প্রাণ দিয়েছিল যারা
আজকে দেখো সামনে এসে
রক্ত মাখা শহীদ বেশে
ফের দাঁড়িয়েছে তারা…….
১৯৮৫ সালের সেই শহীদেরা বারবারই প্রতিভাত হন আমাদের সামনে আর আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়ে যান আমাদের দায়িত্বের কথা। এদেশে কুরআনের রাজ প্রতিষ্ঠার মহান দায়িত্বের কথা। ভারতে যখন কুরআন বাজেয়াপ্ত করার ঘোষনা দেয়া হয় তখন ঈমানের বলে বলিয়ান হয়ে এদেশের মানুষের ক্ষোভে ফেটে পড়ে। ফুঁসে উঠে পুরো মুসলিম বিশ্ব। বাংলাদেশের স্বৈরশাসক ও তার দোসররা এই বিক্ষোভ ঠেকানোর জন্য উঠে পড়ে লাগে। মুসলিম নামধারী কিছু নরপশু বিক্ষোভ করতে দেবে না বলে চাপাইনবাবগঞ্জে ১৪৪ ধারা জারি করে। কুরআন প্রেমিক মানুষ প্রশাসনের এমন অযৌক্তিক আচরণকে মেনে নিতে পারেনি। ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে তারা বিক্ষোভ মিছিল শুরু করে সমাবেশ স্থলের উদ্দেশ্যে। নরঘাতক, কুরআন বিদ্বেষী এবং ইসলাম বিদ্বেষী তৎকালীন মেজিষ্ট্রেট ওয়াহিদুজ্জামান মোল্লার নেতৃত্বে পুলিশ গুলি চালায় সাধারন মানুষের উপর। সেই থেকে ১১ মে কুরআন দিবস হিসেবে পালন করে আসছে এদেশের ইসলামপ্রিয় জনগণ।
ঘটনার সূত্রপাত ভারতে ১৯৮৫ সালের ১০ই এপ্রিল। পৃথিবীর ইতিহাসে সেটি ছিল এক জঘন্যতম ঘটনা। ভারতীয় দু’জন উগ্রবাদী হিন্দু নাগরিক পদ্মমল চেপারা ও শীতল শিং আদালতে কোরআন বাজেয়াপ্ত করার মামলা দায়ের করে। তারা কোরআনের উল্লেখিত সূরা বাকারার ১৯১নং আয়াত ও সূরা তওবার ৩১ নং আয়াতের রেফারেন্স দিয়ে মামলা দায়ের করেছিল। কোরআন যেহেতু কাফের মুশরিকদের বিরুদ্ধে লড়াই করা, তাদের হত্যা করার কথা বলেছে সেহেতু কোরআন একটি সাম্প্রদায়িক উস্কানী দাতা গ্রন্থ।(নাউযুবিল্লাহ) তাই একে বাজেয়াপ্ত করার দাবি তুলে মামলা দায়ের করে। ভারতীয় সংবিধানের ২২৩ নং ধারা সি আর পিসি ১১৫(ক) ও ২৯৯ (ক) উদ্ধৃতি দিয়ে তারা আল কোরআনকে ভারতীয় সংবিধান বিরোধী বলে উল্লেখ করে।
বিচারপতি পদ্মা খাস্তগীর ভারতীয় সংবিধানে ঐশীগ্রন্থ সম্পর্কে যে বক্তব্য রযেছে তা হজম করে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে মামলা গ্রহণ করেন। তিনি ১২ই এপ্রিল এ বিষয়ে তিন সপ্তাহের মধ্যে এফিডেভিট প্রদানের জন্য রাজ্য সরকারের প্রতি নির্দেশ দেন। এ ঘটনায় গোটা ভারতে মুসলমানদের মধ্যে তীব্র উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। বিশ্বের প্রতিটি মুসলিম দেশ এর প্রতিবাদে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। যার উত্তাল তরঙ্গের জলরাশি আছড়ে পড়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠীর দেশ বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায়। বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশে পুলিশ ইসলামপ্রিয় তৌহিদি জনতার মিছিলে অত্যাচার নিপীড়নও চালায়।
১০ মে ১৯৮৫ সালে এদেশের ইসলামপ্রিয় জনগণ জুমার নামাজ শেষে বায়তুল মোকাররম মসজিদ থেকে উক্ত ঘটনার প্রতিবাদে মিছিল ও সমাবেশ করে। সেই সতঃস্ফুর্ত সমাবেশে লাঠিচার্জ করে ছত্রভঙ্গ করে স্বৈরশাসক এরশাদের পুলিশ। কী ভয়াবহ দুঃসাহস! সরাসরি কুরআনের বিরুদ্ধে সরকারের অবস্থান! তারই সূত্র ধরে চাঁপাইনবাবগঞ্জ আলীয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ জনাব হোসাইন আহমদ একটি সভার আহবান করেন। সেই সভা থেকে ১১ই মে ঈদগাহ ময়দানে বিকেল ৩টায় প্রতিবাদ সমাবেশের ডাক দেয়া হয়। সভার প্রস্তুতির জন্য পুরো জেলাতে লিফলেট ও মাইকিং করা হয়। এর পূর্বের দিন শুক্রবার মসজিদে জুমআর খুৎবায় এবং নামাজ শেষে ইমাম সাহেবেরা পরের দিন সামবেশে অংশ গ্রহণের জন্য আহবান জানান। সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে আবেগ ও উত্তেজনা বইতে থাকে। আবাল-বৃদ্ধ সবাই সেই সমাবেশে অংশগ্রহণের জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়। কিন্তু ১১ই মে হঠাৎ করে তৎকালীন পুলিশ সুপার আওলাদ হোসেন এবং মেজিষ্ট্রেট ওয়াহিদুজ্জামান মোল্লার নেতৃত্বে সভাস্থলে ১৪৪ ধারা জারি করে ব্যপক পুলিশ মোতায়েন করে। পুলিশ জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করে। ওয়াহিদুজ্জামান দম্ভ করে চেঁচিয়ে ওঠে বলে “এই মহুর্তে স্থান ত্যাগ করতে হবে নইলে গুলির আদেশ দিব, শালা মৌলবাদীদের সাফ করে দিবো”। কুরআন প্রেমিক জনতা চলে গেল না। তারা জানিয়ে দিলেন, গুলির ভয়ে এ স্থান ত্যাগ করা মানেই আল কোরআনের অপমান, আমরা এস্থান ত্যাগ করবো না।
জেলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে খণ্ড খণ্ড মিছিলের মাধ্যমে কুরআনপ্রেমী মানুষ ঈদগাহ ময়দানে জমায়েত হয়। এক পর্যায়ে মেজিষ্ট্রেট ওয়াহিদুজ্জামান বিনা উস্কানিতে গুলির নির্দেশ দেয়। পুলিশ একনাগাড়ে প্রায় পনের মিনিট পর্যন্ত গুলি রাবার বুলেট ও টিয়ার শেল নিক্ষেপ করতে থাকে। গুলিবিদ্ধ হয়ে ঢলে পড়লো পনের বছরের কিশোর স্কুলছাত্র আবদুল মতিন। পুলিশের গুলিতে একে একে শাহাদাৎ বরণ করলেন কৃষক আলতাফুর রহমান, রিক্সা চালক মোক্তার হোসেন, দশম শ্রেণীর ছাত্র রশিদুল হক, অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র শীষ মোহাম্মদ ও সেলিম এবং ৬ষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র শাহাবুদ্দৌলা। আহত হয় শামীম, গোলাম আযম বুলু, শরীফুল ইসলাম, আলাউদ্দিন, রায়হান, এনামুল হক, মাহবুব, রেজাউল, শাহজাহান, রাজুসহ নাম না জানা আরো অনেকেই। লাশ আর আহতদের স্তুপে ভরে গেল ঈদগাহ ময়দান। সেদিন টুপি, পাঞ্জাবি, দাঁড়ি দেখলেই নির্মমভাবে তাদের উপর আক্রমন চালায় নরপশু ওয়াহিদুজ্জামানের সাঙ্গপাঙ্গরা।
আহতদের রাজশাহীতে নিয়ে যাওয়া হলো দুটো মিনিবাসে করে। দেড়ঘন্টা পর যখন মিনিবাস থানা পার হচ্ছিল কুখ্যাত মেজিষ্ট্রেট আবারো গাড়ি থামিয়ে গুলির নির্দেশ দেয়। এতে আহত হয় গাড়ীর হেলপার, মারা যায় কাপড় ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম। আহতদের নামিয়ে দৈহিক নির্যাতন চালানো হয় এবং নিখোঁজ হয় কয়েকজন আহত ব্যক্তি। কেবল হত্যা ও জখম করেই ক্ষান্ত হয়নি পুলিশ হতাহতদের গুম করে ফেলেছিল সেই দিন। জানাজার মুহুর্তে লাশ কেড়ে নিয়ে আসা হয়েছে তাদের আত্নীয়-স্বজনদের কাছ থেকে। এটি ছিল চাঁপাইবাসীদের জন্য এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতার দিন। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে সেদিন বর্বর পুলিশের গুলিতে আহত হয়েছেন ২০ এর অধিক। নিখোঁজ সংখ্যা ৮ জন।
এতো রক্ত, এতো গুলি, এতো আহত এতো তান্ডব- তারপরও পরবর্তী দিনগলোতে সাহসের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছে চাঁপাই নবাবগঞ্জবাসী। পুলিশের গুলির মুখে নারায়ে তাকবীর ধ্বনি তুলে ছুটে আসেন তারা ঈদগাহ ময়দানে, কারফিউ উপেক্ষা মিছিল আর শ্লোগানে কাঁপিয়ে তোলে ছোট্ট শহর চাঁপাইনবাবগঞ্জ। ১২ই মে পরদিন হরতাল আহবান করা হয়। বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে বাজারে ও মসজিদে লিফলেট দেয়া হয়। গভীর রাতে কারফিউ ভঙ্গ করে সাইকলে চড়ে মোল্লার ফাঁসির দাবিতে পোস্টারিং করা হয়। পুলিশের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে চাঁপাইনবাবগঞ্জবাসী যে অভূতপূর্ব হরতাল পালন করেছে তা ইতিহাস হয়ে থাকবে। সেদিন কেবল গাড়ি-ঘোড়া বা রিক্সাই নয়, মহানন্দার বুকে কোন নৌকাও চলেনি। এভাবেই মানুষ প্রকাশ করেছে কুরআনের প্রতি ভালোবাসা এবং স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।
ছবিঃ ওয়াহিদুজ্জামান মোল্লা
বাংলাদেশের এ ঘটনার ফলে সারা বিশ্বে একটি জনমত সৃষ্টি হয় এবং এর ফলশ্রুতিতে ১৩ ই মে মামলাটি কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি বি. সি বাসক বামনের আদালতে স্থানান্তরিত হয় এবং তিনি উক্ত মামলাটি খারিজ করে দেয়। সেই থেকেই বাংলাদেশের ইসলামপ্রিয় জনগণ ১১ মে'র সেই দিনকে স্মরণ করে “কোরআন দিবস” হিসেবে পালন করে আসছে।
১৯৮৫ সালের চাঁপাইনবাবগঞ্জের সেই নরঘাতক, ইসলাম বিদ্বেষী ম্যাজিস্ট্রেট মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামানের বিচার তো এদেশে হয়ই নি বরং সে দিনকে দিন তার অন্যায় দূর্ণিতি চালিয়ে এসেছে। ইতিমধ্যে সে সচিব পর্যন্ত হয়ে গেছে। সেই মর্মান্তিক ঘটনার দীর্ঘ ৩০ বছর পর ফের খবরের শিরোনামে এসেছে সে। তবে এবার সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে। যুদ্ধ না করেই মুক্তিযুদ্ধের জাল সনদ গ্রহণ করে। সে মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট জালিয়াতি করে চাকুরি নিয়ে এই ধরণের অন্যায় দূর্ণিতিতে অংশ নেই। দুদকের অফিসে তার বিরুদ্ধে রয়েছে অনেকগুলো দূর্ণিতির ফিরিস্তি।
১৯৮৫ সালের ১১ মে চাঁপাইনবাবগঞ্জের এই বর্বরোচিত হত্যাকান্ডের বিচার এখনো হয়নি। এ ঘটনায় নিহতদের পরিবারের অভিযোগের তীর মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামানের বিরুদ্ধে হলেও বিগত ৩০ বছর বিভিন্ন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা সরকারগুলো তাকে তিরস্কার না করে বিভিন্ন মেয়াদে পুরস্কৃত করেছে। জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের গত আমলে দীর্ঘ সময় ধরেই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব ছিলেন মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামান। এরপর ২০১৪ সালের মধ্য জানুয়ারি থেকে প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় তাকে প্রাইভেটাইজেশন কমিশনের চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ দেয়া হয়।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের আলোচিত ওই হত্যাকাণ্ডের বিচারের জন্য এখনো আশায় বুক বেঁধে অপেক্ষায় আছেন নিহতদের পরিবারের সদস্যরা। ৩০ বছর পার হয়ে গেলেও বর্বরোচিত এই হত্যাকাণ্ডের মূল নায়কদের শাস্তির দাবি থেকে সরে আসেনি নিহতদের স্বজনরা। চাঁপাইনবাবগঞ্জ ঈদাগাহ মাঠে যেন আজো শোনা যাচ্ছে কিশোর শীষ মোহাম্মদের আর্তনাদ, শহীদ রফিকুলের করুন আহাজারী। আব্দুল মতিন ও সেলিমের আর্তচিৎকারে শহীদ সবুর ও নজরুলের বুক ফাটা কান্না। আজো বিচারের বানী নিভৃতে কাঁদে। ওয়াহিদুজ্জামান মোল্লাদের বিচার দুনিয়ার জমিনে না হলেও আখিরাতে অবশ্যই আল্লাহর দরবারে এই বিচার আমরা পাবো এবং এই বাংলায় কুরআনের শাসন কায়েমের মধ্য দিয়েই আমরা উত্তম প্রতিশোধ গ্রহন করবো সেদিনের নির্মমতার। ইনশাআল্লাহ।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন