১৮ নভে, ২০১৬

রোহিঙ্গা সমস্যাঃ ঐতিহ্য এবং দূর্দশা


পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ও জাতিগোষ্ঠীর মানুষ প্রায় দুহাজার বছর আগে থেকে বিভিন্ন সময়ে ধর্ম প্রচার, বাণিজ্য ও যুদ্ধবিগ্রহের শিকার হয়ে পূর্ব এশিয়ার সমুদ্র তীরবর্তী ‘রোসাঙ্গ’ বা আরাকান রাজ্যে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। রোসাঙ্গ বা আরাকান বর্তমান মায়ানমার রাষ্ট্রের একটি প্রদেশ বা রাজ্য। রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক, এটা মিয়ানমার স্বীকৃতি দিতে কার্পণ্য করলেও সারাবিশ্বে সর্বজনস্বীকৃত বিষয়। বাংলায় ইসলাম আগমনের সময়কাল থেকেই আরাকানে ইসলামের অগ্রযাত্রা শুরু হয়। চট্টগ্রাম অঞ্চল দীর্ঘকালব্যাপী আরাকানের অংশ হিসেবে শাসিত হওয়ার কারণে চট্টগ্রাম থেকেই আরাকানের বিভিন্ন স্থানে ইসলামের সুমহান বাণী সম্প্রসারিত হতে থাকে।

পরবর্তীতে ১৪৩০ খ্রিষ্টাব্দে মিঙসুয়ামুঙ ওরফে নরমিখলা যার মুসলিম নাম ছিল মুহাম্মদ সুলায়মান শাহ কর্তৃক আরাকান পুনরুদ্ধারের পর থেকে আরাকানে মুসলমানদের সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়। এমনকি আরাকানের রাজধানী লংগ্রেত থেকে ম্রোহঙ এ স্থনান্তর করা হলে সেখানকার প্রায় সকল অধিবাসীই মুসলিম ছিলেন এবং ম্রোহংয়ের অধিবাসীদেরকেই রোহিঙ্গা নামে আখ্যা দেয়া হয়ে থাকে। বর্তমানে রোহিঙ্গা বলতে আরাকানের মুসলমানদেরকেই ধরে নেয়া হয়। কেননা রোহিঙ্গারাই ছিলেন আরাকানের প্রধান মুসলিম জনগোষ্ঠী। ব্রিটিশ আমল থেকে রাজ্যটি বার্মার অংশ থাকার কারণে ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে বার্মা স্বাধীনতা লাভের সময় বার্মার অংশ হিসেবে থেকে যায়। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় আরাকান রাজ্যটি কখনো বার্মার, কখনো আরব ও বাঙালির স্বাধীন রাজ্য হিসেবে শাসিত হয়েছে। দুহাজার বছরের ইতিহাসে মুসলিম, বৌদ্ধ, মগ ও বাঙালিদের শাসনকাল ছিল অনেক বেশি। রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা এখন আন্তর্জাতিক ইস্যু। বেঁচে থাকা ও নিজভূমিতে অবস্থান সব মানুষের জন্মগত অধিকার। এ অধিকার থেকে বঞ্চিত রোহিঙ্গাদের স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার করুণ আর্তি ও অতীত ইতিহাস বিশ্ববিবেকের সামনে তুলে ধরা একান্ত প্রয়োজন।

১. আরাকানে মুসলমানদের আগমন : আরাকান চন্দ্রবংশীয় রাজবংশের সংরক্ষিত ইতিহাস ‘রাদ জাতুয়ে’র বর্ণনা মতে রাজা মহত ইং চন্দ্রের রাজত্ব কালে (৭৮৮-৮১০) একটি আরবীয় বাণিজ্য বহর আরাকানের রামব্রী উপকূলে আঘাত খেয়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। জাহাজের আরোহীরা ভাসতে ভাসতে উপকূলে এসে ভিড়লে পর রাজা মহত ইং চন্দ্র তাদের স্থায়ীভাবে আরাকানে বসবাসের অনুমতি দেন। পরবর্তীতে এসব মুসলিম নাবিক পেশা ত্যাগ করে আরাকানি রমণী বিয়ে করে স্থায়ীভাবে আরাকানে বসবাস শুরু করেন। ধারণা করা যায় ধ্বংসপ্রাপ্ত বাণিজ্য বহর থেকে ভেসে আসা আরবীয় মুসলমানদের এই বড় দলটির মাধ্যমেই আরাকানে মুসলিম আধিপত্যের বিস্তার ঘটে। তবে কেউ কেউ মনে করেন ইসলামের আবির্ভাবের আগে থেকে পর্তুগিজ বণিকদের পাশাপাশি আরব বণিকরা চট্টগ্রাম ও আরাকানে তাদের বাণিজ্য কেন্দ্র গড়ে তোলেন। তখন থেকেই আরাকানে আরবি ও মুসলিম প্রভাব বৃদ্ধি পেতে থাকে। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকে আরাকান ও পার্শ্ববর্তী দ্বীপসমূহে মুসলমানদের প্রভাব-প্রতিপত্তি এতই বৃদ্ধি পেয়েছিল যে, তারা আলাদা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র করেছিল বলে অনেক গবেষকদের ধারণা। খ্রিস্টীয় সপ্তম ও অষ্টম শতকের আরবীয় ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিকরা বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী ‘রুহমী’ নামক একটি রাজ্যের পরিচয় তুলে ধরেছেন। ‘রুহমী’ রাজ্যের বিভিন্ন বর্ণনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, বর্তমান আরাকান রাজ্যই আরবীয়দের কাছে ‘রুহমী’ নামে পরিচিত ছিল। ‘রুহমী’ দেশের বাদশার সঙ্গে বাগদাদে আব্বাসীয় খলিফাদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের উল্লেখও ইতিহাসের বিভিন্ন সূত্রে রয়েছে।

মুসলিম শাসনের সূত্রপাতঃ খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীর শুরুতে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজির বাংলা করায়ত্বের দুশ বছর পর গৌরাধীপতি হন সুলতান জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ শাহ। এ সময় আরাকানে রাজ্যত্ব করছিলেন ম্রাউক রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা মেং সোয়া মউন নামান্তরে নরমিখলা। ১৪০৪ খ্রিস্টাব্দে চব্বিশ বছর বয়সে নরমিখলা সিংহাসনে আরোহণ করেন। তৎকালীন বার্মার সামন্ত রাজারা একজোট হয়ে বার্মার রাজা মেং-শো-আইকে আরাকান আক্রমণ করার জন্য আমন্ত্রণ করেন। ১৪০৬ খ্রিস্টাব্দে রাজা মেং-শো-আই ত্রিশ হাজার সৈন্য নিয়ে আরাকান আমন্ত্রণ করেন। এতে নরমিখলা পরাজিত হয়ে প্রাণ ভয়ে বাংলার রাজধানী গৌরে এসে সুলতান জালাল উদ্দিন শাহের আশ্রয় গ্রহণ করেন। আরাকান বার্মার অধিকারভুক্ত হয়। সুদীর্ঘ চব্বিশ বছর গৌরে অবস্থান করে তিনি মুসলমান ধর্ম, দর্শন, রাজনীতি, বিজ্ঞান প্রভৃতিতে প্রচুর জ্ঞান অর্জন করেন। 

স্বদেশ উদ্ধারের জন্য নরমিখলার সাহায্য প্রার্থনার অনুরোধে গৌরের সুলতান জালাল উদ্দিন শাহ ১৪৩০ খ্রিস্টাব্দে ওয়ালী খানের নেতৃত্বে এক সৈন্য বাহিনী পাঠান। ওয়ালী খান বর্মি বাহিনীকে বিতারিত করে আরাকান পুনরুদ্ধার করার পর বিশ্বাসঘাতকতা করে আরাকান রাজ নরমিখলাকে বন্দি করে নিজেই স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। বন্দিদশা থেকে কোনোক্রমে পালিয়ে নরমিখলা গৌরে এসে সুলতান জালাল উদ্দিন শাহকে সব কথা খুলে বলেন। পরবর্তী বছর ১৪৩১ খ্রিস্টাব্দে জালাল উদ্দিন শাহ, সিন্দিখান নামক অপর এক সেনাপতির নেতৃত্বে পুনরায় একটি সৈন্যবাহিনী দিয়ে নরমিখলাকে স্বদেশ উদ্ধারে সাহায্য করেন। এটিই ছিল ইতিহাসে প্রথম বাংলা-বার্মা যুদ্ধ। ১৪৩১ খ্রিস্টাব্দ থেকে গৌরের করদ রাজ্য হিসেবে নরমিখলা আরাকানের সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং সোলায়মান শাহ নাম ধারণ করে ম্রউক-উ রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন। ১৪৩১ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৫৩০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত একশ বছর আরাকান বাংলার করদ রাজ্য হিসেবে নিয়মিত কর প্রদান করত। যুদ্ধের সময় গৌর থেকে আগত সব সৈন্যকে আরাকান রাজ্যের নিরাপত্তার জন্য স্থায়ীভাবে রাখা হয়। তারা কোনোদিন স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেনি। এরা আরাকানে আগত মুসলমানদের একটি বৃহৎ অংশ।

মোঘলদের আগমন ও চট্টগ্রামে আধিপত্যঃ আরাকানে মুসলমানদের আগমনের অন্যতম তৃতীয় কারণ ছিল মুগল সম্রাট শাহজাহান ১৬৫৭ খ্রিস্টাব্দে অসুস্থ হয়ে পড়লে পুত্রদের মধ্যে সিংহাসন নিয়ে উত্তরাধিকার যুদ্ধ। যুদ্ধে প্রথম মুরাদ আওরঙ্গজেবকে সহযোগিতা করলেও পরে বন্দি হন। দিল্লি থেকে বিতারিত হন দারাশিকো। সিংহাসন দখলের জন্য বাংলা থেকে দিল্লি অভিমুখী শাহ সুজার সঙ্গে ১৫৫৯ খ্রিস্টাব্দে সাজুয়া নামক স্থানে আওরঙ্গজেবের বাহিনীর যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে পরাজিত হয়ে শাহ সুজা বাংলার দিকে পলায়ন করেন। মুগল সেনাপতি মীর জুমলা তাকে ধাওয়া করলে শাহ সুজা চট্টগ্রামের পথে ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দে সপরিবার ও দলবল অনুচর বাহিনী নিয়ে আরাকানে পালিয়ে যান। আরাকানের তৎকালীন রাজা সান্দা-থু ধর্ম্মা প্রথম তাকে রাজকীয় সম্মান দেখিয়ে গ্রহণ করেন। শাহ সুজার মূল্যবান সম্পদ ও অপূর্ব সুন্দরী কন্যা আমেনাকে দেখে সান্দা-থু ধর্ম্মা পাগল হয়ে ওঠেন। আমেনাকে বিয়ে করার প্রস্তাব পাঠালে মুগল বংশীয় শাহ সুজা ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করেন। এ নিয়ে শাহ সুজার সঙ্গে সান্দা-থু ধর্ম্মার যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে শাহ সুজা পরাজিত হলে ১৬৬১ খ্রিস্টাব্দে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এ মর্মান্তিক ঘটনায় ক্ষিপ্ত মুসলমানদের সঙ্গে শুরু হয় রাজার সংঘাত। নিজ ভ্রাতার মর্মান্তিক মৃত্যু সংবাদ সম্রাট আওরঙ্গজেবকেও বিচলিত করে তোলে। প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য বাংলার সুবাদার শায়েস্তা খানকে নির্দেশ দেন চট্টগ্রাম দখল করার জন্য। চট্টগ্রাম ছিল আরাকান রাজার অধীন। ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দে শায়েস্তা খান চট্টগ্রাম দখল করেন। নবাব শায়েস্তাখান কক্সবাজারের রামু পর্যন্ত অধিকার করে আর অগ্রসর হননি। অগ্রসর হয়ে গোটা আরাকান দখল করলে আজ আরাকান থাকত চট্টগ্রামের মতো বাংলাদেশের অংশ।

বর্মী রাজের আরাকান দখল, নির্যাতন অতঃপর মুক্তিসংগ্রাম : চরম বিশৃঙ্খলার মধ্যে চলে আসা দীর্ঘদিনে আরাকানি সামন্ত রাজাদের মধ্যে দেখা দেয় মতবিরোধ। একে অপরের ক্ষমতা দখল সহ্য করতে পারেনি। কতিপয় সামন্ত রাজা একত্রিত হয়ে ঘা-থান-ডির নেতৃত্বে বার্মায় গিয়ে বার্মার রাজা বোদা পায়াকে আরাকান আক্রমণের আমন্ত্রণ জানান। সামন্ত রাজা ঘা-থান-ডি ও বার্মার রাজার মধ্যে চুক্তি ছিল যে, বার্মার রাজা বোদা পায়া আরাকানের স্বাধীন সত্ত্বা অক্ষুন্ন রাখবেন এবং ঘা-থান-ডিকে আরাকানের স্বাধীন রাজা হিসেবে স্বীকৃতি দিবেন। বিনিময়ে ঘা-থান-ডি বার্মার রাজাকে বার্ষিক কর প্রদান করবেন। ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে বার্মার রাজা এক শক্তিশালী বাহিনী নিয়ে আরাকান আক্রমণ করে দখল করেন। বোদা পায়া আরাকান দখল করে সব চুক্তি অস্বীকার করে আরাকানকে বার্মার অংশে পরিণত করেন। ঘা-থান-ডিকে রাজা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার পরিবর্তে গভর্নর হিসেবে নিয়োগ করা হয়। অতি অল্প দিনের মধ্যেই আরাকানিরা দেখতে পেল বর্মী সৈন্যদের নির্মম বর্বর ও পাশবিক অত্যাচার। তের বছরের মধ্যে রাজ্যের দুই-তৃতীয়াংশ অধিবাসী পালিয়ে সীমান্তবর্র্তী পাহাড়ে আশ্রয় নেয়। বর্মীদের অত্যাচার ও নির্যাতনে তখন নাফ নদীর পানি আরাকানিদের মৃতদেহে ভরে ওঠে। তখন থেকেই শুরু হয় আরাকানি রোহিঙ্গা মুসলিম হত্যা ও শরণার্থী সমস্যা। এ থেকেই শুরু হয় আরাকানি বা রোহিঙ্গাদের বিদ্রোহ ও স্বাধীনতা সংগ্রাম। বর্মী সৈন্যদের অত্যাচারে ঘা-থান-ডি এক বিরাট অনুচর বাহিনী নিয়ে সপরিবারে আরাকান ত্যাগ করে বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগ দেন। ঘা-থান-ডির আগমনের পর আরাকানি বিদ্রোহীদের শক্তি বৃদ্ধি পায় এবং মুক্তিযুুদ্ধ জোরদার হয়। ঘা-থান-ডির মৃত্যুর পর তৎপুত্র সিনপিয়া মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেন। তুমুল সংগ্রামের মাধ্যমে একমাত্র রাজধানী ম্রোহং ছাড়া সমগ্র আরাকান সিনপিয়া বাহিনী দখল করে নেন। রাজধানী ম্রোহং অবরোধ করার পর ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অসহযোগিতা ও চরম বিশ্বাসঘাতকতা, গোলাবারুদের ঘাটতি ও প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে আমন্ত্রণ স্তিমিত হয়ে আসে। এতে পরাজয় বরণ করে সিনপিয়া পুনরায় পালিয়ে কোম্পানির অধিকৃত পর্বত এলাকায় আশ্রয় গ্রহণ করেন। বিপদসংকুল পরিবেশে ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে সিনপিয়া মৃত্যুবরণ করেন।

ব্রিটিশদের আরাকান ও বার্মা দখল : বিদ্রোহী নেতা সিনপিয়ার মৃত্যুর পর ব্রিটিশ বার্মার দুই মিত্র শক্তি অভিন্ন স্বার্থের কারণে শত্রু শক্তিতে পরিণত হয়। সত্তর বছরের ইতিহাসে ব্রিটিশ বার্মার মধ্যে খণ্ড খণ্ড যুদ্ধ ছাড়াও বড় ধরনের যুদ্ধ হয় তিনটি। প্রথম যুদ্ধেই ১৮২৬ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ বাহিনী আরাকান দখল করে নেন। অবশেষে ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দের শেষ দিকে সমগ্র বার্মা ব্রিটিশ দখলে চলে আসে। পরাজিত রাজা থিব আত্মসমর্পণ করলে ব্রিটিশ সরকার তাকে ভারতে নির্বাসিত করে।

রাজনৈতিক মূল্যায়নে রোহিঙ্গাদের অধিকার : গত প্রায় দুই হাজার বছরের ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায় ব্রিটিশ শাসনের আগে বার্মা আরাকান শাসন করেছে দু-দফায় মাত্র ৬৬ বছর (১৪০৬-১৪৩০ খ্রি. ও ১৭৮৪-১৮২৬ খ্রি.) পক্ষান্তরে আরাকান স্বাধীন রাজশক্তি বার্মা শাসন করেছে প্রায় একশ বছর। আরাকান বাংলার করদ রাজ্য ছিল একশ বছর। (১৪৩০-১৫৩১ খ্রি.) ব্রিটিশ কর্তৃক একশ বাইশ বছর। বাকি সময় স্বাধীনভাবে শাসিত হয়েছে মুসলিম, বৌদ্ধ ও মগ রাজবংশের মাধ্যমে। ব্রিটিশদের কাছ থেকে ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে বার্মার স্বাধীনতার পরবর্তী সময় ছাড়া আরাকানের ওপর বার্মার একাধিপত্য ও সুশাসনের প্রমাণ নেই। আরাকানিদের ওপর বার্মার শাসন মানেই হত্যা, লুণ্ঠন, নিপীড়ন ও নির্যাতনের ইতিহাস।

ভাগ্যের চরম নির্মমতায় আরাকানের এক সময়কার মুসলিম বাঙালি রাজশক্তির বড় অংশ এখন রোহিঙ্গা শরণার্থী। এ সমস্যার শুরু ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে বার্মা কর্তৃক আরাকান দখলের পর থেকে। ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে আরাকান স্বাধীনতাকামী বিদ্রোহী নেতা সিনপিয়ার মৃত্যুর দুশ বছর পরেও আরাকানি রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা ও স্বাধীনতা আন্দোলনের কোনো সুরাহা হয়নি। মায়ানমারের বর্তমান শাসকগোষ্ঠী আরাকানি জনগণ ও রোহিঙ্গা শরণার্থীর ওপর যে নির্যাতন ও নিপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে তা বিশ্ব ইতিহাসে এক করুণ অধ্যায়। রোহিঙ্গা শরণার্থীরা পূর্বপুরুষদের ভিটেবাড়ি থেকে বিতারিত হয়ে এখন অনাহার পুষ্টিহীনতা খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছে। 

রোহিঙ্গারা জন্মসূত্রে আরাকানের নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও তাদের জীবনে এ দূর্ভোগের পিছনে নিন্মোক্ত কারণ উল্লেখ করা যায়-

প্রথমত, রোহিঙ্গারা দীর্ঘ হাজার বছরের পথ পরিক্রমায় আরাকানের রাজসভাসহ রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদ অধিকার করে থাকলেও তারা নেতৃত্বের ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র কোন ধারা সৃষ্টি করতে পারেনি। এমন পরিস্থিতিতে বর্মীরাজ বোদা পায়া কর্তৃক ১৭৮৪ খ্রিষ্টাব্দে আরাকান দখলের পর আরাকানের সর্বময় ক্ষমতা বর্মীদের হাতে চলে যায়। তারা পরিকল্পিতভাবে রোহিঙ্গাসহ আরাকানী নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদেরকে হত্যা করে। অবশিষ্টদের অনেকেই প্রাণভয়ে বাংলায় পালিয়ে আসে এবং ১৮২৬ সালে প্রথম ইঙ্গ-বর্মী যুদ্ধের মাধ্যমে আরাকান দখল পর্যন্ত এ দীর্ঘ সময়ে দেশের বাইরে অবস্থান করে। এ সময়ে সিনপিয়াসহ অনেক আরাকানী নেতা স্বদেশ পুনরুদ্ধারের জন্য সংগ্রাম পরিচালনা করলেও বিভিন্ন কারণে তারা ব্যর্থ হয়। ফলে বাংলায় আশ্রিত রোহিঙ্গাসহ আরাকানে বসবাসকারী রোহিঙ্গারা নেতৃত্বের দিক থেকে আরো পিছিয়ে পড়ে।

দ্বিতীয়ত, ১৮২৬ সালে আরাকানে ব্রিটিশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হলে তারা রোহিঙ্গাদেরকে বাহ্যিক কিছু সুযোগ সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে নিজেদের ক্ষমতার ভিত্তি মজবুত করে। শাসকগোষ্ঠী নিজেদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির প্রয়োজনেই আরাকানের প্রশাসনের বিভিন্ন ক্ষেত্র ছাড়াও কৃষি, ব্যবসায় প্রভৃতি কাজের জন্য বাংলায় আশ্রিত রোহিঙ্গাসহ আরাকানীদেরকে স্বদেশে বসবাসের সুযোগ প্রদান করে। এ সময় রোহিঙ্গাদের নেতৃস্থানীয় শিক্ষিত শ্রেণীর অনেকেই আরাকানে ফিরে না গিয়ে বাংলার কক্সবাজার ও বান্দরবান অঞ্চলে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। মধ্যবিত্ত ও নিন্মবিত্ত শ্রেণীসহ কিছু সংখ্যক নেতৃস্থানীয় রোহিঙ্গা স্বদেশে ফিরে গেলেও নেতেৃত্বের ক্ষেত্রে নতুন করে কোন অবস্থান সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়নি। 

তৃতীয়ত, রোহিঙ্গারা কখনোই নিজেদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে পারে নি। শিক্ষা এবং প্রোপার গাইডেন্সের অভাবে তারা তাদের ভবিষ্যতের কর্মপন্থা নির্ধারণ করতে সক্ষম হয়নি।  

রোহিঙ্গারা আরাকানের স্বাধিকার আন্দোলন শুরু করলে তাদের উপর নিপীড়ন শুরু হয়। এর ফলশ্রুতিতে একটা গ্রুপ সশস্ত্র হয়ে পড়ে। অতঃপর তাদের উপর চালানো হয় ইতিহাসের বর্বরতম গণহত্যা। এ প্রেক্ষাপটে ১৯৭৮-৭৯ সালে প্রায় তিন লক্ষ রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে বালাদেশে আশ্রয় গ্রহণ করে। আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহের চাপ ও বাংলাদেশের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের কূটনৈতিক তৎপরতায় বিষয়টির বাহ্যিক সমাধান নিশ্চিত হয়। তাই রোহিঙ্গাদের নিঃশেষ করে দেবার জন্য কৌশল অবলম্বন করে ১৯৮২ সালে বিতর্কিত বর্ণবাদী নাগরিকত্ব আইন ঘোষণা করেন। এ আইনের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের ভাসমান নাগরিক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। রোহিঙ্গাদের কাছে কালো আইন হিসেবে বিবেচিত এ আইন তাদের সহায়-সম্পত্তি অর্জন, ব্যবসায়-বাণিজ্য, প্রতিরক্ষা সার্ভিসে যোগদান, নির্বাচনে অংশগ্রহণ কিংবা সভা-সমিতির অধিকারসহ সার্বিক নাগরিক অধিকার কেড়ে নেয়। বাংলাদেশ সরকার ও বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকাসহ প্রচার মাধ্যমগুলো তাদেরকে সেখানকার স্থায়ী নাগরিক হিসেবে সম্বোধন করে।

১৯৭৮ এবং ১৯৯১ সালে রোহিঙ্গাদেরকে অনুপ্রবেশকারী হিসেবে মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে মিয়ানমার সরকার বিভিন্ন অপারেশনের নামে আরাকানে এক অমানবিক নির্যাতন চালায়। তবে তাদের এ অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। এ অপারেশনে তারা হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে নির্মমভাবে হত্যা করে এবং দুইপর্বে প্রায় পাঁচ লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে তাদের পৈতৃক বসতবাড়ী থেকে উচ্ছেদের মাধ্যমে বাংলাদেশে তাড়িয়ে দেয়। বাংলাদেশ সরকার সীমিত সামর্থ্য নিয়েই অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে ত্রাণ কার্যক্রমসহ আশ্রায়ন ক্যাম্প তৈরী করে আন্তর্জাতিক সাহায্য-সহযোগিতায় বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেবার আপ্রাণ চেষ্টা করে। তথাপিও রোগ-শোক, অনাহার-অর্ধাহারে নাফ নদী পেরিয়ে আসা অসংখ্য লোক প্রাণ হারায়; যাদের মধ্যে অধিকাংশই নারী, শিশু ও বৃদ্ধ। বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণসহ বিভিন্ন প্রক্রিয়া ও কৌশল অবলম্বন করে দ্বি-পক্ষীয় ভিত্তিতে এ সমস্যার সমাধান করেন।

যেহেতু রোহিঙ্গা সমস্যার প্রেক্ষাপটে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বাংলাদেশ। তাই রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য বাংলাদেশকেও উদ্যোগ নিতে হবে। আরাকানী মুসলমানদের সাথে বাংলাদেশের সহস্র বছরের বন্ধন ও ঐতিহ্যকে সামনে রেখে ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, পারিবারিক ও ধর্মীয়সহ বহুমাত্রিক বন্ধনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে দেশের স্বার্থে; মানবতার জন্য বাংলাদেশেরই এগিয়ে আসা উচিত। রোহিঙ্গা সমস্যাকে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক বিশ্বের নিকট গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরতে হবে; এক্ষেত্রে বিশ্বের মুসলিম রাষ্ট্রগুলিকে সমস্যা সমাধানের জন্য উৎসাহিত করে ওআইসিসহ আন্তর্জাতিক মুসলিম সংস্থাগুলো মিলে জাতিসংঘের কাছে এর গুরুত্ব তুলে ধরে চাপ সৃষ্টি করতে হবে। সেইসাথে মিয়ানমার সরকারের সাথে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের চেষ্টাও করা উচিত।

মূলত আরাকানে মুসলিম জাতিসত্তা বিনাশ করে এককভাবে মগ প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়েই রোহিঙ্গাদেরকে বসতবাড়ী থেকে উচ্ছেদ করে দেশের বিভন্ন স্থান থেকে মগদের এনে প্রত্যাবাসন করা হয়। এ প্রেক্ষাপটে স্বাধীন আবাসভূমি ছাড়া রোহিঙ্গাদের মুক্তির বিকল্প কোন পথ খোলা নেই বলে অনেকে মনে করেন। কিন্তু স্বাধীকার আন্দোলনের নিমিত্তে কিছু কিছু সংগঠন কাজ করলেও মিয়ানমার সরকারের রোহিঙ্গানীতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার মত সাংগঠনিক ও বৈপ্লবিক শক্তি কোনটিই তাদের নেই। এ প্রেক্ষিতে অসহনীয় নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচানোর জন্যে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহকে মানবাধিকারের মমত্ববোধ নিয়ে এগিয়ে এসে রোহিঙ্গাদের পূর্ণ নাগরিক সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান করতে হবে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন