রাজেশ ফার্মা। মেইন রোডের পাশে বড় ঔষধের দোকান। বেচাকেনা ভালো। সত্ত্বাধিকারী রাজেশ রায় যতটা পরিচিত দোকানের জন্য তার চাইতে বেশী পরিচিত শিক্ষক হিসেবে। জিলা স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক। বিজ্ঞান পড়ান। দিনরাত খুব ব্যস্ততার মধ্যেই তাকে কাটাতে হয়। সকালে দুই ব্যাচ প্রাইভেট পড়ান। এরপর স্কুল। বিকেলে আবার ঔষধের দোকানে সময় দেন। বরাবরই তিনি হিসেবী মানুষ। ইদানিং আরো বেশী হিসেবী। ছেলে পরান দাঁড়িয়ে আছে দোকানের সামনে প্রায় আধাঘন্টা। তার সাইকেলের টায়ার ফেটে গেছে। সারাতে হবে। কিন্তু রাজেশ সাহেব এত সহজে টাকা ছাড়তে রাজি নন। তার দাবী পরানের অসাবধানতার কারণেই এই ঘটনা ঘটেছে। অতঃএব এর দায় তাকে নিতে হবে। সে আগামী দু’দিন টিফিনের জন্য যা টাকা পাবে তা দিয়ে টিফিন না খেয়ে সাইকেল সারাতে হবে। এটাই তার প্রাপ্য শাস্তি।
ছেলে পরানও নাছোড়বান্দা। কিছুতেই সে তার বাবার কথা মানতে রাজি নয়। তার দাবী এই সাইকেলে করে গতকাল অতিরিক্ত ভারবহনের কারণেই এই দূর্ঘটনা ঘটেছে। অতিরিক্ত ভারবহন বলতে এক মণ ওজনের চাউলের বস্তা গতকাল নিতে হয়েছে। রাজেশ সাহেব সাধারণত যেদিন চাউল কিনতে হয় সেদিন পরানকে নিয়ে যান। তিনি বাজার করে চাউল ছাড়া অন্যান্য সদাই রিকশায় করে নিয়ে আসেন। আর চাউলের বস্তা তুলে দেন পরানের সাইকেলে। এতে বিশ টাকা সেইভ হয়। নানা তর্ক, যুক্তি, পাল্টা যুক্তি শেষে টাকা দিতে বাধ্য হলেন রাজেশ সাহেব। ছেলে পরান টাকা নিয়ে যাওয়ার সময় বলে গেছে আর কোনদিন নাকি সে চাউলের বস্তা সাইকেলে তুলবে না।
সখীপুরে হিন্দুবাড়ি একটাই। আর এই বাড়ির প্রধান রাজেশ সাহেব। এখানে সবাই তার আত্মীয় স্বজন। সবার চাইতে বেশী টাকা উপার্জন করা সত্ত্বেও রাজেশ সাহেবের ঘরই সবচেয়ে মলিন। তিনি খরচ করেন কম। তার ধারণা বাংলাদেশে টাকা খরচ করা ঠিক না। তিনি তার দেশ বলতে ভারতকেই বুঝেন। ভারতীয় জিনিস ছাড়া কোন জিনিস কেনেন না। তার চাকরী আছে আর আট মাস। এরপর তার ইচ্ছা তিনি ভারত চলে যাবেন পুরো গোষ্ঠীসহ। তাই তিনি টাকা জমাতে থাকেন বহু বছর জুড়ে।
রাজেশ সাহেবের চাচাতো ভাইরা স্বর্ণের ব্যবসা করেন। তাদের সাথেও তিনি ভারত যাওয়ার বিষয়টা শেয়ার করেন। তারাও সানন্দে রাজি হয়। গোপনে শুরু হয় গুছানোর কাজ। তাদের দেশ ছাড়ার বিষয়টা কঠিনভাবে গোপন রাখে তারা। দেখতে দেখতে সময় চলে যায়। রাজেশ সাহেবের চাকরী শেষ হয়ে যায়। পেনশনের টাকা একত্রেই সব তুলে নেন। একদিন তার দোকান বিক্রী করে দেন। প্রতিবেশীরা সবাই হায় হায় করে। রাজেশ সাহেব বলেন ছোট চাচাতো ভাইকে বিদেশ পাঠাবো তো... তাই কিছু টাকার জরুরী দরকার ছিল। এজন্যই দোকান বিক্রী। আসল কথা গোপন করে।
এলাকার খন্দকার সাহেব ডাক্তারির পাশাপাশি মোটামুটি জমির কারবার করেন। একদিন খুব সকালে রাজেশ সাহেব এসে উপস্থিত খন্দকার সাহেবের বাড়িতে। বয়সের দিক দিয়ে খন্দকার সাহেব একটু ছোট হলেও দুজনেই ছোটবেলা থেকে বন্ধু। সাদরে অভ্যর্থনা জানালেন খন্দকার সাহেব। রাজেশ সাহেব ইনিয়ে বিনিয়ে যা বললেন তার সার সংক্ষেপ হলো তার বউয়ের ক্যান্সার ধরা পড়েছে। বাংলাদেশে ভালো চিকিৎসা নেই। ভারত নিয়ে যেতে হবে। টাকা দরকার। অনেক টাকা। খন্দকার সাহেব ব্যথিত হলেন খুব। নিজে থেকেই বেশ কিছু টাকা ঋণ দিতে চাইলেন। কিন্তু রাজেশ সাহেব বললেন তিনি বাড়ি বিক্রী করে দিতে চান। ঋণ নিয়ে ছোট থাকতে চান না।
খন্দকার সাহেব অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন তবে থাকবেন কই? তিনি জবাব দিলেন সব কিছু ঠিকঠাক হলে এবং চিকিৎসা শেষে ফিরতে পারলে তার শ্বশুর বাড়িতে কিছু জমি আছে। সেখানে থাকার বন্দোবস্ত হবে। আর ফিরে আসলে চাচাতো ভাইদের সাথে স্বর্ণের ব্যবসা করবে। এর মধ্যে পরাণ নিশ্চয়ই চাকরী-বাকরী কিছু জুটাতে পারবে। তাই আর সমস্যা হবে না। তাই ভগবানের উপর ভরসা রেখে বাড়ি বিক্রয় করতে চায়। তার ক্যাশ টাকা লাগবে। তাই বাজারে যা দাম তার চাইতে কিছু কম হলেও তিনি ছেড়ে দিবেন। খন্দকার সাহেবের রাজী না হওয়ার কারণ নেই। রাজেশ সাহেব অত্যান্ত খুশি হলেন, যাওয়ার সময় বলে গেলেন ক্যন্সারের বিষয়ে এবং বাড়ি বিক্রয়ের বিষয়ে যেন কাউকে কিছু জানানো না হয়। কারণ ডাক্তারের পরামর্শে রোগের বিষয়টা রোগীর কাছে গোপন রাখা হয়েছে। সাবধান করে গেলেন, আপনি বৌদিকেও বলবেন না। মেয়েরা পেটে কথা রাখতে পারেনা।
আরো কিছুদিন পরের কথা। একদিন সকালে খন্দকার সাহেব বারান্দায় বসে চা খাচ্ছেন। হঠাৎ কাজের ছেলেটা এসে খবর দিল রায় বাড়ির সবাই হাওয়া হয়ে গেছে। খন্দকার সাহেব অবাক হলেন যাওয়ার কথাতো শুধু রাজেশের। কিন্তু পুরো বাড়ি হাওয়া হয়ে যাওয়ার কারণ তিনি বুঝতে পারেন নি। যাই হোক মনে মনে ঠিক করলেন আজ বিকেলেই তিনি রাজেশ সাহেবের বাড়ির দখল নিবেন। এই কথা চিন্তা করতেই হঠাৎ তার মনে হলো রাশেজের বউয়ের কথাতো সাজেদাকে বলা হয়নি। তিনি উঠে গিয়ে দ্রুত স্ত্রী সাজেদা বললেন রাজেশের স্ত্রীর ক্যন্সারের কথা এবং তার বাড়ি ক্রয় করার কথা। হায় হায় বলে আর্তনাদ করে উঠলেন সাজেদা। হিন্দুদের তুমি চেন নাই। এরা দশজনের কাছে জমি বিক্রী করে রাতের আঁধারে পালিয়ে যায়। তুমি ওর কথায় আমাকে পর্যন্ত বললে না।
সাজেদার কথার কোন গুরুত্বই দিলেন না খন্দকার সাহেব। তিনি রাজেশকে চিনেন। সেই ছোটবেলা থেকে। রাজেশ একটু কৃপণ কিন্তু তাই বলে তাকে প্রতারক তাকে কোনদিন মনে হয়নি। তাছাড়া সে স্কুল শিক্ষক। সামান্য মূল্যবোধ তো তার থাকবেই। নিজের ব্যস্ততায় ঐ পুরো সপ্তাহ রাজেশের বাড়ির মুখো হতে পারেননি। একদিন শুক্রবার আমিনকে (জমি জরিপকারী) ডেকে পাঠালেন। আমিন আসলে রাজেশের বাড়ির কথা বললেন। আমিন চোখ কপালে তুলে বললো আপনিও কিনেছেন সেই জমি? খন্দকার সাহেব অবাক হয়ে বললেন, আপনিও মানে? আমি ছাড়া অন্য কেউ কিনেছে নাকি? আমিন বললো, চলেন গিয়ে দেখেন সেখানে কি হচ্ছে?
রায় বাড়িতে মনে হয় যেন মেলা বসছে। লোকে লোকারণ্য। প্রায় সবাই মারমুখী। জানা গেল রাজেশের জমি কিনেছে চারজন। তার চাচাতো ভাইদের জমি কিনেছে আট জন। আরো বারো জনের কাছ থেকে তারা ৫০ লক্ষ টাকা লোন করে পালিয়ে গেছে। খন্দকার সাহেব জমির দখল নিতে চাইলেন। অন্য তিনজন মালিক খন্দকার সাহেবকে চরম অপমান করলো। তাদের দাবী রাজেশ চলে যাওয়ার খবর পেয়ে তার সম্পদ ভোগ করতে ছুটে গিয়েছেন তিনি। যদি তিনি সত্যই কিনে থাকেন তাহলে এতদিন পরে আসলেন কেন? ভীষন অপমানিত হয়ে রায় বাড়ি থেকে ফিরে আসলেন খন্দকার সাহেব। হার মানতে রাজি হননি।
মামলা ঠুকে দিলেন। একে একে সবাই কোর্টে আসলো। রাজেশের জমি নিয়ে মামলা চলতে লাগলো চার জনের মধ্যে। কেউ কাউরে নাহি ছাড়ে, সমানে সমান লড়াই চলতে লাগলো। এভাবে বছর বছর পার হতে লাগলো। খন্দকার সাহেব ভালো করে নিয়মমত রাজেশ থেকে সব কাগজপত্র বুঝে নিলেও বাকীরা এই বিষয়ে অতটা নজর দেয়নি। তাই খন্দকার সাহেবের কাগজের জোর ছিল বেশী। খন্দকার সাহেব টাকাও খরচ করেছেন দেদারছে। উকিল নিয়োগ করেছেন তার উকিল বন্ধুকে। তিনিও বেশ পরিশ্রম করেছেন। সব মিলিয়ে রায় এলো খন্দকার সাহেবের পক্ষেই। তিনি দখলেও নিয়েছেন। দখলে নিয়েই নীতিবান মানুষ খন্দকার সাহেব অপর তিন ব্যক্তিকে ডাকলেন। কে কত দিয়ে কিনেছে, কার কত খরচ হয়েছে মামলায়, সব বিবেচনায় একটা ফয়সালা করলেন। সিদ্ধান্ত হলো এখানে বহুতল ভবন হবে সবার অংশগ্রহনে। খন্দকার সাহেবেই এই বদান্যতায় সবাই খুশি এবং তাদের মধ্যে আর কোন ঝামেলা রইলো না। তারাও আর এ বিষয় নিয়ে উচ্চ আদালতে গেল না।
এদিকে রাজনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন হলো। আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় আসলো। কয়েকবছর ঠিকঠাক চললেও ধীরে ধীরে স্বৈরাচারী হয়ে উঠে সরকার। খন্দকার সাহেব সরকার বিরোধী লোক হিসেবে একটু কোণঠাসা হয়ে আছেন। তবে অন্যান্য রাজনৈতিক নেতার চাইতে ভালোই আছেন। তিনি নিজের বাসায় থাকতে পারেন। অন্যরা নিজের বাসায়ই থাকতে পারে না পুলিশের ভয়ে। রাজনীতি করা তো দূরের বিষয়। খন্দকার সাহেব ডাক্তার মানুষ। বহু মানুষের সেবা করেন এমনকি আওয়ামীলীগেরও। বিপদে সবাই তাকে কাছে পেতে চায়। এটাই খন্দকার সাহেবের ভালো থাকার কারণ।
এদিকে রাজেশের অবস্থা ভালো না। কলকাতায় সে নিজের ঠাঁই করে নিতে পারেনি। চাচাতো ভাইরা মোটামুটি ব্যবসা ধরে ফেলেছে। তবে অবস্থা মোটেই সন্তোষজনক নয়। রাজেশ কিছুই করতে পারেন নি। এদিকে বয়সও বেড়ে গেছে। আগের মত পরিশ্রম করতে পারেন না। কলকাতায় টুকটাক আয় যা হয় তার চাইতে খরচ বেশী। জমানো টাকা ক্রমেই নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। এই অবস্থায় বাংলাদেশে ফিরে আসা ছাড়া গতি নেই। আবার যে কান্ড করে এসেছে বাংলাদেশে মুখ দেখানোর বা ঠাঁই পাওয়ার কোন অবস্থা নেই। তারপরও তার আশা বাংলাদেশের কোন না কোন অংশে তার ঠাঁই হবে। কারণ বাংলাদেশে কাজ পাওয়া ভারতের চাইতে অনেক সোজা। ছাত্র পড়িয়েও কোন রকম দিন কাটানো যাবে।
রাজেশ সাহেবের আফসোসের এখন সীমা নাই। তিনি আসলে কিসের জন্য আফসোস করবেন ভেবে পান না। প্রতারণার জন্য কখনো কখনো আফসোস করেন, ভাবেন ঐ প্রতারণা না করলে আজ তিনি এলাকায় আবার সম্মানের সাথে গৃহিত হতেন। পড়ানোর জন্য ছাত্র পেতেন অনায়াসে, আবার ঔষধের দোকানটাও চালু করতে পারতেন। আবার আফসোস করেন বাংলাদেশ ছাড়ার সিদ্ধান্তের জন্য। ঐ ভুল সিদ্ধান্তটা মাথায় না আসলে আজ তিনি কত আরামে থাকতে পারতেন। অবশ্য তিনি বুঝতে পারেন নি কলকাতার মানুষেরা এতটা খাইস্টা হবে। ওরা যে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া হিন্দুদের মানুষই মনে করে না এটা তিনি ভাবতেই পারেন নি। এই আফসোসের মধ্যেই একদিন তার মাথায় উঁকি দিল আরেক শয়তানি বুদ্ধি।
একদিন রাজেশকে দেখা গেল সখিপুরে, না কোন হতাশাগ্রস্থ বৃদ্ধকে কেউ দেখেনি। সবাই দেখেছে বিজয়ীর বেশে আসছে রাজেশ। সাথে একগাদা পুলিশ আর জনা দশেক সাংবাদিক আর আওয়ামীলীগ নেতার চ্যালা-চামুন্ডারা। রাজেশ তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল তার সাবেক ঘরের কাছে যেখানে এখন বহুতল বাড়ি করছেন খন্দকার সাহেব। এসে কেঁদে কেঁদে বর্ণনা দিলেন কিভাবে খন্দকার সাহেব আট বছর আগে তাদের পুরো গোষ্ঠীকে নির্যাতন করে তাড়িয়ে দিয়েছে। দেশব্যাপী খবর ছড়িয়ে পড়লো মিডিয়ার কল্যাণে। রাজেশের দুঃখে দুঃখী হয়ে উঠলো পুরো দেশ।
আওয়ামীলীগ নেতা দখলে নিল পুরো সম্পত্তি। রাজেশকে একটু জায়গা দিল। রাজেশ আবার এলাকায় বীরদর্পে চলাফেরা করতে লাগলো। সে এখন সখীপুরের দন্ডমুন্ডের কর্তা। একে একে সব হারাতে লাগলেন খন্দকার সাহেব। নিজের চেম্বার, ব্যবসাপাতি, এমনকি ভিটেমাটিও। তার স্থান হয় কারাগারে। সাজেদা তার ছোট দুই সন্তানকে নিয়ে বহুদিনের গড়া নিজের সংসার ছেড়ে চলে যান অন্য শহরে তার বড় ছেলের কাছে।
অনেকদিন পরের কথা। এতদিনে বহু জল বহু দিকে গড়িয়েছে। খন্দকার সাহেব বয়সের ভারে ন্যুজ। ছেলের বাসায়ই থাকেন। আগের মত চেম্বারে গিয়ে এবং হাসপাতালে গিয়ে রোগী দেখেন না। বাড়িতে কিছু রোগী আসে তাদের চিকিৎসাপত্র দেন। অবসর কাটে নাতীদের সাথে গল্প করে আর বই পড়ে। একদিন সকালে সস্ত্রিক হাঁটছেন পার্কে। হঠাৎ পার্কের বাইরে এক বৃদ্ধ ভিক্ষুককে দেখে চমকে উঠেন। সাজেদাকে দেখান। তারপর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পাশ কেটে চলে যান।
bhai, plz continue this story
উত্তরমুছুন