পনের-ষোল বছর আগের কথা। ছাত্রশিবিরের কর্মী হতে ভাইবা দিতে হবে। তাই প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। দুই/তিন পাতার শিট। পুরো শিট মুখস্ত করতে হবে। ছোট মানুষ ছিলাম। ভাইবার কথা মনে করলেই সব ওলট-পালট হয়ে যেত। যা শিখি তা আবার ভুলে যাই। শিটতো মুখস্ত করতেই হবে, সাথে আরো সাধারণ জ্ঞানও মুখস্ত করা চাই। নইলে শিবিরের কর্মী হওয়া যাবে না।
সেই প্রস্তুতি নিতে গিয়ে রূপকথার এই মানুষের নাম প্রথম জানলাম। তিনি শিবিরের ১ম কেন্দ্রীয় সভাপতি। মীর কাসেম আলী নাম। রূপকথার রাজপুত্রকে যেমন সবাই ভালোবাসে আমিও ভালোবাসতে লাগলাম এই রাজপুত্রকে। বড় হওয়ার সাথে সাথে যখন তাকে আরো জানলাম বুঝেছি আমাদের এই রাজপুত্র শুধুমাত্র রূপকথার রাজপুত্র নন, আরো বড় কিছু।
জাহেলিয়্যাতের মোকাবিলায় ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমানের চেষ্টায় নিজেকে করেছিলেন আত্মনিয়োগ। যেখানেই হাত দিয়েছেন, সোনা ফলেছে। সাহিত্য-সংস্কৃতি, অর্থনীতি, ব্যবসা, পর্যটন শিল্প, আবাসন খাত, কৃষি, মিডিয়া সব ক্ষেত্রেই তিনি ভূমিকা রেখেছেন রাজার মত। তিনি দেখিয়েছেন অমানবিক পুঁজিবাদী সমাজের বিপরীতে ইসলামের অপার সৌন্দর্য।
কেউ বক্তব্য দেয়, কেউ থিউরি দেয়, কেউ আবার সেই থিউরি কপচায়, কেউ বলে এই করা দরকার, সেই করা দরকার, কেউ উপদেশ দেয়, কেউ আবার সেই উপদেশের ক্রিটিসিজম করে, কেউ সমালোচনা করে, কেউ সেই সমালোচনার সমালোচনা করে বিতর্কের হাট বসায়। মীর কাসেম আলী এসবের লোক নন। তিনি নীরবে কাজ করে যেতেন। যারা কাজ করেন তাদের উৎসাহ দিতেন। তিনি বলার চাইতে করতেন বেশী। জনশক্তিদের উপদেশ দিয়ে শেখানোর চাইতে কাজ করে উদাহরণ হওয়া ছিল তার পছন্দের।
আমাদের এই রাজপুত্রের বিরুদ্ধে তাদের অভিযোগ তিনি নাকি অমানবিক। মানবতাবিরোধী কাজ করেছেন। আমি ভাবি আর স্মরণ করি রবীন্দ্রনাথের “দুই বিঘা জমির” শেষ দু’টি লাইন।
আমি শুনে হাসি, আঁখিজলে ভাসি, এই ছিল মোরে ঘটে -
তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ, আমি আজ চোর বটে।।
রাজপুত্রের অপরাধ গুরুতর। মাস্টার্স পাশ করতে না করতেই দায়িত্ব নিলেন রাবেতা আলম আল ইসলামী (মুসলিম বিশ্বে ভ্রাতৃত্ব) নামক একটি এনজিওতে যার অন্যতম কাজ স্বাস্থ্যসেবা, বিশেষ করে যেখানে মুসলমানরা নির্যাতিত। তখন সাল ছিল ১৯৭৯। বাংলাদেশে আগত বার্মার নির্যাতিত মুসলমান শরণার্থীদের জন্য আশ্রয়, খাদ্য, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা প্রদান। কক্সবাজারের মরিচ্যাপালংএ গড়ে তুললেন রাবেতা হাসপাতাল। তার বড় ভাইসহ একদল সদ্যপাশ করা তরুন ডাক্তার আর নিবেদিত প্রাণ একঝাঁক যুবকদের নিয়ে গড়ে তুলেন এই প্রকল্প। সেই প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, কয়েকটি চেয়ার টেবিল দিয়ে শুরু। দেখতে দেখতে সেই হাসপাতালের বড় হলো, অনেক বড়। গড়ে উঠলো ডায়াগনস্টিক সেন্টার, অপারেশন থিয়েটার (O.T), ফার্মেসী, ইনডোর- আউটডোর সার্ভিসসহ সার্বক্ষনিক ব্যবস্থাপনায় এক পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল। স্থানীয় বাংলাদেশীদের চিকিৎসাও চললো পাশাপাশি । গড়ে উঠলো নিজস্ব বিল্ডিং, চালু হলো নার্সিং প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, তৈরি হল আবাসিক হোস্টেল।
গ্রাম-বাংলার জনগন এর চাহিদাকে সামনে রেখে প্রবর্তন করা হলো ‘পল্লী চিকিৎসক প্রকল্প’ এখানে প্রশিক্ষণ নিয়ে যুবকরা ছড়িয়ে পড়লো গোটা বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে। এরপর শুরু হলো ইমামদের স্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ, যার প্রধান অংশে রয়েছে স্থানীয়ভাবে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের প্রশিক্ষণ। এভাবেই মীর কাসেম আলীর মাধ্যমে সারা বাংলাদেশের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা। মীর কাসেম এদেশের জনগণের উন্নতির জন্য যে চিন্তাভাবনা করেছেন তার বাস্তবরূপ প্রকাশ পেয়েছে রাঙ্গামাটির পিছিয়ে পড়া পার্বত্য জনগন এর জন্য নির্মিত রাবেতা হাসপাতাল, মাইনিমুখ এর মাধ্যমে। এছাড়াও রয়েছে রাবেতা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স টেকনাফ এর উখিয়া ও হিলি, রংপুর এর মিঠাপুকুর সহ বিভিন্ন ছোটখাট স্বাস্থ্য প্রকল্পের মাধ্যমে। দিন রাত পড়ে থাকতেন আটকে পড়া রোহিঙ্গা, বিহারী, সাঁওতাল, চাকমা, মারমাসহ পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীদের সেবায়।
ঢাকায় আটকে পড়া বিহারীদের জন্য তৈরী করেছেন মুহাম্মদপুরে রাবেতা হাসপাতাল। দেশের অন্যতম প্রতিষ্ঠান ইবনে সিনাকে একটি ছোট্ট স্বাস্থ্য পরীক্ষা কেন্দ্র থেকে বিরাট হাসপাতাল, ডি ল্যাব, ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাষ্ট্রি, ইমেজিং সেন্টার এবং ইবনে সিনা মেডিকেল কলেজ স্থাপন পর্যায়ে নিয়ে আসেন। এছাড়া ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশনে থাকাকালীন তিনি প্রতিষ্ঠিত করেন ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল কাকরাইল, শাহজাহানপুর, বরিশাল, খুলনা, রংপুর এবং কমিউনিটি হাসপাতাল নামে মানিকগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় গড়ে তুলেন হাসপাতাল। রাজশাহীতে ইসলামী ব্যাংক মেডিকেল কলেজ, নার্সিং ও মেডিকেল টেকনিক্যাল ইন্সটিটিউট মীর কাসেম আলীর একনিষ্ঠ শ্রমের ফসল। আর ফুয়াদ আল খাতিব হাসপাতাল ঢাকা ও কক্সবাজারে এক অতিপরিচিত নাম।
আপনারা হয়তো ভাবছেন ওনার কর্মের কিছু কথা বলে আমি মীর কাসেমের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ ঢাকার চেষ্টা করছি। না তা নয়। আসুন জেনে নিই ওনার বিরুদ্ধে অভিযোগ এবং তার পোস্টমর্টেম।
প্রভুকে ভীষন ভালোবাসেন তিনি। প্রভুর সাথে পাঁচবার সাক্ষাতে তিনি আলাদা করে প্রস্তুতি নিতেন। পছন্দের পোষাকগুলো পরে প্রভুর সামনে হাজির হন বিনম্রভাবে। আমরা সবাই নামাজ আদায় করি। কিন্তু আমাদের রাজপুত্র মালিকের সামনে হাজির হতেন আলাদাভাবে যেন তিনি রবকে দেখতে পেতেন। কেউ তার সেজেগুজে নামাজে যাওয়ার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, দেশের প্রধান আপনাকে ডাকলে আপনি কিভাবে যাবেন? আমাকে তো ডেকেছে তার চাইতে বড়, অনেক বড়, এই মহাবিশ্বের সৃষ্টিকর্তা, মহান প্রভু। আমি কিভাবে অগোছালোভাবে যাই...?
আজ আমাদের রাজপুত্র অপেক্ষা করছে তার প্রভুর কাছে চিরদিনের জন্য যেতে, প্রভু তাকে ডাকছে। আমাদের রাজপুত্র মহান প্রভুর মেহমান হবে।
#MirQuasemAli
#WeAreMirQuasemAli
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন