১১ জুন, ২০১৮

একটি গালি ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা



কিছুদিন আগে কাঁটাবন মোড়ে দেখলাম এক রিকশায় সাথে অন্য রিকশার ধাক্কা লাগলো। অমনি একজন রিকশাচালক চিৎকার করে উঠলো ওই ব্যাটা রোহিঙ্গা দেখে চালাইতে পারিস না?

মিরপুরে একটা ছোট হোটেলে খেতে বসেছিলাম। তখন এক ওয়েটার আরেক ওয়েটারের সাথে কী একটা বিষয় নিয়ে ঝগড়ায় লিপ্ত হলো। খানিক পরেই একজন আরেকজনকে রোহিঙ্গা বলে গালি দিতে লাগলো। এভাবে অনেক ঘটনার সাক্ষী হয়েছি ঢাকায়।

আপনারা খেয়াল করেছেন কিনা জানিনা। তবে আমি ঢাকায় বেশ কয়েকটি স্থানে দেখেছি এবং শুনেছি একটি গালি ভাইরাল হতে। আর সেটা হলো 'রোহিঙ্গা'। একজন অপরজনকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য রোহিঙ্গা বলছে। তবে এই গালিটা শিক্ষিত শ্রেণীর মানুষের মধ্যে নয়। এটা চালু হয়েছে অশিক্ষিত এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে।

রোহিঙ্গা ইস্যুতে একটু পরে আসছি। তার আগে অন্যদিক দিক থেকে ঘুরে আসি।

আমার জন্মসুূত্র পৃথিবীর অন্যান্য স্থানের সাথে যুক্ত থাকলেও আমার জন্ম ও বেড়ে উঠা হয় বাংলাদেশের নোয়াখালী জেলায়। এই কারণে নোয়াখালীর প্রতি সহজাত ভালোবাসা সবসময়ই কাজ করে। নিজেকে নোয়াখাইল্যা পরিচয় দেই এবং নোয়াখালীর ভাষায় কথা বলতে সাচ্ছন্দ্য বোধ করি।

এখন থেকে প্রায় একযুগ আগে আমি নোয়াখালী ছেড়ে অন্যান্য স্থানে বসবাস করা শুরু করি। সেসব স্থানে চলতে গিয়ে আমার যে জিনিসটা জানা হয় তা হলো নোয়াখাইল্যা একটি গালির নাম। খারাপ মানুষদের নোয়াখাইল্যা বলা হয়। এবং নোয়াখালীর মানুষ খারাপ হয়। তাদের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করা ঠিক নয়।

আমার ক্ষেত্রেও এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে। আমি কোথায় নতুন পরিচিত হচ্ছি, যখনই বললাম বাড়ি নোয়াখালী অমনি নাক সিঁটকে বললো, ও নোয়াখালী! আমি বেশ কষ্ট পেতাম। এখন অবশ্য পাই না। অভ্যাস হয়ে গিয়েছে।

আবার অন্য অভিজ্ঞতাও হয়েছে। যেমন একজন মানুষের কিছুদিন চলার পর যখন সে জানতে পারলো বাড়ি নোয়াখালীতে তখন সে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো, আপনার বাড়ি নোয়াখালী? আমি তো নোয়াখালী সম্পর্কে ভিন্ন ধারণা পোষণ করি। কিন্তু আপনি তো সেরকম না।

যাই হোক, আমি সেই থেকেই এর কারণ অনুসন্ধান করতে থাকি। কেন এরা খারাপ? 
আমি নোয়াখালীর এবং নোয়াখালীর বাইরে অনেকের সাথে আলোচনা করেছি। যে বিষয়গুলো উঠে এসেছে। 
১- নোয়াখালীর মানুষগুলো বেশি বুদ্ধিমান। তারা তাদের বুদ্ধি দিয়ে সবাইকে ঠকায়। 
২- তারা একতাবদ্ধ থাকে। নোয়াখালীর বাইরের মানুষকে তারা সবসময় প্রতিরোধ করে। এককথায় সিন্ডিকেট করে চলে। 
৩- নোয়াখালীর মানুষ প্রতারক, খারাপ ও নিচু মানসিকতার লোক হয়ে থাকে। 
৪- এরা নিজেদের বেশি জ্ঞানী মনে করে এবং ধরাকে সরা জ্ঞান করে। সবকিছু দখল করার মানসিকতা থাকে। 
৫- এদের মধ্যে স্বজনপ্রীতির মানসিকতা খুব বেশি।

যিনি এই বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে যে পয়েন্টে কথা বলেছেন তাকে আমি দেখিয়ে দিয়েছি এই রকম বৈশিষ্ট্যধারী মানুষ সব জেলায় সম্ভব। তাহলে নোয়াখালী কেন খারাপ হবে? নোয়াখালীতে যেমন খারাপ মানুষ আছে তেমনি বাংলাদেশের সব অঞ্চলে খারাপ মানুষ আছে।

এই বিষয় নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখলাম অপরাধপ্রবণ এলাকা বলে একটা ব্যাপার আছে। বাংলাদেশে কোন জেলায় কোন অপরাধ বেশি হয় তার পরিসংখ্যান তৈরি করা হয়। সেই অপরাধপ্রবণ এলাকার কোন তালিকায় কোন ক্যাটাগরিতে নোয়াখালীর নাম নেই। তাহলে নোয়াখালীতে খারাপ মানুষ বেশি অথবা অপরাধপ্রবণ মানুষ বেশি এই ধারণাও ধোপে টিকছে না।

নোয়াখালীর মানুষ কেন খারাপ এই বিষয়ে আমাকে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ও যুক্তিযুক্ত উত্তর দিয়েছেন দিনাজপুরের একজন পৌর মেয়র।

দেশ ঘুরার অংশ হিসেবে একবার গিয়েছিলাম দিনাজপুরে। সেখানে যার আথিতেয়তা গ্রহণ করেছিলাম তিনি আবার ঐ পৌর মেয়রের পরিচিত। আমরা সফরকারীরা সেই মেয়রের বাড়িতে গেলাম।

দিনাজপুরের পৌর মেয়র আমাদের মতন না। আমাদের পৌর মেয়রকে তো জনসাধারণের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় না। তারা অনেকটা মন্ত্রী-এমপিদের মতো। গাড়ির কাঁচের আড়ালে তাদের দেখতে হয়।

সেই পৌর মেয়রকে দেখলাম একেবারেই সাধাসিধে। মূল বাড়ির সামনে টিনের তৈরী একটি কাচারি ঘর আছে। তিনি সেখানেই সবার সাথে দেখা করেন। একটি লুঙ্গি ও সাদা পাঞ্জাবি পরা সাদাসিদে চলন।

পরিচিত হতে গিয়ে যখন জানালাম আমার বাড়ি নোয়াখালী তখন তিনি আগ্রহ প্রকাশ করে আরো ডিটেইল ঠিকানা জানতে চাইলেন। তারপর বললেন সেই ছোটবেলায় যে নোয়াখালী থেকে চলে এলাম আর যাওয়া হয়নি। সবাই যথারীতি অবাক। বিশেষ করে অবাক আমাদের সাথে থাকা দিনাজপুরের মানুষগুলো।

গত শতাব্দীতে উপকূলীয় এলাকা বলতে নোয়াখালীকেই বুঝানো হতো। জানেনই তো, নোয়াখালীর ইন্টারসিটি ট্রেনের নাম 'উপকূল এক্সপ্রেস'। সেই উপকূলীয় অঞ্চলে সবসময়ই প্রাকৃতিক দুর্যোগ লেগে থাকতো। বন্যা, জলোচ্ছাস, নদীভাঙ্গন, ঘুর্নিঝড় ইত্যাদি নোয়াখালীকে নিয়মিত আক্রমণ করতো। বিশেষ করে নদীভাঙ্গনের কবলে পড়ে মানুষ নোয়াখালী ছেড়ে বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়তে থাকে।

মেয়রের ক্ষেত্রেও সেই ঘটনাই ঘটেছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে নদীভাঙ্গন চরম আকার ধারণ করে। একপর্যায়ে নোয়াখালী শহর পুরোটাই নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। সেই থেকে নোয়াখালীর মানুষ রোহিঙ্গা স্রোতের মত পুরো দেশে ছড়িয়ে পড়ে।

নোয়াখালীর মানুষ যখন বিভিন্ন জেলায় অনুপ্রবেশ করে তখন সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয় ঐসব অঞ্চলের শ্রমজীবী ও নিন্ম আয়ের মানুষ। তাদের আয়-রোজগারে ভাগ বসায় নোয়াখালীর মানুষ। সেই থেকে নোয়াখালী ধীরে ধীরে একটি গালিতে ও ঘৃণাবাচক শব্দ হিসেবে পরিচিত হতে থাকে।

এর মধ্যে যে ব্যক্তি নোয়াখালীর কোন খারাপ মানুষের সাথে পরিচিত হয় তখন তার বিশ্বাস আরো দৃঢ় হয়। নোয়াখালীর ব্যাপারে সে আরো সতর্ক ও সমালোচনা মুখর হয়। নোয়াখালীর সেই অবস্থানটা এখন নতুন করে নিতে যাচ্ছে রোহিঙ্গারা।

আমরা যারা সচেতন আছি আমাদের উচিত হবে নতুন কোন জাতিবিদ্বেষ তৈরী না করা। কাউকে রোহিঙ্গা বলে গালি দিতে দেখলে তাদের সাবধান ও সতর্ক করে দেব। বুঝিয়ে বলবো এই ধরণের আচরণ সঠিক নয়। রোহিঙ্গাদের দুর্দশার কথা চিন্তা করে বাংলাদেশে তাদের প্রতি যাতে কোন বিদ্বেষ সৃষ্টি না হয় সেই ব্যাপারে সতর্ক থাকবো।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন