২৯ এপ্রি, ২০১৮

গণতন্ত্র কি কুফরি মতবাদ? না কি গণতন্ত্র ইসলামসম্মত?



গণতন্ত্র নিয়ে ইসলামপন্থীদের মধ্যে ব্যাপক ভুল ধারণা আছে বলে আমার মনে হয়। যারা গণতন্ত্রের বিরোধী তাদের প্রায় বলতে শোনা যায় আব্রাহাম লিংকনের গণতন্ত্র। আসলে গণতন্ত্র লিংকন সাহেবের নয়। তিনি এর একটি দারুণ সংজ্ঞা দিয়েছিলেন।

গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নেতা নির্বাচন এখন থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগের কথা। যাই হোক। গণতন্ত্র কোন মতবাদ বা জীবনবিধান নয়। এর কোন শ্বাশত রূপ নেই। এটা নির্বাচন পদ্ধতি বা সিদ্ধান্ত গ্রহণ পদ্ধতি। এটাকে যেকোনভাবে ব্যবহার করা যায়।

পৃথিবীর সব দেশের গণতন্ত্র একরকম নয়। গণতন্ত্রকে সবাই নিজের দেশের জন্য উপযোগী করে ব্যবহার করছেন। একটি এলাকার বেশিরভাগ মানুষ যদি ইসলামের বিপরীত হয় তাদের সিদ্ধান্ত আর একটি এলাকার বেশিরভাগ মানুষ যদি ইসলামিক হয় তবে তাদের উভয়ের সিদ্ধান্ত একরকম হবে না এটাই স্বাভাবিক।

প্রতিটি দেশের মূলনীতি ও সংবিধান থাকে। তাকে সার্বভৌম মেনেই প্রত্যেক দেশ গণতন্ত্রের চর্চা করে। বাংলাদেশের জাতীয়ভাবে যে গণতন্ত্রের চর্চা হয় দলগুলোতে আবার সেই চর্চা হয় না। আমার দলের কথাই ধরি। আমার দল 'বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী' বাংলাদেশে সে গণতন্ত্র চালু আছে তাকে ত্রুটিমুক্ত মনে করে না। তাই জামায়াত নিজেদের নেতা নির্বাচনে গণতান্ত্রিক পন্থা অবলম্বন করলেও সেটা বাংলাদেশের মত নয়।

এবার তবে প্রশ্ন ইসলাম কি গণতন্ত্র সাপোর্ট করে? 
এককথায় যদি উত্তর করি তবে বলতে হয় গণতন্ত্রকে ইসলাম শুধু সাপোর্ট করে না। ইসলামে নেতা নির্বাচন পদ্ধতিই গণতান্ত্রিক। অতএব এটা শুধু ইসলামসম্মত নয় বরং গণতন্ত্র ইসলামের দাবী।

আসুন আমরা জেনে নিই ইসলামে নির্বাচনের মূলনীতি কী? 
হযরত আবু মাসউদ রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন : মানুষের ইমামতি করবে সে-ই, যে কুরআন ভাল পড়ে। যদি কুরআন পড়ায় সকলে সমান হয়, তবে যে সুন্নাহ বেশি জানে। যদি সুন্নাহেও সকলে সমান হয়, তবে যে হিজরত করেছে সে। যদি হিজরতেও সকলে সমান হয়, তবে যে বয়সে বেশি। কেউ যেন অপর ব্যক্তির অধিকার ও সেইস্থলে ইমামতি না করে এবং তার বাড়িতে তার সম্মানের স্থলে অনুমতি ব্যতীত না বসে। (মুসলিম)

হযরত আবু সায়ীদ খুদরী রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন : যখন তিন ব্যক্তি হবে, তখন যেন তাদের মধ্য হতে একজন নেতৃত্ব দেয় এবং নেতৃত্বের অধিকার তার, যে কুরআন অধিক ভাল পড়ে। (মুসলিম)

এরকম যতগুলো হাদীস এসেছে তা সবই এই হাদীসদ্বয়ের অনুরূপ।

হাদীসটিতে রাসূল সা. নেতা হওয়ার জন্যে প্রয়োজনীয় গুণাগুণ বা যোগ্যতাগুলো যে ক্রম অনুযায়ী উল্লেখ করেছেন, তা হচ্ছে-
ক. শুদ্ধ করে পড়াসহ কুরআনের জ্ঞান থাকা,
খ. সুন্নাহ তথা হাদীসের জ্ঞান থাকা,
গ. হিজরত করা এবং
ঘ. বেশি বয়স/ প্রাজ্ঞতা/ অভিজ্ঞতা

অনেক স্কলার হিজরতের ব্যাখায় বলেছেন ইসলাম প্রতিষ্ঠায় যারা গুরুত্বপূর্ণ ত্যাগ স্বীকার করেছেন। মদীনার প্রাথমিক সময়ে হিজরত ছিল সবচেয়ে বড় আমল যা করতে সবচেয়ে বেশী ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। হিজরত করেছেন তারা যারা দ্বীন কায়েমের জন্য তাদের সকল সহায় সম্পত্তি আত্মীয় স্বজন বিসর্জন দিয়েছেন। এখনো আমাদের দেশে যারা দ্বীন কায়েমের পথে নিয়োজিত আছেন, শ্রম দিচ্ছেন, ত্যাগ স্বীকার করছেন তারা নেতা হওয়ার জন্য অধিকতর যোগ্য।

যাই হোক এগুলো হল নেতার গুণাগুণ।

এবার আমরা আরেকটি হাদীসের দিকে আলোকপাত করি...

ইবনে উমর রা. বলেন, রাসূল সা. বলেছেন, তিন ব্যক্তির নামাজ কবুল হবে না। যে কোন গোত্র বা জাতির ইমাম হয়েছে অথচ তারা তাকে পছন্দ করে না, যে নামাজ পড়তে আসে দিবারে। আর দিবার হল- নামাজের উত্তম সময়ের পরের সময়কে এবং যে কোন স্বাধীন নারীকে দাসীতে পরিণত করে। (আবু দাউদ ও ইবনে মাজাহ)।

ইবনে আব্বাস রা. বলেন, রাসূল সা. বলেছেন, তিন ব্যক্তির নামাজ তাদের মাথার উপর এক বিঘতও ওঠে না অর্থাৎ কখনই কবুল হয় না। ক. যে ব্যক্তি কোন গোত্র বা জাতির ইমাম হয় কিন্তু তারা তাকে পছন্দ করে না, খ. সেই নারী যে রাত্রি যাপন করেছে অথচ তার স্বামী সঙ্গত কারণে তার ওপর নাখোশ এবং গ. সেই দুই ভাই যারা পরস্পরে বিচ্ছিন্ন। (ইবনে মাজাহ)

উপরিউক্ত হাদীসগুলো থেকে একথা স্পষ্ট কোন ব্যক্তির ইমামতির যোগ্যতা থাকার পরও অনুসারী বা জনগনের ভোট বা সমর্থন জরুরী। অধিকাংশ জনগনের সমর্থন না থাকলে তিনি ইমামতি তথা নেতা হওয়ার যোগ্যতা হারান।

আমার দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী মনে করে ইসলামের আলোকে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নেতা নির্বাচন করতে হবে এবং জামায়াত তার নিজ দলের অভ্যন্তরে এভাবেই গণতন্ত্রের চর্চা করে। খুলাফায়ে রাশেদার চারজনই গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত নেতা। যাদের প্রতি অধিকাংশ মুসলিম সমর্থন দিয়েছেন।

এবার আসুন সিদ্ধান্ত গ্রহণের পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা হোক।

ইসলামে পরামর্শের আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। এমনকি আল্লাহতায়ালা মানুষকে পৃথিবীতে প্রেরণ করার আগে ফেরেশতাদের সঙ্গে পরামর্শ করে তাদের মতামত জানতে চেয়েছিলেন। এর মাধ্যমে মূলত আল্লাহতায়ালা মানবজাতিকে পরামর্শের গুরুত্ব বুঝিয়েছেন।

ইসলামের প্রথম যুগ থেকেই সব কাজ সম্পাদিত হতো পরামর্শের ভিত্তিতে। ইসলাম বরাবরই পরস্পরের পরামর্শকে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে দেখে আসছে। আমাদের রাসূল সা: নিজের সিদ্ধান্ত কখনোই চাপিয়ে দিতেন না। সাহাবাদের মধ্যে তিনি যাদের গুরত্বপূর্ণ ও যোগ্য মনে করতেন তাদের সাথে আলোচনা ও পরামর্শ করতেন। আযান কীরূপ হবে এটা নিয়ে তিনি পরামর্শ করেছিলেন, বদর যুদ্ধের গ্রেপ্তারকৃতদের সাথে কী আচরণ করা হবে এই নিয়েও তিনি আলোচনা করেছিলেন। এভাবে সব বিষয়ে তিনি সাহাবাদের সাথে আলোচনা করতেন।

খন্দকের যুদ্ধে পরিখা খননের বিষয়টা পরামর্শের মাধ্যমে উঠে এসেছে এবং বেশিরভাগ সাহাবা এতে রায় দিয়েছেন। বদর যুদ্ধের গ্রেপ্তারকৃতদের ব্যাপারে দুটো প্রস্তাব এসেছিলো। আল্লাহর রাসূল সা: চেয়েছিলেন তাদের থেকে মুক্তিপণ দিয়ে মুক্ত করে দিতে। ঊমার রা: চেয়েছিলেন তাদের হত্যা করতে। সাহাবারা আল্লাহর রাসূলের মতামতকে বেশি ভোট দিয়েছেন তাই তাঁর সিদ্ধান্তই কার্যকর হয়েছে। এভাবে আল্লাহর রাসূল সা: ও খুলাফায়ে রাশেদার যুগে গণতান্ত্রিকভাবে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে।

কারা পরামর্শ সভায় থাকবেন এই নিয়ে অন্য আলোচনা। 

এবার আসুন ইসলামের প্রথম রাষ্ট্র কীভাবে গঠিত হয়েছিল তা নিয়ে একটু চিন্তা করি।

আল্লাহর রাসূল সা: যে যুগে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সে যুগে অধিকংশ মানুষের মতামতের কোন গুরুত্ব ছিল না। সে যুগে যার শক্তি বেশি সেই হতো ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু। অনেকটা জোর যার মুল্লুক তার অবস্থা। আল্লাহর রাসূল দীর্ঘ ১৩ বছর মক্কায় দাওয়াতী কাজ করেছেন। যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে ইসলামী রাষ্ট্র চালানোর উপযোগী করেছিলেন। সেসময় মক্কার সেরা বীরদের কয়েকজন ইসলাম গ্রহণের মাধ্যমে ইসলামকে শক্তিশালী করেছিলেন। এর মধ্যে উল্লেখ যোগ্য হামযা রাঃ ও ওমর রাঃ । অর্থের দিক দিয়েও আল্লাহর রাসূল পেছনে ছিলেন না। আবু বকর রাঃ এবং ওসমান রাঃ এর মত অসাধারণ ধনী ব্যাক্তি ইসলামের অনুসারী ছিলেন।

তবে মক্কায় অধিকাংশ মানুষ আল্লাহর রাসূল সাঃ এর অনুসারী ছিলেন না। জনসমর্থন ইসলামের সাথে ছিল না। তাই সেখানে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কোন রাষ্ট্রে ইসলামী বিপ্লবের জন্য অধিকাংশ জনসমর্থন জরুরী। শুধু শক্তি প্রয়োগ করে ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম আল্লাহর রাসূলের সীরাত বিরোধী, সুন্নাহ বিরোধী। এটা ইসলাম সম্মত নয়। ইসলামী বিপ্লবের জন্য জনগণের সাপোর্ট প্রয়োজন। আল্লাহর রাসূল সাঃ এমন সময়ে গণতন্ত্রের চর্চা করেছেন যখন পৃথিবীতে গণতন্ত্র ছিল না। আজ পৃথিবীতে অনেকাংশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত কিন্তু আপনি ইসলামপন্থী অথচ আপনি গণতন্ত্রের বিরোধীতা করেন। আপনি/ আপনারা আসলে কী চান?

তাহলে বিরোধ কোথায়? 
যারা গণতন্ত্র বিরোধী তারা বলতে চান এর মাধ্যমে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব নষ্ট হয়। এই সমস্যা বাংলাদেশের সংবিধানে আছে। বাংলাদেশের সংবিধানে সার্বভৌমত্বের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি বা পার্লামেন্টের কাছে। এর ফলে সংসদ ইচ্ছে করলে আল্লাহর নির্দেশের বাইরে যেতে পারে। এই সমস্যা গণতন্ত্রের নয় বরং এই সমস্যা সংবিধানের। 

জামায়াতে ইসলাম বাংলাদেশ সংবিধানের এই পদ্ধতি ও গণতন্ত্রের এই ব্যাখ্যা মানে না। আমরা মনে করি সার্বভৌম ক্ষমতা থাকবে আল্লাহর। পার্লামেন্ট যে কোনো সিদ্ধান্ত নিবে আল্লাহর সীমারেখার মধ্যে থেকে। এবং ঠিক এই কারনে আমাদের গঠনতন্ত্র বা সংবিধান বাংলাদেশের সংবিধানের সাথে মিলে না। আর মিলে নাই বিধায় আমাদের নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে। আমাদের নিবন্ধন বাতিল হওয়া সত্ত্বেও আমরা এক্ষেত্রে আপোষ করিনি।    

আমাদের নিবন্ধন বাতিলের কারণ হলো আমরা জনগণ বা মানুষের সার্বভৌমত্ব মানিনা। আমরা একমাত্র আল্লাহর সারবভৌমত্বকেই মানি। আর গণতন্ত্রকে আমরা নেতা নির্বাচন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের টুলস হিসেবে ব্যবহার করি।