২৫ মার্চ, ২০১৯

গোলান মালভূমি হাতছাড়া হওয়ার ৫২ বছর

গোলানের অপরূপ দৃশ্য
সম্ভবত কয়েক ঘন্টা পর গোলান মালভূমিকে ইসরাঈলের বলে স্বীকৃতি দিবে যুক্তরাষ্ট্র। এটা একটা অফিসিয়াল স্বীকৃতি মাত্র। তবে শুরু থেকেই গোলান মালভূমি ইসরাঈলকে দেয়ার ব্যাপারে কাজ করে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। 

গোলান মালভূমি এক হাজার ৮০০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের একটি মালভূমি (Heights) যা সিরিয়ার গোলান পর্বতমালার অংশ। ইসরাইলের উত্তর প্রান্তে অবস্থিত সিরিয়ার এই অঞ্চলটির প্রায় এক হাজার ২০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা ১৯৬৭ সালের আরব ইসরাইলি যুদ্ধে ইসরাইল দখল করে নেয়। তখন থেকেই এই অঞ্চলটিকে অবৈধভাবে এবং জোর করে দখল করে আছে।

দখলের পর থেকেই গোলান মালভূমিতে ইসরাইলে বড় ধরনের সামরিক উপস্থিতি বজায় রেখেছে। মালভূমিটিতে বর্তমানে প্রায় ৩০ হাজার লোকের বসবাস। এদের মধ্যে ২০ হাজার হলো অবৈধ দখলদারি ইহুদি যারা ইসরাইলের গড়া ৩০টি বসতি এলাকায় বাস করছে। ইসরাইল প্রতিনিয়ত আরব বা সিরিয়ানদের বসতবাড়ি দখল করে ইহুদিদের জন্য বসতি স্থাপন করছে।

১৯৬৭ সালে দখল করার প্রায় ১৪ বছর পর ১৯৮১ সালে গোলান মালভূমিকে আনুষ্ঠানিকভাবে নিজ ভূখণ্ড বলে ঘোষণা দেয়। কিন্তু আন্তর্জাতিক মহল কখনোই ইসরাইলের এই দাবির স্বীকৃতি দেয়নি। সর্বশেষ ২০১৮ সালের ১৬ নভেম্বর শুক্রবার জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গোলান মালভূমির মালিকানা সংক্রান্ত এক ভোটাভুটি হয়। সেখানে উপস্থিত ১৫৩টি দেশের মধ্যে ১৫১ দেশ এ ভূখণ্ডের মালিকানা সিরিয়ার বলে স্বীকৃতি দেয়। শুধুমাত্র আমেরিকা ও ইহুদিবাদী ইসরাইল প্রস্তাবটির বিপক্ষে অবস্থান নেয়।

গোলানে ইসরাঈলী বসতি
সামরিক এবং কৌশলগত গুরুত্বের বাইরেও গোলান মালভূমি ওই এলাকার মিঠাপানির প্রধান উৎস। ইসরাইলে ব্যবহৃত মিঠাপানির তিন ভাগের প্রায় এক ভাগ জোগান দেয় গোলান। জায়গাটি চাষাবাদের জন্যও বিশেষ উপযোগী। ইসরাইল দখলের পরে এলাকার লোকজনকে উৎপাদিত ফসলাদি সিরিয়াতে বিক্রি করতে বাধা দেয়। ধীরে ধীরে সাধারণ জনগণকে তাদের ইচ্ছামতো ফল-ফলাদি চাষ করার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করে ইসরাইল। তারপরে আরব বা সিরিয়ানদের ওপর আরোপ করে অতিরিক্ত ট্যাক্স। তাদের কাছে সেচের পানি, সার ইত্যাদি বিক্রি করা হয় চড়া মূল্যে যা ইহুদিদের কাছে বিক্রি করা হয় প্রায় অর্ধেক দামে।

গোলান থেকে প্রায় ২ লাখ সিরীয় আরবকে জোরপূর্বক তাদের বসতবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয়। ২০০৭ সালে সিরীয় আরবদের মধ্যে দেখা করা বা পারিবারিক পুনর্মিলন বন্ধ করে দেয় ইসরাইল। এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ি হয়তো দূর থেকে চোখে দেখা যায় কিন্তু তাদের ওই বাড়িতে থাকা আত্মীয়র সঙ্গে দেখা করতে পারে না দিনের পর দিন এবং মাসের পর মাস।

ইহুদিবাদী দখলদারিত্বের কারণে গোলানবাসীরা আজ নিজ ভূমিতে শরণার্থী হয়ে জীবনযাপন করছে। হাজার হাজার গোলানবাসী তাদের ঘরবাড়ি ও এলাকা থেকে জোর করে বের করে দেয়া হয়েছে। তাদের চোখের সামনে নিজেদের গড়া স্বপ্নের ঠিকানা বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দিয়ে ইসরাইল সেখানে গড়ে তুলেছে নতুন বসতি।

গোলানে বসবাসরত আরবরা নিজের জন্মভূমি সিরিয়া থেকে সাহায্য সহযোগিতা পেয়ে আসছিল যুগ যুগ ধরে। কিন্তু সেই মাতৃভূমি সিরিয়া গত নয় বছর ধরে গৃহ যুদ্ধে চূর্ণ-বিচূর্ণ। মুসলিম বিশ্ব যে তাদের সমস্যা নিয়ে কথা বলবে সেই মুসলিম বিশ্ব আজ নেতৃত্বহীন। 

গোলানের নয়নকাড়া দৃশ্য
সৌদি আরব তো এখন প্রকাশ্য ইসরাঈল ও আমেরিকার দোসর, মিসরের অবস্থাও একই। তুরস্ক এই নিয়ে কথা বললেও পর্যাপ্ত পদক্ষেপ নিতে পারছে না। গোলানের ভাগ্যবিড়ম্বিত অসহায় আরবদের দুর্ভোগের কফিনে ট্রাম্প যখন শেষ পেরেকটি মারতে উদ্যত সেই দুর্দিনে আজ তাদের পাশে দৃঢ়ভাবে দাঁড়ানোর কেউ নেই।

২০১১ সালে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার প্রাক্কালে সিরিয়া ইরানের সহায়তায় গোলান ইসরাঈলের দখলমুক্ত করার জন্য উদোগ গ্রহণ করেছিলো। কিন্তু সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের কারণে সেই উদ্যোগ আর সম্ভব হয়নি। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ গোলানে ইসরাঈলের উপস্থিতিকে আরো শক্তিশালী করেছে। 

গোলানের প্রায় ৬০০ বর্গ কিলোমিটার এখনো সিরিয়ার নেতৃত্বে। যুদ্ধে নাকাল সিরিয়াকে ইসরাঈল আরেকটি যুদ্ধের দিকে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ইসরাঈল চাইছে পুরো গোলান মালভূমি নিজেদের কব্জায় নিয়ে নিতে। এই জন্যই এই স্বীকৃতির আয়োজন। আশা করছি লেবানন, সিরিয়া ও তুরস্কও যদি একটি শক্ত পদক্ষেপ নিতে পারে এবং একত্রিত থাকতে পারে তবে হয়তো গোলান পুরো হাতছাড়া হবে না।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন