে ১০০ কিলোমিটার (৬১ মাইল) উজানে মণিপুর রাজ্যের বরাক উপত্যকার চারাচাঁদপুর টুইভাইয়ের সঙ্গমস্থলে অবস্থিত। এই টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্পে ১৬ লাখ ৮০ হাজার হেক্টর মিটার ধারণক্ষমতাসম্পন্ন একটি জলাধার ও বাঁধ নির্মাণের কাজ বর্তমানে এগিয়ে চলছে। বিকল্পপথে পানিপ্রবাহের জন্য বৃহদাকার দু’টি স্লুইসগেট এবং দুটি সুড়ঙ্গ জলপ্রবাহের পথ তৈরি করে সেখানে ১৫শ’ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা হচ্ছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়নে খরচ হবে ৫,১৬৩ কোটি টাকা। এক তথ্য মতে, এই বাঁধটি হবে ১২৫ মিটার উঁচু এবং ৩৯০ মিটার দীর্ঘ। এতে মোট ১৫.৯ হাজার মিলিয়ন ঘনমিটার পানি মজুদ করে রাখার ব্যবস্থা থাকবে। পানি মজুদ করে ভারত বিদ্যুৎ উৎপাদন, সেচ, নৌচলাচল সুবিধা এবং শুষ্ক মৌসুমে পানির প্রবাহ বৃদ্ধির উদ্যোগ নিয়েছে। টিপাইমুখে বাঁধ দেয়ার ফলে বর্ষা মৌসুমে সিলেট অঞ্চলে ভয়াবহ বন্যার আশঙ্কা দেখা দেবে এবং এর ফলে সিলেট, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ এলাকার প্রায় ২ লক্ষ একর জমির ফসল ধ্বংস হয়ে যাবার আশঙ্কা থাকবে। এর সাথে প্রায় ১০০ কোটি টাকা ব্যয়ে মনু প্রকল্পের কার্যকারিতা আস্তে আস্তে অচল হয়ে পড়বে। এই বাঁধ শুষ্ক মৌসুমে মেঘনার মূল স্রোতধারা সুরমা ও কুশিয়ারাসহ সংশ্লিষ্ট সকল নদীর পানিপ্রবাহ ভীষণভাবে হ্রাস করবে। ভারত কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন উল্লিখিত আন্ত:নদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল বিশেষ করে পুরো সিলেট অঞ্চল (সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার জেলা), ময়মনসিংহ অঞ্চলের পূর্ব, কুমিল্লা অঞ্চলের উত্তর এবং ঢাকার পূর্বাঞ্চল বিরাণ ভূমিতে পরিণত হবে। পরিবেশগত বিরূপ প্রভাবে জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যাবে। পক্ষান্তরে, উচ্চাভিলাসী আন্ত:নদী সংযোগ প্রকল্পের মাধ্যমে গঙ্গা ও পুরো ব্রহ্মপুত্র, সংকোশ এবং তিস্তাকে সংযোগ করে বিশাল পানিপ্রবাহ থেকে ১৭৩ বিলিয়ন ঘনমিটার পানি সরিয়ে নিতে সক্ষম হবে। ভারতীয় বিশেষজ্ঞদের মতে, এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে প্রাপ্ত উক্ত পরিমাণ পানি দিয়ে ভারতের ৩৪ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে সেচ দিয়ে কৃষিকাজ করা সম্ভব হবে এবং আরো ৮ লক্ষ হেক্টর জমিতে ভূ-গর্ভস্থ পানি পাওয়া সম্ভব হবে। তবে, ইউরোপীয় বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন, এই প্রকল্পের ফলে হিমালয় হতে নি:সৃত নদীসমূহের ৩৫ ভাগ পানি বাষ্পাকারে আকাশে উড়ে যাবে। ফলে রাশিয়ার একদা উচ্চাভিলাষী প্রকল্প যেমন- বুমেরাং-এ পরিণত হয়েছিল, ভারতও সেরকম ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে বলে উক্ত বিশেষজ্ঞগণ অভিমত পোষণ করেছেন।


ফারাক্কা বাঁধ ও আন্ত:নদী সংযোগ প্রকল্পের ক্ষতিকর প্রভাবঃ
ফারাক্কা বাঁধের ফলে বাংলাদেশের যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে এবং হচ্ছে, এই আন্ত:নদী প্রকল্পের বাস্তবায়নে তাতে শুধু আরেকটা মাত্রা সংযোজনই করবে না বরং অর্থনীতি, রাজনীতি ও পরিবেশের বিপর্যয়ে উল্লেখযোগ্য নেতিবাচক ভূমিকা রাখবে। আন্ত:নদী সংযোগ প্রকল্পে খোদ পশ্চিমবঙ্গ সরকারও তাদের অংশের পরিণতির জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে প্রবল আপত্তি জানিয়েছে। 

(১) বিস্তৃত অঞ্চল মরুকরণ : গঙ্গানদীতে ফারাক্কা বাঁধ দেয়ার ফলে ইতোমধ্যে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম, উত্তর-পূর্ব মধ্যাঞ্চলের সকল নদ-নদীর পানি আসে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা ও মেঘনা থেকে। এসব নদী এবং এর উপনদীগুলোর উৎপত্তি প্রতিবেশী দেশ ভারত, নেপাল, তিববত (চীন) ও ভুটানে অবস্থিত হিমালয়ের হিমবাহ থেকে। এগুলো আন্তর্জাতিক নদী। এই নদীগুলোর পানি কোন দেশের একক সম্পদ নয় বরং এসব নদীর পানিপ্রবাহ সকল দেশের ঐক্যমতের ভিত্তিতে সুষম বণ্টনের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আইন ও নীতিমালা রয়েছে। কিন্তু ভারত সরকার আন্তর্জাতিক কোন আইনের তোয়াক্কা না করে বরং পেশিশক্তির জোরে গঙ্গা নদীর ওপর ফারাক্কা বাঁধের মত উচ্চাবিলাসী প্রকল্প চালু করে পুরো বাংলাদেশের বেশিরভাগ অঞ্চলে আজ পানির জন্য হাহাকার অবস্থা বিরাজ করাচ্ছে। এছাড়া দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল এখন মরুকরণের মত ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। নদীমাতৃক এই দেশটির বেঁচে থাকার অন্যতম উৎস পানি। এই পানিকে ভারত ফারাক্কা বাঁধের পর দ্বিতীয় উচ্চাভিলাসী প্রকল্প হিসেবে আন্ত:নদী সংযোগ প্রকল্প (River Link Project) হাতে নিয়েছে। 

বাংলাদেশের মোট পানিপ্রবাহের ৬৫ থেকে ৬৭ শতাংশ আসে ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে। বিশেষ করে ব্রহ্মপুত্রের শুকনো মৌসুমে গড় পানিপ্রবাহ ১,২৩,০০০ কিউসেক। এর ভেতর ঐ ক্যানালে নিয়ে যাওয়া হবে ১,০০,০০০ কিউসেক এবং গঙ্গা নদীর শুকনো মৌসুমে পানিপ্রবাহ ৮০ হাজার কিউসেক (কম বেশি হতে পারে) এর মধ্যে ৪৪ হাজার কিউসেক প্রত্যাহার করে ঐসব ক্যানালে প্রবাহিত করা হবে। ফারাক্কা বাঁধের পর দ্বিতীয় বার এই আন্ত:নদী সংযোগ মেগাপ্রকল্প ছাড়াও মেঘনা, সুরমা ও কুশিয়ারার মূল উৎস বরাক নদীর উজানে ভারতের মণিপুর রাজ্যের টিপাঁই গ্রামের চারাচাঁদপুর টুইভায়ের সঙ্গমে টিপাইমুখ নামক স্থানে বরাক নদীতে কৃত্রিম বাঁধ দিয়ে বিদ্যুৎ প্রকল্প চালু (Hydro Electric Power Plant) করার কর্মসূচী হাতে নিয়েছে। সে লক্ষ্যে ২০০৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাঁধ প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। সিলেট জেলার জকিগঞ্জ সীমান্ত থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার উজানে নাগা-মণিপুর রাজ্যে এই বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু করেছে। এই সব মেগাপ্রকল্প ছাড়া আরও ২২টি নদী শাখা-প্রশাখা থেকে প্রবাহিত পথে বাঁধ দিয়ে নানারকম প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেছে। এগুলোর মধ্যে তিস্তা, মহানন্দা, করতোয়া, গুমতি, খোয়াই, মনু, কোদালিয়া, ইসালিছড়া, ফুলছড়ি, আধার মানিকছড়া, ছাগলনাইয়া ছড়া, মহামায়া ছড়া, গইরাছড়া, গজারিয়া ছড়া, কাচুয়া ছড়া, মাবেস নদী ছড়া, মাতাই ছড়া, উজিরপুর ছড়া, চন্দান ছড়া, রাজেশপুর তেতনা ছড়া, কমলা ছড়া ও ভৈরব সঙ্গলী নদী উল্লেখযোগ্য। এ সকল নদীর পানিপ্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করায় ইতোমধ্যে পরিবেশ ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সারা বাংলাদেশে ভীষণভাবে প্রভাব পড়েছে। এই সব মরণ ফাঁদ প্রকল্পের ফলে পুরো বাংলাদেশের ভবিষ্যত পরিণতি হবে অত্যন্ত ভয়াবহ।

ভূমিরূপের স্বাভাবিক স্তরের বিপরীতে এ ধরনের কৃত্রিম খাল বাংলাদেশের নদীর স্বাভাবিক প্রবাহকে বিঘ্নিত করছে এবং করবে। এছাড়াও এ ধরনের কর্মসূচী পুরো দেশের জল নিষ্কাশন ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণভাবে ব্যাহত করবে। এই আন্ত:নদী সংযোগ থেকে ভারত যদি এই বিশাল পানিপ্রবাহ একসাথে প্রত্যাহার করে নেয় তাহলে বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদন ভীষণভাবে ব্যাহত হবে এবং শিল্প উৎপাদন, সেচ, শক্তি, বনায়ন, মৎস্যসম্পদ প্রভৃতির ওপর যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে তাতে সারা বাংলাদেশের নদী অববাহিকা অঞ্চলে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত বড় ধরনের বিপর্যয় ডেকে আনবে।

পানির দেশের মানুষ পানির জন্য এ রকম হাহাকার! মাছের দেশের মানুষ মাছের জন্য হাহাকার! কোন সচেতন মানুষ এসকল দৃশ্য নিজের চোখে না দেখলে বুঝতেও পারবে না যে, এদেশের নদ-নদী ও পরিবেশ আজ কতটা অসহায়! এই অবস্থার পরেও যদি ভারত আবার আন্ত:নদী সংযোগ কিংবা টিপাইমুখ প্রকল্প বাস্তবায়ন করে তাহলে পুরো দেশ পোরশা, সাপাহার কিংবা নাচোলের মত অবস্থায় পরিণত হবে। এই নদীনির্ভর ছোট্ট ভূ-খন্ডটির বিশাল জনগোষ্ঠী ও পরিবেশ আজ এবং আগামীতে বিপন্ন। এই দেশটি মরুভূমিতে পরিণত হতে যাচ্ছে। ফারাক্কা এবং অন্যান্য বাঁধের প্রভাবে দেশের অধিকাংশ নদ-নদীর নাব্যতা হ্রাস পেয়ে মরতে শুরু করেছে এবং কিছু নদীর চিহ্ন ইতোমধ্যেই মুছে গেছে। বাকিগুলোও মরণপথের যাত্রী। 

২। লবণাক্ততা বৃদ্ধি এবং সুন্দরবন বিনাশ : 
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চল জুড়ে পৃথিবীর একমাত্র বৃহত্তর প্রাকৃতিক এই ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনটি দিন দিন বিনাশ হচ্ছে। উজানে ভারত গঙ্গার ওপর ফারাক্কা বাঁধ ও অন্যান্য নদীতে বাঁধের কারণে প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা এই অমূল্য সম্পদ আজ ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছে। বনটি বেঁচে থাকার জন্য যে পরিমাণ স্বাদু পানির প্রয়োজন তা পাচ্ছে না। উজান থেকে পানিপ্রবাহ হ্রাস পাওয়ায় সাগর থেকে জোয়ারের সময় মাত্রাতিরিক্ত লোনাপানি বিভিন্ন নদী, খাল ও ছড়া দিয়ে বনের ভেতরে প্রবেশ করে। এই লোনাপানি বনের ভেতর প্রবেশের কারণে সুন্দরবনের পানি ও মাটির লবণাক্ততা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ফলে বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষের পাকা ফল মাটিতে পড়ে বীজ থেকে অঙ্কুর এবং অঙ্কুর থেকে চারাবৃক্ষ জন্মাতে পারছে না। কেননা ছোট ছোট চারাগাছের বেঁচে থাকার জন্য যে পরিমাণ স্বাদু পানির প্রয়োজন, তা না পাওয়াতে অর্থাৎ প্রয়োজনীয় পানির অভাবে বৃক্ষশূন্য অঞ্চলে বাষ্পীয়ভবন বেশি হওয়ায় পানির স্তর (Ground level water) অনেক নিচে নেমে যায়। অন্য দিকে এই বৈরী পরিবেশের কারণে বনে পাখিকুলের সংখ্যাও হ্রাস পাচ্ছে। ফলে যে সব পাখি ফল খেয়ে বীজ অন্যত্র নিয়ে ফেলে, সেখানেই স্বাভাবিকভাবে বৃক্ষ জন্মে। আর সেই বীজ বৃক্ষ থেকেই বিশাল বৃক্ষের জন্ম নেয়।

প্রয়োজনীয় পানির অভাবে সুন্দরবনের সুন্দরী বৃক্ষরাজি আজ বিপন্ন। ইতোমধ্যে অধ্যুধিক লোনাপানি বনে প্রবেশের কারণে সুন্দরী আগা মরা রোগের (টপ ডাইং) বিস্তার অব্যাহত রয়েছে। বাংলাদেশ অংশের সুন্দরবনের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে এই রোগ। ১৯৮০ এর দশকের গোড়ার দিকে সর্বপ্রথম সাতক্ষীরা জেলার বৃক্ষ বিনাশকারী এই রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। দেশের ভেতরে রাজনৈতিক হানাহানি, মানুষের ভেতর দেশপ্রেমের অভাব ও জন-সচেতনার কারণে দেশের অমূল্য সম্পদ সুন্দরবন আজ ক্রমশ ধ্বংসের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এক অনুসন্ধানে দেখা গেছে যে, সুন্দরবনের প্রায় ৪০ ভাগ সুন্দরী গাছ আগা মরা রোগে আক্রান্ত। ১৯৭০ দশকের চেয়ে বর্তমানে সুন্দরবনে গাছ, মাছ, পশু এবং পাখিকুলের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যহারে হ্রাস পেয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, লোনা ও স্বাদুপানির মিশ্রণের অনুপাত সঠিক না থাকা অর্থাৎ সুন্দরবনের মিঠাপানির প্রবাহ কমে যাওয়ার ফলে দেখা দিয়েছে লোনাপানির আধিক্য। ফলে গাছের ডগায় এবং শেকড়ে পোকার আক্রমণ বেড়েছে। বনের ভেতরে নদী ও খালে পলি পড়ে নাব্যতা হ্রাস হেতু পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হওয়া এবং পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে মৃত্তিকার বিশেষ উপাদানের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। তবে মিঠাপানি প্রবাহ হ্রাস পেয়ে লবণাক্ততা বৃদ্ধিই সুন্দরবন বিনাশের প্রধান কারণ বলে সর্বজনমহলে স্বীকৃত।

সুন্দরবনের মাটি ও পানিতে মৃদু লবণাক্ততা উদ্ভিদের জন্য সহায়ক। কিন্তু অতিরিক্ত লবণের কারণে সুন্দরবন ও এর আশপাশের বৃক্ষশোভিত সকল বেষ্টনী বিপন্ন হতে চলেছে। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতে, মাটিতে ১ হাজার থেকে ২ হাজার মাইক্রোমস ও পানিতে ৩ হাজার মিলিমস পর্যন্ত লবণের পরিমাণ সহনীয়। সুন্দরবনের আশেপাশে ইছামতি, পশুর, রায়মঙ্গল, মালঞ্চ প্রভৃতি নদীতে বিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে লবণ ছিল ১৯ হাজার মিলিমস। এর পরিমাণ বেড়ে বর্তমানে ৬০ হাজার মিলিমসে এসে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে ১৯৮৬ সালে সুন্দরবনের মাটিতে লবণ ছিল ৩২ হাজার মাইক্রোমস, যা বর্তমানে প্রায় ৪০ হাজার মাইক্রোমস এ দাঁড়িয়েছে। জোয়ারের সময় লোনাপানি সাগর থেকে সুন্দরবনের নদ-নদীতে প্রবেশ করে। নদীতে স্বাদু পানির স্বাভাবিক প্রবাহ থাকলে সেই প্রবাহ সাগরের লোনাপানিকে ঠেলে পুনরায় সাগরে নিয়ে যায়। কিন্তু ফারাক্কা বাঁধের প্রভাবে বাংলাদেশের নদীগুলোতে শুকনো মৌসুমে পানি শূন্যতা দেখা দিয়েছে, যার অনিবার্য পরিণতি লবণাক্ততা। এই লোনায় আক্রান্ত সুন্দরবনের সবুজ বন ও গাছপালা দিন দিন বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে। সাগরের লোনাপানির আঘাতে বেশ কয়েক প্রজাতির ধান ও মাছ বিলুপ্ত হয়েছে। এমনকি লোনা পানির আধিক্যের কারণে বনের বিভিন্ন এলাকা “ব্লাস্ট ও টপ ডাইং” রোগে আক্রান্ত হয়ে লক্ষ লক্ষ গাছ মারা গেছে এবং যাচ্ছে।

একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, ভারত কর্তৃক গঙ্গা নদীতে ফারাক্কা বাঁধ এবং অন্যান্য বাঁধ দেয়ার কারণে দেশের বৃহত্তম বন সুন্দরবন বিনাশের পথে। কারণ ফারাক্কা বাঁধ চালুর আগে এরকম কোন সমস্যার সৃষ্টি হয়নি। শত শত বছর ধরে সুন্দরবন প্রাকৃতিকভাবে তার আপন সৌন্দর্য ও ঐতিহ্য এবং এর জীববৈচিত্র্যকে রক্ষা করে চলছিল। কিন্তু ফারাক্কা বাঁধের ক্ষতিকর কারণে বনটি এখন মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ করছে। বনটি বিনাশের সাথে সাথে ধ্বংস হচ্ছে দেশের জীববৈচিত্র্য এবং ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এর সাথে সংশ্লিষ্ট লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবিকার পথ। ফলে মারাত্মক বিপর্যয় নেমে আসবে দেশের পরিবেশ ও অর্থনীতির ওপর। এরপর যদি ভারতের আন্ত:নদী সংযোগ প্রকল্পের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন সম্পন্ন হয় তাহলে কী হবে আমাদের দেশের অবস্থা! কী হবে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের পরিণতি! তাই সময় থাকতে আমাদের শাসকগোষ্ঠী বা সরকার এবং সর্বস্তরের মানুষকে দলমত নির্বিশেষে সচেতন হতে হবে, রক্ষা করতে হবে দেশকে।

১৯৭৪ সালে উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততার পরিমাণ ছিল ৩৮০ মাইক্রোমস। বর্তমানে তা তিনগুণ থেকে চারগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে যা একাধারে মানবসম্পদ ও পরিবেশের জন্য বিপজ্জনক। সমুদ্র থেকে যে লবণাক্ত পানি জোয়ারের মাধ্যমে উপকূলীয় অঞ্চলে প্রবেশ করে তা অপসারণ করতে নদীর স্বাভাবিক মিঠাপানির প্রবাহ প্রয়োজন। তাতে লবণ পানি আবার সমুদ্রে গিয়ে পড়তে পারে। প্রতি বছর শুষ্ক মৌসুমের শুরুতে দেশের নদ-নদীতে পানিশূন্যতা দেখা দেয়, ফলে লবণাক্ততা বাড়তে থাকে। সে কারণে সাগর উপকূলীয় অঞ্চলে অনেক গাছের পাতা শুকিয়ে ঝরে পড়ে।

মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানের রিপোর্ট অনুযায়ী খুলনা অঞ্চলের প্রধান কয়েকটি নদীতে গত কয়েক বছর ধরে লবণাক্ততা বৃদ্ধির হার ৫০ শতাংশেরও বেশি। খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলার বেশির ভাগ নদ-নদীতেই এখন স্বাভাবিকের চেয়ে বহুগুণ লবণাক্ততা বিরাজ করছে। খুলনা জেলার রূপসা, শিবসা, কাজীবাছা ও পশুর নদীতে ২০০২ সালের মার্চ মাসের তুলনায় ২০০৩ সালের মার্চে লবণাক্ততা গড়ে প্রায় ৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। রূপসা নদীতে গত এক বছরে লবণাক্ততা বৃদ্ধির হার সবচেয়ে বেশি অর্থাৎ ৮৫ শতাংশ, শিবসায় ৫৬ শতাংশ, কাজীবাছায় ২৫ শতাংশ এবং পশুর নদীতে এ হার ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

৩। কৃষিক্ষেত্র ধ্বংস হচ্ছে : বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক কৃষিপ্রধান দেশ। কৃষির ওপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে এদেশের অর্থনীতি। এদেশের প্রায় ৮৫ ভাগ লোক কৃষিজীবী। দেশটিতে রয়েছে বিস্তীর্ণ সমভূমি আর ঊর্বর নদীপলল সমৃদ্ধ মৃত্তিকা। বৃষ্টিবহুল উষ্ণ আর্দ্র জলবায়ু এদেশকে উৎকৃষ্ট কৃষিভূমিতে পরিণত করেছে। এদেশের মোট ভূমির প্রায় ৭৫ শতাংশ জমি কৃষিযোগ্য এবং চাষাবাদের জন্য নদীনালার পানির ওপর নির্ভরশীল। এ সব জমিতে আউশ, আমন, ইরি ও বোরোসহ বিভিন্ন প্রজাতির ধান উৎপন্ন হয়। এক সময় এদেশের মাটিকে বলা হত ‘সোনার চেয়েও খাঁটি। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় এই যে, আজ এদেশের মানুষ শুষ্ক মৌসুমে পানির অভাবে চাষাবাদ করতে পারছে না। উত্তরাঞ্চলসহ দেশের অধিকাংশ এলাকায় গভীর অগভীর কোন নলকূপে পানি পাওয়া যাচ্ছে না। পানির স্তর ভয়াবহভাবে নিচে নেমে গেছে। পানির জন্য সর্বত্র হাহাকার। এর প্রধান কারণ হচ্ছে, গঙ্গা নদীর ওপর ভারত ফারাক্কা বাঁধ দিয়ে গঙ্গার পানির সিংহভাগ প্রত্যাহার করে ভারতের খরাপীড়িত অঞ্চলে কৃষিকাজ চালাচ্ছে আর আমাদের দেশের কৃষকরা কৃষি জমিতে সেচের জন্য প্রয়োজনীয় পানি পাচ্ছে না। ফলে দেশের অনেক জায়গায় পুড়ে যাচ্ছে ফসল এবং ফসলী জমি। পানির অভাবে ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে মাঠ-ঘাট। আষাঢ়-শ্রাবণ এই দু’মাস বর্ষাকাল। অথচ এই বর্ষাকালেও দেশে পর্যাপ্ত পানি নেই। যেখানে দেশের প্রায় ৭০% সেচকার্যে ভূ-গর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল সেখানে পানির অভাবে দেশের উত্তরাঞ্চলের কৃষকেরা কৃষিজমিতে প্রয়োজনীয় সেচকার্য চালাতে পারছে না। তারপর পানিপ্রবাহের স্বল্পতার কারণে সমুদ্র থেকে জোয়ারের সাথে প্রচুর লবণ পানি প্রবেশ করে জমির ঊর্বরতা ও উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস করছে। বরেন্দ্র অঞ্চলসহ দেশের উত্তর-পশ্চিম অংশে হাজার হাজার নলকূপে আরও বেশি পাইপ বসিয়ে গভীর নলকূপের সাহায্যে পানি উত্তোলনের কারণে পানির স্বাভাবিক স্তর অস্বাভাবিক নিচে নেমে গেছে। গঙ্গার পানি প্রত্যাহারের কারণে ইতোমধ্যেই দেশের অন্যতম বৃহৎ সেচ প্রকল্প তথা গঙ্গা- কপোতাক্ষ প্রকল্প (G.K. Project) এলাকায় পাম্পিং ক্যাপাসিটির প্রায় ৬০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। দক্ষিণ-পশ্চিম এলাকায় মাটির আর্দ্রতা কমে যাওয়ার কারণে ফসল উৎপাদন কমে যাচ্ছে। বৃষ্টির আশায় কৃষকরা বিলম্বে চাষাবাদ শুরু করে, ফলে ফলন কমে যাচ্ছে। কৃষকেরা শাক-সবজি চাষের জন্য বৃষ্টি অথবা হাজামজা পুকুরের পানির ওপর নির্ভর করছে। কিন্তু তা-ও ঠিকমত পাচ্ছে না। বৈরী পরিবেশের কারণে নদীগুলো শুষ্ক মৌসুমে পানিশূন্য থাকা এবং অনাবৃষ্টির কারণে অনেক সময় কষ্টার্জিত ফসল নষ্ট হয়ে যায়। ফলে চাষী বা সবজি উৎপাদনকারী ভীষণভাবে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।

বাংলাদেশের উজানে প্রধান নদীসমূহে ভারত কর্তৃক বাঁধ নির্মাণ এবং দেশের বিভিন্ন নদীতে ক্রস বাঁধ তৈরিতে পানি প্রবাহ হ্রাস, পলি ভরাট এবং জলজ পরিবেশ দূষণের ফলে ৫৬টি নদীতে ইলিশের বিচরণক্ষেত্রে শতভাগ ধ্বংস ও কয়েকটি নদীর ওপরের অংশ ৯০ শতাংশ বিচরণক্ষেত্র বিলীন হয়েছে। এর প্রধান কারণ অবাধে জাটকা নিধন ও মিঠা পানির চারণভূমি হ্রাস।

৪। নদ-নদীর বিলুপ্তি : বাংলাদেশে এক সময় নদ-নদী ছড়ানো ছিল জালের মত। এ জন্য এদেশকে বলা হত নদীমাতৃক দেশ। উনিশশ’ সত্তরের দশকের গোড়ার দিকেও ছোটবড় সব মিলিয়ে প্রায় একহাজার থেকে পনেরশ’ নদী ছিল। কিন্তু ঐ সকল নদীর সংখ্যা হ্রাস পেয়ে বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ২৪০ থেকে ২৫০ এ। কোন কোন তথ্য মতে, বর্তমানে দেশে নদীর সংখ্যা ২৩০টি। এগুলোর মধ্যে প্রধান নদী পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, মেঘনা ও কর্ণফুলী। প্রধান নদী পাঁচটির মধ্যে পদ্মা ও ব্রহ্মপুত্র এর উৎপত্তি মূল হিমালয়ে এবং এগুলো ভারতের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। ব্রহ্মপুত্রের বর্তমানে প্রধান প্রবাহ নব-ব্রহ্মপুত্র বা যমুনা (Young Brahmaputra) যা দক্ষিণে প্রবাহিত হয়ে গোয়ালন্দের উত্তরে পদ্মার সাথে মিলিত হয়েছে। অতঃপর দক্ষিণ-পূর্বে ১০৪ কিলোমিটার প্রবাহিত হয়ে চাঁদপুরের কয়েক কিলোমিটার উজানে মেঘনায় মিলিত হয়ে এটি দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়। ভারত কর্তৃক ফারাক্কাসহ অন্যান্য নদীর উৎস-মুখে বাঁধ নির্মাণের ফলে ইতোমধ্যেই দেশের নদীগুলোর করুণ চিত্র ফুটে উঠেছে। 

সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ঐতিহ্য ঘেরা এই গঙ্গা (পদ্মা) এখন মৃত্যুমুখে। গঙ্গা-পদ্মার ক্ষীণদশার জন্য দায়ী ফারাক্কা বাঁধ। আর এর ফলে অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে তো বাঁধাগ্রস্ত করছেই সেই সাথে ঘটছে সামাজিক বিপর্যয়। বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ জমি গঙ্গাবিধৌত। শুধু বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের মাছ ধরা ও চাষাবাদসহ জীবন জীবিকা নির্ভর এই নদীর ওপর। অথচ নাব্যতা হারিয়ে পদ্মার বুকে প্রতি বছর চরের সংখ্যা ও এর উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং এসব চরে দিন দিন জনবসতি বেড়েই চলেছে। মানিকগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, মাদারিপুর ও শরিয়তপুরের পদ্মার চরে এ সংখ্যা বেশি। মাদারীপুর জেলার শিবচর উপজেলার উত্তরে পদ্মায় একাধিক চরের সৃষ্টি হয়েছে। শুধু পদ্মা নয় পুরনো ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, (নব-ব্রহ্মপুত্র) এবং মেঘনা নদীরও একই অবস্থা। ব্রহ্মপুত্র-যমুনায় দেশের অন্য সকল নদীর চেয়ে বেশি চর সৃষ্টি হয়েছে। এসকল চরে এখন বিশাল জনগোষ্ঠীর বসবাস। এখানে অন্তত ১০টি চরে (২০০৭ এর তথ্য) কমপক্ষে দু’হাজার পরিবারের বসবাস। এদের সংখ্যা দিনে দিনে বেড়েই চলছে। এরকম শুধু ব্রহ্মপুত্র আর যমুনায়ই সীমবদ্ধ নয়, সারা দেশের প্রায় সকল বৃহৎ নদীগুলোর একই করুণ দশা। আর শাখা-প্রশাখাগুলো বছরে প্রায় ৮-৯ মাসই পানিশূন্য বা মৃতাবস্থায় থাকে অতএব অতি সহজেই বোঝা যাচ্ছে দেশের প্রধান নদীগুলোর করুণ পরিণতি। তাহলে এদের শাখা-প্রশাখার অবস্থা কী হতে পারে!

গত তিন দশকে ফারাক্কা বাঁধের কারণে দেশের ২৩০টি নদীর মধ্যে অনন্ত ৮০টি নদী, উপনদী ও শাখানদী পানিশূন্য হয়ে পড়েছে। পানিপ্রবাহ অস্বাভাবিকভাবে হ্রাসের কারণে বৃহৎ নদীসমূহ মৃত নালায় পরিণত হচ্ছে। যেখানে ১৯৭১ সালে দেশে মোট নাব্য নদীপথ ছিল ২৪ হাজার ১শ’ ৪০ কিলোমিটার। বর্তমানে সেখানে শুকনো মৌসুমে এর পরিধি এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৩ হাজার ৮শ’ কিলোমিটার। এ পরিধি দিন দিন আরও কমছে। চুক্তি অনুযায়ী পানি পাচ্ছে না বাংলাদেশ। দু’হাজার কিলোমিটার জুড়ে চর, প্রমত্তা পদ্মা এখন মৃতপ্রায় স্রোতহীন নদী। পাকশি নর্থবেঙ্গল পেপার মিলের পাম্প স্টেশনের নিচে চর জেগে ওঠায় পদ্মা এখন একটি খালে পরিণত হয়েছে। জেগে ওঠা এসব চরে কৃষকেরা আখ, বাদাম ও ধান চাষ করছে। 

সুজলা-সুফলা এই দেশে শীতের শুরু থেকে সমগ্র শুকনো মৌসুম জুড়ে নদীতে পানি থাকে না। পানির অভাবে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে ইতোমধ্যে মরুকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। নদীসমূহের নাব্যতা সংকটের কারণে দেশের নৌপথ প্রতিবছর সংকুচিত হচ্ছে। আবহাওয়ার স্বাভাবিকতার পরিবর্তন বাড়ছে। পলি জমে নদীর তলদেশের উচ্চতা বেড়ে যাওয়া এবং নদীর সংখ্যা কমে যাওয়ায় বর্ষাকালে উত্তরের পাহাড়ি ও বৃষ্টির পানি সীমিত আয়তনের নদীসমূহ বহন করতে পারছে না। ফলে বন্যার পানি নদী ছেড়ে উপকূলের গ্রাম-গঞ্জে ঢুকে পড়ায় প্রতি বছর বন্যায় দেশের শত শত কোটি টাকার সম্পদ বিনষ্ট করে এবং বানভাসী মানুষেরা আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে। নদীর সংখ্যা হ্রাস এবং নাব্যতা সংকটের কারণে নদীর অস্বাভাবিক এ আচরণ। এর ফলে প্রতিনিয়ত নদী ভাঙন বেড়ে চলছে ফলে মানুষ হয়ে পড়ছে সহায় সম্বলহীন এবং শহরমুখী।

পানি বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের প্রধান নদীপ্রবাহ তিনটি-পদ্মা (গঙ্গা), ব্রহ্মপুত্র-যমুনা (নব-ব্রহ্মপুত্র) এবং মেঘনা এই তিনটি প্রবাহের সাথে যুক্ত দেশের বড় ও মাঝারি আয়তনের ২৩০টি নদ-নদী। উজান থেকে আসা ঐ তিনটি প্রধান নদীর প্রবাহ কৃত্রিম কারণে বাধাগ্রস্ত হওয়ায় এর সাথে সংযুক্ত অন্য নদ-নদীগুলোর অবস্থাই বদলে গেছে। আর এর সাথে সংযুক্ত হচ্ছে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বিস্ফোরণ। দেশের প্রধান নদীগুলোর মধ্যে একটি আদি ব্রহ্মপুত্র এখন মৃতপ্রায়। শুকনো মৌসুমে এর অধিকাংশ এলাকায় পানি থাকে না। এই আদি ব্রহ্মপুত্রের পানি এক সময় বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের প্রায় ৫০ হাজার একর জমির সেচের উৎস ছিল। কিন্তু এখন পানির অভাবে সেই সমস্ত সেচ প্রকল্পগুলো বন্ধ। সাথে সাথে বন্ধ হয়ে গেছে নৌপথের ব্যবসা বাণিজ্য, উপরন্তু ব্রহ্মপুত্রের চরে এখন রবিশস্যের চাষ হচ্ছে।
প্রয়োজনীয় পানিপ্রবাহ না থাকায় উত্তরাঞ্চলের দীর্ঘতম প্রমত্তা নদী তিস্তা ধীরে ধীরে শীর্ণ খালে পরিণত হয়েছে। যেখানে তিস্তা ব্যারেজকে সচল রাখার জন্য দরকার কমপক্ষে ৫ হাজার কিউসেক পানি সেখানে পাওয়া যাচ্ছে মাত্র ২৫০ কিউসেক। ফলে উত্তরাঞ্চলের সেচভিত্তিক কৃষি ব্যবস্থা বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। তিস্তার বিরূপ প্রভাব পড়েছে ঐ অঞ্চলের তিস্তার পুরনো ধারা আত্রাই, করতোয়া ও পুনর্ভবার ওপর। তিস্তার দু’টো শাখা নদী বাঙ্গালী ও ঘাঘট শুকিয়ে মরা নদীতে পরিণত হয়েছে।

এক সময়ের পদ্মার প্রধান শাখানদী প্রমত্তা গড়াই এখন শুকনো মৌসুমে থাকে প্রায় পানি শূন্য। কেবল বর্ষা মৌসুমে কিছুটা প্রবাহমান হয়। রাজবাড়ি জেলার ওপর থেকে বয়ে যাওয়া সেরাজপুর হাওড় ও চন্দনা এখন মৃত নদী। ফরিদপুরের কুমার নদী দিয়ে কয়েক দশক আগেও বড় বড় স্টিমার চলাচল করত। কিন্তু সেদিনের সে কুমার এখন কঙ্কাল নদী। বৃহত্তর কুষ্টিয়া এবং যশোর অঞ্চলের প্রায় সকল নদীর মাতানদী ছিল মাথাভাঙ্গা। এখন শুকনো তো দূরের কথা, বর্ষা মৌসুমেও এককালের প্রমত্তা মাথাভাঙ্গা থাকে নীরব, নিথর ও প্রাণহীন।

দেশের দক্ষিণাঞ্চলে গড়াই-মধুমতির নিম্ন প্রবাহ বলেশ্বর। এই বলেশ্বর নদীর নামডাক ছিল বিখ্যাত আর অন্য সব নদীর চেয়ে আলাদা। পিরোজপুর ও বাগেরহাট জেলা বিভক্তকারী এই নদীতে প্রচুর ইলিশ ও হাঙ্গর পাওয়া যেত। আর এর স্রোত ছিল তীব্র। কিন্তু ২০০৫ এবং ২০০৬ সালে কয়েকবার বরিশাল হয়ে খুলনা ভ্রমণকালে দেখা গেল যে, বলেশ্বর ছিল একেবারে নীরব ও নিস্তব্ধ। বর্ষা মৌসুমে কিছুটা সচল থাকলেও শুকনো মৌসুমে একে দেখলে সকলে ভাববে এটি একটি স্রোতহীন মৃতপ্রায় নদী। সাগরের তুলনামূলকভাবে কাছাকাছি অবস্থান বিধায় নাজিরপুর থেকে জিয়ানগর উপজেলা পর্যন্ত ছোট ছোট নৌযান চলাচল করতে পারে। কিন্তু এই নদীর অবস্থা দিন দিন আশংকাজনক। পদ্মার আর একটি বৃহত্তর শাখানদী আড়িয়াল খাঁ। এই আড়িয়াল খাঁকে প্রমত্তা পদ্মার এক সময় প্রধান প্রবাহ নির্গমন পথ হিসেবে গণ্য করা হত। সেই আড়িয়াল খাঁ-র উৎসমুখ সদরপুর থেকে মাদারিপুর পর্যন্ত অবস্থা অত্যন্ত করুণ। শিবচরের যেখানে আড়িয়াল খাঁ সেতু নির্মিত হয়েছে সেখানে সেতুর ওপরে দাঁড়ালে এর করুণ দৃশ্য সহজেই দেখা যায়। নদীটি বর্ষা মৌসুমে সচল থাকলেও শুকনো মৌসুমে মৃতপ্রায়। দু’তীরের চরে চাষ হচ্ছে চীনাবাদাম, পেঁয়াজ, রসুন, পাট, গাম, আখ ও শাক-সবজি। সারিবদ্ধভাবে সাদা কাশফুল শোভা পাচ্ছে, এরই কিছু ভাটিতে বিভিন্ন উপজেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত প্রমত্তা পদ্মার শাখা কীর্তিনাশাসহ কয়েকটি নদীর অবস্থাও অত্যন্ত আশংকাজনক। সেখানে সংস্কারের কোন লক্ষণ নেই এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপজ্জনক।

যশোর ও খুলনা অঞ্চলের ওপর দিয়ে প্রবাহিত কপোতাক্ষ, হরিহর, নবগঙ্গা, চিত্রা, ব্যাঙ, ইছামতি, ভৈরবসহ প্রায় সকল নদী শুকনো ঋতুতে মৃতপ্রায় দশা। এছাড়াও কালনী, ডাকুয়া, বেতনা, বেগবতী, মুক্তেশ্বরী, হাঁসকুড়া, বাগমারা, চিলা, শোলামারি (সৈলমারী), ভদ্রা, ঘুমনা, টেকা, হানু, শ্রী, সোনাই ও কালিন্দী নদীর অবস্থাও একই রকম।
কুমিল্লার দুঃখ নামে পরিচিত ছিল গোমতী নদী। এখন শুকনো মৌসুমে সেটি শুকিয়ে থাকে কিন্তু বর্ষা মৌসুমে কিছুটা প্রাণ ফিরে পায়। তবে স্রোত আর আগের মত নেই। অপরদিকে তিতাস নদীসহ এর সকল শাখানদীর অবস্থা আরও করুণ। পুবের টিলাপাহাড় থেকে নেমে আসা চোয়ানো পানিতে বর্ষা মৌসুমে সচল থাকলেও শুকনো মৌসুমে নদীটি মৃতপ্রায়। কিশোরগঞ্জের নরসুন্দর যৌবন হারিয়ে কঙ্কাল। ঢাকা, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, গাজিপুর, মানিকগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জ জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত শীতলক্ষ্যা, ধলেশ্বরী, লৌহজং, বানার, ইছামতি, বুড়িগঙ্গা, বংশী, বালু, কালিগঙ্গা ও তুরাগ নদী প্রভাবশালীদের দখলে চলে যাচ্ছে এবং উত্তর দিকের মরে যাওয়া অংশে এখন চাষাবাদ চলছে। এ সকল নদীর অবস্থা দিন দিন ক্ষীণ ধারায় পরিণত হচ্ছে।

সর্বশেষ পরিসংখ্যানে দেখা গেছে পঞ্চগড়, নীলফামারী, রংপুর, বগুড়া এবং সিরাজগঞ্জের ওপর দিয়ে প্রবাহিত ছিল প্রমত্তা করতোয়া ও বাঙ্গালী নদী। সেগুলো এখন প্রায় মৃত। পাবনার ইছামতি এবং মানিকগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জের ইছামতি ছাড়াও পাবনার বড়াল এবং এর সমস্ত শাখা নদীগুলো এখন মৃত নদী।

এই সব নদী-নালা দেশের পরিবেশের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। নদী-নালার সাথে দেশের আবহাওয়া ও জলবায়ুর গভীর সম্পর্ক। সুতরাং নদ-নদী হুমকির সম্মুখীন হলে দেশের আবহাওয়া ও জলবায়ুর পরিবর্তন হতে বাধ্য। ফলে ভারতের নদী প্রকল্পের প্রতিক্রিয়া হিসেবে বাংলাদেশ চরমভাবাপন্ন হয়ে উঠবে। বাড়বে তাপমাত্রা, মানুষের জীবনযাপন হবে কষ্টসাধ্য, বিপন্ন হবে Ecological Balance বা প্রতিবেশ ভারসাম্য। বিশেষজ্ঞদের মতে, যেভাবে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, আবহাওয়ার পরিবর্তনের কারণে বিশ্বব্যাপী অনাবৃষ্টি এবং বায়ুমন্ডলে উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে মেরু অঞ্চলে অত্যাধিক বরফগলা ইত্যাদির অস্বাভাবিকতার কারণে পানিই হবে বর্তমান শতাব্দীর প্রধান সমস্যা। প্রসঙ্গে ২০০৬ সালের ২৩ অকটোবর ‘‘দৈনিক ইত্তেফাক’’ এর প্রধান সম্পাদকীয় ছিল পানি সংকেটে আগামী বিশ্ব। এতে বলা হয়েছে ২০৭০ থেকে ২০৮০ সালে মধ্যে পানিসংকট ভয়াবহ সমস্যা হয়ে দেখা দিবে। দরিদ্র দেশগুলোর খাদ্যোৎপাদনে অর্জিত বিশাল সাফল্য ম্লান হয়ে যাবে পানীয় ও জলের সংকটের মুখে। কেবল খাদ্য দুর্ভিক্ষ নয়, বরং দরিদ্র বিশ্বের বহু দেশকে তখন মুকাবিলা করতে হবে পানীয় জলের দুর্ভিক্ষের। ২০৫৬ সালে অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় অর্ধশত বছর পর পৃথিবীর জনসংখ্যা দাঁড়াবে ৯শ’ কোটিতে। এক বৈজ্ঞানিক সমীক্ষা হতে জানা যায়, ভূ-মন্ডলে বর্তমানে পানির সংস্থান আছে ১ হাজার ৩ শ’ লক্ষ কোটি ঘনমিটার। এর মধ্যে পানযোগ্য পানির পরিমাণ মাত্র ২.৫ ভাগ। এর মধ্যে হিমবাহ আকারে আটকে আছে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ। বাকি ৯৭.৫ ভাগ পানিই পানের অযোগ্য। জাতিসংঘের এক সমীক্ষায় আশঙ্কা ব্যক্ত করে বলা হয়েছে ২০২৫ সালের মধ্যে চরম পানীয়জলের সংকটে পড়ে গরীব দেশের কোটি কোটি লোকের মৃত্যু হতে পারে। সমীক্ষায় আরো বলা হয়, বিশ্বের ১২০ কোটি মানুষ পানির অভাবে মৃত্যুর ঝুঁকিতে পড়বে এবং ১ কোটি ৫০ লক্ষ শিশু অনিবার্যভাবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে। বিশেষজ্ঞদের আরও আশঙ্কা বর্তমানে বিশ্বে যেভাবে জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটছে তাতে কেবলমাত্র বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের অধিকাংশ জেলা অর্থাৎ ১২ থেকে ১৫ শতাংশ প্লাবিত এবং প্রায় ২০ মিলিয়ন (২ কোটি) মানুষ উদ্বাস্ত্ত হয়ে পড়তে পারে। তাদের ধারণা, তাপমাত্রা যদি বর্তমানের চেয়ে ১ থেকে ২ ডিগ্রী বাড়ে তাহলে বাংলাদেশের শীতকালীন ফসল বিশেষ করে গম ও আলুসহ বিভিন্ন প্রকার শাক-সবজি উৎপাদন হ্রাস পাবে। এছাড়া দেশের জীববৈচিত্র্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ভূমির ক্ষয় বৃদ্ধি পাবে।

৫। জীববৈচিত্র্য (Bio-Diversity) ধ্বংস : বাংলাদেশের নদ-নদীর স্বার্থের সাথে শুধু মানুষই নয় বরং প্রতিবেশী হিসেবে জড়িয়ে আছে অসংখ্য প্রজাতির পশুপাখি, কীটপতঙ্গ ও পোকা মাকড়ের জীবনধারা। এদেশের নদ-নদীসমূহ মরে গেলে দেশের দুর্লভ প্রাণী ও কীটপতঙ্গসমূহ আমাদের বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয় জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যাবে। আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য মানবসৃষ্ট পরিবেশ পরিপন্থী পদক্ষেপের কারণে পরিবেশ রক্ষাকারী অনেক প্রজাতির অস্তিত্ব অবলুপ্ত হতে চলেছে। অনেক প্রজাতি ইতোমধ্যে এদেশ থেকে চিরতরে হারিয়ে গেছে। প্রকৃতির নৈসর্গিক ভুখন্ড থেকে বৈচিত্র্যময় প্রাণী ও উদ্ভিদ হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম। ক্রমাগতভাবে পরিবেশ হয়ে উঠছে ভারসাম্যহীন। এদেশের অবস্থান উত্তরে হিমালয় পর্বত, সমতল ও দক্ষিণে সাগরের কারণে অসংখ্যা নদী শিরা-উপশিরার মত বয়ে চলেছে। তাই জীববৈচিত্র্য রক্ষা অতি জরুরী। কারণ ক্রান্তীয় এ ভূখন্ড অত্যন্ত ঊর্বর। দক্ষিণ-পূর্ব ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কিছু পাহাড় ছাড়া এদেশের বাকি অঞ্চল নবীন পললে গড়া সমতলভূমি। প্রাণী ও উদ্ভিদের যথাযথ বিকাশের জন্য এখানকার আবাহওয়া অত্যন্ত অনুকূল। বিশাল বৈচিত্র্য ধারণ করার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও এখানকার জীববৈচিত্র্য দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। 

এদেশের সর্বত্র জীববৈচিত্রে সমৃদ্ধ। এখানে ১১৩ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৬৩০ প্রজাতির বেশি পাখি, ১২৫ প্রজাতির সরীসৃপ ইত্যাদি বাস করে। স্বাদু পানিতে বসবাস করে ২৬০ প্রজাতির মাছ আর ৪৭৫ প্রজাতির আছে সামুদ্রিক মাছ। এদেশে উদ্ভিদ প্রজাতির সংখ্যা ৩২৭ এবং ৬৬ প্রজাতির মাছ আর ৪৭৫ প্রজাতির আছে সামুদ্রিক মাছ। এছাড়াও প্রতিবছর শীতের শুরুতে উত্তর সাইবেরিয়া অঞ্চল থেকে অসংখ্য প্রজাতির পাখি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের লেক ও সিলেটের হাকালুকি হাওড়সহ দেশের বিভিন্ন জলাশয়ে আশ্রয় নেয়, কিন্তু শীতের শেষে স্বাভাবিকভাবে নিরাপদে দেশে ফিরে যেতে পারে না। অসাধু শিকারিদের হাত থেকে এরা নির্বিচারে নিধনের শিকার হয়। ফলে ঐ সব অতিথি পাখির আগমন ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। প্রয়োজনীয় খাদ্য, বৈরী আবহাওয়া, নির্বিচারে বনভূমি ধ্বংস এবং সর্বোপরি মানুষের নিষ্ঠুর আচরণের ফলে ১৬ হাজার প্রজাতির উদ্ভিদ ও বন্য পশুপাশির বিলুপ্তি ঘটেছে। 

প্রতিবেশী দেশ ভারত বাহুবলে গঙ্গাসহ বিভিন্ন নদীতে বাঁধ দিয়ে নদীর স্বাভাবিক পানি প্রবাহ বন্ধ করে দিয়েছে এবং নতুন করে শুরু করেছে আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প। এর ফলে আমাদের দেশের স্বাভাবিক পরিবেশ ধ্বংস এবং জীববৈচিত্র্য আরও বিপন্ন হবে। তাই ভারতের আন্ত:নদী প্রকল্পের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। বিষয়টি বিশ্ববাসীকে জানানোর জন্য আন্তর্জাতিক ফোরামে উত্থাপন করতে হবে। কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়াতে হবে, আধুনিক গণমাধ্যম ও ই-মিডিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে, সরকারের পাশাপাশি প্রবাসীদের বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে হবে এবং দেশের ভেতরের বিশাল জনগোষ্ঠিকে সংশ্লিষ্ট করে জনমত গঠন করতে হবে, পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন জোরদার করতে হবে। এদেশকে রক্ষার জন্য প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রেখে আমাদের জীবনকে রক্ষা করতে হবে। সেই সাথে জীববৈচিত্র্য রক্ষা করা আমাদের মূল দায়িত্ব। এজন্য সকলকে সচেতনতা বৃদ্ধি, পরিবেশ-বান্ধব নীতি প্রণয়নে, পরিবেশ বিষয় নিবিড় অনুসন্ধানের মাধ্যমে জীববৈচিত্র্যের আন্তঃসম্পর্ক বা আন্তঃনির্ভরশীলতা আবিষ্কার জরুরি। বাংলাদেশ জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য সকলকে আর বেশি সচেতন হওয়া উচিত।

পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বন ও বৃক্ষ যেমন অপরিহার্য, তেমনি বনের স্বাভাবিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য প্রয়োজন বনচর পশুপাখীর। বাংলাদেশের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় কমপক্ষে ১৮৫টি আইন রয়েছে। এছাড়াও পরিবেশের সাথে সম্পর্কযুক্ত ২২টি আন্তর্জাতিক চুক্তি বাংলাদেশ অনুমোদন করেছে। উপরন্তু বাংলাদেশ আরও ২৬টি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। দেশে এখন ১৪টি অভয়ারণ্য ও ন্যাশনাল পার্ক রয়েছে। কিন্তু কোন বিধিবিধান ও আইনের তোয়াক্কা না করে দেশের সংরক্ষিত এলাকাতেও পশুপাখির জন্য নির্ধারিত অভয়ারণ্যে চলছে বন উজাড় ও পশুপাখি নিধনের ঘটনা। 

অতএব দেখা যাচ্ছে যে, বাংলাদেশের পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের প্রধান কারণ ফারাক্কা বাঁধসহ অন্যান্য বাঁধ ও দেশের নদ-নদী, খাল-বিলের নাব্যতা হ্রাস এবং ভূমি দস্যুদের দখল, গাছপালা কেটে লাগামহীনভাবে বনভূমি ধ্বংস, এদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের উঁচু ভূমি কিংবা প্রকৃতির অমূল্য সম্পদ পাহাড় কেটে নিচুভূমি ভরাট করে আবাসভূমি তৈরি এবং অপরিকল্পিত ভাবে নগর ও শিল্পায়ন ইত্যাদি।

৬। দেশের প্রায় সকল নদীবন্দরসমূহের সৃষ্ট অচলাবস্থা : ভারত কর্তৃক ফারাক্কা বাঁধ প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে বাংলাদেশের প্রধান প্রধান নদীসমূহের পানিপ্রবাহ ভীষণভাবে হ্রাস পেয়েছে। ফলে নদীগুলোর নাব্যতার অভাবে ঢাকা, খুলনা, নারায়গঞ্জ, ভৈরববাজার, চাঁদপুর, বাঘাবাড়ি, চিলমারী, গোয়ালন্দ, বরিশাল, ঝালকাঠি, হুলারহাট, কাউখালী, স্বরূপকাঠী (নেছারাবাদ), ভান্ডারিয়াসহ বিভিন্ন নদীবন্দরে জাহাজ বা বড় নৌ-যান আগের ন্যায় ভিড়তে পারে না। নদীমাতৃক এদেশের এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে পণ্যদ্রব্য আনা-নেয়ার জন্য সকল নৌ-বন্দরমুখী কার্যক্রম অচল হয়ে পড়ছে ফলে এই নদীনির্ভর দেশটি অর্থনৈতিকভাবে নানামুখী ক্ষতির শিকার হচ্ছে।

ইতোমধ্যে ফারাক্কার ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ি ও চিলমারী নৌবন্দরে বছরের প্রায় সময়ই তেলের ট্যাংকারসহ পণ্যবাহী বিভিন্ন জাহাজ নোঙর করতে পারছে না। বৃটিশ আমলের শেষদিকেও ধানসিঁড়ি নদীর সাথে পিরোজপুরের কাউখালী উপজেলার চিরপাড়া নদী দিয়ে বিশাল আকারের লঞ্চ-স্টীমার ঢাকা বরিশাল ও খুলনা হয়ে কোলকাতাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চলাচল করত। ১৯৮০ দশকের গোড়ার দিকে চর পড়ে চিরপাড়া চ্যানেলটির মুখ বন্ধ হয়ে যায়, ফলে বর্তমানে উক্ত নৌযানসমূহ রুট পরিবর্তন করে সুন্দরবন হয়ে খুলনা যেতে হচ্ছে। অতএব, সারাদেশের নৌ-বন্দরসমূহের অচলাবস্থার জন্য দায়ী ভারতের ফারাক্কাসহ অন্য সকল বাঁধ। তাই আজ আমাদের উচিত হবে দেশের মাটি, মানুষ ও পরিবেশকে রক্ষার জন্য সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

৭। নদীভাঙন, অকালবন্যা ও উদ্বাস্তু সমস্যা : নদীমাতৃক এই বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা নদীনালার ওপর নির্ভরশীল। অতএব নদীর অস্তিত্ব বিপন্ন হলে এর সাথে সংশ্লিষ্ট সকল পেশার মানুষ বেকার হয়ে পড়বে। ভারত কর্তৃক ফারাক্কাসহ অসংখ্য বাঁধ নির্মাণ পরবর্তী বাংলাদেশের নদ-নদীর বিপন্নদশার কারণে লক্ষ লক্ষ জেলে পেশার মানুষ বেকার হয়ে যাচ্ছে। নদীসমূহের নাব্যতা হ্রাসের কারণে সাগরের লোনাপানি উপকূলীয় অঞ্চলে প্রবেশের ফলে বনভূমি তথা সুন্দরবনের সুন্দরীবৃক্ষসহ সকল বৃক্ষ বিনাশ ও সংকুচিত হচ্ছে। ফলে এর সাথে নির্ভরশীল বাওয়ালী, কাঠুরে, জেলে ও মধু আহরণকারী (মৌয়ালী) লোকজনও দিনদিন কর্মহীন হয়ে পড়ছে।

পানি সংকটের কারণে নদীসমূহের নাব্যতা হ্রাস পেয়ে তলদেশের উচ্চতা বেড়ে দেশের প্রধান প্রধান নদীসমূহের মাঝে চর সৃষ্টি হয়। অতঃপর এই সকল চর বা দ্বীপে জনবসতি শুরু হয়, সেখানে ক্রমান্বয়ে লোকজন ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট তৈরি এবং কৃষিকাজ করতে শুরু করে। কিন্তু বর্ষা মৌসুমে ভারত পাহাড় পর্বতের অতিরিক্ত পানি ধারণে অক্ষম হয়ে পড়ায় ফারাক্কাসহ যখন সকল বাঁধ খুলে দেয় তখন প্রয়োজনের অধিক পানি বাংলাদেশ ভাটির অঞ্চল বলে এদেশের ওপর সরাসরি আঘাত হানে। ফলে জনবসতি, রাস্তাঘাট ও ব্যাপক শস্যহানি ঘটে এবং মারাত্মক নদীভাঙনের সৃষ্টি হয়। গত কয়েক দশক ধরে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যাপক নদীভাঙন দেখা দিয়েছে। 

সম্প্রতি এক গবেষণা থেকে জানা গেছে যে, বাংলাদেশের ভূ-ভাগ ক্রমান্বয়ে পরিবর্তিত হয়ে দক্ষিণে অগ্রসর হয়ে নতুন নতুন চর সৃষ্টি হচ্ছে। এসব চরের আয়তন দেশের দক্ষিণ দিক বরাবর বেড়েই চলছে। আগামী ৫০ থেকে ১০০ বছরের মধ্যে বঙ্গোপসাগরের উত্তর প্রান্তে অগভীর উপকূল অঞ্চলে চলমান ব-দ্বীপ গঠন প্রক্রিয়ায় আরও কমপক্ষে ২৫ থেকে ৩০ হাজার বর্গকিলোমিটার নতুন ভূমি লাভ করবে। অন্যদিকে কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, জামালপুর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জের লৌহজং, শরিয়তপুর, সিলেট, পাবনা, নেত্রকোণা, খুলনা, রংপুর, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, রাজবাড়ি, মাদারীপুর, শেরপুর, বরগুনা, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, বরিশালসহ অনেক বিশেষ করে ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, পদ্মা, মেঘনা, আড়িয়াল খাঁ ও সন্ধ্যা নদীর বিস্তীর্ণ এলাকা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায় প্রতিবছর। ফলে এসব ভাঙনকবলিত এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত মানুষেরা সহায়-সম্বল হারিয়ে শহর কিংবা রেললাইনের পাশে আশ্রয় নেয়। তারা উদ্বাস্ত্ত হয়ে মানবেতর অবস্থায় জীবন কাটায়। কাজের সন্ধানে শরহগুলোতে ভিড় জমানোর ফলে তাদের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বেড়েই চলছে।

আন্তর্জাতিক নদীর পানি ব্যবহারের আইনগত ভিত্তিঃ
আন্তর্জাতিক নদী আইন অনুযায়ী একটি নদী যদি দুই বা ততোধিক রাষ্ট্রের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয় তবে ঐ নদীর পানি সম্পদের ব্যবহার আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী পরিচালিত হবে। এক্ষেত্রে প্রতিটি রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে এমনভাবে আন্তর্জাতিক নদীকে ব্যবহার করবে তা যেন অপরাপর রাষ্ট্রসমূহের সহজাত অধিকার ও স্বার্থ ক্ষুণ্ণ না হয়। যে দেশের ওপর দিয়ে নদী প্রবাহিত, নদীর সে অংশের পানি সে দেশের পক্ষে ইচ্ছেমত ব্যবহারের একচেটিয়া অধিকার আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত নয়। এ সম্পর্কে প্রখ্যাত আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ওপেনহেইম বলেন ‘‘কোন রাষ্ট্রকে নিজ ভূখন্ডের প্রাকৃতিক অবস্থা এমন করে পরিবর্তন করতে দেয়া যাবে না যার ফলে প্রতিবেশি কোন রাষ্ট্রের ভূখন্ডের প্রকৃত অবস্থায় কোন অসুবিধা সৃষ্টি করতে পারে।’’ আন্তর্জাতিক নদীর ব্যবহার সংক্রান্ত অনুরূপ মতামত ব্যক্ত করেছেন আন্তর্জাতিক আইন ইনস্টিটিউটও।

পৃথিবীতে প্রায় ২১৪টি আন্তর্জাতিক নদী রয়েছে। এই নদীসমূহ একাধিক স্বাধীন দেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত। এসব নদীর মধ্যে আমাজান, জায়ার, জাম্বেসী, দানিয়ুব, নাইজার, নীল, রাইন, মেকং, লেকচাঁদ ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখাযোগ্য। যে কোন আন্তর্জাতিক নদীর ওপর তীরবর্তী রাষ্ট্রের অধিকার সমঅংশীদারিত্বের নীতির ওপর নির্ভরশীল। আন্তর্জাতিক নদী সম্পদের তীরবর্তী রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে সুষম বণ্টনের নীতি আজ স্বীকৃত। আন্তর্জাতিক নদীর ব্যবহার সম্পর্কে ১৮১৫ সালে ভিয়েনা সম্মেলনে এবং ১৯২১ সালে আন্তর্জাতিক দানিয়ুব নদী কমিশন কর্তৃক প্রণীত আইনে এই নীতির উল্লেখ রয়েছে।
১৯৬৬ সালে আন্তর্জাতিক আইন সমিতির হেলসিংকি সম্মেলনে গৃহীত নীতিমালার ১৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রতিটি রাষ্ট্র তার সীমানায় আন্তর্জাতিক পানি সম্পদের ব্যবহার অধিকার ভোগ করবে যুক্তি ও ন্যায়ের ভিত্তিতে। পানি সম্পদের সুষম বণ্টনের নীতি ১৯৭২ সালে স্টকহোমে অনুষ্ঠিত মানব পরিবেশ সংক্রান্ত জাতিসংঘের কনফারেন্স ঘোষণাপত্রের ৫১ অনুচ্ছেদে স্থান লাভ করে।

১৯২১ সালে সুদান ও মিশরের মধ্যে নীলনদ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। তাতে উল্লেখ করা হয়েছিল যে, সুদান নীলনদে এমন কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করবেনা যাতে মিশরের স্বার্থ ক্ষুন্ন হতে পারে।

১৯৬০ সালে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে স্বাক্ষরিত সিন্ধু উপত্যকা চুক্তিতেও এমন ঘোষণা উল্লেখ ছিল যে, তীরবর্তী একটি রাষ্ট্র এমন কোন ব্যবস্থা নেবে না যাতে অপর তীরবর্তী রাষ্ট্রের নদীর স্বাভাবিক প্রবাহকে বিঘ্নিত করতে পারে।

যে নদী একবার একাধিক দেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে, তার ব্যবহার সম্পর্কে স্পষ্টতই আন্তর্জাতিক আইন রয়েছে। সেখানে নিজ দেশের আইন দ্বারা কখনোই তা নির্ধারিত হয় না। কিংবা নিজ দেশ এককভাবে সেই পানি ব্যবহার করে পার্শ্ববর্তী দেশকে পানির ব্যবহার থেকে বঞ্চিত করতে পারে না। কিন্তু প্রতিবেশি দেশ ভারত আন্তর্জাতিক স্বীকৃত কোন আইন মানছে না। শক্তির জোরে একের পর এক বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ৫৪টি নদীর প্রায় সকল প্রবাহ পথে বাঁদ দিয়ে বাধার সৃষ্টি করে এর বিশাল পানিপ্রবাহ কৃত্রিম খালের সাহায্যে উঁচু অঞ্চলে প্রবাহিত করে কৃষিক্ষেত্রসহ ইচ্ছেমতো সকল ক্ষেত্রে পানি ব্যবহার করছে। আর এই প্রক্রিয়া শুরু হয় ১৯৭৫ সাল থেকে। প্রথম ১৯৭৫ সালে ৪১ দিনের (২১ এপ্রিল থেকে ৩১ মে) অজুহাতে বাংলাদেশ সরকারকে আই ওয়াশ (Eye Wash) বা প্রতারণার ফাঁদে ফেলে বহু বিতর্কিত ফারাক্কা বাঁধটি চালু করে। ওয়াদা অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময় পার হয়ে যাওয়ার পরও বাঁধটি আর বন্ধ করেনি এবং পর্যায়ক্রমে অন্যান্য সকল আন্তর্জাতিক নদীসহ ভারতের ওপর দিয়ে বয়ে আসা সকল নদীর মুখে বাঁধ দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের সকল প্রবাহপথ বন্ধ করে দিয়েছে। এদের মধ্যে গঙ্গা নদীর ওপর ফারাক্কা বাঁধ, ব্রহ্মপুত্র নদীর ওপর বাঁধ, মুহুরী নদীতে বেলুনিয়া বাঁধ, পিয়াই নদীর ওপর পিয়াই বাঁধ, খোয়াই নদীর ওপর শহর প্রতিরক্ষা বাঁধ। এই সকল নদীতে বাঁধ, গ্রোয়েন নির্মাণ কিংবা স্লুইচ গেট নির্মাণসহ আরও অসংখ্য ছড়ানদীতে বাঁধ বা স্লুইচগেট নির্মাণ করে পানির স্বাভাবিক প্রবাহপথে বাধার সৃষ্টি করছে। এই বেআইনী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ বার বার প্রতিবাদ জানালেও তাতে তারা কোন কর্ণপাত করছে না। ফলে ফারাক্কাসহ ঐ সকল বিপদজনক বাঁধের প্রভাবে সারা বাংলাদেশ ক্রমশ মারাত্মক বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত হচ্ছে। নদীমাতৃক সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা এ অপরূপ বাংলাদেশ প্রয়োজনীয় পানির অভাবে আজ দিন দিন বিরাণ ভূমিতে পরিণত হচ্ছে। ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে বিশাল জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত দরিদ্র এই দেশটির উন্নয়নের সকল ক্ষেত্র। গুরুত্বপুর্ণ এই সেক্টরের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার শিকার দেশের অর্থনৈতিক খাত। পানির সাথে সংশ্লিষ্ট দেশের শিল্পকারখানা, নৌ-পরিবহন, নৌ যোগাযোগ ব্যবস্থা, মৎস্যসম্পদ, বনজসম্পদ, জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ বিপর্যয়, জীববৈচিত্র্য ধ্বংসসহ মৃত্তিকার জলীয়তা ও লবণাক্ততা বৃদ্ধির কারণে দেশ এক মারাত্মক সংকটের দিকে এগুচ্ছে। প্রয়োজনীয় পানিপ্রবাহের অভাবে প্রায় সকল নদীর নাব্যতা ভীষণভাবে হ্রাস পেয়েছে। ফলে প্রতিবছর অকাল বন্যা ও প্রকট নদীভাঙনের শিকার হচ্ছে নদীর তীরবর্তী অঞ্চলের অধিবাসীরা। তার শহর, সড়ক, মহাসড়ক ও রেললাইনের পাশে আশ্রয় নিচ্ছে এবং ভূমিহীন মানুষের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে।

ফারাক্কা বাঁধের পর তিস্তা বাঁধ, টিপাই বাঁধ প্রকল্প এবং আন্ত:নদী সংযোগ প্রকল্প ইত্যাদির প্রতিক্রিয়ায় দেশ নিশ্চিত মরুময়তার দিকে এগুচ্ছে। নদীসমূহে প্রয়োজনীয় পানিপ্রবাহের অভাব দেশের নদ-নদী, হাওড়-বাওড়, বিল-ঝিল, পুকুর-ডোবাসহ সকল ক্ষেত্রে মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। মৎস্যক্ষেত্র প্রয়োজনীয় বিচরণভূমির অভাবে মৎস্য উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে। বর্তমানে বর্ষা মৌসুমেও নদীতে মাছ নেই, হাওড় বাওড় মাছশূন্য। এর ফলে প্রতিবছর মাছের ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে।

প্রয়োজনীয় পানিপ্রবাহ না থাকায় দেশের উপকূলীয় নদীসমূহে প্রতিনিয়ত বেড়ে চলছে লবণাক্ততার পরিমাণ। লবণাক্ততার কারণে সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে খুলনা অঞ্চল।
ফারাক্কা বাঁধ ও আন্ত:নদী সংযোগ প্রকল্প ভারতের একটি সূদুর প্রসারী চক্রান্ত। বাংলাদেশ নামের এ ভূ-ভাগকে চিরতরে মরুভূমির দিকে ঠেলে দেয়ার প্রয়াস তাদের। 

এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য যা করা দরকার। 
১. দেশের ভেতরে এবং বাইরে এ বিষয়ে গণসচেতনতা সৃষ্টি করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যাপক জনমত সৃষ্টি করতে হবে।
২. শুষ্ক মৌসুমে ভারত ফারাক্কা ব্যারেজের মাধ্যমে বাংলাদেশকে ন্যায্য পানির হিস্যা দিচ্ছে কি না সে বিষয়ে দু’দেশের চুক্তির প্রতি খেয়াল বা নজরদারী রাখতে হবে।
৩. দু’দেশের পররাষ্ট্রনীতিতে এ বিষয়টির গুরুত্ব তুলে ধরতে হবে। কারণ শুষ্ক মৌসুমে প্রয়োজনীয় পানি সরবরাহের কথা বলে যদি সেখানে চাহিদা অনুযায়ী কম পানি দেয়া হয় সেক্ষেত্রে তা গুরুত্বের সাথে দেখতে হবে।
৪. অববাহিকা ভিত্তিক নদী উন্নয়ন কার্যক্রম চালাতে হবে।
৫. দেশকে বাঁচাতে হলে নদী বাঁচাতে হবে। প্রতিবেশি দেশ ভারতের সাথে গঠনমূলক ও সৃজনশীল আলোচনায় ফারাক্কাসহ সকল সমস্যা মিটিয়ে ফেলতে হবে।
৬. প্রয়োজন হলে দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগী সংস্থা এর অন্য সদস্য দেশসমূহের সাহায্য নিতে হবে। আমাদের নদীর নাব্যতা বাড়াতে প্রয়োজনে বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে বৃহত নদী ও হাওড় বরেন্দ্র এলাকার নদী সমূহে পরিকল্পিতভাবে জলাধার তৈরি করতে হবে যাতে বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করা যায় এবং শুষ্ক মৌসুমে কৃষি ও সেচ কাজে প্রয়োজন মত ব্যবহার করা যায়।
৭. ভারতের আন্ত:নদী সংযোগ প্রকল্পের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিরোধ করতে হবে।
৮. বিষয়টি বিশ্ববাসীকে জানানোর জন্য আন্তর্জাতিক ফোরামে উপস্থাপন করতে হবে।
৯. কুটনৈতিক তৎপরতা বাড়াতে হবে। আধুনিক গণমাধ্যম ও ইলেকট্রনিকস মিডিয়ার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। সরকারের পাশাপাশি প্রবাসীদের বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে হবে।

তথ্যসূত্র :
১.ফারাক্কা বাঁধ ও আন্ত:নদী সংযোগ প্রকল্প : বাংলাদেশের ওপর এর ক্ষতিকর প্রভাবঃ আখতার হামিদ খান
২. বি.এম.এ.টি আব্বাস : ১৯৮০ : ফারাক্কা ব্যারেজ ও বাংলাদেশ, ঢাকা।
৩. আবদুল জলিল; ১৯৮২ : সুন্দরবনের ইতিহাস, ঢাকা।
৪. বাংলাপিডিয়া, এশিয়াটিক সোসাইটি: ২০০৭, ঢাকা।
৫. সচিত্র বাংলাদেশ বিশেষ সংখ্যা (১৯৯৫) ঢাকা।
৬. মোকাররম হোসেন; ১৯৯৫ : বাংলাদেশের নদী, ঢাকা।
ঢাকা।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন