১৭ জুল, ২০১৮

ঢাকার সবচেয়ে পুরনো মসজিদের ছোঁয়া


এই যে মসজিদের শহর ঢাকা, বলতে পারবেন কোন মসজিদটি ঢাকা শহরের প্রথম মসজিদ?

একটু ভড়কে যাওয়ার মতই প্রশ্ন। আসলে এই ইতিহাস কোথাও লিখিত নেই। প্রথমে ঢাকার কোথায় মসজিদ স্থাপিত হয়েছে এটা আসলেই জানা যায় না। তবে বর্তমানে ঢাকার মসজিদ্গুলোর মধ্যে কোনটি সবচেয়ে পুরনো তা বলা যায়। এক অর্থে এটাই এখন ঢাকার ১ম মসজিদ।

রাতেই ঠিক করে ফেললাম বিনত বিবির মসজিদে যাবো। গুগল ম্যাপ দেখে বুঝে নিলাম কত সময় লাগতে পারে।

জুমার নামাজের বেশ আগেই আমরা তিনজন রওনা হলাম পুরান ঢাকার নারিন্দায়। যেখানে আছে ঢাকার সবচেয়ে প্রাচীন মসজিদ বিনতে বিবির মসজিদ।

সায়েদাবাদ পর্যন্ত বাসে করে গেলাম। এরপর রিকশা নিয়ে রওনা হলাম। রিকশাওয়ালা মামাকে বললাম, চিনেন কিনা? তিনি বেশ আত্মবিশ্বাসের সাথে জানান দিলেন, অবশ্যই চিনেন।

বেশ, তাহলে তো আর চিন্তা নেই! তবে নিত্যদিনের সঙ্গী গুগল ম্যাপ তো সাথে আছেই। মাথার উপর ভীষণ রোদ। চোখটা ভালো করে খুলে তাকাতে পর্যন্ত পারছি না। এমন সময় একজন বলতে লাগলো সেলফি তুলবে। রিকশায় নাকি তিনজনের সেলফি ভালো উঠে।

ভীষণ রোদে সেলফি তুলতে গিয়ে পড়লাম বেকায়দায়। ভালো করে হাসি মুখে ছবি তোলা যাচ্ছে না। রোদের তীব্রতায় কপাল কুঁচকে আছে। এমতাবস্তায় হাসতে গিয়ে আমার চেহারার যে দশা তা নিতান্তই দুর্দশা।

যাই হোক রিকশাওয়ালা একটা মসজিদের সামনে আমাদের নামিয়ে দিলো। গুগোল ম্যাপে তখনো দুই মিনিটের রাস্তা বাকী। জিজ্ঞাসা করলাম এটাইতো সেই মসজিদ? সে বললো, হু এটা তো সেটাই।

বেশ ভালো মসজিদে ঢুকে পড়লাম। কিছুটা পুরাতন ছাপ আছেই। ভিতরে তিনটা কবরও আছে। অবাক হতে শুরু করলাম। অনলাইনে যা পড়ে এসেছি এবং যেসব ছবি দেখেছি তার সাথে তো মিল পাচ্ছি না।

ইতিমধ্যে আমাদের এক সঙ্গী কাতচিৎ হয়ে ছবি তোলা শুরু করেছে। গুগোল ম্যাপ অনুসারেও এটা সেই স্থান নয়। বেকায়দায় পড়ে গেলাম। একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম এটা কি বিনত বিবির মসজিদ? তিনি বললেন না, এটা পীরসাব বাড়ির মসজিদ, একটু সামনে হেঁটে গেলেই সেই মসজিদ।

রিকশাওয়ালার উপর প্রচন্ড বিরক্তি প্রকাশ করে হাঁটা শুরু করলাম। যে সঙ্গীটা এতক্ষণ বহু কসরত করে বহু ছবি তুলেছিলো সে রাগে গজরাতে গজরাতে শালীন কিছু গালি দিচ্ছে আর ছবি ডিলেট করছে।

আমরা অল্প কিছুক্ষণ হেঁটেই পেয়ে গেলাম বিনত বিবির মসজিদ। ভাবা যায়, প্রায় সাড়ে পাঁচশত বছর আগের মানুষের স্মৃতি। তাদের স্পর্শ পেতে যাচ্ছি। ভাবছি আর শিউরে উঠছি। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি ব্যবসায়ী আরাকান আলীর। আল্লাহ তাকে উত্তম প্রতিদান দান করুন।

ঢাকায় প্রাপ্ত শিলালিপিসমূহের মধ্যে বিনত বিবির মসজিদের শিলালিপিটিই ছিল প্রথম মুসলিম শিলালিপি। শিলালিপিটি মূল মসজিদের প্রধান প্রবেশ পথে লাগানো ছিল, কিন্তু বর্তমানে এটা উত্তর দিক থেকে দ্বিতীয় প্রবেশ পথের মাথায় রয়েছে। ঢাকায় এটিই একমাত্র মসজিদ, যার নাম রাখা হয়েছে একজন নারীর নামে।

মসজিদের দেয়ালে স্থাপিত একটি কালো পাথরে ফারসি ভাষায় লিখিত বর্ণনায় রয়েছে, সে-সময় পারস্য উপসাগরের আশেপাশের এলাকা থেকে লোকজন জলপথে এ অঞ্চলে বাণিজ্যে আসতেন। পুরান ঢাকার এই নারিন্দা-ধোলাইখাল এলাকা দিয়ে তখন বয়ে যেত বুড়িগঙ্গার একটি শাখা, যা বুড়িগঙ্গা হয়ে শীতলক্ষ্যায় গিয়ে মিশেছিল। আরাকান আলী নামক এক সওদাগর সে সময় এ এলাকায় বাণিজ্যের জন্য আসেন এবং এখানে বসবাস শুরু করেন। তিনিই নামাজ পড়ার সুবিধার্থে এখানে মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন। এখানে বসবাসকালীন আরাকান আলীর মেয়ে বিনত বিবির আকস্মিক মৃত্যু হয়।

মসজিদের পাশেই সমাধিস্থ করা হয় এবং মেয়ের মৃত্যুর শোকে ছয় মাস পর আরাকান আলীর মৃত্যু ঘটলে তাকেও এখানেই কবর দেয়া হয়। পরবর্তীতে বিনত বিবির নামে মসজিদটির নামকরণ করা হয়। বর্তমানে চারপাশে ঘিঞ্জি দোকান-পাট আর অনেক দোকানের মাঝেই একটি দোকানের মতো জায়গা নিয়ে পড়ে আছে আরকান আলি ও তার মেয়ের খুব সাধারণভাবে পাশাপাশি দুটি কবর। কবরের উপরটা চাদরে মোড়ানো।

সুলতানি আমলে সাধারণভাবে আরবি শিলালিপি পাওয়া গেলেও এখানে আরবির সঙ্গে ফার্সি লিপিরও ব্যবহার লক্ষণীয়। মসজিদটির প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, এর আককোণবিশিষ্ট পার্শ্ব স্তম্ভ, বর্গাকার কক্ষের ওপর অর্ধ বৃত্তাকার গম্বুজ, উত্তর, দক্ষিণ ও পূর্বদিকে খিলানের ব্যবহার, সাদামাটা অলঙ্করণ, প্লাস্টারে ঢাকা, বাঁকানো কার্নিশ প্রভৃতি।

ছয়-সাত কাঠা জায়গায় গড়ে ওঠা মূল মসজিদটি বর্গাকৃতির এবং এক গম্বুজবিশিষ্ট। এর ভেতরভাগের পরিমাপ প্রতিদিকে ৩.৬৬ মিটার। মসজিদটির ছাদ গোলাকার গম্বুজ দ্বারা আচ্ছাদিত এবং গম্বুজটি সরাসরি ছাদে স্থাপিত। মসজিদের দেওয়ালগুলি ১.৮৩ মিটার পুরু। এর পূর্ব, উত্তর ও দক্ষিণ দিকে একটি করে মোট তিনটি প্রবেশপথ আছে। পশ্চিম দেওয়ালের পেছনের দিকে একমাত্র মিহরাবটি এখন অব্যবহৃত।

মসজিদের দুটো গম্বুজের একটির গায়ে আদি ভবন প্রতিষ্ঠার সাল ৮৬১ হিজরি (১৪৫৭ খ্রি:) লেখা আছে। আরেকটি গম্বুজের লেখা অনুযায়ী ভবনটি প্রথম সংস্কারের মুখ দেখে ১৩৩৭ বঙ্গাব্দে (১৯৩০ খ্রি:)।

২০০৬ সালে মসজিদের পুরান ভবনটি ভেঙে নতুন করে আবার নির্মাণের জন্য কাজে হাত দেয় পরিচালনা কমিটি। সে সময় মসজিদের প্রায় সব অংশই ভেঙে ফেলা হয়। তবে এলাকাবাসীর প্রতিরোধে মসজিদের বারান্দাটুকু বেঁচে যায়। ফলে রয়ে যায়, ঢাকার প্রথম মসজিদের এক টুকরো স্মৃতি।

ঢাকায় মুসলিমদের অবস্থার উন্নতি মূলত মুঘল সেনাপতি ইসলাম খানের ঢাকা আগমনের পর থেকে। তখন থেকেই মূলত ঢাকা ইসলামের শহরে পরিণত হয়। বিনত বিবির মসজিদ ইসলাম খানের ঢাকা আগমনেরও প্রায় ১৫০ বছর আগে তৈরি হয়েছে। তখন বাংলার স্বাধীন সুলতান নাসির উদ্দিন মাহমুদ শাহের আমল চলছিলো।

তখন ঢাকায় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ না হলেও সারা পৃথিবীজুড়ে মুসলিমদের রাজত্ব ছিল। দিল্লিতে রাজত্ব করছিলেন লোদী রাজবংশের বাহলুল খান লোদী। আর পৃথিবী চালাচ্ছিলেন মুসলিমদের ইতিহাসে খ্যতিমান বীর সুলতান ফাতিহ মুহাম্মদ যিনি মাত্র ২১ বছর বয়সে কনস্টান্টিনোপল জয় করেন।

ইতিহাসের ছোঁয়া নিয়ে বের হয়েছি মসজিদ থেকে। কিন্তু তখনো রোদের তেজ কমেনি। একটু হেঁটে মোড়ে আসতেই দেখি লাচ্ছি বিক্রি হচ্ছে। পুরান ঢাকার নামকরা লাচ্ছি। গলায় ঢেলে দিলাম সেই ঠাণ্ডা লাচ্ছি। আহ শান্তি। ইতিহাস ও লাচ্ছি একসাথেই খেলাম।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন