ভাষা আন্দোলনকে আমার মনে হয়েছে বাঙ্গালী জাতির সংকীর্ণতা। তাই আদতেই আমি এর বিপক্ষে। কোন ভাষা রাষ্ট্রীয় ভাষা না হলে সেই ভাষা ধ্বংস হয়ে যায় না। আর এটি ছিল তৎকালীন পাকিস্তানের সংহতির বিরোধী। পাকিস্তানী নেতারা (ইনক্লুডেড বাঙ্গালী) এমন একটি ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করেছে যা মাত্র ৩-৪ শতাংশ জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা ছিল। এটি সহজ এবং বোধগম্য ছিল। কোন নেতারই এটা মাতৃভাষা ছিল না। তাছাড়া উর্দু মুসলিমদের ভাষার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছিল মুসলিম লীগ গঠনের পর থেকেই।
আরো স্পষ্ট করে বলতে গেলে উর্দু কারো মাতৃভাষা না। এটি একটি লিঙ্গুয়াফ্রাঙ্কা। লিঙ্গুয়াফ্রাঙ্কা মানে হল আন্তর্জাতিক যোগাযোগের ভাষা। যেটি কয়েকটি ভাষার সমন্বয়ে গঠিত। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের (যেমন সিলেট, নোয়াখালী, বরিশাল, রংপুর ও চট্টগ্রাম) মানুষ যখন একটা অফিসে বাংলা একাডেমীর ঠিক করে দেয়া কলকাতার সাথে মিল রেখে তৈরি করা 'প্রমিত' বাংলায় কথা বলে, তখন কিন্তু সেখানে এক প্রকার লিঙ্গুয়াফ্রাঙ্কাই ব্যবহার করে। এইখানেও মাতৃভাষার উপরে একটা লিঙ্গুয়াফ্রাঙ্কা চাপানো হয়েছে।
আরো স্পষ্ট করে বলতে গেলে উর্দু কারো মাতৃভাষা না। এটি একটি লিঙ্গুয়াফ্রাঙ্কা। লিঙ্গুয়াফ্রাঙ্কা মানে হল আন্তর্জাতিক যোগাযোগের ভাষা। যেটি কয়েকটি ভাষার সমন্বয়ে গঠিত। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের (যেমন সিলেট, নোয়াখালী, বরিশাল, রংপুর ও চট্টগ্রাম) মানুষ যখন একটা অফিসে বাংলা একাডেমীর ঠিক করে দেয়া কলকাতার সাথে মিল রেখে তৈরি করা 'প্রমিত' বাংলায় কথা বলে, তখন কিন্তু সেখানে এক প্রকার লিঙ্গুয়াফ্রাঙ্কাই ব্যবহার করে। এইখানেও মাতৃভাষার উপরে একটা লিঙ্গুয়াফ্রাঙ্কা চাপানো হয়েছে।
হিন্দি নামটি ফার্সি থেকে এসেছে। পারস্যের অধিবাসীরা ভারতীয় লোক ও তাদের ভাষাকে হিন্দি নামে ডাকতো। ইতিহাসবিদেরা তাই মনে করেন। ৮ম-১০ম শতকের দিকে ভারতে মুসলিম আক্রমণের সময় উত্তর ভারতের খাড়ি বোলি কথ্য ভাষা থেকে হিন্দির উৎপত্তি ঘটে। খাড়ি বোলি ছিল দিল্লি এলাকার ভাষা, এবং বহিরাগত মুসলিম শাসকেরা সাধারণ জনগণের সাথে যোগাযোগের জন্য এই ভাষাই ব্যবহার করতেন। এই খাড়ি বোলি ভাষার একটি রূপ ধীরে ধীরে ফার্সি ও আরবি ভাষা থেকে প্রচুর শব্দ ধার করলে উর্দু নামের এক সাহিত্যিক ভাষার উদ্ভব ঘটে। উর্দু শব্দটি তুর্কি "ওর্দু" শব্দ থেকে এসেছে যার অর্থ "শিবির" বা "ক্যাম্প"। অন্যদিকে সাধারণ জনগণের মুখের ভাষায় আরবি-ফার্সির তেমন প্রভাব পড়েনি, বরং তারা সংস্কৃত ভাষা থেকে শব্দ ও সাহিত্যিক রীতি ধার করতে শুরু করে এবং এভাবে হিন্দি ভাষার জন্ম হয়। সেই হিসেবে ঐতিহাসিকভাবে উপমহাদেশের মুসলিমরা উর্দু আর অন্যরা হিন্দি ভাষায় কথা বলতো। পাকিস্তানের সেসময় সংখ্যাগরিষ্ঠ মাতৃভাষাগুলো ছিল বাংলা, পাঞ্জাবী, বেলুচ, সিন্ধি, পশতু ইত্যাদি। এর মধ্যে উর্দুই ছিল বোধগম্যতার দিক দিয়ে কমন যা হিন্দীর অনুরূপ। তাই এই ভাষাই মুসলিমদের ভাষা হয়ে উঠে।
হিন্দি ভাষা দেবনাগরী লিপিতে লেখা হয় এবং এর শব্দভাণ্ডারের বেশির ভাগই সংস্কৃত থেকে এসেছে। অন্যদিকে উর্দু ভাষা ফার্সি লিপিতে লেখা এবং এর শব্দভাণ্ডার ফার্সি ও আরবি থেকে বহু ঋণ নিয়েছে। এছাড়া ভাষা দুইটির ধ্বনি ব্যবস্থা ও ব্যাকরণেও সামান্য পার্থক্য আছে। ১২শ শতক থেকে উর্দু ও হিন্দি উভয় ভাষাই সাহিত্যের ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ১৮শ শতকে ইংরেজির প্রভাবে উর্দু ও হিন্দি সাহিত্যের বিকাশ ঘটে।
মুসলিম লীগের তথা পাকিস্তানের তৎকালীন নেতারা তাদের প্রদেশগুলোর মধ্যে কমন ভাষা চালু করার জন্যই উর্দুকে সিলেক্ট করেছে। আর বিষয়টা এমন ছিল না যে উর্দু অপ্রত্যাশিতভাবেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হয়েছে। প্রত্যেক জাতি তাদের মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষা থেকে বঞ্চিত করেছে সংহতি রক্ষার জন্য। শুধুমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সভ্যতার সীমা ছাড়িয়েছে আমাদের কিছু বাঙ্গালী। বাংলার সব মানুষ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে ছিল এটাও সঠিক নয়। ঢাকায় সেসময় প্রচুর ছাত্র উর্দুর পক্ষেও ভূমিকা রেখেছিলো। তারা যেসব পোস্টার ছাপিয়েছিল ছবিতে সেগুলোর মধ্যে জনপ্রিয় দু'টি দেয়া আছে। বাংলার কোন রাজনৈতিক নেতা বায়ান্নোর আগ পর্যন্ত বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে ছিলেন না। ঢাকা ভার্সিটি ও জগন্নাথ কলেজের (তখন কলেজ ছিল) কিছু ছাত্র ছাড়া এই আন্দোলন কেউ করেনি। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবী সর্বপ্রথম অফিসিয়ালি উত্থাপন করেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। তৎকালীন সকল বাঙ্গালী সংসদ সদস্যরা ওনার বক্তব্যকে সাম্প্রদায়িক আখ্যা দিয়ে প্রত্যাখ্যান করেন। অতঃএব এটা বাংলার গণমানুষের দাবী এটা বলা অযৌক্তিক।
ছবি সূত্রঃ ডেইলি স্টার ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫
আরো মজার বিষয় হলো ২১ ফেব্রুয়ারীর ঘটনায় আমরা অবাঙ্গালী পাকিস্তানীদের দোষারোপ করি। অথচ আমাদের মনে থাকে না আমরাই সেসময় পাকিস্তানের শাসক ছিলাম। তৎকালীন পাকিস্তানে আমরা ৫৬ শতাংশ ছিলাম। ২১ ফেব্রুয়ারির ঘটনা আলোচনায় আসলেই আমরা ঐ সময়ের পশ্চিম পাকিস্তানীদের দিকে তর্জনী উঁচিয়ে বিষোধগার করি এবং বলে থাকি ৫৬ শতাংশ মানুষের উপর উর্দু চাপিয়ে দিচ্ছে তারা। অথচ সেই তারা হলেন বাঙ্গালীরাই।
১৯৫২ তে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন বাঙ্গালী খাজা নাজিমুদ্দিন। তিনি ঢাকার নবাব পরিবারের। ভাষা আন্দোলনের যারা আন্দোলনকারী, যারা আন্দোলন দমনকারী, যারা জেলে গিয়েছে, যারা জেলে নিয়েছে, যারা গুলি করেছে, যারা গুলির নির্দেশ দিয়েছে, যারা গুলিতে মৃত্যুবরণ করেছে সবাই বাঙ্গালী। বামপন্থি কিছু নেতা ছাড়া এদেশের কোন বাঙ্গালী রাজনৈতিক নেতা এবং তাদের অনুসারীরা বাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে ছিলেন না। বামদের গ্রহনযোগ্যতা তৎকালীন ৫২’র পাকিস্তানে ছিল না।
সেসময়ের বাঙ্গালী শীর্ষ নেতা ছিলেন
১- হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী
২- নবাব খাজা নাজিমুদ্দিন
৩- এ কে ফজলুল হক
৪- মোহাম্মদ আলী বগুড়া
৫- নুরুল আমীন
৬- মাওলানা আতাহার আলী
৭- হাজী মুহাম্মদ দানেশ
ওনারা কেউই রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে ছিলেন না পাকিস্তানের সংহতি রক্ষা করার নিমিত্তে। ভাষা আন্দোলন প্রথমে কিছু সাধারণ ছাত্র এবং খেলাফতে রব্বানীর সাংস্কৃতিক উইং তমুদ্দিন মজলিশের মাধ্যমে শুরু হলেও পরে এটির লক্ষ্য অন্যদিকে পরিবর্তিত হয়। ১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের সাথে জিন্নাহর বৈঠকে জিন্নাহ তাদের বুঝাতে সক্ষম হন কেন উর্দু জরুরী। আন্দোলন থামিয়ে দিতে চায় তমুদ্দুন মজলিশ। কিন্তু কমরেড তোয়াহা তমুদ্দুন নেতা শামসুল হক থেকে বাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের দায়িত্ব ছিনিয়ে নিয়ে বামদের আন্দোলনে পরিণত করে।
এখন স্বাভাবতই প্রশ্ন উঠতে পারে জনবিচ্ছিন্ন এই আন্দোলন কেন সফল হলো?
১- পাকিস্তান রাষ্ট্রে সেসময়ে তখনো কোন স্বৈরশাসক আসেনি। সাধারণ কোন বিষয়ে গুলি চালানো মানুষের কল্পনার বাইরে ছিল। সাধারণ মানুষ গুলি চালানো মেনে নিতে পারেনি। আন্দোলনকারীদের প্রতি সবাই সিম্পেথাইজড হয়। দাবিটাও জোরালো হয়। আর এতেই পরিস্থিতি অন্যদিকে ঘুরে যায়। যদিও রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের বৈঠকে সেদিন সিদ্ধান্ত হয় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হবে না। কিছু সিদ্ধান্ত অমান্যকারী মিছিল শুরু করলেই পুলিশ গুলি করে।
২- ১৯৫৬ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকার ঐ ঘটনার দায় মুসলিম লীগের উপর চাপিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের উদ্দেশ্যে এবং ভাষা আন্দোলন তাদের অর্জন এটা প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করেন।
ভারত চেয়েছিল পূর্ব-পাকিস্তান কে পশ্চিম-পাকিস্তান থেকে আলাদা করার জন্য। এই ভাষা আন্দোলনের পেছনে ভারতের যথেষ্ট অবদান আছে। ভাষা আন্দোলনের এই বিষয়টি সর্বপ্রথম জনসম্মুখে আনেন তৎকালে ভারতীয় চর হিসেবে পরিচিত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। তিনি গণপরিষদে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করেন। কিন্তু গণপরিষদের অন্য কোন সদস্য তার এই প্রস্তাবকে সমর্থন করেননি। বহুজাতি নিয়ে গঠিত পাকিস্তানে এই বক্তব্য সাম্প্রদায়িক বক্তব্য হিসেবে বিবেচিত হয় এবং তার প্রস্তাব নাকচ হয়।
বিষয়টাকে গুরুত্ব দিয়ে আলোচনায় নিয়ে আসে তথাকথিত প্রগতিবাদী ইসলামী সংগঠন, সমাজতান্ত্রিক ইসলাম ও ধর্মনিরপেক্ষ ইসলামের প্রবক্তা খেলাফতে রব্বানী। তাদেরই কালচারাল উইং তমুদ্দুনে মজলিশ।
খেলাফতে রব্বানীর সাংস্কৃতিক উইং তমুদ্দিন মজলিশের মাধ্যমে শুরু হলেও পরে এটির লক্ষ্য অন্যদিকে পরিবর্তিত হয়। ১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের সাথে জিন্নাহর বৈঠকে জিন্নাহ তাদের বুঝাতে সক্ষম হন কেন উর্দু জরুরী।........ এখনে সালটি মনেহয় ভুল হয়েছে।
উত্তরমুছুন