কিছুদিন আগে প্রায় সাড়ে তিনশ বছরের পুরাতন একটি মসজিদে নামাজ পড়তে গিয়েছি। সাথের সঙ্গীরা পুরাতন সেই মসজিদের ছবি তুলতে ব্যস্ত। আমি ওর মধ্যে নেই। আর তাছাড়া আমি ভাল ছবিও তুলতে পারি না। আমি ইতিহাসের ছাত্র। তাই খুঁজতে গেলাম কীভাবে এই মসজিদটি স্থাপিত হলো? এর ইতিহাসই বা কী?
মসজিদটি হলো সাত গম্বুজ মসজিদ। মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডের কাছেই। আমি খুঁজতে লাগলাম কোন মুরব্বী শ্রেণির মানুষ পাই কিনা? পেয়েও গেলাম কয়েকজনকে। তাদের সাথে গল্প করতে লাগলাম এই ঐতিহাসিক মসজিদের ইতিহাস নিয়ে।
মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবরে কে না চিনে? তার মত ধার্মিক ও ক্ষমতাশালী সম্রাট মুঘলদের মধ্যে আর কেউ ছিল না। তার আমলেই মুঘলরা চট্টগ্রাম থেকে কাবুল পর্যন্ত সাম্রাজ্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল। ফতোয়ায়ে আলমগীরী সুন্নী হানাফী মাযহাবের একটি অসাধারণ সংকলিত আইনের বই।
আওরঙ্গজেব প্রায় ৫০০ আলেম নিয়োগ করেছেন এই ফতোয়ার বইকে সমৃদ্ধ ও নির্ভুল করার জন্য। উনি রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য এই বই থেকেই সাহায্য নিতেন।
আলমগীর/ আওরঙ্গজেব ক্ষমতা গ্রহণ করার সময় চট্টগ্রাম বাংলার সাথে ছিল না। এটা শাসন করতো আরাকনীরা। আবার সেখানে ছিল পর্তুগীজদের উৎপাত। এই দুই দস্যু প্রজাতির মানুষের শাসনের ফলে সেখানের মানুষরা অবর্ণনীয় জুলুমের মধ্যে ছিল।
দিল্লিতে মুঘল শাসকদের নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বের সুযোগে বাংলায়ও মুঘল শাসন শক্তিশালী ছিল না। তখন বাংলায় স্বাধীন নবাবদের উত্থান হয়। চট্টগ্রামের মানুষরা বিশেষত মুসলিমরা নবাবদের কাছে তাদের উদ্ধারের আহবান জানান। তারা আরাকানদের সাথে লড়ে ব্যর্থ হন। এই ব্যর্থতার মূল কারণ ছিল আরাকানীদের শক্তিশালী নৌবাহিনী। অন্যদিকে বাংলার শাসকরা নদীপথের যুদ্ধে পারদর্শী ছিলেন না।
যাই হোক বাংলার এহেন দুর্দশায় আওরঙ্গজেব সুবেদার হিসেবে থাকা মীর জুমলাকে প্রত্যাহার করে নেন। এবং সেখানে নতুন দায়িত্ব দেন মীর্যা আবু তালিবকে।
মীর্যা আবু তালিব তার মূল নাম হলেও তিনি এই নামে পরিচিত নন। তিনি পরিচিত তার উপাধি দিয়ে। তার উপাধি ছিল শায়েস্তা খাঁ। এই উপাধি তাকে দিয়েছিলেন সম্রাট শাহজাহান। তার এই উপাধি ছিল সরকারি কাজে তার নিষ্ঠা ও যুদ্ধের ময়দানে বীরত্বের জন্য। শায়েস্তা খাঁ ভালো শাসকের পাশাপাশি ছিলেন একজন ভালো মুসলিমও।
যাই হোক তিনি যখন ঢাকায় এসেছিলেন তখন ঢাকার মানুষ খুব খুশি হন। শায়েস্তা খাঁর নাম ডাক ইতিমধ্যে ঢাকায়ও প্রচার হয়েছিল। ঢাকার সবাই তার কাছে বিভিন্ন আবদার নিয়ে আসলো।
এমনি কিছু আবদার নিয়ে এলো মোহাম্মদপুরের মানুষরা। তখন তার নাম মোহাম্মদপুর ছিল না। বলতে গেলে এটা ছিল ঢাকার অনেক বাইরে। বুড়িগঙ্গা নদীর ওপারে। সেখানে বিশুদ্ধ পানি, নদী ভাঙ্গন থেকে রক্ষা ইত্যাদি দাবী নিয়ে এসেছিল তারা।
শায়েস্তা খাঁ এই বিষয়ে দায়িত্ব দিলেন তাঁর ছেলে উমেদ খাঁকে। উমেদ খাঁ এসে দেখলেন এখানে মুসলিম নেই বললেই চলে। মাত্র চারটি পরিবার। উমেদ খাঁ তাদের প্রয়োজনমত এবং রাজ্যের সাধ্যমত সমস্যাগুলোর সমাধান করলেন।
তারপর তিনি মুসলিমদের বললেন তিনি এখানে একটি মসজিদ করতে চান। মুসলিমরা বললো এখানে তো মুসলিম খুব বেশি নেই। আমরা মাত্র চার পরিবার।
তখন তিনি বললেন এখানে একটি দৃষ্টিনন্দন মসজিদ হবে। এই মসজিদ থেকেই এই এলাকার প্রশাসনিক কার্যক্রম হবে। বিচার সালিশ হবে। এখানে ধ্বনিত হবে পাঁচবার আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্বের মহিমা। এখানকার মানুষ এই মসজিদের প্রভাবে মুসলিম হয়ে যাবে।
সেসময়ের মুসলিমরা বুঝতে পারেনি। কিন্তু উমেদ খাঁ ঠিকই বুঝতে পেরেছেন। মাত্র বিশজন মুসলিমের জন্য তিনি বানিয়েছেন ২০০ মুসল্লি ধারণ ক্ষমতার এই সাত গম্বুজ মসজিদ। মুসলিমরা তো অবাক। এতবড় মসজিদ দিয়ে তারা কী করবে? উমেদ খাঁ বললেন, তোমরা যদি ন্যায়নিষ্ঠ হও আর তোমাদের মধ্যে যদি সাহাবাদের চরিত্র থাকে তবে তোমরা দেখবে এই এলাকায় এত মুসল্লি হবে যে, তোমরা মসজিদে জায়গা দিতে পারবে না।
উমেদ খাঁ এই এলাকার নাম রাখলেন মোহাম্মদপুর। সত্যিই সেদিনের সেই অল্প কয়জন মুসলিমের প্রভাবে ও সুবেদার শায়েস্তা খাঁর ন্যায় বিচারে পাল্টে গেলো মোহাম্মদপুরের চিত্র।
আমি উমেদ খাঁর নাম সেদিনই মোহাম্মদপুরের মুরুব্বীদের কাছ থেকে শুনলাম। বাসায় এসে তাঁকে নিয়ে পড়তে বসলাম। অবাক হলাম। আসলেই তিনি ছিলেন দাওয়াতী চরিত্রের মানুষ।
শুধু মোহাম্মদপুর নয় পুরো বাংলায় বহু স্থানে তিনি তাঁর মিশনারি কার্যক্রমের স্বাক্ষর রেখেছেন। সেসময়ে মানুষ তাকে বলতো বুজুর্গ উমেদ খাঁ।
চট্টগ্রামের মুসলিমদের উদ্ধারে শায়েস্তা খাঁ তাঁর ছেলে উমেদ খাঁকেই পাঠিয়েছেন। তিনি শক্তিশালী আরাকানীদের পরাজিত করেন শুধু অস্ত্রের জোরে নয়। বুদ্ধি, কূটনীতি, উদারতা সবকিছু দিয়েই তিনি চট্টগ্রাম জয় করেন।
চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক আন্দরকিল্লা শাহী মসজিদ তাঁর তৈরী। এটাকে আগে পর্তুগিজরা ও আরাকানীরা যুদ্ধের দূর্গ হিসেবে ব্যবহার করতো। আওরঙ্গজেবের নির্দেশে কিল্লাতেই মসজিদ নির্মাণ করেন উমেদ খাঁ।
এই মসজিদ থেকেই চট্টগ্রামে ইসলামের প্রচার প্রশাসনিকভাবে শুরু হয়। এখানে উমেদ খাঁ মসজিদ, সরাইখানা, বিশ্রামাগার, লাইব্রেরি, গবেষণাগার ইত্যাদি তৈরী করেন। পাশাপাশি এই মসজিদ চট্টগ্রামের নিরাপত্তার জন্য দূর্গ হিসেবেও ব্যবহার হয়।
ইংরেজরা এই দূর্গ দখল করতে অনেক বেগ পেতে হয়। তাই তারা আন্দরকিল্লা শাহী মসজিদ দখল করেই নামাজ পড়া বন্ধ করে দেয়। এখানে তারা অস্ত্রের গোডাউন হিসেবে ব্যবহার করে। পরে ১৮৮৫ সালে সালে তা আবার মুসলিমরা উদ্ধার করে নামাজ পড়া শুরু করে।
উমেদ খাঁ সম্পর্কে আরেকটি কাহিনী আমি জানতে পেরেছি। উমেদ খাঁ চট্টগ্রাম অধিকার করার পর হিঁদু জমিদার শ্যাম রায় তাঁর আনুগত্য স্বীকার করে। শ্যাম রায় তার সাথে পর্তুগীজদের বিরুদ্ধে লড়াই করে।
সেসময় উমেদ খাঁ শ্যাম রায়ের বুদ্ধিমত্তা ও সাহসের পরিচয় পান। তিনি তার সাথে বন্ধুত্বপূর্ন সম্পর্ক সৃষ্টি করেন এবং ইসলামের দাওয়াত দেন। শ্যাম রায় প্রথমে অস্বীকার করে। হাল না ছেড়ে এবং ক্ষুব্দ না হয়ে ধীরে ধীরে ইসলামের সৌন্দর্য তুলে ধরেন উমেদ খাঁ।
একপর্যায়ে উমেদ খাঁ জয়ী হন। শ্যাম রায়ের মন বিগলিত হয়। তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। উমেদ খাঁ অত্যন্ত খুশি হন এতে। তিনি শ্যাম রায়ের কাছে তার বোন বিয়ে দেয়ার প্রস্তাব নিয়ে যান পিতা শায়েস্তা খাঁয়ের কাছে। শায়েস্তা খাঁ রাজি হন।
দেওয়ান মনোহরের (শ্যাম রায়) সাথে চট্টগ্রামের একটি বৃহত হিঁদু সমাজ ইসলামে ছায়াতলে এসে পড়েন। সেই থেকে চট্টগ্রাম ইসলামী ভাবধারার শহরে পরিণত হয়। আওরঙ্গজেবের পরামর্শে উমেদ খাঁ চট্টগ্রামের নাম রাখেন ইসলামাবাদ।
আফসোস হয়, সেসময়ের মুসলিম ও মুসলিম নেতারা ছিলেন মিশনারি চরিত্রের। তাঁরা কাফির-মুশরিকদের মুসলিম বানাতেন। আর এখনকার মুসলিমদের মধ্যে সেই বিখ্যাত হয় যে ফিরকাবাজ ও ফিতনাবাজ। আমাদের দেশে এখন সেই বড় মুসলিম নেতা যে কথায় কথায় মুসলিমদের কাফির-মুশরিক বানায়।
আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করুন।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন