ঢাকা মসজিদের শহর। একথা কে না জানে? কিন্তু ঢাকা লিখে গুগোলে ইমেজ সার্চ করলে কিন্তু সেকথার প্রমাণ পাওয়া যায় না। কোনো বিদেশি যদি ঢাকা নিয়ে জানতে চায় ইমেজের মাধ্যমে তবে বুঝতেই পারবে না ঢাকা মুসলিমদের শহর। মসজিদের শহর তো পরের কথা।
আমার কাছের একজন শখের ফটোগ্রাফার এই নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন। তিনি বললেন, ভাই সুযোগ করে আমরা একেকদিন একেক মসজিদে জুমার নামাজ পড়বো। এতে মসজিদগুলোর সাথে পরিচিত হবো। সাথে কিছু ছবিও তুলে নিতে পারবো। এরপর তার নাকি সেই ছবিগুলো নিয়ে বিস্তর পরিকল্পনা আছে।
সে যাকগে, আমার এত পরিকল্পনা নাই। আমি যাই তার সাথে। ঘুরতে আমার ভালোই লাগে। তবে সমস্যা হলো বেকার মানুষ তো, তেরো কোম্পানির কাজ করতে হয়। তাই অবসর খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তারপরও চেষ্টা করি।
কয়েক দিন আগে প্ল্যান করেছি তারা মসজিদে যাব। ঢাকার তারা মসজিদ। অনেক পুরনো। উইকি-টুইকি সার্চ করে করে কিছু ইনফো জেনে নিলাম। গুগোল ম্যাপ থেকে জেনে নিলাম ঠিকানা। ব্যাস সব প্রস্তুতি শেষ। এবার মানিব্যাগে ঢুঁ মেরে দেখে নিলাম কী অবস্থা। মনটাই খারাপ হয়ে গেলো। সিকি আধুলি সব মিলে একশ বিশ টাকা। এটা দিয়ে তো হবে না। কারণ সুন্দর করে মাঞ্জা মেরে বের হবো ভাবছি।
এখন যদি লোকাল বাসে যাই তবে ফিটফাট পোশাকের বারোটা বেজে যাবে। তাহলে? যাই হোক যেতে হবে। কারণ আমার কাছে টাকা পয়সার চাইতে সময় আরো দুর্লভ। তাই দেরী না করে বেরিয়ে পড়লাম। মনে মনে ভাবছি আরেকজনের পকেটের কুরবানী করে আজ পার হয়ে যাবো।
শুনেছি বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা। পরবর্তিতে কিছু বিজ্ঞ গবেষক জানালেন না, তা নয়, শেষ স্বাধীন নবাব হলেন মীর কাসিম। তিনি স্বাধীনভাবে চলতে গিয়ে ইংরেজদের সাথে বক্সারের যুদ্ধে উপনীত হন। অবশেষে মারা পড়েন। কিন্তু আমি জানি এসব কিছুই সঠিক নয়। বাংলার স্বাধীন নবাবরা আজো আছেন। বীর বিক্রমে রাজপথ দাপিয়ে বেড়ান। তারা হলেন সিএনজি ড্রাইভার। আপনি যেখানেই যাবেন তারা তাদের ইচ্ছেমত ভাড়া দাবী করে নবাবী হালে উদাস হয়ে চেয়ে থাকবেন। আপনার ইচ্ছে হলে যাবেন না হলে হাঁটবেন।
নিজের পকেটের যা অবস্থা তা দিয়ে নবাবের গাড়িতে উঠাতো দূরস্থান, নবাবের পায়ের ধূলোও কিনতে পারবো না। ইঙ্গিতে বুঝালাম সঙ্গীদের আমার অবস্থা সঙিন।
আমরা মোটে তিনজন। সবাই হাঁটছি। হঠাৎ বৃষ্টির দেখা পেলাম। সবাই তো খুব অবাক। যদিও কিছুদিন ধরে বৃষ্টিকে কামনা করছিলাম। কিন্তু তাই বলে এখন পবিত্র হয়ে মসজিদে যাচ্ছি। এখন তো তার আসা উচিত হয়নি। মুখটা পাংশু করে পালানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু জানেনইতো আমার ভারী শরীর। এই নিয়ে পালানো সহজসাধ্য নয়।
বৃষ্টির অত্যাচারে বিশ মিনিট ধরে আটকে আছি। সঙ্গীদের একজনকে দেখলাম মোবাইল গুতাচ্ছে। বললো উবার কল করতেছি। আজকে গাড়িতে করে যাবো। আমি দরিদ্র মানুষ। গাড়ি টাড়ি দেখলে কী করতে গিয়ে কী করে ফেলি এই ভয়ে এসব উবার টুবারে কাছে ঘেঁষি না।
বললাম ভাই আমারে বেচলেও গাড়ি ভাড়া হবে না। বাদ দেন। সে আমার মতন ভীরু কিসিমের না। সাহসী মানুষ। বললো, আরে দেখেন না কারবার! দেখতে দেখতে বৃষ্টির মধ্যে একটি গাড়ি এসে হাজির। ঝটপট উঠে পড়লাম। আমাদের মত অনেকেই বৃষ্টির ভয়ে আড়াল হয়ে ছিল। গটাগট করে তিনজন গাড়িতে উঠতে দেখে মুখটা করুণ হয়ে গেলো অনেকের।
বেশ ভাব নিয়ে গাড়িতে উঠলাম। মানুষ দরিদ্র হলে কী হবে! ভাবের কমতি নেই। গাড়িতে উঠার পর বৃষ্টির তীব্রতা আরো বেড়ে গেলো। ভাব-সাব বাদ দিয়ে নাকটা গুঁজে দিলাম গাড়ির কাঁচে। আহা কী শান্তি বৃষ্টি যেন এসে পড়ছে আমার মুখে।
অপর সঙ্গীদ্বয় ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আমি ছবি-টবি ভালো তুলতে পারিনা। তাই ওসবে নাই আমি। আমি বৃষ্টি উপভোগ করছি গাড়িতে বসে। গাড়ি এগিয়ে চললো গুলিস্তান-বংশাল হয়ে তারা মসজিদ পানে।
বেশ উপভোগ করে এলাম। কিন্তু এখন গাড়ি ভাড়া দেয়ার সময় হয়েছে। আমি ভাবতেছি না জানি কত টাকা বিল এসেছে। দেখলাম আমার সঙ্গী মাত্র ৬০ টাকা দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে গেলো। আমি হা করে রইলাম!
সে বললো উবার ৭০% ডিসকাউন্ট দিয়েছে। তাইতো অভাবের দিনে গাড়িতে করে ঘুরে বেড়াই। মনে মনে খুশি হলাম। যাক এবার তাহলে বিদেশী বেনিয়া উবার ঠিকই দেশীয় স্বাধীন নবাবদের নবাবী ছুটিয়ে দিবে। বুঝলাম এমনই কোন কারণে হয়তো মুর্শিদাবাদের জনগণ সিরাজের পতন উপভোগ করেছিলো।
মসজিদে ঢুকেই প্রাণ জুড়িয়ে গেলো। কী সুন্দর উঠান। সবুজ ঘাসের কার্পেট বিছানো। সেখানে বড় করে একটি কংক্রিটের তারা অবস্থান করছে। লোকজন চাইলে সেখানে বসে বিশ্রামও করতে পারে। মসজিদের বাইরের চাইতেও ভিতরের কারুকাজ আমাকে বিমোহিত করেছে। খুব বড় মসজিদ নয়। তবে যত আগের মসজিদ তত আগে এই মসজিদই যে সবচেয়ে বিশাল স্থাপনা ছিল সেটা সহজেই অনুমেয়।
সাদা মার্বেলের গম্বুজের ওপর নীলরঙা তারায় খচিত এ মসজিদ নির্মিত হয় আঠারো শতকের প্রথম দিকে। মসজিদের গায়ে এর নির্মাণ-তারিখ খোদাই করা ছিল না। বিভিন্ন সুত্র থেকে ইতিহাসবিদেরা অনুমান করেন, আঠারো শতকে ঢাকার 'মহল্লা আলে আবু সাঈয়ীদ'-এ (পরে যার নাম আরমানিটোলা হয়) আসেন জমিদার মির্জা গোলাম পীর। যার আসল নাম মির্যা আহমদ জান। ঢাকার ধণাঢ্য ব্যক্তি মীর আবু সাঈয়ীদের নাতি ছিলেন তিনি। মির্জা গোলাম পীর এ মসজিদ নির্মাণ করেন। মির্জা সাহেবের মসজিদ হিসেবে এটি তখন বেশ পরিচিতি পায়। ১৮৬০ সালে মারা যান মির্জা গোলাম পীর। পরে ১৯২৬ সালে ঢাকার তৎকালীন স্থানীয় ব্যবসায়ী আলী জান বেপারী মসজিদটির সংস্কার করেন। সে সময় জাপানের রঙিন চিনি-টিকরি পদার্থ ব্যবহৃত হয় মসজিদটির মোজাইক কারুকাজে।
পুরাতন তারা মসজিদ বর্তমান তারা মসজিদের ন্যায় নকশালংকারে সমৃদ্ধ ছিল না। মসজিদের পিছনের ভগ্ন ও নগ্ন দেয়াল সেই সাক্ষ্য বহন করছে। এ মসজিদের দরজাগুলির মধ্যে দক্ষিণ দিকের তিনটি দরজাই প্রাচীন। ১৯২৬ সালে আলীজান ব্যাপারী বহু অর্থ ব্যয় করে মসজিদটির পূর্বপার্শ্বে বারান্দা সংযুক্ত করে মসজিদের আকৃতি বৃদ্ধি করেন। এতে কেবল প্রস্থের দিক বর্ধিত হয়। চারটি স্তম্ভ ও পাঁচটি খিলানে মসজিদের সম্মুখভাগ গঠিত হয় এবং প্রস্থে ৩.৯৯ মিটার সম্প্রসারিত করায় তারা মসজিদের প্রস্থ দাঁড়ায় একেবারে দ্বিগুণ অর্থাৎ ৭.৯৮ মিটার। এ সময়ের সম্প্রসারণে মসজিদের মূল ভূমিনকশায় কোনোরূপ পরিবর্তন আনা হয়নি। তবে বিভিন্ন নকশার রঙিন চকচকে টালির সংযোজন করা হয়।
১৯৮৭ সালে তিন গম্বুজের তারা মসজিদকে পাঁচ গম্বুজের মসজিদে রূপান্তর করা হলে মসজিদটি দৈর্ঘ্যে বৃদ্ধি পায়। অবশ্য প্রস্থে কোনোরূপ পরিবর্তন করা হয় নি। বর্তমানে সম্প্রসারিত মসজিদের দৈর্ঘ্য ২১.৩৪ মিটার এবং প্রস্থ ৭.৯৮ মিটার। পাঁচ গম্বুজের মসজিদে পরিবর্তন করার প্রয়োজনে একটি মিহরাব ভেঙ্গে ফেলা হয় এবং দুটি নতুন গম্বুজ ও তিনটি নতুন মিহরাব যুক্ত করা হয়। মসজিদে প্রবেশের জন্য পাঁচটি খিলানবিশিষ্ট পথ সৃষ্ট করা হয়েছে। এ খিলানগুলি বহু খাঁজবিশিষ্ট এবং চারটি অষ্টভুজাকৃতির স্তম্ভ হতে উত্থিত। মসজিদের অভ্যন্তরে ও বাইরে সম্পূর্ণরূপে মোজাইক নকশা করা।
মসজিদের গায়ে চিনামাটির প্লেট, পেয়ালা ইত্যাদির ছোট ভগ্নাংশ ও কাঁচের টুকরা ব্যবহূত হয়েছে। এ পদ্ধতিকে ‘চিনি টিকরী’বা চিনি দানার কাজ বলা হয়। ফুলদানি, ফুলের ঝাড়, গোলাপ ফুল, এক বৃন্তে একটি ফুল, চাঁদ, তারা, নক্ষত্র ও আরবি ক্যালিগ্রাফিক লিপি মসজিদের দেয়ালকে অসাধারণ সৌন্দর্যমন্ডিত করেছে। প্রায় বৃত্তাকার শ্বেত-শুভ্র গম্বুজগুলিতে বসানো হয়েছে নীল রঙের অসংখ্য তারা বা নক্ষত্র। সমগ্র নকশায় সর্বাধিক প্রাধান্য পেয়েছে তারার ‘মোটিফ’; তাই মসজিদটি তারা মসজিদ নামে খ্যাত।
জুমার নামাজ শেষ করে যখন বাড়ি ফিরছিলাম তখন বার বার ফিরে তাকিয়েছি। ছেড়ে যেতে একদম ইচ্ছে করছিলো না। তারা মসজিদ আমার মন কেড়েছে। আমি নিশ্চিত আপনাদেরও মন কাড়বে।
কীভাবে যাবেন?
ভ্রমণ বর্ণনা লিখলে একথা অবশ্যই লিখতে হয় সেখানে কীভাবে যেতে হবে? তবে এসব ধারণা পুরাতন হয়ে গেছে। এখন এগুলোর প্রয়োজন পড়ে না। আপনি গুগোল ম্যাপে যাবেন। তারা মসজিদ লিখে সার্চ করবেন। আপনাকে দেখিয়ে দিবে আপনার বাসা থেকে আপনি কীভাবে কোন রাস্তা দিয়ে সেখানে যাবেন। সুতরাং এসব কথা বলে লিখার দৈর্ঘ্য আর বাড়াতে চাই না।