৩০ মার্চ, ২০১৭

সোনালী সূর্যোদয়


১। 
তাহমিদ। খুব ভালো একজন কণ্ঠশিল্পী। একটু পরেই তার স্টেজ পারফর্মেন্স। আজ কলেজের বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হচ্ছে। তার নেতৃত্বে কয়েকটি দলবদ্ধ গান গাওয়া হবে। এছাড়া তার একক পরিবেশনাও আছে। সব মিলিয়ে আজ সে খুব ব্যস্ত। ইতোমধ্যে সবাইকে নিয়ে কয়েকবার রিহার্সেল হয়ে গেছে। তারপরও তার একটু নার্ভাস লাগছে। নিজের জন্য আত্মবিশ্বাসের অভাব নেই তার। কিন্তু সমবেত গানের অন্যরা কেউ নিয়মিত শিল্পী বা গায়ক না। বছরে দু’একটা অনুষ্ঠানে গান গায় সখের বশে এমন। তাহমিদের গান শেখা ও গাওয়ার নিয়মিত চর্চা কলেজে হয় না। সে কলেজের বাইরে একটা সংগীত দলে গান গায়। ঐ দলের সবাইকে নিয়ে গাইলে আজ এ টেনশন থাকতো না। তারা সবাই নিয়মিত গান করে। কিন্তু কলেজে যাদের নিয়ে গান গাইবে তারা নিয়মিত না হওয়ায় এটা সেটা ভুল করার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। তাই সে চিন্তায় ঘামতে শুরু করেছে। বার বার সবাইকে নির্দেশনা দিচ্ছে যাতে ভুল না হয়। যত বেশি সম্ভব রিহার্সেল করে ভুল টুল কমানো দরকার।

এমন সময় একটা ফোন আসলো। আজ বিকেলে স্বৈরাচারবিরোধী মিছিল হবে। তার বন্ধু আজমল জানিয়েছে। আরো জানিয়েছে আজকে গণ্ডগোল হওয়ার বেশ সম্ভাবনা আছে। তাহমিদের অবশ্য মিছিলে যাওয়া বারণ। ওদের সবার নেতা শফিক ভাই সবসময় বলেন আন্দোলনের প্রতিটি সেক্টর গুরুত্বপূর্ণ। যারা যে বিষয়ে দক্ষ তারা সে বিষয়ে কাজ করবে। তাই সংগীত শিল্পীরা গান রচনা করবে, গান করবে, অন্দোলনের কর্মীদের উৎসাহ দেবে। তাদের মিছিলে যাওয়ার দরকার নেই। তাই সাধারণত তাহমিদ এবং তার মতো অন্য যারা গান অথবা অভিনয়ে দক্ষ তারা মিছিলে যাওয়ার তেমন একটা সুযোগ পায় না। কিন্তু সে যখনই মিছিলের খবর পায় তখনই তার মনের মধ্যে এক ধরণের অস্থিরতা শুরু হয়। তার মনে হয় মিছিলের স্লোগানই হলো পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা কবিতা, মিছিলের স্লোগানের মতো রক্তে আলোড়ন তোলা গান আর কি আছে! আর সে মিছিল যদি হয় প্রতিবাদী মিছিল, সে মিছিল যদি হয় দেশ রক্ষার মিছিল তবে তো কথাই নেই। 

ফোনে খবরটা পাওয়ার পর থেকে তাহমিদ মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। আজ সে মিছিলে যাবেই। কলেজের অনুষ্ঠানে আর সে মনযোগী হতে পারে না। তার চিন্তা জুড়ে কেবলই বিকেলের মিছিল। অনুষ্ঠান নিয়ে আগের সে টেনশন আর থাকেনা। মোটামুটি ভালোভাবে অনুষ্ঠানের সব কিছু শেষ হয়ে যায়। তার গানের দলের পারফর্মেন্সও খারাপ হয়নি। তবে তার মাথায় ঘুরছে বিকেলে কথা। কোন রকমে অনুষ্ঠান শেষ করেই সে বাসায় ফিরে যায়। খাওয়া দাওয়া করে মিছিলের প্রস্তুতি নেয়। একটা পতাকা সবসময় সে সাথে রাখে। মিছিলে গেলেই সেটা মাথায় বেঁধে বের হয়। সেদিনও তার ব্যতিক্রম হয়নি। মিছিল শুরু হওয়ার কিছুটা আগেই সে সভার জায়গাতে হাজির হয়ে যায়। 

নারায়ে তাকবীর, আল্লাহু আকবার। রক্তে আলোড়ন তোলা সে চিরপরিচিত শ্লোগানে শুরু হয় মিছিল। তাকবীর দেয়ার সাথে সাথেই ভীমরুলের মত হাজার হাজার ছাত্র-যুবক-শ্রমিক মিছিলে শরিক হয়। জনা বিশেক পুলিশ অস্ত্র হাতে আগে থেকেই সেখানে প্রস্তুত ছিল। তারা ভাবতে পারেনি এত মানুষ হবে। যখন মিছিল শুরু হয় তখন তারা অস্ত্র বাগিয়ে তেড়ে আসার চেষ্টা করে। কিন্তু যখনই চারদিক থেকে হাজার হাজার মানুষ জড়ো হতে থাকে তখন মানুষের ঢল দেখে তারা পিছিয়ে যায়। মিছিল থেকে দুই তিনজন নেতা এগিয়ে গিয়ে পুলিশদের বলে তারা শুধু শান্তিপূর্ণভাবে মিছিল করতে চায়। কোন ধরণের সহিংসতা কিংবা গোলমালের কোন চিন্তা তাদের নেই। মিছিল করা প্রতিবাদ করা নিশ্চয় আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার। এসব শুনে পুলিশ দলের অফিসাররা চুপ করে থাকে। তারা কোন উত্তর দেয় না।

ফ্যাসিবাদের লাঠিয়াল পুলিশরা অবস্থা বেগতিক দেখে সাময়িক চুপ করে থাকলেও আসলে তারা ওয়ারলেসে আশেপাশের থানাগুলো থেকে জরুরী অতিরিক্ত পুলিশ এবং রিজার্ভ ফোর্স কল করে। মিছিল শুরু হওয়ার দশ পনেরো মিনিটের মধ্যেই চারপাশ থেকে পঙ্গপালের মতো বিপুল সংখ্যক পুলিশ এসে সবাইকে ঘিরে ফেলে। 

ছাত্রনেতারা মাইকে আহবান করেন পুলিশদেরকে শান্তিপূর্ণভাবে সরে দাঁড়াতে। কিন্তু উত্তরে পুলিশরা আচমকা টিয়ারশেল এবং গুলির বন্যা বইয়ে দেয়। হাজার হাজার মানুষ আটকে পড়ে রাস্তায়। পুলিশ নিরস্ত্র মানুষের প্রতিবাদে আগ্রাসী ভূমিকায় হামলে পড়ে। প্রথমে একটু হতচকিত এবং ছত্রভঙ্গ হলেও তাহমিদরা অল্পসময়ের মধ্যেই ইটপাটকেল দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলে। নেতারা সিদ্ধান্ত দিয়েছেন যে করেই হোক ক্ষয়ক্ষতি কমাতে হবে। যেদিকে পুলিশের অবস্থান দূর্বল সেদিকে তাদের প্রতিরোধ ভেঙ্গে বের হয়ে যেতে হবে। পুলিশের গুলিতে একের পর এক প্রতিবাদকারী গুলি খেয়ে আহত হচ্ছে। এরই মাঝে তাহমিদরা একটি পথে পুলিশকে পিছু হটতে বাধ্য করে।

এর মধ্যে হঠাৎ করেই বুকটা যেন একটু চিনচিন করে উঠে তাহমিদের। তার মনে হয় এক সাগর পিপাসা লেগেছে। সে পাশের একটি টং দোকানে পানি খাওয়ার জন্য যায়। টং দোকানদার বহু আগেই দোকান ছেড়ে পালিয়েছে। বোতল মুখে দিয়ে ঢক ঢক করে পানি ঢালতেই একটু শান্তি লাগলো। কিন্তু তৃষ্ণা কমছেই না। এসময় হঠাৎ নিজের দিকে তাকিয়ে দেখতেই চমকে উঠে তাহমিদ। রক্তে ভেসে গেছে বুক। শার্টের নিচে হাত চালান করে বুঝতে পারলো বুকে কয়েকটা গুলি লেগেছে। শর্টগানের গুলি। কখন যে গুলি লেগেছে টেরই পায়নি সে। বুক চেপে রক্ত বন্ধ করার চেষ্টা করে সে। কিন্তু সে চেষ্টা ব্যর্থ। আশেপাশে সাহায্যের আশায় তাকায়। সহকর্মীরা সবাই ইট-পাটকেল নিয়ে পুলিশের আক্রমণ প্রতিরোধে ব্যস্ত। কাউকে বিরক্ত না করে নিজেই নিজের সমস্যা সমাধান করার চেষ্টা করেছে। সব রাস্তা বন্ধ। কোথাও গিয়ে চিকিৎসা নিতে হবে। তবে সবার আগে এখান থেকে বেরুতে হবে। কিন্তু বেরুনোর কোন উপায় দেখা যাচ্ছে না। হাঁটতে হাঁটতে পাশের একটা বস্তিতে ঢুকে পড়ে সে। একটু সাহায্যের আশায় সে একের পর এক দরজায় নক করতে থাকে। প্রতিটি দরজা তার অবস্থা দেখেই তার মুখের উপর বন্ধ হয়ে যায়।

২।
জামিল। তাহমিদ যে গানের দলে গান শিখে সে দলের পরিচালক। ভার্সিটি থেকে বাসায় ফিরে অলসভাবে টিভি দেখছিল। হঠাত টিভির স্ক্রলে ব্রেকিং নিউজ লিখা উঠছে। চট্টগ্রামের বহদ্দারহাটে ছাত্রদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষ। বহু হতাহত। জামিল তড়াক করে উঠে দাঁড়ায়। তাহমিদ তার অচেনা নয়। তার দলের মধ্যে একমাত্র তাহমিদই সবসময় একটু বেশি বেয়াড়া ধরণের। সে সাধারণত এই ধরনের মিছিলে না গিয়ে থাকে না। ফোন তুলে নিয়ে জামিল ডায়াল করে তাহমিদের নাম্বারে। কল যায়। কিন্তু রিসিভ করার কেউ নাই। বার বার সে ফোন করতেই থাকে। তাহমিদের বন্ধু আজমলকেও চিনে জামিল। তাকেও ফোন দিল। একবার, দুইবার, তিনবার, চারবার...। চতুর্থবারে ফোন রিসিভ করে আজমল। প্রচুর শব্দ, চিৎকার। জামিল বুঝতে পারে সে ঘটনাস্থলেই আছে। 

আজমলের সাথে কথা বলে জামিল জানতে পারলো তাহমিদও ওখানে ছিলো। তবে তাকে এখন আশেপাশে দেখা যাচ্ছে না। ওরা একসাথে মিছিলে গিয়েছিল কিন্তু সংঘর্ষ শুরু হওয়ার একটু পর সে হারিয়ে গেছে। একে একে অনেককেই ফোন করে জামিল। না, কোথাও তাহমিদের হদিস নেই। এবার সে ফোন দেয় সাদমানকে। সাদমানও তাদের দলের ছেলে। সে অভিনয় শিল্পী। তাহমিদের সাথে তার বেশ ভাব। জামিল সাদমানকে বাসা থেকে বের হতে বলে। ওরা তাহমিদকে খুঁজে বের করবে। অজানা আশংকায় সবারই বুক কাঁপছে। 

জামিল আর সাদমান প্রথমে তাহমিদের বাসায় এল। সব খুলে বললো। তাহমিদের বাসায় জানেনা সে কোথায় গিয়েছে। কান্নার রোল পড়ে যায় তাহমিদের বাসায়। ওর মা ঘটনাস্থলে যাওয়ার জন্য বেরিয়ে পড়ে। অনেক কষ্টে ওনাকে আটকানো হল। ওরা তাহমিদের বাসায় থাকতেই আজমল ফোন দেয়। ততক্ষণে সে নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছাতে পেরেছে। জামিল ভয়ে ভয়ে ফোন রিসিভ করে, না জানি কি খবর দেয় আজমল। কিন্তু কিছুই জানাতে পারেনা সে। অনেক খোঁজাখুঁজি করেছে। অনেককে ফোন দিয়েছে। কোথাও তার খোঁজ জানা যায় নি। 

জামিল আর সাদমান তাহমিদদের বাসা থেকে বের হলো। হাসপাতালে গেল। অনেক খুঁজলো। না, কোথাও নেই। যারা এরেস্ট হয়েছে তাদের নাম সংগ্রহ করলো আজমল। সেখানেও নাম নেই তাহমিদের। তাহলে তাহমিদ কোথায়? চারদিকে অনেকেই বের হয়েছে তাহমিদকে খোঁজার জন্য। এরমধ্যে পুলিশের টহলতো আছেই। যারা পরিচিত আন্দোলনকারী তারা পুলিশের তৎপরতার কারণে রাস্তায় বের হতে পারছে না। যাদের সে সমস্যা নেই তারা বের হয়েছে তাহমিদকে খুঁজতে। প্রায় বিশজন লোক এখন তাহমিদকে খুঁজছে। 

এ সময় হঠাৎ কল আসলো জামিলের মোবাইল ফোনে। অপরিচিত নাম্বার।ফোন রিসিভ করতেই তাহমিদের কণ্ঠ। বড় দুর্বল সে কণ্ঠ। জানালো তার আহত হওয়ার কথা, একটা ঠিকানা দিল। কলটা কেটে গেল। জামিল চিৎকার করে উঠলো। তাহমিদ, তাহমিদের ফোন। বলেই আবার কল দিল সেই নাম্বারে। এবার শোনা গেল একটা পুরুষ কণ্ঠ। তার থেকেই জানা গেল তাহমিদ গুলিবিদ্ধ। যে সে জায়গায় নয়, একেবারে বুকে গুলি লেগেছে। ঠিকানা আরেকটু বিস্তারিত জানালো লোকটা। সব শুনে বিষাদগ্রস্থ হয়ে গেল জামিলের মুখ। একটা সিএনজিতে করে রওনা হলো তারা। কথা নাই দুজনের। কেবল বেদনায় নীল হয়ে যাওয়া কষ্টগুলো জল হয়ে গড়িয়ে পড়ছে চারটি চোখ জুড়ে। এক পর্যায়ে জামিল সাদমানের পিঠে হাত রেখে শক্ত হতে বলার চেষ্টা করলো। কিন্তু শক্ত হতে কি বলবে! নিজেরইতো গলা কাঁপছে। 

৩।
আশ্রয়ের জন্য একের পর এক দুয়ারে করাঘাত করে যাচ্ছে তাহমিদ। না, আজ তার কোন আশ্রয় নেই। এমন রক্তাক্ত কাউকে বাড়িতে জায়গা দিয়ে কেউ স্বৈরাচারী পুলিশের শত্রু হতে চায় না। বস্তির গরীব মানুষ তারা, পুলিশের অত্যাচার সামলাতে পারবে না। ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছে তাহমিদ। চোখে ঝাপসা দেখা শুরু করেছে। পা দুটো টলছে। আশ্রয় তাকে পেতে হবেই। অবশেষে একটা দরজা খুলে গেল। ছেলে হারানো এক মা। বহুক্ষন ধরেই তাহমিদের ছোটাছুটি দেখছেন। অবশেষে সহ্য করতে না পেরে দরজা খুললেন। তাহমিদকে শুইয়ে দিলেন বিছানায়। রক্ত বন্ধ করার চেষ্টা করলেন। একটু দুধ গরম করে খেতে দিলেন। তাহমিদ খেতে চাইলো না। কিন্তু তিনি জোর করে খাইয়ে দিলেন।

এর মধ্যে সমস্যা হয়ে দেখা দিল মমতাময়ী সে মহিলার স্বামী। তিনি আসন্ন বিপদের কথা ভেবে বার বার বলছেন ছেলেটিকে যাতে বের করে দেয়া হয়। কিন্তু মহিলা বার বার চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় বলছেন, এতটুকু ছেলের গুলি লেগেছে। পুলিশ গুলি করেছে, এখন সে কই যাবে? উত্তরে তিনি বললেন, যে ছেলের জন্য মায়া দেখাচ্ছ সে ছেলের জন্যই আমাদের সবাইকে জেলে যেতে হবে। সে এখানে থাকলে পুলিশ ওর সাথে আমাদেরও জেলে নিয়ে যাবে। আর সে গুলি খেয়েছে। যে কোন সময় মারা যেতে পারে। তখন একে খুন করার দায়ে পুলিশ আমাদের নিয়ে যাবে। ফাঁসীতে ঝুলাবে। এসব শুনে কিছুটা দমে গেলেন মহিলা। 

তাহমিদও ভাসাভাসা শুনতে পাচ্ছিলো তাদের কথাবার্তা। একটু পর সে নিজেই চলে যাবার জন্য উঠে বসতে চেষ্টা করে। উঠতে গিয়ে বুঝতে পারলো তার অবস্থা খুব খারাপ। শরীরের উপর নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে দ্রুত। কথা বলতে গিয়ে দেখে কথা বলতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। শব্দ কমে নির্জীব হয়ে এসেছে কণ্ঠ। আস্তে আস্তে কথা বলতে হচ্ছে। তবু্ও সে এসময় উঠে দাঁড়ালো ধীরে ধীরে। ঘর থেকে বের হয়ে যাচ্ছে এমন সময় সে মহিলা তার রক্তমাখা শার্ট বদলিয়ে তাকে আরেকটি শার্ট পরিয়ে দেন। তারপর একটা কাঁথা জড়িয়ে দেন তার গায়ে। 

টলতে টলতে বেরিয়ে এলো তাহমিদ। এখন তার অবস্থা ভীষণ খারাপ। আগে তো সে বিভিন্ন দরজায় নক করেছিলো, এখন নক করার মতো শক্তিও আর নেই তার। টলতে টলতে একসময় সে একটা ঘরের সামনে লুটিয়ে পড়ে। ওর লুটিয়ে পড়া দেখে সে ঘরের সবাই বের হয়ে এলো। ওকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে এল ঘরে। পানি খেতে দিল। ঘরের কর্তা তাহমিদকে জিজ্ঞাসা করলো ওর ফোন কই। তাহমিদ কাঁপা হাতে পকেটে হাত দিয়ে দেখে ফোন নেই। তখন তারা তাহমিদকে অভিভাবক কারো মোবাইল নাম্বার জিজ্ঞাসা করলো। তাহমিদ এক ঝলক চিন্তা করে জামিলের নাম্বারই দিল। জামিলকে তাহমিদ নিজের অভিভাবকই মনে করে। জামিলকে ফোন দিয়েই উপস্থিত সবাই তাহমিদের সেবায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো। এদিকে তাহমিদ ক্রমেই তার কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলছে। সারা শরীর কাঁপছে তার। কষ্ট হচ্ছে ভীষণ। চোখ খুলে রাখাও তার জন্য কষ্ট হয়ে পড়ছে। চোখ বন্ধ করে সে কেবলই আল্লাহকে ডাকছে। এতটাই কাঁপছে যে তার মনে হচ্ছে সে বিছানা থেকে পড়ে যাবে। এমন সময়ে কেউ একজন তার হাত শক্ত করে ধরলো। তার মনে হলো পানিতে ডুবন্ত অবস্থায় কেউ যেন তার হাত ধরে তোলার চেষ্টা করছে। সেও শক্ত করে সেই হাতটি চেপে ধরলো। চোখ খুললো তাহমিদ। অন্য কারো হাত নয়। তার অভিভাবক জামিলেরই হাত। ডুকরে কেঁদে উঠলো তাহমিদ। 

৪।
দেরী করেনি জামিল। পাঁজাকোলে করে তাকে সিএনজিতে তুললো। সবাইকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে রওনা হয়ে গেল হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। একের পর এক পুলিশের চেক এড়িয়ে যাওয়া সহজসাধ্য ছিল না। এর মধ্যে একটা চেকপোস্টে গাড়ি থামাতে হলো। জিজ্ঞাসা করলো পুলিশ, কই যাও? হাসপাতালে। আমার ছোট ভাই। খুব জ্বর। আচ্ছা। ছেড়ে দিল পুলিশ। আবার চলতে শুরু করলো। হাসপাতাল আর মাত্র একশ গজ দূরে। আবারো চেকের সম্মুখীন। কি হয়েছে এর? দুদিন ধরে জ্বর, হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি। পুলিশ ভালো করে দেখলো। তাহমিদের রক্ত কিছুটা কাঁথার উপরে উঠে এসেছে। রক্ত দেখেই পুলিশের সন্দেহ হয়। কাঁথা সরাতে বলে। জামিল বিপদ বুঝতে পেরে কৌশল করে একটু খুললো। দুজন পুলিশ কাঁথা টানটানি করে সরিয়ে ফেললো। রক্তাক্ত তাহমিদকে দেখে তারা বুকে হাত দেয়। বুঝতে দেরী হয় না পুলিশের। এরা প্রতিবাদকারী ছাত্র। 

সিএনজি ড্রাইভারকে থানার দিকে গাড়ি ঘুরাতে বলে। জামিল মিনতি করতে থাকে। বার বার বলে, অনেক রক্তক্ষরণ হয়েছে ওর। এখনই চিকিৎসা করাতে হবে। নইলে মারা যাবে। প্লিজ আমাদের এরেস্ট করেন। যা ইচ্ছা তাই করেন। শুধু এর চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। একজন পুলিশ সিএনজিতে উঠলো। আর অন্যরা গাড়ি নিয়ে সিএনজির পেছনে আসতে শুরু করলো। জামিল-সাদমানের আর্তনাদ, কাকুতি-মিনতি কোন কিছুকেই পাত্তা দিল না তারা। চলছে গাড়ি থানার দিকে। 

থানায় জামিল আর সাদমানকে নামানো হল। পরে তাহমিদকেও নামানো হল। তারা সেকেন্ড অফিসারের রুমে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাত তিনজন এসে শুরু করলো লাঠি দিয়ে বেদম মার। মারের চোটে তিনজনই পড়ে গেল। জামিল চিৎকার করতে লাগলো ওকে মারবেন না, ও গুলিবিদ্ধ। কে শুনে কার কথা। জামিল প্রথমে তাহমিদকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছে। তাকে আড়াল করে তার মারগুলো নিজের পিঠে নিয়েছে। কিন্তু তা অল্প কতক্ষন। পুলিশের হিংস্রতায় সে নিজেই দিশেহারা। লুটিয়ে পড়েছে এক পাশে। একের পর এক লাঠি ভাংছে। আবার নতুন লাঠি এনে মারা হচ্ছে তিনজনকে। রক্তাক্ত হয়ে পড়েছে সবাই। এভাবে চললো আধঘন্টা। একে একে সব পুলিশ ক্লান্ত হয়ে পড়লো। তারা একটু বিশ্রাম নিচ্ছে। সাদমান এই ফাঁকে একটু মাথা উঁচু করে তাহমিদের দিকে তাকালো। তাহমিদ চোখ উলটে পড়ে আছে। জামিল ভাই, তাহমিদ আর নেই বলে আর্তনাদ করে উঠলো। জামিলও উঠে এল। সাদমান চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। জামিল নিঃশ্বাস পরীক্ষা করে দেখলো এখনো প্রাণ আছে। এবার সে পুলিশদের পায়ে ধরে মিনতি করতে লাগলো ওকে যাতে হাসপাতালে পাঠানো হয়। এক পর্যায়ে নিষ্ঠুর লোকগুলোর মন একটু গলে। তারা তাহমিদকে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করে। সাদমান-জামিল পরষ্পরকে জড়িয়ে কাঁদতে থাকে। তারা নিশ্চিত তারা হারাতে যাচ্ছে তাদের দীর্ঘদিনের বন্ধুকে। 
রাতে সাদমান-জামিলের উপর নেমে আসলো আগের চেয়েও ভয়াবহ নির্যাতন। ওরা কি তার বন্ধুর জন্য চিন্তা করবে, না নিজের কথা চিন্তা করবে কোন কিছুর কূল পায় না। একের পর এক লাঠির আঘাত এবং লাথি আছড়ে পড়ছে তাদের উপর। বাসায় কেউ জানে না। কোন খবর পাঠাতে পারেনি। এদিকে তাহমিদের খবরও পাঠাতে পারেনি তার বাসায়। সব মিলিয়ে তাদের পুরো পৃথিবী যেন থমকে দাঁড়ায় এ হাজতখানার অন্ধকার প্রকোষ্ঠে। রাত তিনটার দিকে তাদেরকে মারা বন্ধ হলো। রক্তাক্ত নিথর দুটো দেহ পড়ে আছে মেঝেতে। একটু নড়ার সামর্থ্য নেই কারো। মাঝে মাঝে কেবল যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছে তারা। আর আল্লাহকে ডাকছে বার বার। হঠাৎ আজানের ধ্বনি। ফজরের আজান। হৃদয় নাড়া দেয়া চিরপরিচিত সুর। সারাজীবন আজান শুনে আসছে, কিন্তু আজ যেন প্রতিটা ধ্বনি হৃদয়ে এক অচেনা শান্তির প্রলেপ আর আশ্বাস যোগালো। আজান শুনে মনে সাহস পেল দুজনই। ধীরে ধীরে এক সময় উঠে বসলো তারা। সে রক্তাক্ত অবস্থাতেই তায়াম্মুম করে নামাজ পড়লো। নামাজ শেষে বসে থেকে জামিল ছাদের কাছাকাছি থানার গরাদের একচিলতে জানালার ফাঁকা জায়গাটুকু দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলো। সাদমান জিজ্ঞাসা করলো, ভাই কি দেখেন? জামিল আপনমনে উত্তর দিলো, সূর্যোদয় দেখি। সোনালী সূর্যোদয়। একদিন এদেশে সত্যিকারের সূর্যোদয় হবে। সেদিন এ জনপদে আর কোন অত্যাচারী স্বৈরাচারের কালো থাবা আমাদের স্বপ্নময় ভবিষ্যতকে আড়াল করে রাখতে পারবে না।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন