দু’দফা জামায়াত নিষিদ্ধ :
আইয়ুব খান ১৯৫৮ সালে এবং ১৯৬৪ সালে জামায়াত নিষিদ্ধ করে। ১৯৬৪ সালে গ্রেপ্তার হন এবং সে বছরই মুক্তি পান। সরকারের স্বৈরচারী আচরণের প্রতিবাদ এবং ইসলামী সংবিধানের জন্য চলমান আন্দোলনের জন্য জামায়াতের উপর এই নির্যাতন নেমে আসে। [৬]
আগরতলা ষড়যন্ত্র :
আইয়ুব সরকারকে উৎখাত করার জন্য শেখ মুজিব ভারতের গোয়েন্দা বাহিনীর সাথে গোপন বৈঠক করে। এটা সরকারি গোয়েন্দারা আবিষ্কার করে এবং মুজিব সহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করে। মুজিবের বিরুদ্ধে জনগণ ক্ষেপে উঠে। মুজিবসহ আওয়ামীলীগ এই বৈঠকের কথা অস্বীকার করে। জনগণ গোড়া থেকেই ভারতবিরোধী। মুজিব এই ধরণের কাজ করতে পারে তা তাদের ধারণার অতীত। বাঙ্গালীরা স্বৈরাচারী আইয়ুবের কথা বিশ্বাস করেনা বিশ্বাস করে আওয়ামী লীগের কথা। আওয়ামীলীগ এই মামলার নাম দেয় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিরুদ্ধে এবং শেখ মুজিবের মুক্তির দাবীতে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ আন্দোলন শুরু করে। [১৩, ১৪]
অপরদিকে পশ্চিম পাকিস্তানেও স্বৈরাচারী আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। সৃষ্টি হয় গণঅভ্যুত্থানের। বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি বড় ধরণের মিথ্যা প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। বলা হয়ে থাকে ১৯৬৯ সালে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানে আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে গণঅভ্যুত্থান হয়েছে। সেই গণ অভ্যুত্থানের চাপ সামলাতে না পেরে আইউব ক্ষমতা ইয়াহিয়া খানের হাতে দিয়ে অবসরে চলে যায় বা পদত্যাগ করে। কিন্তু ব্যপারটা তা ছিলো না।
পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটিতে আইয়ুব বিরোধী ছাত্র বিক্ষোভ শুরু হয়। সেই বিক্ষোভ ক্রমেই বিদ্রোহে রূপ নেই। আর এই বিদ্রোহের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন জুলফিকার আলী ভুট্টো। তার নেতৃত্বে আইয়ুবের পতন হয়। আর আইয়ুবের পতনের আগেই শেখ মুজিবের মুক্তি দেয় আইয়ুব খান। শেখ মুজিব আইয়ুবের হাতকে শক্তিশালী করার ঘোষণা দেয়। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে পড়ুন, "ঊনসত্তরে আইয়ুব খানের পতনে কি বাঙালিদের ভূমিকা ছিল?"
যাই হোক, আইয়ুব খান পরিস্থিতি সামাল দিতে না পেরে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ায় সেনাপ্রধান ইয়াহিয়া খানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে। ইয়াহিয়া খান এসেই প্রথমে সাধারণ নির্বাচনের ঘোষনা দেয়। আগরতলা মামলা নিষ্পত্তির চার যুগ পর মামলার আসামী ক্যাপ্টেন এ. শওকত আলী ২০১১ সালে প্রকাশিত একটি স্বরচিত গ্রন্থে এ মামলাকে সত্য মামলা' বলে দাবী করেন। মজার বিষয় হলো এই দাবীটা তিনি যদি ১৯৬৯ এ করতেন তাহলে আর আওয়ামীলীগের এতদিন পর্যন্ত রাজনীতি করার সৌভাগ্য হতো না। ভারত সংশ্লিষ্টতা কিংবা পাকিস্তান বিরোধী কোন কর্মকান্ড সে সময় জনগণ সহ্য করতো না। এই সমস্যাটা হয়েছে ভাসানীর ক্ষেত্রে। ভাসানী ১৯৭০ এ বাঙ্গালীদের মধ্যে সবচাইতে প্রভাবশালী নেতা ছিলেন। তিনি নির্বাচন না করে ঘোষনা দিলেন “ভোটের বাক্সে লাথি মার বাংলাদেশ স্বাধীন কর”। বাঙ্গালী জনগণ লাথি ঠিকই মেরেছে তবে ভোটের বাক্সে নয়, ভাসানী এবং তার দল ন্যশনাল আওয়ামী পার্টিকে। ভাসানী হিরো থেকে জিরোতে পরিণত হন। অপরদিকে পাকিস্তানের সংহতির প্রতি আনুগত্য পোষন করে ইশতেহারে কুরআন সুন্নাহ পরিপন্থী কোন সিদ্ধান্ত নেবেন না এমন প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচন করেন মুজিব। মুজিবের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে মুজিবকে বিপুল ভোট দেয় বাঙ্গালী জনগণ।
পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটিতে আইয়ুব বিরোধী ছাত্র বিক্ষোভ শুরু হয়। সেই বিক্ষোভ ক্রমেই বিদ্রোহে রূপ নেই। আর এই বিদ্রোহের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন জুলফিকার আলী ভুট্টো। তার নেতৃত্বে আইয়ুবের পতন হয়। আর আইয়ুবের পতনের আগেই শেখ মুজিবের মুক্তি দেয় আইয়ুব খান। শেখ মুজিব আইয়ুবের হাতকে শক্তিশালী করার ঘোষণা দেয়। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে পড়ুন, "ঊনসত্তরে আইয়ুব খানের পতনে কি বাঙালিদের ভূমিকা ছিল?"
যাই হোক, আইয়ুব খান পরিস্থিতি সামাল দিতে না পেরে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ায় সেনাপ্রধান ইয়াহিয়া খানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে। ইয়াহিয়া খান এসেই প্রথমে সাধারণ নির্বাচনের ঘোষনা দেয়। আগরতলা মামলা নিষ্পত্তির চার যুগ পর মামলার আসামী ক্যাপ্টেন এ. শওকত আলী ২০১১ সালে প্রকাশিত একটি স্বরচিত গ্রন্থে এ মামলাকে সত্য মামলা' বলে দাবী করেন। মজার বিষয় হলো এই দাবীটা তিনি যদি ১৯৬৯ এ করতেন তাহলে আর আওয়ামীলীগের এতদিন পর্যন্ত রাজনীতি করার সৌভাগ্য হতো না। ভারত সংশ্লিষ্টতা কিংবা পাকিস্তান বিরোধী কোন কর্মকান্ড সে সময় জনগণ সহ্য করতো না। এই সমস্যাটা হয়েছে ভাসানীর ক্ষেত্রে। ভাসানী ১৯৭০ এ বাঙ্গালীদের মধ্যে সবচাইতে প্রভাবশালী নেতা ছিলেন। তিনি নির্বাচন না করে ঘোষনা দিলেন “ভোটের বাক্সে লাথি মার বাংলাদেশ স্বাধীন কর”। বাঙ্গালী জনগণ লাথি ঠিকই মেরেছে তবে ভোটের বাক্সে নয়, ভাসানী এবং তার দল ন্যশনাল আওয়ামী পার্টিকে। ভাসানী হিরো থেকে জিরোতে পরিণত হন। অপরদিকে পাকিস্তানের সংহতির প্রতি আনুগত্য পোষন করে ইশতেহারে কুরআন সুন্নাহ পরিপন্থী কোন সিদ্ধান্ত নেবেন না এমন প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচন করেন মুজিব। মুজিবের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে মুজিবকে বিপুল ভোট দেয় বাঙ্গালী জনগণ।
সত্তরের নির্বাচন ও ফলাফল :
ইয়াহিয়া খানের সামরিক শাসনামলে ১৯৭০ সনে পাকিস্তানে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৭০ সনের অক্টোবরে নির্বাচন হওয়ার কথা থাকলেও বন্যার কারণে ডিসেম্বর পর্যন্ত পিছিয়ে যায়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ১৯৭১ এর জানুয়ারি পর্যন্ত পিছিয়ে যায়। নির্বাচনে মোট ২৪ টি দল অংশ নেয়। ৩০০ টি আসনে মোট ১,৯৫৭ জন প্রার্থী অংশগ্রহণ করার জন্য মনোনয়নপত্র জমা দেয়। এর পর কিছু প্রার্থী তাদের প্রার্থীতা প্রত্যাহার করে নেয়। মনোনয়নপত্র বাছাই শেষে ১,৫৭৯ জন প্রার্থী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দীতা করে। আওয়ামী লীগ ১৭০ আসনে প্রার্থী দেয়। এর মধ্যে ১৬২টি আসন পূর্ব পাকিস্তানে এবং অবশিষ্টগুলি পশ্চিম পাকিস্তানে। জামায়াতে ইসলামী দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যক প্রার্থী দেয়। তাদের প্রার্থী সংখ্যা ১৫১। পাকিস্তান পিপলস পার্টি মাত্র ১২০ আসনে প্রার্থী দেয়। তার মধ্যে ১০৩ টি ছিল পাঞ্জাব ও সিন্ধু প্রদেশে। পূর্ব পাকিস্তানে তারা কোন প্রার্থী দেয়নি। পিএমএল (কনভেনশন) ১২৪ আসনে, পিএমএল (কাউন্সিল) ১১৯ আসনে এবং পাকিস্তান মুসলিম লীগ (কাইয়ুম) ১৩৩ আসনে প্রতিদ্বন্দীতা করে।
নির্বাচনে জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণ এবং প্রায় ৬৫% ভোট পড়েছে বলে সরকার দাবী করে। সর্বমোট ৫৬,৯৪১,৫০০ রেজিস্টার্ড ভোটারের মধ্যে ৩১,২১১,২২০ জন পূর্ব পাকিস্তানের এবং ২৩,৭৩০,২৮০ জন ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের ভোটার। [১৫]
ন্যশনাল এ্যাসেম্বলীতে আওয়ামী লীগ ১৬০ টি আসনে জয়লাভ করে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। সাধারণ নির্বাচনের একই সাথে প্রাদেশিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তান এ্যাসেম্বলীর ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৮৮টিতে জয়লাভ করে। পাকিস্তান পিপলস পার্টি পশ্চিম পাকিস্তানে ১৩৮টি আসনের ৮১টিতে জয়লাভ করে। [১৫]
আওয়ামী লীগ ৩৮.৩% ভোট এবং আসন ১৬০
পাকিস্তান পিপলস পার্টি ১৯.৫% ভোট এবং আসন ৮১
পিএমএল (কাইয়ুম) ৪.৫% ভোট এবং আসন ৯
পিএমএল (কনভেনশন) ৩.৩% ভোট এবং আসন ৭
জমিয়ত উলেমা -ই- ইসলাম ৪.০% ভোট এবং আসন ৭
মারকাজি জমিয়তন-উলেমা-পাকিস্তান ৪.০% ভোট এবং আসন ৭
ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ওয়ালি) ২.৩% ভোট এবং আসন ৬
জামায়াত-ই-ইসলামী ৬.০% ভোট এবং আসন ৪
পিএমএল (কাউন্সিল) ৬.০% ভোট এবং আসন ২
পিডিপি ২.৯% ভোট এবং আসন ১
স্বতন্ত্র ৭.১% ভোট এবং আসন ১৬
১৯৭১ সাল হতে পারতো পাকিস্তানের জন্য সবচেয়ে ভালো সময়। কারণ এই প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। যদিও এই নির্বাচন সামরিক শাসনের অধীনে হয়েছে তারপরও এই নির্বাচন নিয়ে কোন পক্ষেরই অভিযোগ ছিল না। সুষ্ঠু নির্বাচন সবাই মেনে নেন। সংবিধান অনুযায়ী বৈধ প্রধানমন্ত্রী হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেন আওয়ামীলীগের শেখ মুজিব। ইয়াহিয়া খান সেভাবেই প্রস্তুত হচ্ছিলেন। কিন্তু বাধ সাধে ভুট্টো। সে প্রশ্ন তোলে নৈতিকতার। কারণ পাঁচটি প্রদেশের মধ্যে একটি প্রদেশ ছাড়া বাকী চারটিতে কোন সমর্থনই পায়নি আওয়ামীলীগ। শুধু একটি প্রদেশের ভোট দিয়ে পুরো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়া সমীচীন নয়। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া উভয়পক্ষকে আলোচনার প্রস্তাব দেন। মুজিব আলোচনা প্রত্যাখ্যান করেন এবং বলেন কারো যদি আলোচনা করতে হয় সে যেন ঢাকায় এসে আলোচনা করে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ভুট্টোকে নিয়ে ঢাকায় আসেন। পার্লামেন্ট অধিবেশন স্থগিত করেন এবং শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য ত্রিপক্ষীয় আলোচনা শুরু করেন।
ষড়যন্ত্র শুরু হয় ১৯৬২ সাল থেকে :
রুশপন্থী বামেরা একটা সফল বিপ্লবের জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছিল যেখানে তাদের আদর্শ তারা বাস্তবায়ন করবে। এদিকে র’ গঠিত হওয়ার পর তাদের ১ম প্রজেক্ট হলো পাকিস্তান আলাদা করা। ১৯৬২ সালে সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে ছাত্রলীগের মধ্যে একটি গোপন সংগঠন সৃষ্টি হয় যার নাম নিউক্লিয়াস। র’ এর পক্ষ থেকে চিত্তরঞ্জন, ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে সিরাজুল আলম খানের সমন্বয়ে এই আন্দোলন অত্যন্ত গোপনে চলতে থাকে। ছাত্রলীগের মধ্যে যারা সমাজতন্ত্রের পক্ষে তাদের আস্তে আস্তে গোপন সংগঠনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এরাই মূলত বাংলাদেশ নাম ঠিক করে, পতাকা ঠিক করে, সংগীত ঠিক করে ১৯৬৮ সালে। [১৬, ১৭]
অপরদিকে মাওবাদীরা মানে চীনপন্থী বামেরাও এমন একটি রাষ্ট্রের স্বপন দেখতো তবে তাদের গুরুদের কাজ থেকে আশা না পাওয়ায় তারা একটু পিছিয়ে থাকে। ভাসানী নিউক্লিয়াস সম্পর্কে জানতেন। কিন্তু চীন পাকিস্তানের কৌশলগত মিত্র হওয়ায় ভাসানীর বহিঃবিশ্বের সাপোর্ট পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। তবুও সে তার জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে স্বাধীনতার ঘোষনা দিয়ে দেয়। এই ঘোষনাই তার রাজনৈতিক ক্যরিয়ার শেষ করে দেয়। কারণ এদেশের পাঁচ শতাংশ মানুষও এমনকি ভাসানীর দল ন্যাপ যারা করে তারাও স্বাধীনতার পক্ষে ছিল না। [১৭]
র’ আর নিউক্লিয়াসের লোকজন গোপনে স্বাধীনতার প্রস্তুতি নিতে থাকে। এক্ষেত্রে তাদের প্রয়োজন ছিল কোন একটা গন্ডগোলের উসিলায় দেশে যুদ্ধ লাগিয়ে দেয়া। বাকী কাজ ভারত করবে। এটা ছাড়া তাদের একজন নেতাও দরকার ছিল। তারা মুজিবকে নানানভাবে প্ররোচিত করেন। মুজিব তাদের প্ররোচনায় কান দেন নি। আসলে কান দেয়ার কোন প্রয়োজনই মুজিবের পড়েনি। মুজিব যেখানে পুরো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার যোগ্যতা রাখে সেখানে কেন সে শুধু শুধু দেশ ভাগ করে একটা ছোট দেশের প্রধানমন্ত্রী হবে? আবার ভাগ হয়ে গেলে সেই দেশটা ভারতের পেটের ভেতর ঢুকে যাবে! আ স ম রব সহ ছাত্রলীগের নিউক্লিয়াসপন্থী নেতারা ৭১ এর ২ মার্চ বাংলাদেশের পতাকা মুজিবের বাড়ির সামনে উত্তোলন করেন। মুজিব অত্যন্ত রাগান্বিত হন এবং নিজেই পতাকা ছিড়ে ফেলেন। তারপরও থেমে থাকে নি তারা, গনহত্যা চালাতে শুরু করে। [১৬]
৩ ও ৪ মার্চ চট্টগ্রামের ফিরোজ শাহ কলোনীতে ও ওয়্যারলেস কলোনীতে প্রায় ৭০০ অবাঙ্গালীদের বাড়িঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। এখানে বসবাসকারী বহু শিশু, নারী, পুরুষ নিহত হয়। সে সময় সরকারি হিসেবে ৩০০ লাশ দাফন করা হয়। [১৮, ১৭, ১৯ ২০, ২১]
দ্যা টাইমস অফ লন্ডন ১৯৭১ সালের ৬ এপ্রিল রিপোর্ট করেছিলো, হাজার হাজার সহায় সম্বলহীন মুসলিম উদ্বাস্তু যারা ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় পূর্ব পাকিস্তানে এসে আশ্রয় গ্রহন করে তারা গত সপ্তাহে বিক্ষুব্ধ বাঙ্গালীদের দ্বারা ধ্বংসাত্মক আক্রমনের শিকার হয়। বিহারী মুসলিম উদ্বাস্তু যারা সীমানা পেরিয়ে ভারতে প্রবেশ করে এবং ভারতে প্রবেশকারী একজন বৃটিশ টেকনিশিয়ান এই খবর নিশ্চিত করেন। উত্তর পূর্ব শহর দিনাজপুরে শত শত অবাঙ্গালী মুসলিম মারা গিয়েছে। [১৭, ২২]
খুলনায় টেলিফোন এক্সচেঞ্জে ৪ মার্চ কয়েকজনকে হত্যা করা হয়, ৫ মার্চ খালিশপুর ও দৌলতপুরে ৫৭ জনকে অবাঙ্গালীকে ছোরা দা দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। সামরিক বাহিনীর কঠোর সমালোচক সাংবাদিক মাসকারেনহাসও স্বীকার করেছেন অবাঙ্গালীদের এই অসহায়ত্বের কথা। অবাঙ্গালীদের জান মাল রক্ষায় শেখ মুজিবের পক্ষ থেকে বাহ্যত নির্দেশ থাকলেও কোন কার্যকর উদ্যোগ ছিলনা। আওয়ামীলীগের কর্মীরা অদৃশ্য ইঙ্গিতে হত্যা খুন লুটতরাজ করে যাচ্ছিল অবারিতভাবে। সারাদেশেই চলছিল নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড। সেই হিসেবে ঢাকা অনেক ভালো ছিল। [১৭, ২৩, ২২]
ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসসহ অনেক দূতাবাসে হামলা চালায় বিদ্রোহীরা। ১২ মার্চ ও ১৫ মার্চ মার্কিন কনসুলেট লক্ষ্য করে বোমা হামলা ও গুলি করা হয়। ১৯ মার্চ হোটেল ইন্টারকন্টিনালে বোমা হামলা ও গুলি করে বিদ্রোহীরা। এগুলো ছিল শান্তি আলোচনার জন্য বড় অন্তরায়। তারপরও বলা চলে ইয়াহিয়া, ভুট্টো ও মুজিব আলোচনা ফলপ্রসুই হতে যাচ্ছিল। পরিস্থিতির উপর মুজিবসহ কারোই নিয়ন্ত্রণে ছিলনা। সেনাবাহিনীও সরকারি আদেশের বাইরে কোন জোরালো ভূমিকা রাখতে পারছিল না। [১৭, ২৩]
আর এদিকে RAW, এদেশীয় বাম ও আওয়ামীলীগে ঘাপটি মেরে থাকা সমাজতন্ত্রবাদীরা এদেশকে যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়ার জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছে। ইয়াহিয়া, ভুট্টো ও মুজিবের আলোচনাকে ব্যর্থ করে দেয়ার জন্য একের পর এক অবাঙ্গালী গণহত্যা চালিয়েছে, সারা দেশে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। অনেক বিহারীকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে বিশেষ করে জগন্নাথ হল এবং ইকবাল হলে (বর্তমান জহুরুল হক হল) আটকে রেখে নির্যাতন ও হত্যা করা হয়। [১৭, ২২]
সারাদেশে সেনাবাহিনীর উপর বিনা উস্কানীতে আক্রমন করেছিলো বাঙ্গালীদের একটা অংশ। সবচেয়ে বড় ঘটনা ঘটে জয়দেবপুরে। গাজিপুরে সমরাস্ত্র কারখানার নিরাপত্তা জোরদার করার জন্য ব্রিগেডিয়ার জাহানজেবের নেতৃত্বে একদল সৈন্য সেখানে পৌঁছানোর আগে আওয়ামীলীগ কর্মীরা জয়দেবপুরে ব্যরিকেড সৃষ্টি করে। ব্যরিকেডের জন্য তারা একটি ট্রেনের বগি ব্যবহার করে। অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে জাহানজেবের নেতৃত্বে সৈন্যদল। তারা ব্যরিকেড সরিয়ে সেখানে পৌঁছায়। নিরাপত্তার বিষয়গুলো দেখে জাহানজেব আরবাব আবার যখন হেডকোয়ার্টারে ফিরে যাচ্ছিলেন তখন বিশৃংখলাকারীরা সৈন্যদলকে আবারো ঘিরে ফেলে। বন্দুক, শর্টগান, লাঠি, বোমা ইত্যাদি নিয়ে হামলা চালায়। জাহানজেব বাঙ্গালী অফিসার লে. ক. মাসুদকে গুলি চালাতে নির্দেশ দিলেন। মাসুদ ইতস্তত করলে অপর বাঙ্গালী অফিসার মঈন তার সৈন্যদের নিয়ে পাল্টা আক্রমন চালালে কিছু মানুষ নিহত হয় বাকীরা পালিয়ে যায়। মাসুদকে পরে ঢাকায় এসে দায়িত্ব থেকে অব্যহতি দেয়া হয়। তার স্থলাভিষিক্ত করা হয় আরেক বাঙ্গালী অফিসার কে এম সফিউল্লাহকে। [১৭, ২৩]
এই ঘটনার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কে এম সফিউল্লাহ বলেন, ১৯ মার্চ সকাল দশটায় তার ইউনিটকে জানানো হয় ব্রিগেড কমান্ডার মধ্যহ্নভোজে আসছেন এবং নিকটবর্তী গাজিপুর সমরাস্ত্র কারখানা পরিদর্শন করবেন। কিন্তু জনতা প্রায় ৫০০ ব্যরিকেড বসিয়ে সৈন্যদের আটকে দেয়। এগুলো সরিয়ে তারা আসলেও ফিরে যাওয়ার সময় জয়দেবপুরে মজবুত ব্যরিকেড সৃষ্টি করলে লে. ক. মাসুদ তাদের বুঝানোর চেষ্টা করেছিলেন। এমন সময় দুজন বাঙ্গালী সৈনিক জাহানজেবকে জানায় তাদেরকে বেধড়ক পিটিয়েছে, অস্ত্র গোলাবারুদ ছিনিয়ে নিয়েছে। এবার জাহানজেব গুলি করার নির্দেশ দিলে মঈন তার সৈন্যদের গুলি করতে বলে। তবে বাংলায় বলে দেয় ফাঁকা গুলি করার জন্য। এরপরও পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রনে না এলে এবার জাহানজেব কার্যকরভাবে গুলি করার নির্দেশ দেন। তারাও পাল্টা গুলি ছোঁড়ে। দু’জন নিহত হয়। সফিউল্লাহ আরো জানান, গাজিপুরের পরিস্থিতিও ছিল উত্তেজনাকর। রাস্তায় ব্যরিকেড দেয়া হয়েছিল। সমরাস্ত্র কারখানার আবাসিক পরিচালক ব্রিগেডিয়ার করিমুল্লাকে আটকে ফেলে বাঙ্গালীরা। আবাসিক পরিচালককে উদ্ধার করতে আমরা সেনা প্রেরণ করেছিলাম। [২৩]
এভাবে সারাদেশে সেনাবাহিনীকে নানাভাবে উস্কে দিয়ে যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টি করেছিলো বাঙ্গালীদের একটা অংশ। ইয়াহিয়া বিদ্রোহ দমন করার জন্য টিক্কা খানকে এদেশে আনলেও সেনাবাহিনীকে শুধুমাত্র আক্রান্ত হওয়া ছাড়া কোন ভূমিকা নিতে বারণ করেন। ২৫ মার্চ পর্যন্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এই ধৈর্য্যের প্রশংসা করেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কট্টর সমালোচক সাংবাদিক মাসকারেনহাস। এসব ঘটনায় মুজিব বেশ চাপ পড়েছিলেন। সমঝোতাও পড়েছিলো হুমকির মুখে। তারপরও হয়তো সমঝোতা হত। কিন্তু একটা ছবি যা বিদেশী পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়েছিলো এরপর আর কোন আলোচনাতে অংশ নিতে রাজি হয়নি ইয়াহিয়া এবং ভুট্টো। সেটি ছিল ঢাকা ভার্সিটি এলাকায় যুবক ছেলে মেয়েদের যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে মার্চপাস্টের ছবি। ইয়াহিয়া এবং ভুট্টো একথা মনে করেই নিয়েছেন আলোচনার নামে সময়ক্ষেপন করে মূলত মুজিব ভারতীয় স্বার্থ হাসিলের জন্য যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
এই রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকান্ডের জন্য ও আটক বিহারীদের উদ্ধারের জন্য সেনাবাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল সমূহে অভিযান চালায়। এসময় তারা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা খালি করে দেয়ার জন্য বলেন। সকল ছাত্র এবং শিক্ষক হল ছেড়ে দিলেও কয়েকজন শিক্ষক ও প্রায় পঞ্চাশজনের মত ছাত্র র’ ইঙ্গিতে সেদিন বিশ্ববিদ্যালয় না ছেড়ে সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। বিদ্রোহী ছাত্রদের চেষ্টা ছিল বালির বাঁধের মত। সেদিন হলে যারা সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে চেয়েছিলো তাদের সবাইকে নির্মমভাবে হত্যা করে সেনাবাহিনী। এটাই অপারেশন সার্চলাইট নামে পরিচিত। এবং এটা খুবই যৌক্তিক অপারেশন ছিল। তবে সবাইকে হত্যা না করে গ্রেপ্তার করতে পারলে পাকিস্তান সরকার হয়তো সেসময় পরিস্থিতি ভালোভাবে সামাল দিতে পারতো। [১৭]
এতক্ষন পর্যন্ত যত ঘটনা ঘটেছে তাতে কোনভাবেই দেশ ভাগ হওয়ার মত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি। এদেশের মানুষ পাকিস্তান সেনাশাসনের প্রতিবাদ করেছে। গণতন্ত্র চেয়েছে কিন্তু দেশভাগ কেউই চায়নি। এর পরদিনই জিয়াউর রহমান নিজ সিদ্ধান্তে ক্যু করেন। ওসমানী তার এই ক্যু কে ভালো চোখে দেখেননি। তিনি কিছু রাজনৈতিক লোকদের একত্র করে ১৭ এপ্রিল আবার ক্যু করেন এবং স্বাধীন রাষ্ট্রের ঘোষনাপত্র পাঠ করেন অতঃপর ভারত গমন করেন। জয় হয় ভারতীয় ষড়যন্ত্রের। জামায়াত সেসময় নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য আন্দোলন করে এবং দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার পক্ষে অবস্থান নেয়। জামায়াতের এই অবস্থান ছিল এদেশের অধিকাংশ মানুষের অবস্থান। আওয়ামীলীগের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান নেন। স্বাধীনতা এদেশের মানুষের দাবী ছিল না। [১৭]
কথিত স্বাধীনতার নামে ভারতের গোলামী চেয়েছিলেন এদেশের কিছু সমাজতন্ত্রী মানুষেরা আর কিছু উচ্চবিলাসী সেনা কর্মকর্তা। জামায়াত সেসময় একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে অবস্থান নিয়েছে কোন সশস্ত্র গ্রুপ হয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহন করেনি। জামায়াত যুদ্ধ বন্ধে কয়েকবার চেষ্টা করেছিল, শান্তি আনার চেষ্টা করেছিল, সরকার এবং বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মধ্যে সমঝোতার চেষ্টা করেছিল কিন্তু দু-পক্ষের বাড়াবাড়িতে সেটা সম্ভব হয়নি। হত্যা খুন ধর্ষন উভয় পক্ষ করেছে। জামায়াত উভয়পক্ষের অন্যায় আচরণের প্রতিবাদ করেছে আর বিচ্ছন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে কথা বলেছে যারা ভারতের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করেছে। [২৪]
পাকিস্তান আমল এবং জামায়াত। পর্ব-০১
পাকিস্তান আমল এবং জামায়াত। পর্ব-০২
তথ্যসূত্র
১- ইসলামী বিপ্লবের পথ/ সাইয়্যেদ আবুল আলা মওদুদী
২- মাওলানা মওদুদী/ একটি জীবন একটি ইতিহাস
৩- The History of Urdu Language
৪- ভাষা আন্দোলন, বাংলা পিডিয়া
৫- কাদিয়ানী সমস্যা/ সাইয়্যেদ আবুল আলা মওদুদী
৬- মাওঃ মওদুদী, একটি জীবন একটি ইতিহাস/ আব্বাস আলী খান
৭- ছয় দফা থেকে বাংলাদেশ/ রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী
৮- বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ, প্রামান্য চিত্র।
৯- বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে 'র' ও সিআইএর ভূমিকা/ মাসুদুল হক।
১০- আব্দুল মালেক উকিলের সাক্ষাতকার, সাপ্তাহিক মেঘনা, ১৯৮৫ সালের ১৬ই ডিসেম্বর
১১- কাল নিরবধি/ ড: আনিসুজ্জামান
১২- স্বৈরাচারের দশ বছর/ আতাউর রহমান খান
১৩- বাংলাদেশে র/ আবু রুশদ
১৪- সত্য মামলা আগরতলা/ কর্ণেল শওকত আলী (অবঃ)
১৫- The last days of United Pakistan/ G.W.Choudhury
১৬- দুঃসময়ের কথাচিত্র সরাসরি/ ড. মাহবুবুল্লাহ ও আফতাব আহমেদ
১৭- বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধঃ বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ, এম আই হোসেন।
১৮- দ্যা ক্রুয়েল বার্থ অব বাংলাদেশ, আর্চার ব্লাড
১৯- The 1971 Indo-Pak war, A soldier's Narrative, Hakim Arshad Koreshi
২০- The Crisis in East Pakistan, Govt of Pakistan, 5 August, 1971.
২১- Anatomy Of Violence, Sarmila Bose
২২-The event in East Pakistan, 1971- International Commission of Jurists, Geneva.
২৩- ডেড রেকনিং, শর্মিলা বসু
২৪- পলাশী থেকে বাংলাদেশ/ অধ্যাপক গোলাম আযম
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন