২৬ জুল, ২০১৭

উপমহাদেশের এক ভয়ংকর ডাকাত দলের উপাখ্যান


মানুষের সম্পদ অন্যায়ভাবে লুট করার প্রবণতা সকল যুগেই ছিল। আজ যেমন শেয়ার বাজার লুট করা হয় ঠিক তেমনি আগেও সাধারণ মানুষদের সম্পদ লুট হতো। তবে সেটা হত অত্যন্ত নৃশংসভাবে। একটা ডাকাত দল যারা ঠগী নামে পরিচিত ছিল। ঠগীরা মানুষের সাথে ঠগ বা প্রতারণা করে ডাকাতি করতো বলে তাদের এমন নামকরণ করা হয়। একজন ঠগী মাসে গড়ে ৮-১০ জনকে খুন করত। ধারণা করা হয় তারা প্রায় ২০ লক্ষেরও অধিক মানুষকে খুন করেছে। বাহরাম নামে এক নিষ্ঠুর ঠগীর নিজের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী ৯৩১ জন মানুষকে সে খুন করেছিল বলে দাবি করে। 

ঠগীদের ভয়ংকর সেই ইতিহাস হারিয়ে গেলেও বর্তমান সরকারের অনেক কাজ-কর্মে সেই ঠগীদের কথাই মনে করিয়ে দেয়। বাংলাদেশে এখন প্রায় প্রতিদিনই মানুষ হারিয়ে যাচ্ছে। গুম হয়ে যাচ্ছে শত শত মানুষ। এরকম গুমের সূত্র ধরেই তাদের বিনাশ হয়। কয়েকটি ব্যবসায়ী দল হারিয়ে গেলে সেসময়ের মানুষরা যখন ঠগীদের কথা ইংরেজদের বলতো তখন তারা এটাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে উড়িয়ে দিত। যখন ইংরেজরাও হারিয়ে যেতে থাকে তখন তাদের টনক নড়ে এবং এর নির্মূলে তারা শক্তি প্রয়োগ করে। দূর্ভাগ্য বাংলাদেশের। বাংলাদেশে এখন ঠগীরাই ক্ষমতায়। কে কার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবে? 

আসুন আমরা ইতিহাসে ফিরে যাই। ঠগি শব্দটি সংস্কৃত ঠগ শব্দ থেকে এসেছে। ঠগ অর্থ- ঠক বা প্রতারক বা ধূর্ত বা প্রবঞ্চক। ভারত শাসনের সময় যেসব শব্দ ইংরেজি ভাষায় যুক্ত হয়েছে থাগ তাদের মধ্যে অন্যতম। শব্দটির অর্থ চোর বা ডাকাত। থাগ শব্দটি সংস্কৃত ঠগি শব্দ থেকে এসেছে। ১৮৩৯ সালে ফিলিপ মেডোউস টেলরের উপন্যাস কনফেসনস অফ অ্য থাগ এর মাধ্যমে ঠগিদের কাহিনী জনপ্রিয়তা অর্জন করে এবং একই সাথে থাগ শব্দটি ইংরেজি ভাষায় যুক্ত হয়ে যায়। এই ধরনের হত্যাকাণ্ডের গল্প দক্ষিণ এশিয়া তথা ভারতে খুব প্রচলিত ছিল।

ইংরেজ শাসকগণ ঠগী শব্দটিকে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার আগেও উত্তর ভারতের লোকেরা তাদেরকে ফাঁসি শব্দ হতে ফাঁসিগর বলে অভিহিত করত। ঠগীদের উৎপত্তি অস্পষ্ট। সতেরো এবং আঠারো শতকে, বিশেষ করে কোম্পানির শাসনের প্রতিষ্ঠালগ্নে এদের উদ্ভব ঘটে। উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের দুষ্কৃতিপরায়ণ উপজাতি হতে উদ্ভূত হয়ে ঠগীরা নওয়াবী আমলের শেষ ও ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার ক্রান্তিলগ্নে ক্রমান্বয়ে প্রায় সমগ্র ভারত জুড়ে তাদের আধিপত্য বিস্তার করে।

ভৃপ্রকৃতি এবং পরিবহণ ব্যবস্থাভেদে বিভিন্ন অঞ্চলে ঠগীদের কার্যপ্রণালী বিভিন্ন প্রকার ছিল। ঠগিরা ১৩ থেকে ১৯ শতকে বাংলা এবং উত্তর ভারতে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। তারা হিন্দুদের দেবী কালীর পূজা করত। তাদের কথা প্রথম জানা যায় ১৩৫৬ সালে ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দীন বারানি লিখিত ‘ফিরোজ শাহর ইতিহাস’ গ্রন্থে। সাধারণত তারা দূরের যাত্রী ও তীর্থযাত্রীর ছদ্মবেশে দল বেঁধে চলাচল করত এবং আগন্তুক ভ্রমণকারীদের সঙ্গে মিশে যেত এবং তাদের প্রতি আন্তরিকতা ও সহযোগিতার মনোভাব প্রদর্শন করে তাদের বিশ্বাস অর্জন করত। সময়-সুযোগ বুঝে ও নির্ধারিত স্থানে ঠগীরা তাদের প্রথানুযায়ী হতভাগ্য শিকারের গলায় রুমাল পেঁচিয়ে তাকে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করত, তার সর্বস্ব লুণ্ঠন করত এবং ঠগী প্রথানুসারে তাকে সমাহিত করত। পরবর্তী শিকারের উদ্দেশ্যে অভিযানের আগে তারা সর্বশেষ ঘটনাস্থলে সারা রাত ধরে পান-ভোজন ও নাচগান করত। 

এছাড়াও মুসলিম সমাজে গিয়ে মুসলিমদের কাছে হজ্জের মুয়াল্লিম সাজতো। ধনী মুসলিমদের তারা হজ্জে যাওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী করে তুলতো। ঠিক এভাবে হিন্দু সমাজে গিয়েও তারা কাশী, গয়া ও গঙ্গাস্নানে যাওয়ার জন্য উৎসাহিত করতো। তারপর তাদের নিয়ে তাদের আস্তানার কাছাকাছি গিয়ে হত্যা করে সম্পদ লুট করতো। 

১৩৫৬ সালের জিয়াউদ্দীন বারানি লিখেন, ১২৯০ এর দিকে সুলতানের শাষন আমলে কিছু ঠগী ধরা পরে, কেউ কেউ বলে এ সংখ্যা এক হাজার। তাদের নতুন দিল্লী নিয়ে যাওয়া হয়েছিল কিন্তু সুলতান তাদের একজনকেও হত্যা করেন নি বরং তাদেরকে নৌকায় তুলে ভাটির দেশে পাঠিয়ে দিতে নির্দেশ দেন যাতে তারা আর কোনদিন দিল্লীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না পারে।”

ঠগীরা সাধারনত বংশপরম্পরায় এই হত্যাকাণ্ড ঘটাত। একজন ঠগি বালক ১৮ বছর হলে সে হত্যার অনুমতি পেত। ১৮১২ সালে ব্রিটিশ সরকার ঠগীদের কথা প্রথম জানতে পারে। সেসময় একটি গণকবরে ৫০টি মৃতদেহ গলায় ফাঁস দিয়ে হত্যা করা অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল। তারা সাধারনত বছরের এক সময় ঘর সংসার করত এবং শরৎকালে দলগতভাবে যাত্রা করত মানুষ হত্যার জন্য। ঠগীরা দলের সর্দারকে জমাদার নামে অভিহিত করত। ঠগিদের প্রধান তীর্থক্ষেত্র ছিল পশ্চিমবাংলার 'কালীঘাট' ও বিন্ধ্যাচলের 'ভবানী মন্দির'।

ঠগীরা হত্যাকান্ডের জন্য একটি হলুদ রঙের রুমাল ব্যবহার করত যার র্দৈঘ্য ছিল মাত্র ৩০ ইঞি। রুমালটি ভাজ করে তার দুই মাথায় দুটি রুপার মুদ্রা দিযে বেধে দিত। হত্যা সময় একজনকে হত্যার জন্য তিনজন ঠগি ছিল এদের একজন মাথা ঠেসে ধরত, একজন রুমালটি হত্যার শিকার ব্যাক্তির গলায় পেচিয়ে ধরত ও অরেকজন পা ধরে থাকত।

ঠগীরা হত্যার পর লাশগুলো মাটিতে পুতে ফেলত। কেউ পালিয়ে গেলে ঠগীদের অগ্রবর্তী দল তাদের হত্যা করত। তারা সাধারনত ভিক্ষুক, সংগীতজ্ঞ, নৃত্যশিল্পী, ঝাড়ুদার, তেল বিক্রেতা, কাঠমিস্ত্রি, কামার, বিকলাঙ্গ, কুষ্ঠরোগী, গঙ্গাজলবাহক ও নারীদের হত্যা করত না।

ঠগীরা শীত মৌসুমে বাংলার জেলাসমূহে আসত এবং বংশগত স্থানীয় অপরাধীদের সহযোগিতায় বর্ষাকাল আসার আগ পর্যন্ত তাদের কাজ চালিয়ে যেত। উইলিয়ম বেন্টিং এর প্রশাসন ঠগীদের বিরুদ্ধে এক ব্যাপক সামরিক ও বেসামরিক অভিযান পরিচালনা করে। ফলে শত শত ঠগী ধরা পড়ে। তাদেরকে বিচার করে প্রকাশ্যে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। ঠগী উচ্ছেদ অভিযানের নেতা ছিলেন কর্নেল শ্লিম্যান। ১৮৩০ সাল থেকে ১৮৪১ সাল পর্যন্ত তিনি প্রায় ৩৭০০ ঠগিকে ধরতে সমর্থ হন। ১৯৪০ সালের দিকে প্রায় ৫০০ ঠগির ফাঁসি দেওয়ার পর ঠগিদের সংখ্যা কমে আসে। উনিশ শতকের মাঝামাঝিতে আইন-শৃঙ্খলার প্রতি হুমকিস্বরূপ এ ঠগবাজী প্রায় সম্পূর্ণভাবে উৎখাত হয়ে যায়। এখনো ভারতের রাজস্থানে ঠগীদের বংশধরদের দেখা যায় তবে তারা স্বাভাবিক জীবন যাপন করছে।

তথ্যসূত্র 
৬- ঠগী, শ্রীপান্থ 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন