মিশরের ইখওয়ানুল মুসলিমিনের সাবেক মুর্শিদে আ’ম মুহাম্মদ মাহদী আকিফের মৃত্যুই তাকে মুক্তি দিয়েছে শিকল থেকে। অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করা স্বৈরশাসক সিসির কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি পৌঁছে গেছেন মুক্তির সিংহদরজায়। মহান আল্লাহ তায়ালা তাকে জান্নাতের সর্বোচ্চ মর্যাদা দান করুন। শহীদ হিসেবে কবুল করুন।
২০১৩ সালে মিশরের জনগণের নির্বাচিত ১ম প্রেসিডেন্ট মোঃ মুরসিকে যখন সেনাবাহিনী ক্ষমতাচ্যুত করে তখন হাজার হাজার মুক্তিকামী মানুষকে হত্যা করা হয়। গ্রেফতার করা হয় অগণিত মানুষকে। তার মধ্যেই একজন ছিলেন ৮৯ বছরের বর্ষিয়ান নেতা মাহদী আকিফ। ২০০৪ সালে তিনি ইখওয়ানের প্রধান বা মুর্শিদে আ’ম হন। ২০১০ সাল পর্যন্ত তিনি এই দায়িত্ব পালন করেন। ২০১০ সালেই তিনি স্বেচ্ছায় নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়ান। নেতৃত্ব তুলে দেন উত্তরসূরীদের কাছে। এ যেন উপমহাদেশের সেরা মুজাদ্দিদ মাওলানা মওদুদীর অনুসরণ। এরকম নজির আরো দেখা যায় এদেশের ইসলামপ্রিয় মানুষের প্রাণের স্পন্দন, ইসলামী আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক গোলাম আযমের মধ্যেও। মাহদী আকিফের পর মুর্শিদে আ’ম হন মুহাম্মদ ব’দি।
গ্রেফতারের পর পরই ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন মাহদী আকিফ। জালিম সিসি সরকার তার চিকিৎসার কোন ব্যবস্থাই করেনি। বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা ও আইনজীবীরা তার মুক্তির জন্য বহু চেষ্টা করলেও জালিমদের কাছে তা মুখ থুবড়ে পড়ে। বরং তাকে আদালত অবমাননার কথা বলে কারাগারে বন্দী করে রাখে। তিনি ২০১৩ সালের আগষ্টে তাঁর আইনজীবিদের তাঁর বার্ধক্য ও অসুস্থ শরীরের কারণ দেখিয়ে তাঁর জন্য মুক্তির আবেদন করতে নিষেধ করে দিয়ে বলেন, “আমার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগই দায়ের করা হয় নি যে, আমার মুক্তির জন্য আবেদন করতে হবে। বরং জরুরি অবস্থার অধীন আমাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কোন অমীমাংসিত মামলার কারণে আমি গ্রেফতার নই। বৈধ সরকার ফিরিয়ে আনার জন্য আমি শহীদি মৃত্যু বরণ করতে ইচ্ছুক।” ক্রমেই অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। এক পর্যায়ে বিনা চিকিৎসায় গত ২২ সেপ্টেম্বর তার মৃত্যু হয়।
মাহদী আকিফ জন্মগ্রহন করেন ১৯২৮ সালে। সেই বছরই কিংবদন্তী ঈমাম হাসান আল বান্না প্রতিষ্ঠা করেন ইখওয়ানুল মুসলিমিন যা মুসলিম ব্রাদারহুড নামেও পরিচিত। ১৯৪০ সালে মাহদী আকিফ মাত্র ১২ বছর বয়সেই ইখওয়ানে যোগদান করেন। জীবনের ছোটবেলা থেকেই তিনি ইসলাম প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করেন। সেই থেকে একেবারে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত প্রায় ৭৭ বছর তিনি ইসলামী আন্দোলনে যুক্ত থেকেছেন। সংগ্রাম করেছেন। পথ দেখিয়েছেন। সামনে থেকে লড়াই করতে শিখিয়েছেন সারাবিশ্বের অগণিত মুক্তিকামী মানুষকে।
মাহদী আকিফের জন্ম ছিল ইখওয়ানুল মুসলিমিনের প্রতিষ্ঠাকালীন বছরেই, ১৯২৮ সালে। বেশ স্বচ্ছল পরিবারেই জন্মগ্রহণ করেন তিনি। যেখানে দশ ভাই-বোনের সাথে একসাথে বেড়ে উঠেন। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করেন নিজ শহর মনসুরাতেই। এরপর উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য প্রথমে ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টিতে ভর্তি হন, কিন্তু পরবর্তীতে ইমাম হাসান আল বান্নার (রহঃ) পরামর্শে ইঞ্জিনিয়ারিং ছেড়ে ‘শারীরিক শিক্ষা’ উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হন। হাসান আল বান্নার ইচ্ছা ছিল মিশরের প্রতিটি স্কুলে ও উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি ফ্যাকাল্টিতে ইখওয়ানের উপস্থিতি নিশ্চিত করা; তার ওপর মাহদী আকিফেরও ছিল শারীরিক কসরতের প্রতি আলাদা একটি ভালোবাসা। সব মিলিয়েই হাসান আল বান্না মাহদী আকিফকে এই পরামর্শ দেন। এরপর ১৯৫১ সালে তিনি ইবরাহীম ইউনিভার্সিটির (বর্তমান নাম আইন শামস ইউনিভার্সিটি) আইন বিভাগে ভর্তি হন উচ্চ শিক্ষা লাভ করার জন্য।
মাহদী আকিফ ঈমাম হাসান আল বান্নার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন। যখন ইখওয়ান প্রতিষ্ঠাতা তার সাথে প্রথম পরিচিত হন তখন তিনি তরুণ মাহদী আকিফের মেধাদীপ্ত চেহারা ও যোগ্যতা দেখে মুগ্ধ হন। তিনি তাকে খেলাধূলায় ও শরীর গঠনে উৎসাহিত করেন। মাহদী আকিফ ছিলেন সুঠামদেহী এবং একজন উদ্যমী খেলোয়াড়। যখন তার বয়স মাত্র সতের তখন হাসান আল বান্না তাকে একটা বিশেষ প্যারামিলিটারি বাহিনীর জন্য নির্বাচন করেন। এটি ছিল গোপন বিশেষ সংগঠন। এই বিশেষ বাহিনী কাজ করতো মিশরে দখলদার ব্রিটিশ সেনাবাহিনী এবং ফিলিস্তিনে দখলদার ইহুদীবাদীদের বিরুদ্ধে।
ইখওয়ানের এই বিশেষ শাখা ছিল অনেকটা আধা সামরিক সংগঠনের মত, যা গঠিত হয়েছিল মিশরে দখলদার ব্রিটিশ বাহিনী এবং ফিলিস্তিনে দখলদার জায়োনিষ্টদের বিরুদ্ধে স্পেশাল সামরিক অপারেশন চালানোর জন্য। ১৯৪৮ সালে আরব ইসরাইল যুদ্ধে ইখওয়ানের পাঠানো স্বেচ্ছাসেবক মুজাহিদ দলের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন তিনি। এছাড়াও ইখওয়ানের বিশেষ শাখার দায়িত্বের অংশ হিসেবেই ১৯৫২ সালের ফ্রি অফিসার্স মুভমেন্ট কর্তৃক সামরিক ক্যু সংঘটিত হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি ইবরাহীম ইউনিভার্সিটিতে গঠিত সামরিক ক্যাম্পগুলোর নেতৃত্ব দেন, যেগুলো ইংরেজদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিত। এরপরে তিনি ইখওয়ানের ছাত্রশাখা এবং শারীরিক শিক্ষা বিভাগের প্রধানের দায়িত্বও পালন করেন।
ইখওয়ানের এই বিশেষ শাখা ছিল অনেকটা আধা সামরিক সংগঠনের মত, যা গঠিত হয়েছিল মিশরে দখলদার ব্রিটিশ বাহিনী এবং ফিলিস্তিনে দখলদার জায়োনিষ্টদের বিরুদ্ধে স্পেশাল সামরিক অপারেশন চালানোর জন্য। ১৯৪৮ সালে আরব ইসরাইল যুদ্ধে ইখওয়ানের পাঠানো স্বেচ্ছাসেবক মুজাহিদ দলের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন তিনি। এছাড়াও ইখওয়ানের বিশেষ শাখার দায়িত্বের অংশ হিসেবেই ১৯৫২ সালের ফ্রি অফিসার্স মুভমেন্ট কর্তৃক সামরিক ক্যু সংঘটিত হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি ইবরাহীম ইউনিভার্সিটিতে গঠিত সামরিক ক্যাম্পগুলোর নেতৃত্ব দেন, যেগুলো ইংরেজদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিত। এরপরে তিনি ইখওয়ানের ছাত্রশাখা এবং শারীরিক শিক্ষা বিভাগের প্রধানের দায়িত্বও পালন করেন।
মাহদী আকিফ মিশরের প্রায় সকল সরকার কর্তৃক গ্রেফতার হন। ১৯৪৮ সালে যখন তার বয়স ২০ বছর তখন তিনি ১ম গ্রেফতার হন। ১৯৫৪ সালে স্বৈরাচারী জামাল আব্দেল নাসের প্রায় ১০০ জন ইখওয়ান নেতাকর্মীকে আটক করেন যাদেরকে নাসের তার ক্ষমতার জন্য হুমকি মনে করতো। সেই ১০০ জনের মধ্যে একজন ছিলেন মাহদী আকিফ। সেই একশ জনের মধ্যে অল্প কয়েকজনকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। মাহদী আকিফ তার মধ্যেও একজন ছিলেন। তবে কিছুদিনের মধ্যেই তার মৃত্যুদন্ডাদেশ যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ডে রূপ নেয়।
তিনি দীর্ঘ বিশ বছর কারাগারে ছিলেন। মুক্তি পান ১৯৭৪ সালে। তিনি ছিলেন একজন ধৈর্য্যশীল মানুষ। কারাগারে কঠিন নির্যাতন তার জীবনকে জাহান্নাম বানিয়ে ফেললো। তারপরও তিনি ছিলেন স্থির এবং শান্ত। তার কারাগারে থাকাকালীন যখন কেউ তার সাথে কথা বলতো তখন তার মধ্যে কোন দুশ্চিন্তা, হতাশা, অসন্তোষ কিছুই লক্ষ্য করা যেত না। আল্লাহর উপর ভরসা করা এই মহান মানুষ কখনোই আল্লাহর সাহায্যের ব্যাপারে হতাশ ছিলেন না। বরং সবসময় আশাবাদী ছিলেন।
মুক্তি পাওয়ার তিনবছর পর ১৯৭৭ সালে তিনি সৌদী আরবে ভ্রমণ করেন। সেখানে তিনি যুক্ত হন বিশ্বখ্যাত মুসলিম এনজিও ওয়ামীর (WAMY) সাথে। ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত তিনি ওয়ামীর বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ওয়ামীর হয়ে বিশ্বব্যাপী মুসলিম ইয়ুথ ক্যাম্পের অর্গানাইজার ছিলেন।
১৯৮৩ সালে মাহদী আকিফ ইউরোপ গমন করেন। তিনি কিছুদিন জার্মানিতে ইসলামিক সেন্টার ইন মিউনিখের প্রধান হিসেবে কাজ করেন। জার্মানিতে থাকাকালে তিনি মুসলিম ব্রাদারহুডের ইন্টারন্যশনাল এফেয়ার্সের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন। এর মাধ্যমে তিনি বিশ্বের বিভিন্ন কমিউনিটির সাথে ও বিশ্বের বিভিন্ন ইসলামী আন্দোলনের সাথে ইখওয়ানুল মুসলিমিনের সংযোগ স্থাপনে ভূমিকা রাখেন।
মাহদী আকিফ মিশরে প্রত্যাবর্তন করেন ১৯৮৭ সালে। একই বছর তিনি মুসলিম ব্রাদারহুডের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে আসেন। তিনি মুসলিম ব্রাদারহুডের কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। একই সময়ে তিনি একটি সংসদীয় আসনে বিজয় লাভ করেন এবং ৩৭ জন সংসদ সদস্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম ব্রাদারহুডের সংসদীয় ব্লকের অংশ হিসেবে তিন বছর দায়িত্ব পালন করেন। ইখওয়ানের সেসময় সংসদীয় নির্বাচনে অংশগ্রহনের অনুমতি ছিল না কিন্তু সমাজতান্ত্রিক লেবার পার্টির সাথে একটা বিশেষ এলায়েন্সের মাধ্যমে ইখওয়ান নির্বাচনে অংশ নেয়।
১৯৯৬ সালে সেনা সরকার আবারো মুসলিম ব্রাদারহুডের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে। একের পর এক গ্রেপ্তার করতে থাকে ইখওয়ানের নেতাদের। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তারা শ্রমিক ইউনিয়নের মাধ্যমে বিদ্রোহ করতে চেয়েছিলেন। মাহদী আকিফ সেসময় গ্রেফতার হন। মিলিটারি কোর্ট সেসময় নেতাকর্মীদের বিভিন্ন মেয়াদের শাস্তি ঘোষণা করে। মাহদী আকিফ তিনবছর সশ্রম কারাদন্ড শেষে ১৯৯৯ সালে মুক্তি পান।
২০০৪ সালে জানুয়ারিতে মা’মুন আল হুদায়বির মৃত্যুর পর মাহদী আকিফ ইখওয়ানুল মুসলিমিনের মুর্শিদে আ’ম নির্বাচিত হন। একই সালের মার্চ মাসে তার নেতৃত্বে মুসলিম ব্রাদারহুড প্রথমবারের মতো একটি রাজনৈতিক সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করে। যা গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও নারী অধিকার সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে কাজ করা দল ও গোষ্ঠীগুলোর দৃষ্টি আকর্ষন করতে সক্ষম হয়। ইখওয়ানের এই সংস্কার আন্দোলন অল্প সময়ের মধ্যেই জনপ্রিয় হয় যা সরকারের জন্য উদ্বেগের কারণ হিসেবে দেখা দেয়। এটি ছিল শান্তিপ্রিয় ও জনপ্রিয় আন্দোলন। তাই অন্যান্য রাজনৈতিক আন্দোলনের মত এই আন্দোলনকে দমিয়ে দেয়া এবং নিষিদ্ধ করা ছিল সরকারের জন্য বিব্রতকর।
মাহদী আকিফের সময়কালে মুসলিম ব্রাদারহুডের রাজনৈতিক আন্দোলনের উন্মেষ ঘটে। মিশরের মুসলিমদের প্রিয় সংগঠনে পরিণত হতে থাকে ইখওয়ান। মাহদী আকিফ মনে প্রাণে একজন বিপ্লবী ছিলেন। যখন তার বয়স আশি পেরিয়েছে তখনও তিনি কথা বলতেন একজন উদ্যমী যুবকের মত। তার চিন্তাভাবনা ছিল সবসময় আধুনিক। এজন্য তিনি যুবকদের কাছে ছিলেন ভীষণ প্রিয়। এর অন্য কারণ ছিল তিনি সবসময় যুবকদের চাহিদা, আকাঙ্ক্ষা বুঝতেন। তাদের অভিযোগগুলো এবং পরামর্শগুলো মন দিয়ে শুনতেন। তিনি সবসময় নেতৃত্বের আধুনিকতা এবং পরিবর্তনের দিকে গুরুত্ব দিতেন।
চার বছর আগে তিনি যখন আটক হন তখন তার বয়স ছিল ৮৫। শেষ দিনগুলো তার স্বাস্থ্যের অবস্থা ক্রমশ খারাপ অবস্থার মধ্য দিয়ে গিয়েছিল। তাঁর মৃত্যুতে সারা বিশ্বের ইসলামী আন্দোলন বিশেষ করে মুসলিম ব্রাদারহুড অনেকটা ইয়াতিম হয়ে গেছে, অভিভাবকহারা হয়েছে। মাহদী আকিফকে চিকিৎসা না দিয়ে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়ে খুন করার মাধ্যমে মিশরসহ সারা বিশ্বের ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের মধ্যে যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে সেই ক্ষোভ থেকে জন্ম নিবে হাজারো আকিফ। ইনশাআল্লাহ্।
শহীদেরা মরে না। তারা জীবিত। দুনিয়ায় থাকা মাহদী আকিফের চাইতে শহীদ মাহদী আকিফ আরো শক্তিশালী হবে ইনশাআল্লাহ্।
তথ্যসূত্রঃ
১। আল জাজিরা
২। মিডল ইস্ট মনিটর
তথ্যসূত্রঃ
১। আল জাজিরা
২। মিডল ইস্ট মনিটর
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন