এদেশে সংগঠিত '৭১ সালের যুদ্ধ' বা 'যুদ্ধে নিহত মানুষদের' নিয়ে কোন গবেষণা সম্ভব নয়। একটা শক্তিশালী পক্ষ আছে যারা কখনোই চায় না এদেশের নিহত মানুষদের তালিকা হোক কিংবা যারা নিহত হয়েছে তাদের নিহত হওয়ার প্রকৃত কারণ নিয়ে গবেষনা হোক। কারণ গবেষণা করলেই মহান(!) মুক্তিযুদ্ধের গোমর ফাঁস হয়ে যাবে বা হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা থেকে যাবে। হিন্দুস্থান নিয়ন্ত্রিত তথাকথিত স্বাধীনতা অর্জনের পর যে কয়জন মানুষ এই কাজ করার উদ্যোগ নিয়েছেন তাদের প্রত্যেককে থেমে যেতে হয়েছে। বেশীরভাগ ধমক খেয়েই গবেষণা থেকে সরে এসেছেন। আর যারা সরে আসেন নি তারা খুন এবং গুমের শিকার হয়েছেন। এই গবেষনার ১ম শিকার জহির রায়হান সর্বশেষ শিকার ড. আফতাব আহমেদ। তাকেও গুলি করে সন্ত্রাসীরা চলে যায়। আজো তার সমাধান হয়নি হবেও না কোনদিন যেভাবে হয়নি জহির রায়হান হত্যাকান্ড রহস্যের সমাধান।
বাংলা চলচ্চিত্রের নামকরা পরিচালক জহির রায়হানের আজ ৪৫তম গুম দিবস। জহির রায়হান তথাকথিত স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতেন। স্বপ্ন দেখতেন এদেশকে বামরাজ্য বানাবেন। সমাজতন্ত্রের মহান(!) আদর্শ বাস্তবায়ন করবেন। তিনি ধর্মীয় চেতনায় বা বিধি-নিষেধে বেশ বিরক্ত ছিলেন। তাই পাকিস্তান কোনভাবেই তার সহ্য হত না। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম এবং সহজাত পরিহাস দেশ যখন তার চাওয়ামত স্বাধীন হলো তখন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ‘গুম’ হওয়া ব্যক্তি হয়ে গেলেন তিনি স্বয়ং। অর্থাৎ জহির রায়হানকে দিয়েই স্বাধীন(!) বাংলাদেশে গুমের মতো একটি জঘন্য রাজনৈতিক চক্রান্তের সফল অভিষেক হয়।
জহির রায়হান ১৯৩৫ সালের ১৯ আগস্ট বর্তমান ফেনী জেলার অন্তর্গত মজুপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। জন্ম ফেনীতে হলেও ওনারা পারিবারিকভাবে থাকতেন কলকাতায়। ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর তিনি তার পরিবারের সাথে কলকাতা হতে বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) স্থানান্তরিত হন। তিনি ১৯৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে বাংলায় স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ব্যক্তিগত জীবনে দু'বার বিয়ে করেন। ১৯৬১ সালে সুমিতা দেবীকে এবং ১৯৬৬ সালে তিনি সুচন্দাকে বিয়ে করেন, দুজনেই ছিলেন সে সময়কার বিখ্যাত চলচ্চিত্র অভিনেত্রী।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর জহির রায়হান আগরতলা হয়ে কলকাতায় পৌঁছান। নিজেকে যুক্ত করেন মুক্তিযুদ্ধের প্রচার কাজ সংগঠিত করার কাজে নিজেকে যুক্ত করেন এবং পাকিস্থানের গণহত্যা বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরার জন্য ‘’স্টপ জেনোসাইড" নামের একটি প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করার উদ্যোগ নেন। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো যুদ্ধে শরণার্থী শিবিরে মানুষের দুর্দশার চিত্র, কলকাতায় পালিয়ে যাওয়া বড় বড় নেতাদের আরাম আয়েশের চিত্র তুলতে গিয়ে জহির রায়হান মুজিবনগর সরকারের রোষানলে পড়েছিলেন। সাধারন মানুষদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করার অমানুষিক পরিশ্রমের অনেক চিত্র তিনি জীবন বাজি রেখে ধারন করেছিলেন । ‘স্টপ জেনোসাইড’ প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করার সময় ও মুক্তির দেয়ার সময় কলকাতায় আওয়ামীলীগ
নেতারা বারবার জহির রায়হানকে বাধাগ্রস্থ করেছিলেন যে সম্পর্কে জহিরের চাচাতো ভাই শাহরিয়ার কবির বলেন – “তিনি (জহির রায়হান) যুদ্ধে যোগ দেয়ার জন্যই ঢাকা ছেড়ে আগরতলা এবং পরে কলকাতা চলে যান। কলকাতায় তিনি প্রচার কাজ সংগঠিত করার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেন। এই কাজ করতে গিয়ে তিনি প্রবাসী আওয়ামী লীগ সরকারের রোষানলে পতিত হন এবং তাঁকে বিভিন্নভাবে নিগৃহীত হতে হয়।
নেতারা বারবার জহির রায়হানকে বাধাগ্রস্থ করেছিলেন যে সম্পর্কে জহিরের চাচাতো ভাই শাহরিয়ার কবির বলেন – “তিনি (জহির রায়হান) যুদ্ধে যোগ দেয়ার জন্যই ঢাকা ছেড়ে আগরতলা এবং পরে কলকাতা চলে যান। কলকাতায় তিনি প্রচার কাজ সংগঠিত করার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেন। এই কাজ করতে গিয়ে তিনি প্রবাসী আওয়ামী লীগ সরকারের রোষানলে পতিত হন এবং তাঁকে বিভিন্নভাবে নিগৃহীত হতে হয়।
"স্টপ জেনোসাইড" ছবিটি নির্মাণের সময় আওয়ামী লীগের নেতারা তাঁকে নানাভাবে বাধা দিয়েছে। বিভিন্ন সেক্টরে শুটিং করতে দেয় নি, এমন কি কোন কোন সেক্টরে তাঁর গমন পর্যন্ত নিষিদ্ধ ছিল।
... আওয়ামী লীগের নেতারা ছবি দেখে ছাড়পত্র না দেয়ার জন্য পশ্চিমবঙ্গ সেন্সর বোর্ডকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন।” তথ্যসূত্র : একুশে ফেব্রুয়ারী / জহির রায়হান (ভূমিকা : শাহরিয়ার কবির) ॥ [ পল্লব পাবলিশার্স - আগস্ট, ১৯৯২ । পৃ: ১৩-১৬ ]
‘স্টপ জেনোসাইড’ মুক্তি দেয়ার প্রতিবাদে ১০ই সেপ্টেম্বর ১৯৭১ সালে কলকাতায় বসবাসরত আওয়ামী সমর্থিত বুদ্ধিজীবী ও ‘সন অব পাকিস্থান’ চলচ্চিত্রের পরিচালক ফজলুল হক [ চ্যানেল আইয়ের ফরিদুর রেজা সাগর ও কেকা ফেরদৌসীর বাবা] অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের কাছে একটি চিঠি লিখেন যেখানে প্রামাণ্য চিত্রটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে/ বন্ধের ব্যাপারে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। [সম্পূর্ণ চিঠিটা ছাপা আছে - বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস ও দলিলপত্র (৩য় খন্ড, পাতা ১২৭-১২৮), তথ্য মন্ত্রণালয়, গনপ্রজাতন্তী বাংলাদেশ সরকার। প্রথম প্রকাশ - নভেম্বর ১৯৮২।]
বাংলাদেশ স্বাধীন হলে ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর জহির রায়হান ঢাকায় ফিরে আসেন। ফিরে এসেই শুনলেন তার অগ্রজ শহীদুল্লাহ কায়সার ১৪ ডিসেম্বর থেকে নিখোঁজ। তার উদ্যোগে বেসরকারি বুদ্ধিজীবী হত্যা তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডসহ অন্যান্য ঘটনার প্রচুর প্রমাণাদি তিনি সংগ্রহ করেন এবং সাংবাদিক সম্মেলনে ঘোষণা করেন যে, তার সংগৃহীত প্রমাণাদি প্রকাশ করলেই অনেকের কুকীর্তি ফাঁস হয়ে যাবে। স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে ভারতের মাটিতে আওয়ামী লীগের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কর্মকান্ড, বিভিন্ন হোটেলে বিলাসবহুল ও আমোদ-ফুর্তিময় জীবনযাপন, রাজনৈতিকভাবে প্রতিপক্ষ আওয়ামী আদর্শে বিশ্বাসহীন বাঙালিদের নির্মূল করার ষড়যন্ত্র প্রভৃতির প্রামাণ্য দলিল জহির রায়হান কলকাতা থাকাকালে সংগ্রহ করেছিলেন। বড় ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারের নিখোঁজ ও বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের ঘটনাবলী তাকে বিচলিত করে। এসব ঘটনা তাঁর পূর্বেকার রাজনৈতিক বিশ্বাসের ভিত নাড়িয়ে দেয়।
শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের সর্বময় ক্ষমতায় আসীন হওয়ার ১৫ দিন পর ১৯৭২ সালের ২৫ জানুয়ারি ঢাকা প্রেসক্লাবে এক সাংবাদিক সম্মেলনে চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান ঘোষণা দেন, বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের পেছনে নীলনকশা উদ্ঘাটনসহ মুক্তিযুদ্ধের সময়ের অনেক গোপন ঘটনার নথিপত্র, প্রামাণ্য দলিল তার কাছে আছে, যা প্রকাশ করলে সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের মন্ত্রীসভায় ঠাঁই নেয়া অনেক নেতার কুকীর্তি ফাঁস হয়ে পড়বে। আগামী ৩০ জানুয়ারি সন্ধ্যায় এই প্রেসক্লাবে ফিল্ম শো প্রমাণ করে দেবে কার কি চরিত্র ছিল।
১৯৭২ সালের ২৫ জানুয়ারি সাংবাদিক সম্মেলনের কয়েকদিন পর ৩০ জানুয়ারি রোববার সকালে এক রফিক নামের অজ্ঞাত টেলিফোন আসে জহির রায়হানের কায়েতটুলির বাসায়। রফিক ছিলেন জহিরের পূর্ব পরিচিত যিনি ইউসিসে চাকরি করতেন । প্রথমে ফোন ধরেছিলেন জহির রায়হানের ছোট বোন ডাক্তার সুরাইয়া যার কাছে জহিরকে খোঁজা হচ্ছিল । সুরাইয়া জহির রায়হানকে ডেকে ফোন ধরিয়ে দেয় । টেলিফোনে জহিরকে বলা হয়েছিল, আপনার বড়দা মিরপুর বারো নম্বরে বন্দী আছেন। যদি বড়দাকে বাঁচাতে চান তাহলে এক্ষুণি মিরপুর চলে যান। একমাত্র আপনি গেলেই তাকে বাঁচাতে পারবেন। টেলিফোন পেয়ে জহির রায়হান দুটো গাড়ী নিয়ে মিরপুরে রওনা দেন। তাঁর সাথে ছিলেন ছোট ভাই মরহুম জাকারিয়া হাবিব, চাচাত ভাই শাহরিয়ার কবির, বাবুল (সুচন্দার ভাই), আব্দুল হক (পান্না কায়সারের ভাই), নিজাম ও পারভেজ।মিরপুর ২ নং সেকশনে পৌছার পর সেখানে অবস্থানরত ভারতীয় সেনাবাহিনী, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী (ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট) এবং পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে জহির রায়হানের টয়োটা গাড়ি (ঢাকা-ক-৯৭৭১)সহ থাকতে বলে অন্যদের ফেরত পাঠিয়ে দেন। শাহরিয়ার কবির অন্যদের সাথে করে বাড়ী ফিরে আসেন । এভাবেই জহির চিরতরে হারিয়ে যায়। অথচ সেদিন বিকেলেই প্রেসক্লাবে তাঁর কাছে থাকা অনেক দুর্লভ তথ্য প্রমান ফাঁস করার কথাছিল যা ফাঁস হলে অনেকের মুখোশ উম্মোচিত হয়ে যেতো যা আর কোনদিন করা হলো না ।
জহির রায়হান নিখোঁজ হওয়ার মাস দেড়েক পর শহিদুল্লাহ কায়সার ও জহির রায়হানের বোন নাফিসা কবির, শহিদুল্লাহ কায়সারের স্ত্রী পান্না কায়সার, জহিরের ২য় স্ত্রী সুচন্দা সহ ১৯৭১ সালে নিহত বুদ্ধিজীবীদের পরিবারের অনেকে শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে দেখা করতে গেলে শেখ মুজিবুর রহমান সবাইকে বাড়ির গেইটে অপেক্ষামান রাখেন । এক সময় শেখ মুজিবুর রহমান গেইটের সামনে এসে বিক্ষোভ ও দেখা করার কারণ জানতে চাইলে এক পর্যায়ে শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে নাফিসা কবিরের উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয় -
মুজিব : অনেকে ত দালালী করে মরেছে।
নাফিসা কবির : বুদ্ধিজীবীরা কেউ দালালী করে মরেনি। দালালী যারা করেছে তারা এখনও বেঁচে আছে। সে দালালদের বিচারের দাবী জানাতে এসেছি॥
[ শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবার কল্যাণ পরিষদের পক্ষ থেকে শহীদুল্লাহ কায়সারের বোন এবং পরিবারের সদস্যদের সাথে শেখ মুজিবের উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়কালে]
[ সুত্র - মুক্তিযুদ্ধ : আগে ও পরে / পান্না কায়সার [আগামী প্রকাশনী - ফেব্রুয়ারী, ১৯৯১ । পৃ: ১৬৮]
জহির রায়হান নিখোঁজের প্রায় এক বছর পর [ ১৯৭৩ সালের ২২ শে জানুয়ারি] সাংবাদিক আহাম চৌধুরীর লিখা '' জহির রায়হান হত্যা রহস্য আর কতদিন ধামাচাপা পড়ে থাকবে '' শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলেছিলেন - জহির রায়হান মিরপুর কলোনির অভ্যন্তরে যাননি । ক্যাম্প থেকেই তিনি নাকি নিরুদ্দেশ হয়েছিলেন । কারা তাঁকে নিয়ে গিয়েছিলেন সেই খবরও কারো অজানা নয় । সরকার নিখোঁজ জহির রায়হান'কে খুঁজে বের করার কোন আন্তরিকতা দেখায়নি বরং জহির রায়হান নিখোঁজের রহস্য ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু কতদিন থাকবে এই ধামাচাপা?
''জহির রায়হান'কে যে কোন উপায়ে আটকাতে হবে । তাঁর তদন্ত কমিটি ভেঙে দিতে হবে নতুবা তাঁকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দাও '' এই নির্দেশ খোদার গায়েবী আওয়াজের মতোই সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশে এসে পৌঁছেছিল । তাই জহির রায়হানকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে চিরদিনের জন্য । মুজিবনগরে যে কজন রুই কাতলার সাথে জহির রায়হানের চিন্তাধারার সাথে বচসা হয়েছিল জহির হত্যাকাণ্ডে তারাও নাকি জড়িত রয়েছেন । জহির হত্যার পরিকল্পনা ১৫ দিন ধরে করা হয়েছিল । জহিরকে তিরিশে জানুয়ারি খাঁচায় পুরে একত্রিশ তারিখে অন্য একটি স্থানে সরিয়ে দেয়া হয় ।সেখানে তাঁকে তদন্ত কমিটি ভেঙে দেয়ার আহবান জানানো হয় । বুদ্ধিজীবী হত্যার তদন্তের চিন্তা না করে ভাতের চিন্তা করতে বলা হয় ।
জহির রায়হানের হত্যাকারী দল আরও একদিন তাঁকে চিন্তা করার সময়ও নাকি দিয়েছিলেন - আর সেদিনটি নাকি ছিল উনিশ'শ বাহাত্তর সালের দ্বিতীয় মাসের প্রথম দিন যথা সর্বনাশা ফেব্রুয়ারির সর্বনাশা মঙ্গলবার । ''
জহির রায়হান এর প্রথম স্ত্রী প্রয়াত অভিনেত্রী সুমিতা দেবী এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন ''জহির রায়হান নিখোঁজ এই নিয়ে পত্র-পত্রিকায় বেশ লেখালেখিও হলো। একদিন বড়দি অর্থাৎ জহিরের বড় বোন নাসিমা কবিরকে ডেকে নিয়ে শেখ মুজিব বললেন, জহিরের নিখোঁজ হওয়া নিয়ে এ রকম চিৎকার করলে তুমিও নিখোঁজ হয়ে যাবে। পরে নাসিমা আর কিছু বলেনি। টেলিফোন করেছিল যে রফিক, তাকে নিয়ে যখন পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি শুরু হলো। তখন তাকে নাগরিকত্ব দিয়ে পুরো পরিবারসহ আমেরিকায় পাঠিয়ে দেয়া হলো। এই ঘটনা জহিরের নিখোঁজ হওয়ার সম্পর্কে রফিকের ভূমিকাকে আরো সন্দেহযুক্ত করে তোলে আমার কাছে।'' (সুত্রঃ দৈনিক আজকের কাগজ ৮ ডিসেম্বর ১৯৯৩)
দৈনিক আজকের কাগজ ৮ ডিসেম্বর ১৯৯৩ সংখ্যা ‘জহির রায়হানের হত্যাকারী রফিক এখন কোথায়' শীর্ষক প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে ‘রাহুর কবলে বাংলাদেশের সংস্কৃতি' গ্রন্থে সরকার সাহাবুদ্দিন আহমদ লিখেছেন, ‘আজকের কাগজের ৮ ডিসেম্বর ১৯৯৩ সংখ্যায় জহির রায়হানের হত্যাকারী রফিক এখন কোথায়' শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, জহির রায়হান নিখোঁজ এই নিয়ে লেখালেখি হলে একদিন বড়দি অর্থাৎ জহির রায়হানের বড় বোন নাফিসা কবিরকে ডেকে নিয়ে শেখ মুজিব বললেন, জহিরের নিখোঁজ নিয়ে এ রকম চিৎকার করলে তুমিও নিখোঁজ হয়ে যাবে। কিন্তু এখন প্রশ্ন হচ্ছে যে, জহির রায়হানের মতো একজন বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা স্বাধীনতার পর নিখোঁজ হয়েছে এটা নিয়ে চিৎকার হওয়াটাই স্বাভাবিক। জহির রায়হান তার বড় ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারকে মিরপুরে খুঁজতে গিয়ে নিখোঁজ হন। সম্ভব তাকে হত্যা করা হয়েছিল। সুতরাং তার হত্যাকারীদের বিচারের দাবিতে তার আত্মীয়-স্বজন সোচ্চার হতেই পারেন। কিন্তু শেখ মুজিব কেন জহির রায়হানের বড় বোনকে ডেকে নিয়ে নিখোঁজ করে ফেলার হুমকি দিলেন। কি রহস্য ছিল এর পেছনে? তাহলে কি বুদ্ধিজীবী হত্যার ব্যাপারে শেখ মুজিব এমন কিছু জানতেন, যা প্রকাশ পেলে তার নিজের কিংবা আওয়ামী লীগের জন্য ক্ষতির কারণ হতো? আর কেনইবা তড়িঘড়ি করে জহির রায়হানের তথাকথিত হত্যাকারী রফিককে সপরিবারে আমেরিকা পাঠিয়ে দেয়া হলো? রফিক কে ছিলেন/ কি তার রাজনৈতিক পরিচয়? (সূত্র : সরকার সাহাবুদ্দিন আহমদ, রাহুর কবলে বাংলাদেশের সংস্কৃতি, ঢাকা, পৃষ্ঠা-১০৮)
৯ আগস্ট ১৯৯৯ দৈনিক বাংলার বাণী পত্রিকায় প্রকাশিত হয় জহির রায়হানের মেজো সন্তান অনল রায়হানের অভিযোগ। তিনি অভিযোগ করেন, ‘জহির রায়হান নিখোঁজ হওয়ার পর আওয়ামী লীগ সরকার এক ভুয়া তদন্ত কমিটি গঠন করেছিলেন। এই কমিটি কোনো কাজ করেনি। মুক্তিযুদ্ধের প্যানপ্যানানি করে আওয়ামী লীগ সরকার আবার ক্ষমতায় এলো ...মুজিব হত্যার বিচার হচ্ছে। এই হত্যাকান্ড ঘটেছে ১৯৭৫ সালে। এর আগে জহির রায়হানসহ অনেক বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়েছে। কই তাদের তো বিচার হলো না।'
১৯৯২ সালের ১ মে তারিখে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় বিশ্ববিখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের একটি সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছিল।সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন শাহরিয়ার কবির।সাক্ষাৎকারের এক পর্যায়ে সত্যজিত রায় শাহরিয়ার কবিরকে হঠাৎ করে জিজ্ঞেস করলেন,
-জহিরের ব্যাপারটা কিছু জেনেছো?
-তাকে সরিয়ে ফেলার পেছনে ষড়যন্ত্র রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। আমরা ব্যক্তিগতভাবে তদন্ত করে যা বুঝতে পেরেছি তাতে বলা যায়, ৩০ জানুয়ারি দুর্ঘটনায় তিনি হয়তো মারা যাননি। তারপরও দীর্ঘদিন তাকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিল বলে অনেকে মনে করেন।
-স্ট্রেঞ্জ! জহিরকে বাঁচিয়ে রাখার পেছনে কারণ কি?
-সেটাই ষড়যন্ত্রের মূল সূত্র বলে ধরছি। মিরপুরে দুর্ঘটনায় তার মৃত্যু হলে গভীর ষড়যন্ত্র মনে করার কোনো কারণ ছিল না। আমি যতদূর জানি, বুদ্ধিজীবীদের হত্যার তদন্ত করতে গিয়ে তিনি এমন কিছু তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন যা অনেক রথী-মহারথীদের জন্যই বিপজ্জনক ছিল, সে জন্য তাকে সরিয়ে ফেলার প্রয়োজন ছিল।''
শুধু তাই নয় শাহরিয়ার কবির আরেকটি গ্রন্থে জহির রায়হানের অন্তর্ধান সম্পর্কে বলেছিলেন – ‘’ ৭১ এর ১৬ই ডিসেম্বর শহিদুল্লাহ কায়সারের মৃত্যুর সংবাদ শুনে জহির রায়হান একেবারেই ভেঙ্গে পড়েন।
... বিভিন্ন জায়গায় ছোটাছুটি করে হানাদার বাহিনীর সহযোগী বহু চাঁই ব্যক্তির নাম সংগ্রহ করলেন। সাংবাদিক সম্মেলনে বললেন তিনি শ্বেতপত্র প্রকাশ করবেন। বুদ্ধিজীবিদের হত্যার জন্য তিনি আওয়ামী নেতৃত্বকেও দায়ী করেন। মুজিবনগর সরকারের সকল গোপন তথ্য ফাঁস করে দেবেন বলেও ঘোষণা করেন।
... তাঁর উপস্থিতি যাদের জন্য অস্বস্তিকর তারা এই পরিস্থিতির সুযোগ নেবে এটা খুব স্বাভাবিক। ৭২ এর ৩০শে জানুয়ারী মিরপুরে তাঁর অগ্রজকে (শহিদুল্লাহ কায়সার) খুঁজতে গিয়েছিলেন। তদন্ত করলে হয়ত জানা যেতো সেই অজ্ঞাত টেলিফোন কোত্থেকে এসেছিল, যেখানে তাঁকে বলা হয়েছিল শহিদুল্লাহ কায়সার মিরপুরে আছেন।
... এটাও বিস্ময় যে তাঁর (জহির রায়হানের) অন্তর্ধান নিয়ে কোন তদন্ত হয় নি। কেন হয় নি অনুমান করতে অসুবিধে হয় না॥" - শাহরিয়ার কবির
তথ্যসূত্র : একুশে ফেব্রুয়ারী / জহির রায়হান (ভূমিকা : শাহরিয়ার কবির) ॥ [ পল্লব পাবলিশার্স - আগস্ট, ১৯৯২ । পৃ: ১৩-১৬ ]
জহির রায়হান নিখোঁজ হওয়া সম্পর্কে প্রখ্যাত সাংবাদিক নির্মল সেন উল্লেখ করেন - “ " স্বাধীনতার ৪০ বছর পরেও একটি প্রশ্নের জবাব আমি পাইনি। প্রশ্নটি হচ্ছে - জহির রায়হানের ব্যাপারে বিভিন্ন মহলের নিস্পৃহ আচরণ। একটি মানুষ যে এভাবে নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। কেউ যেন তার খোঁজ রাখল না। আমরা ঘাতক দালাল নির্মূলের কথা বলি, গণআদালত করে গোলাম আযমের ফাঁসি দাবি করি। অথচ জহির রায়হানের নামটি চলচ্চিত্র জগৎ ছাড়া আর কোথাও উচ্চারিত হয় না। কেন হয় না, সে প্রশ্নের জবাব দেয়ার মতো কেউ এদেশে নেই।
সাম্প্রতিককালে জহির রায়হান নিরুদ্দেশ হওয়া নিয়ে নতুন তথ্য শোনা গেছে। বলা হয়েছে - পাকিস্তানি হানাদার বা অবাঙালিরা নয়, মুক্তিযোদ্ধাদের একটি অংশই জহির রায়হানকে খুন করেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের এ অংশটির লক্ষ্য ছিল - বাংলাদেশকে স্বাধীন করা এবং সঙ্গে সঙ্গে বামপন্থী বুদ্ধিজীবিসহ সামগ্রিকভাবে বামপন্থী শক্তিকে নি:শেষ করে দেয়া। এরা নাকি বামপন্থী বুদ্ধিজীবিদের হত্যার একটা তালিকা প্রণয়ন করেছিল। এদের ধারণা এ তালিকাটি জহির রায়হানের হাতে পড়েছিল। জহির রায়হানও জানত তার জীবন নিরাপদ নয়। তবুও সে ছিল ভাইয়ের শোকে মূহ্যমান। তাই শহীদুল্লাহ কায়সারের নাম শুনেই সে ছুটে গিয়েছিল মিরপুরে তারপর আর ফিরে আসেনি। এ মহলই তাকে ডেকে নিয়ে খুন করেছে।
তাহলে কোনটি সত্য? জহির রায়হানকে কারা গুম করেছে? পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীরা, আল বদর, আল শামস্, না রাজাকার? নাকি মুক্তিবাহিনীর একটি অংশ? স্পষ্ট করে বললে বলা যায় - মুক্তিবাহিনীর এ অংশটি মুজিব বাহিনী।
১৯৭১ সালে প্রবাসী স্বাধীন বাংলা সরকারের অজান্তে গড়ে ওঠা মুজিব বাহিনী সম্পর্কে অনেক পরস্পরবিরোধী তথ্য আছে। বিভিন্ন মহল থেকে বারবার বলা হয়েছে, এ বাহিনী গড়ে উঠেছিল ভারতের সামরিক বাহিনীর জেনারেল ওবান-এর নেতৃত্বে। এ বাহিনী নাকি মিজোরামে ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে মিজোদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে। এদের নাকি দায়িত্ব ছিল - রাজাকার, শান্তি কমিটিসহ বাংলাদেশের সকল বামপন্থীদের নি:শেষ করে ফেলা। মুজিব বাহিনী সম্পর্কে এ কথাগুলো বারবার লেখা হচ্ছে। কোন মহল থেকেই এ বক্তব্যের প্রতিবাদ আসেনি। অথচ দেশে মুজিব বাহিনীর অনেক নেতা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে আছেন। তারা কোন ব্যাপারেই উচ্চবাচ্চ্য করছেন না। তাদের নীরবতা তাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত বক্তব্যই প্রতিষ্ঠিত করছে এবং সর্বশেষ জহির রায়হানের নিখোঁজ হবার ব্যাপারেও মুজিব বাহিনীকেই দায়ী করা হচ্ছে॥"
- নির্মল সেন / আমার জবানবন্দি ॥ [ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ - ফেব্রুয়ারি, ২০১২ । পৃ: ৪০৫-৪০৬ ]
জহির রায়হানের সন্তান অনল রায়হান ১৯৯৯ সালে ‘সাপ্তাহিক ২০০০’ ম্যাগাজিনে ‘পিতার অস্থির সন্ধানে পুত্র’’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে লিখেছিলেন - '' ৪ ঠা ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ এ দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত '' জহির রায়হানের খোঁজ চলছে ... রহস্যজনক ফোন আসছে '' শিরোনামে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে ' বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে নিখোঁজ জহির রায়হানের অনুসন্ধানের জন্য মিরপুরে ব্যাপক তল্লাশি অব্যাহত রয়েছে । ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু , রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ , মিত্র বাহিনীর প্রধান জেনারেল অরোরা আলাদাভাবে দুটো বৈঠকে মিলিত হন। ...অথচ এরমধ্যেও আসছে টেলিফোনে অজ্ঞাত পরিচয়ে নানা মহলের হুমকি ' ।
এসব পুরনো খবরের পাতা উল্টাতে উল্টাতে মনে হবে এক জীবন্ত মানুষের জন্য রাষ্ট্র, পত্রিকা বা মানুষজনের চিন্তার অন্ত নেই। কিন্তু এসব ঘটনা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হলো না কেন এবং তা নিরুত্তর রয়ে গেলো কেন ? ''
স্বাধীন বাংলাদেশের একটি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী’র সব অপকর্মের প্রামাণ্য দলিল হাতে পাওয়ায় সেই গোষ্ঠীটি সুকৌশলে জহির রায়হান’কে হত্যা করে লাশ গুম করে ফেলেছিল যার কূল কিনারা সেইসময়ের শাসকগোষ্ঠী তো করেই নি বরং জহিরকে গুম করার বিষয়টিকে ধামাচাপা ও বৈধতা দিতে ২৮ বছর পর কোন এক হাবিলদার কে চাক্ষুস সাক্ষী বানিয়ে ১৯৭২ সালের ৩০ শে জানুয়ারির ঘটনা শুনায় আর সেই স্বার্থান্বেষী মহলের হাতের পুতুল বর্তমানের অন্ধ যুব সমাজের একটি অংশ সেই মনগড়া কাহিনী প্রচার করে জহিরকে গুম করার অন্যায়টির বৈধতা দেয় । অথচ তাদের মনে নিচের এই প্রশ্নগুলো একবারও নাড়া দেয় না।
১) ৩০ শে জানুয়ারি জহির রায়হান বুদ্ধিজীবী হত্যার নীল নকশা ও মুক্তিযুদ্ধের সময়কালের একটি রাজনৈতিক নেতাদের গোপন কিছু দুর্লভ তথ্য প্রমাণ প্রেসক্লাবে উপস্থাপন করার আগাম ঘোষণা দিয়ে রেখেছিলেন সেদিন তাঁকে অপরিচিত (সরকারি এক কর্মকর্তা) এক ব্যক্তি ফোন করে মিরপুরে যেতে বলেছিল কেন?
২) সেদিন ছিল মিরপুর বিহারী পল্লীতে সামরিক অভিযানের দিন যেদিন ‘মিরপুর মুক্তদিবস’ পালন করা হয় । সেই সামরিক অভিযানে একজন বেসামরিক ব্যক্তিকে কেন সংরক্ষিত এলাকায় প্রবেশ করানো হলো? ১৯৭১ সালের ১৪ ই ডিসেম্বর শুধু শহিদুল্লাহ কায়সার একাই নিহত হননি সেদিন আরও অনেক বুদ্ধিজীবী শহীদ হয়েছিলেন , সেইসব বুদ্ধিজীবী পরিবারের কোন সদস্যকে তো সেই অভিযানে তাঁদের হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জন’কে পাওয়া যেতে পারে বলে তো মিরপুরে ডেকে আনা হয়নি, তবে কেন শুধু বেছে বেছে জহির রায়হান’কে শহিদুল্লাহ কায়সার’কে পাওয়া যেতে পারে বলে ডেকে আনা হয়েছিল? জহির তো নিজে থেকেই সেখানে যাওয়ার জন্য ঘর থেকে বের হননি, তাঁকে ফোন করে সেই ঠিকানায় যেতে বলা হয়েছিল। কেন?
৩) জহির যে তথ্যপ্রমাণ ৩০ শে জানুয়ারি প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন সেইগুলো কোথায় কেউ কি বলতে পারবেন? জহির গুম হওয়ার সাথে সাথে সেই প্রমাণাদি গুলোও কি গুম হয়ে গেলো? জহির তো সাথে করে সেইসব প্রমাণাদি কিছুই নেননি।
আরেকটা মজার ব্যাপার হল শহীদুল্লাহ কায়সারকে কেন হত্যা করতে যাবে পাকিস্তানী বাহিনী বা আল বদর? কি তাদের স্বার্থ? কেন ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানপন্থী বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করবে পাকিস্তানী বাহিনী? খটকা কি লাগে না? এজন্য পড়ুন আমার আরেকটি ব্লগ।
সুন্দর অনুসন্ধান।
উত্তরমুছুনসত্যি কথা বলছেন
উত্তরমুছুন