আল্লাহ তায়ালা অসংখ্য গ্রহ-তারা-নক্ষত্র ইত্যাদি সৃষ্টি করে তা সুশৃঙ্খলভাবে নিয়ন্ত্রণ করছেন। সব কিছুকে তিনি একটি প্রাকৃতিক নিয়মের মধ্যে আবদ্ধ করে রেখেছেন। সকলে ইচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায় স্রষ্টার সে নিয়ম মেনে চলছে। এ নিয়মের কোন ব্যতিক্রম ঘটলে সৃষ্টিজগতে বিশৃঙ্খলা ঘটতে বাধ্য এবং তার ফলে মুহূর্তেই সৃষ্টিজগতে মহাপ্রলয় ঘটে যেতে পারে। মহাসৃষ্টির একটি ক্ষুদ্র গ্রহ হলো আমাদের এ পৃথিবী। এ পৃথিবীতে অসংখ্য সৃষ্টির মধ্যে মানুষ অন্যতম মাখলুক বা আল্লাহর সৃষ্টজীব। অন্য সব সৃষ্টির জন্য আল্লাহ যেমন প্রাকৃতিক নিয়ম তৈরি করেছেন, মানুষের জন্যও আল্লাহর পক্ষ থেকে তেমনি একটি নিয়ম বা নীতিমালা তৈরি করে দেয়া হয়েছে। এক কথায় এ নীতিমালার নাম ইসলাম।
তবে অন্যসব সৃষ্টির জন্য যে প্রাকৃতিক নিয়ম রয়েছে, তারা ইচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায় তা মেনে চলতে বাধ্য। কিন্তু মানবজাতির জন্য যে নীতিমালা তৈরি করা হয়েছে, মানুষ ইচ্ছা করলে তা মেনে চলে আল্লাহর অনুগত বান্দা হিসেবে তার জীবনকে সফল ও সুন্দর করে তুলতে পারে। তবে মানুষকে আল্লাহপ্রদত্ত এ নীতিমালা অমান্য করে তার নিজের খেয়ালখুশি মোতাবেক চলার অধিকারও দেয়া হয়েছে। সে ক্ষেত্রে আল্লাহর অনুগত বান্দাদের পরিণাম কী হবে এবং অবাধ্যদের পরিণতি কী হবে মহান স্রষ্টা তাও সুস্পষ্টভাবে তাঁর ঐশী কিতাবে বর্ণনা করেছেন।
মানবসমাজে শান্তিশৃঙ্খলা, কল্যাণ সাধনের জন্যই ইসলামের প্রতিষ্ঠা অপরিহার্য। এ জন্য আল্লাহর অনুগত বান্দাদেরকে সচেতনভাবে সর্বদা অতন্দ্র প্রহরীর ন্যায় ইসলামকে ধারণ ও তা প্রতিষ্ঠার জন্য নিরলসভাবে সচেষ্ট হওয়া প্রয়োজন। এটা ঈমানের অপরিহার্য দাবি। এটাকে ইসলামী পরিভাষায় বলা হয় জিহাদ। আল্লাহতায়ালা তাই ঈমানের পরই জিহাদের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। এ সম্পর্কে কতিপয় আয়াত উদ্ধৃত হলো :
১- যারা ঈমান এনেছে এবং যারা আল্লাহর পথে হিজরত করে এবং জিহাদ করে, তারাই আল্লাহর অনুগ্রহ প্রত্যাশা করতে পারে। আল্লাহ ক্ষমাপরায়ণ, পরম দয়ালু। (সূরা বাকারা, আয়াত : ২১৮)
২- তোমরা আল্লাহর পথে সংগ্রাম কর এবং জেনে রাখ যে আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ। (সূরা বাকারা, আয়াত : ২৪৪)
৩- তোমরা কি মনে কর যে, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে, যখন আল্লাহ তোমাদের মধ্যে কে জিহাদ করেছে এবং কে ধৈর্যশীল তা এখনো জানেন না (অর্থাৎ পরীক্ষা করা হয়নি)। (সূরা আল ইমরান, আয়াত :১৪২)
৪- এবং তোমরা তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে থাকবে যতক্ষণ না ফিতনা দূরীভূত হয় এবং আল্লাহর দ্বীন সামগ্রিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং যদি তারা বিরত হয় তবে তারা যা করে আল্লাহ তার সম্যক দ্রষ্টা। (সূরা আনফাল, আয়াত : ৩৯)
৫- যারা ঈমান আনে, হিজরত করে এবং সম্পদ ও জীবন দ্বারা আল্লাহর পথে জিহাদ করে তারা আল্লাহর নিকট মর্যাদায় শ্রেষ্ঠ, আর তারাই সফলকাম। (সূরা তওবা, আয়াত : ২০)
৬- সুতরাং যারা পরকালের বিনিময়ে তাদের পার্থিব জীবন বিক্রয় করে তারা আল্লাহর পথে সংগ্রাম করলে সে নিহত হোক অথবা বিজয়ী হোক তাকে মহাপুরস্কার দান করবো। (সূরা নিসা, আয়াত : ৭৪)
৭- যারা আমার (আল্লাহ) উদ্দেশ্যে সংগ্রাম করে আমি তাদেরকে অবশ্যই আমার পথে পরিচালিত করবো। আল্লাহ অবশ্যই সৎকর্মপরায়ণদিগের সঙ্গে থাকেন। (সূরা আনকাবুত, আয়াত : ৬৯)
মানবতার ইতিহাসে ইসলামই প্রথম স্পষ্ট করে যে, মজলুমের পক্ষে কিভাবে শক্তি প্রদর্শন করতে হয়। শুধু আত্মরক্ষার জন্য নয়, বিশ্বমানবতার ন্যায্য অধিকার রক্ষায় আল্লাহর দ্বীনকে প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধ করতে হয়। প্রথাগত অর্থে মুসলমানরা যুদ্ধ করেনা, তারা জিহাদ করে। প্রচলিত যুদ্ধ বলতে যা বোঝায়, জিহাদের সঙ্গে তার রয়েছে বিস্তর পার্থক্য। যুদ্ধের মূলে রয়েছে পররাজ্য গ্রাসের লিপ্সা ও প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার তীব্র আকাঙ্ক্ষা। অন্য দিকে, জিহাদের উদ্দেশ্য হলো দ্বীন প্রতিষ্ঠায় আত্মরক্ষার তাগিদে অন্যায়ের মূলৎপাটনে ন্যায়, নিরাপত্তা, সুবিচার ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। এই মৌলিক পার্থক্যের কারণেই প্রচলিত প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ও ইসলামের প্রতিরক্ষাব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে সুনির্দিষ্ট পার্থক্য। পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা হিসেবে ইসলাম জীবনের সকল বিষয়ের মতো প্রতিরক্ষা বিষয়েও সুস্পষ্ট বিধানাবলী এবং ধারণা দিয়েছে।
ইসলামে সমরনীতির অন্যতম লক্ষ্যনীয় বিষয় হলো:
ক. ইসলামী শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দুনিয়ার সাফল্য ও সৌভাগ্য লাভের সাথে পারলৌকিক সাফল্য নিশ্চিত হবে।
খ. সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব অক্ষুন্ন থাকবে।
গ. জুলুম-নিপীড়ন বন্ধে দুর্বল ও মজলুমদের সাহাযার্থে ইসলাম যুদ্ধের অনুমতি দেয়।
ঘ. ইসলামে সশস্ত্র যুদ্ধই একমাত্র যুদ্ধ নয়, সে অন্তরের, মুখের এবং অস্ত্রের ধারাবাহিক ও সময়োপযোগী ব্যবহার প্রাধান্য দেয়। ইসলামের লড়াই যেমন চলবে চিন্তার ময়দানে, তেমনি চলবে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ময়দানে এবং সর্বশেষ রণাঙ্গনেও। যাতে অন্য কোন জাতিকে জুলুমের মাধ্যমে তাদের অস্তিত্ব বিলুপ্ত করে দিতে না পারে।
ইসলামে যুদ্ধ যেহেতু মানবতার কল্যাণে নিবেদিত সেহেতু যুদ্ধ ক্ষেত্রে কিছু নিষেধাজ্ঞাও আরোপ করেছে। যেমন, অপরাপর কোন ধর্মের উপাসনালয় যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। এমনিভাবে অন্য ধর্মের পীর-পুরোহীত, বুজর্গ ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের সম্মান ও শ্রদ্ধা জানানোর জন্য তাগিদ দেয়া হয়েছে, যাতে মুজাহিদ বাহিনী জুলুম অবসানের জোশে সীমা অতিক্রম না করে।
অপর পক্ষের যোদ্ধাদের হত্যা করার ব্যাপারে ইসলাম অনেক সাবধানী
ইসলামের প্রদত্ত যুদ্ধ নীতিতে যোদ্ধা ও বিচারে দন্ডপ্রাপ্ত ব্যতীত কাউকে হত্যা করার বিধান নেই। তেমনি শরী‘আতের দেওয়া নিয়ম-নীতির বাইরে কোনরূপ স্বেচ্ছাচারিতার সুযোগ নেই। যেমন-
(১) হযরত সুলায়মান বিন বুরায়দা (রাঃ) তাঁর পিতা হ’তে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যখন কোন বড় কিংবা ছোট সেনাদলের উপর কাউকে ‘আমীর’ নিযুক্ত করতেন, তখন তাকে বিশেষভাবে আল্লাহকে ভয় করে চলার এবং তার সঙ্গী মুসলমানদের সাথে উত্তম ব্যবহার করার উপদেশ দিতেন।
অতঃপর বলতেন‘আল্লাহর নামে আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধে গমন কর এবং যারা আল্লাহর সাথে কুফরী করে তাদের সাথে যুদ্ধ কর। সাবধান! জিহাদ কর, কিন্তু গণীমতের মালে খেয়ানত করো না, চুক্তি ভঙ্গ করো না, নিহতদের অঙ্গহানি করো না, কোন শিশুকে হত্যা করো না। কাফেরদের মুকাবিলায় তুমি তাদেরকে তিনটি কথার প্রতি আহবান জানাবে’। যদি তারা সেগুলি মেনে নেয়, তাহ’লে তাদের প্রতি আক্রমণ করা থেকে বিরত হবে।
- তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিবে।
- যদি তারা ইসলাম কবুল করে, তাহ’লে তারা তাদের নিজ এলাকা থেকে মুসলমানদের এলাকায় হিজরত করে চলে আসবে এবং তারা মুহাজিরগণের ন্যায় (গণীমত ইত্যাদির) অধিকার প্রাপ্ত হবে।
- ইসলাম কবুলের পরেও যদি তারা হিজরত করে আসতে রাযী না হয়, তাহ’লে তারা বেদুঈন মুসলমানদের মত সেখানে থাকবে এবং আল্লাহর বিধানসমূহ পালন করবে।
পক্ষান্তরে যদি তারা ইসলাম গ্রহণ করতে অস্বীকার করে, তাহ’লে তাদের নিকট থেকে জিযিয়া দাবী কর এবং তাদের প্রতি আক্রমণ করা হ’তে বিরত থাক। যদি তারা জিযিয়া দিতে অস্বীকার করে, তাহ’লে আল্লাহর প্রতি ভরসা কর এবং তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর। আর যদি তুমি কোন দুর্গ অবরোধ কর, আর তারা তোমাদের সাথে চুক্তিতে আবদ্ধ হ’তে চায়, তাহ’লে তোমরা নিজ দায়িত্বে তাদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হ’তে পার।
(২) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, ‘যদি কোন ব্যক্তি কোন চুক্তিবদ্ধ ব্যক্তিকে অর্থাৎ রাষ্ট্রের অনুগত কোন অমুসলিম ব্যক্তিকে হত্যা করে, তবে সে জান্নাতের সুগন্ধিও পাবে না। অথচ তার সুগন্ধি ৪০ বছরের দূরত্ব হ’তে লাভ করা যাবে’।
(৩) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করা নিষিদ্ধ করে বলেন, إِنَّ النَّارَ لاَ يُعَذِّبُ بِهَا إِلاَّ اللهُ ‘আগুন দ্বারা কেউ শাস্তি দিতে পারে না আল্লাহ ব্যতীত’। তিনি আরও বলেন, لاَ تُعَذِّبُوا بِعَذَابِ اللهِ ‘তোমরা আল্লাহর শাস্তি দ্বারা শাস্তি প্রদান করো না’ (বুখারী হা/৩০১৬)।
(৪) বিদায় হজ্জের ভাষণে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, فَإنَّ دِمَاءَكُمْ وَأمْوَالَكُمْ وَأَعْرَاضَكُمْ عَلَيْكُمْ حَرَامٌ، كَحُرْمَةِ يَوْمِكُمْ هَذَا فِيْ بَلَدِكُمْ هَذَا فِيْ شَهْرِكُمْ هَذَا ‘তোমাদের রক্ত, তোমাদের ধন-সম্পদ ও তোমাদের ইযযত পরস্পরের উপরে এমনভাবে হারাম, যেমন এই দিন, এই শহর ও এই মাস তোমাদের জন্য হারাম’। (বিস্তারিত দ্রঃ ‘ইসলামের জিহাদ বিধান’ অনুচ্ছেদ পৃঃ ২৬৫)।
ইসলামে যুদ্ধের মূল উদ্দেশ্য ছিল ন্যূনতম ক্ষতিসাধনের মাধ্যমে মানবসমাজকে নিরাপদ করা। কোনরূপ ধ্বংস বা অশান্তি সৃষ্টি করা নয়। প্রকৃতপক্ষে, ইসলাম যুদ্ধকে কখনো উৎসাহিত করে না। যুদ্ধ অপরিহার্য হলে কেবল তখনই রাসূল (সা.) যুদ্ধে অবতীর্ণ হতেন। তবে সে ক্ষেত্রেও আল্লাহর সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা অনুসরণ করতেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) প্রদর্শিত যুদ্ধনীতি অনুসরণ করার মধ্যেই মানবজাতির প্রকৃত কল্যাণ নিহিত।
রাসূল (সা.)-এর যুদ্ধনীতির মধ্যে অন্যতম মৌলিক গুরুত্বপূর্ণ কিছু দিক হচ্ছে:
- আক্রান্ত হওয়ার পর আক্রমণ করা।
- আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সমাজের যাবতীয় ফেৎনা-ফাসাদ দূর করা।
- শত্রু পক্ষের নারী, শিশু, রুগ্ন ও নিরীহ সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে কোনরূপ ক্ষতিসাধন না করা।
- যুদ্ধাহত ও যুদ্ধবন্দীদের সাথে কোনরূপ অমানবিক আচরণ না করা ।
বলা বাহুল্য ইসলামী জিহাদের উপরোক্ত নীতিসমূহ অনুসরণের ফলেই খুলাফায়ে রাশেদীন ও পরবর্তী যুগে সে সময়ে খ্রিষ্টান, পারসিক ও পৌত্তলিকদের শাসনাধীনে থাকা উত্তর আরব, সিরিয়া, ইরাক, ইরান এবং এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপ মহাদেশের বিভিন্ন এলাকা ইসলামী খেলাফতের অধীনস্ত হয়। একমাত্র ইসলামী খেলাফতের অধীনেই রয়েছে মুসলিম-অমুসলিম সকল নাগরিকের জান-মাল ও সম্মানের নিশ্চয়তা। কেননা ইসলামী জিহাদ-এর মূল উদ্দেশ্য হল, মানুষকে শয়তানের দাসত্ব হতে মুক্ত করে আল্লাহর দাসত্বে ফিরিয়ে আনা এবং সর্বত্র আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠা করা। আর এর মধ্যেই রয়েছে মানবতার মুক্তি ও কল্যাণের স্থায়ী নিশ্চয়তা।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন