দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদক হিলাল-ই-জুররাত প্রাপ্ত জিয়াউর রহমান |
বীরের জাতি হসেবে বাঙালিদের খুব একটা নাম ডাক নেই। ইতিহাসে কোন বাঙালি দিগ্বিজয়ী বীরতো দূরের কথা আশপাশের এলাকা জয় করেছে বা নিজের এলাকা নিজেরা শাসন করেছে এমন নজিরও নাই বললেই চলে।
বীরের এই খরার মধ্যে কিছু বীরের কথা আজ বলতে চাই। ঘটনাটা ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময়কার। সেসময় বাঙালি কিছু বীর অসম সাহসীকতা প্রদর্শন করে।
৬ সেপ্টেম্বর মার্কিন পরামর্শে ভারত হঠাৎ করেই করাচি আক্রমণ করে বসে। এ সময় বাঙ্গালি সেনাদের প্রচন্ড আক্রমণের মুখে লাহোরের উপকণ্ঠে এসে থেমে যায় ভারতীয় বাহিনীর অগ্রযাত্রা। লাহোর প্রতিরক্ষার সেই যুদ্ধ ছিল আধুনিক যুগে বাঙ্গালি সেনাদের অংশ নেওয়া প্রথম সক্রিয় ও সর্বাত্মক যুদ্ধ।
১৯৬৫ সালে পাকিস্তানের ৮ টি ডিভিশনের মধ্যে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট মাত্র ৪ টি ব্যাটেলিয়নের মাধ্যমে সংগঠিত ছিল। এর অধিনায়ক ছিলেন লে. কর্নেল আতিক হক। মাত্র এই ৪ টি ব্যাটেলিয়ন নিয়ে তিনি যুদ্ধে অসম দক্ষতা দেখান।
সে যুদ্ধে পরবর্তীতে বাংলাদেশের ইতিহাসে স্থান পাওয়া প্রায় প্রত্যেক সমরনায়কই কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানী, জিয়াউর রহমান, খালেদ মোশাররফ, আবু তাহের, আবুল মনজুরসহ প্রত্যেকেই বীরত্ব দেখান।
জিয়াউর রহমান ৪৬৬ জন সৈন্যের একটি বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন। সেই বাহিনীই প্রথম ভারতীয় বাহিনীর সামনে পড়ে। তাজুল ইসলাম নামে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন এনসিও নিজের বুকে মাইন বেঁধে আগুয়ান ভারতীয় ট্যাংক বহরের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মাহুতি দেন। জিয়াউর রহমান পাকিস্তানের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সামরিক পদক হিলাল-ই-জুররাত লাভ করেন। জিয়ার ইউনিট তিনটি তৃতীয় সর্বোচ্চ সামরিক পদক সিতারা-ই-জুররাত ও নয়টি চতুর্থ সর্বোচ্চ সামরিক পদক তমঘা-ই-জুররাত অর্জন করে।
মোহাম্মদ মাহমুদুল আলম, যিনি একাই নয়টি ভারতীয় বিমান ভূপাতিত করেছেন |
স্থলবাহিনীর পাশাপাশি বিমানবাহিনীতে কর্মরত সেনারাও ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে কৃতিত্ব দেখান। বাঙ্গালি বৈমানিক মোহাম্মদ মাহমুদুল আলমের নাম এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি আলোচিত। একটি দুর্বল এফ-৮৬ স্যাবর জঙ্গিবিমান দিয়ে ভারতের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে প্রথম মিনিটেই পাঁচটি ভারতীয় হকার হান্টার বিমান ভূপাতিত করে বিমানযুদ্ধের ইতিহাসে সর্বকালের সেরা রেকর্ড গড়েন। যার মধ্যে প্রথম চারটি ভূপাতিত করেন মাত্র ৪০ সেকেন্ডের মধ্যে। এটি আজ পর্যন্ত একটি বিশ্বরেকর্ড। পুরো যুদ্ধে তিনি মোট নয়টি ভারতীয় জঙ্গিবিমান ভূপাতিত করেন। তিনি ৩য় সর্বোচ্চ পদক সিতারা-ই-জুররাত লাভ করেন।
১৯৭১ সালে অন্যান্য বাঙালি অফিসারের মতো তিনি গ্রাউন্ডেড ছিলেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে তিনি ঢাকা থেকে তার পরিবার পরিজন নিয়ে স্থায়ীভাবে পাকিস্তানে বসবাস শুরু করেন। পাকিস্তানে এখনো তিনি একজন জাতীয় বীর হিসেবেই পরিগণিত। ২০১৪ সালে তার নামে পাঞ্জাবের মিয়ানওয়ালী বিমানঘাঁটির নামকরণ করা হয়েছে ‘পিএএফ বেস এম এম আলম’। তিনি ২০১৩ সালে ইন্তেকাল করেন। লাহোরের একটি প্রধান সড়কের নামও এম এম আলম রোড। ঢাকা মিউনিসিপালটি করপোরেশন ৬৫’র যুদ্ধের পর তাকে ঢাকায় একটি বাড়ি উপহার দেয়। তার এই সাঁড়াশি আক্রমনই মূলত যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।
কিংবদন্তি সাইফুল আজম, যিনি ইসরাঈলী বিমান ধ্বংসে রেকর্ডধারী |
আরেক বাঙ্গালি বৈমানিক সাইফুল আজমও বীরত্বের সাথে ভারতীয় বিমানবাহিনীর সাথে ডগফাইট করে একটি জঙ্গিবিমান ভূপাতিত করেন। শুধু তাই নয় ভারতীয় বিমানের বৈমানিক মায়াদেবকে তিনি জীবন্ত গ্রেপ্তার করেন। পৃথিবীর ইতিহাসে তিনি একজন সেরা যোদ্ধা। ভারতের সাথে যুদ্ধের পর সাইফুল আজম ১৯৬৭ সালে আরব-ইসরাইল যুদ্ধেও অংশ নেন।
সেখানেও তিনি ইসরাইলি বিমানবাহিনীর ত্রাসে পরিণত হন। তিনি যতগুলো ইসরাইলি বিমান ভূপাতিত করেন তা আজও রেকর্ড হয়ে আছে। আজ পর্যন্ত অন্য কেউ একা এতগুলো ইসরাইলি বিমান ধ্বংস করতে পারেনি। সাইফুল আজম বিশ্বের ২২ জন লিভিং ঈগলের একজন বলে বিবেচিত। তিনিও ৩য় সর্বোচ্চ পদক সিতারা-ই-জুররাত লাভ করেন।
এই যুদ্ধে ভালো অবদান রাখে পাকিস্তানী বৈমানিকেরা। তারা প্রায় ৭০টি ভারতীয় যুদ্ধবিমান উড়িয়ে দেন বিনিময়ে হারিয়েছেন ১৫টি যুদ্ধবিমান। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনিও গ্রাউন্ডেড ছিলেন। পরবর্তিতে মুজিবের আমলে বাংলাদেশে আসেন এবং বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে যোগ দেন। তিনি পাবনা-৩ আসন থেকে বিএনপি'র সংসদ সদস্য ছিলেন।
রাজশাহীর সরফরাজ আহমেদ রফিকী ভারতীয় বিমান বাহিনীকে তাড়া করতে করতে ভারতে পাঠিয়ে দেন কয়েকবার। এরপর সাহসীকতার সাথে ভারতীয় বিমান ঘাঁটিতে আক্রমন শুরু করেন। কিন্তু তিনি আর ফিরতে পারেন নি। ভারতেই শাহদাত বরণ করেন। তিনি হিলাল-ই-জুররাত লাভ করেন। এছাড়া পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় বিমানঘাঁটি, করাচির একটি প্রধান রাস্তা ও একটি পেশোয়ারের একটি কলেজ তার নামে করা হয়।
১৯৬৫ সালের যুদ্ধে অংশ নেওয়া বেশিরভাগ বাঙ্গালি অফিসারই বীরত্বের জন্য পদক/পদোন্নতি লাভ করেন। যারা পদক লাভ করেন এর মধ্যে শুধুমাত্র জিয়াউর রহমানই নিজ বাহিনীর সাথে গাদ্দারী করে ১৯৭১ সালে মুশরিকদের সাথে হাত মেলান। পরবর্তিতে অবশ্য প্রায়শ্চিত্য করার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু সফল হননি।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন