১৫ মে, ২০১৯

নারী নির্যাতন রোধে করণীয়



আমাকে কারাগারে প্রথম নিয়ে যে ভবনে রাখা হয় তাকে 'আমদানি' বলা হয়। আমদানি ভবন থাকলেও সেখানে রপ্তানি ভবন ছিল না। যাদের বের করা হবে তাদেরও আমদানিতেই রাখা হয়। আমদানিতে ভদ্র চেহারার বা দেখতে ছাত্রের মত কাউকে দেখলেই অন্যরা জিজ্ঞাসা করতেন কি মামলা? শিবির মামলা নাকি? আর সকল মাদক মামলার নাম ছিল 'বাবা'।

জেলখানায় আলাদা আলাদা পরিভাষা ছিল প্রায় সবগুলো বিষয়ের। যেমন রান্নাঘরকে বলা হত 'চৌকা'। মামলাগুলোর নামও ছিল আলাদা আলাদা। যেমন আমাদের সংগঠনের যে কেউ ভাংচুর, বিস্ফোরক, অস্ত্র যে মামলায় এরেস্ট হোক না কেন তার মামলার নাম ছিল শিবির মামলা।

যাই হোক, সেখানে 'খাট ভাঙ্গা কেইস' নামে একটা কেইস আছে। প্রথমে বুঝতে পারতাম না 'খাট ভাঙ্গা কেইস' এটা কী জিনিস? পরে জানতে পারলাম নারী নির্যাতন কেইস। বর্তমানে এটা নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছে। নারী নির্যাতন বেড়েই চলেছে। মহামারী আকার লাভ করেছে।

নারীর প্রতি সহিংসতা নিয়ে মানুষ এক লাইনে সমাধান টানতে চাইছেন। ব্যাপারটা মোটেই এরকম কিছু নয়। এটা এক লাইনে সমাধানে আসার মত কিছু নয়। এটা একটা টোটাল সমাজব্যবস্থার ব্যাপার। সামাজিক মূল্যবোধের ব্যাপার।

কারাগারে আমি বিভিন্ন আসামীদের সাথে আলোচনা করতাম। তাদের সাইকোলজি বুঝার চেষ্টা করতাম। বেশ কয়েকজন ধর্ষকের সাথে আমার কথা হয়েছে। একজন বলেছেন স্রেফ প্রতিশোধের উদ্দেশ্যে ধর্ষণ করেছে। মেয়েটির ভাই তার বন্ধু ছিল। সেই বন্ধু তার লাখখানেক টাকা মেরে দিয়েছে। টাকা দিতে না পেরে উল্টো বোনকে উত্যক্ত করে বলে অভিযোগ দিয়ে সামাজিকভাবে অপমান করেছে। বিনিময়ে সে প্রতিশোধ নিয়েছে।

আরেকজনকে পেয়েছি সে মধ্যবয়স্ক। একটি বাড়ির দারোয়ান ছিলেন। তার কথা হলো ধনীরা খারাপ। গবীরদের সম্পত্তি লুট করা ছাড়া কেউ ধনী হতে পারে না। তাই সুযোগ পেলেই সে ধনীদের ক্ষতি করবে। তার এই চিন্তার প্রতিফলন আমি কারাগারেই দেখেছি। সে পয়সাওয়ালা বন্দিদের বিরুদ্ধে লেগেই থাকতো। প্রায়ই প্রশাসনের কাছে তাদের নামে অভিযোগ করতো কারাবিধি লঙ্ঘনের।

একজনকে পেয়েছি টেম্পো চালক। সে বলেছে প্রতিদিন সিনেমা না দেখলে আমার ঘুম আসে না। আর প্রতিটা সিনেমা শেষেই তার এমন আচরণ করতে ইচ্ছে হয়। সে আরো বলেছে প্রতিদিন রাস্তাঘাটে কত রঙঢং দেখি। আমারও কি এমন করতে ইচ্ছে করে না? সে সেদিন আমার কাছে প্রশ্ন করেছে।

আরেক গ্রুপ পেয়েছি। তারা মাত্র অনার্স সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র। তিনজন। বান্ধবীর সাথে আড্ডা দিতে দিতে নির্যাতন করেছে। গ্রুপ স্টাডির নাম করে একজনের বাসায় বান্ধবীদেরও ডাকে। তাদের দাবী বিষয়টা মিউচুয়াল ছিল। তাদের কথাবার্তায় বুঝলাম তারা ইংলিশ, হিন্দি ও নীল ছবি আসক্ত।

আরেকটা ছিল পারিবারিক পর্দা না থাকার কারণে। বউয়ের ছোট বোনকে নিয়ে ঢাকায় গিয়েছিল তার চাকুরীর ইন্টারভিউ এর জন্য। ব্যাস... শয়তান জয়ী হয়েছে।

আমি কয়েকটা কেইস স্টাডি উল্লেখ করেছি। এখানে নানান বিষয় উঠে এসেছে। পাঠক মাত্রই তা অনুধাবন করতে পারবেন। বিস্তারিত আলোচনায় যাওয়ার কোন প্রয়োজন নেই।

আবার আসুন এবার সরকারের ভূমিকা নিয়ে কিছু কথা বলি। যেমন ছাত্রশিবির আটাশ বছর চট্টগ্রাম কলেজে প্রাভাবশালী ছিল। সেখানে নারী নির্যাতন তো অনেক দূরের বিষয় তার কাছাকাছি বিষয়ও হয়নি। কিন্তু ছাত্রশিবিরের প্রভাব নষ্ট হওয়ার দুই বছরের মধ্যেই অভিযোগ আসা শুরু হয়েছে।

এর কারণ কী?

এর কারণ হলো যারা ক্ষমতাসীন তারাই বিকৃত মানসিকতার। সুতরাং তাদের এই গর্হিত কাজের শাস্তির বিধান কার্যকর হবে না। আগে যে কোন কারণে (সিনেমা, নীল ছবি, নারীদের রঙ-ঢং, প্রেমে প্রত্যাখ্যাত) বিকৃত হয়ে যাওয়া পুরুষরা এই কাজে সাহস পেতো না কারণ তারা জানতো এর শক্ত বিচার হবে।

আর এখন চট্টগ্রাম কলেজের বিকৃতরা জানে ক্ষমতাসীনদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে পারলে তার অপরাধের বিচার হবে না। তাহলে সুষ্ঠু ও ন্যায়পরায়ন সমাজব্যবস্থা না থাকা ধর্ষণের সবচেয়ে বড় কারণ।
আমি মোটাদাগে ধর্ষণের কয়েকটি কারণ উল্লেখ করতে চাই 
১- সমাজের সীমাহীন বৈষম্য ও অপরাধের বিস্তার 
২- উপযুক্ত ও নৈতিক শিক্ষার অভাব
৩- অপসংস্কৃতির প্রভাব
৪- ব্যাক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিকভাবে পর্দার বাস্তবায়ন না থাকা
৫- বিয়ে কঠিন হওয়া এবং জেনা সহজ হওয়া
৬- সর্বোপরি একটি সুষ্ঠু ও ন্যায়পরায়ণ শাসনব্যবস্থা না থাকা।

অশালীন পোষাক কি সমস্যা?

জ্বি অশালীন পোষাক সমস্যা। তবে পোষাক একমাত্র সমস্যা না। অনেকগুলো সমস্যার মধ্যে একটি। আমিও পুরুষ। আমি জানি অশালীন পোষাক আমার মধ্যে সুড়সুড়ি তৈরী করে। উদ্বুদ্ধ করে অন্যায় কাজের। যেখানে ছোট শিশু ধর্ষণের শিকার হয় সেখানে হয়তো পোষাক ভূমিকা রাখে না, আবার রাখে।

যেমন কেউ সামাজিকভাবে পর্দা প্রতিষ্ঠিত না থাকার কারণে বিকৃত হয়ে গেছে। এমন ঘটনার খবর পাওয়া যায়, যাকে দেখে সে উত্তেজিত হয়েছে তা তার নাগালের বাইরে তখন নাগালের মধ্যে থাকা শিশু অথবা অন্য কেউ তার জঘন্য আচরণের শিকার হয়। বাংলাদেশের বেশিরভাগ বিকৃতদের মানসিকতা নষ্ট হয় সিনেমার নায়িকাদের দেখে। শুধু দেশী নয়, বিদেশী নায়িকারাও এর মধ্যে আছেন। কিন্তু ধর্ষকরা তাদের নাগালে পায় না। নাগালে যাকে পায় তাকেই নির্যাতন করে।

আমাদের একটা ব্যাপার হলো আমরা ইফেক্ট নিয়ে আলোচনা করি। কারণ অনুসন্ধান করি না। কারণ অনুসন্ধান করলে ধর্ষণ শূন্যের কাছাকাছি নিয়ে আসা সম্ভব।

তাহলে করণীয় কী?

করনীয় দুই ধরণের এক. ব্যাক্তিগতভাবে, দুই. সামাজিক বা রাষ্ট্রীয়ভাবে

ব্যক্তিগতভাবে করণীয় :

১- পর্দার ব্যবস্থা করা। এই পর্দা শুধু সতর ঢাকা নয়। পর্দার বিধান মেনে নেয়া। ১৪ শ্রেণীর মাহরাম ছাড়া কারো সাথে (পুরুষ এবং নারী) দেখা না দেয়া। পরিবারে ও ব্যাক্তিগতভাবে পর্দা মেইন্টেইন করা। অবৈধ কোন কিছু না দেখা। পরিবারের সদস্যদের শালীন পোষাকে অভ্যস্ত করা। এতে সামাজিক মর্যাদাও বৃদ্ধি পায়।

২- ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষায় সন্তানদের সুশিক্ষিত করা।

৩- অপসংস্কৃতি থেকে নিজে ও পরিবারকে রক্ষা করে সেখানে সুস্থ সংস্কৃতির বিস্তার করা। সন্তানরা কার সাথে মিশছে কাকে বন্ধু বানাচ্ছে এগুলো খেয়াল করা। অসৎ সঙ্গ থেকে সন্তানকে রক্ষা করা। শুধু পড়ালেখা নয় অন্য কোন এক্সট্রা কারিকুলার এক্টিভিটিজে সন্তানদের আগ্রহী করা ও ব্যস্ত রাখা।

৪- ইন্টারনেট কানেকশনে প্যারেন্টিং সফটওয়্যার ইউজ করা।

রাষ্ট্রীয়ভাবে করণীয় :

আপনি ব্যাক্তিগতভাবে যত পদক্ষেপই নেন না কেন তা কেবল সামান্যই ভূমিকা রাখবে। বলা চলে আপনি কিছুটা হিফাযত হবেন। কিন্তু মূল সমস্যার সমাধান কোনভাবেই হবে না। সমস্যার সমাধান হতে পারে রাষ্ট্রীয়ভাবে গৃহীত পদক্ষেপে।

১- পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে  ধর্মীয় অনুশাসন কার্যকর করতে হবে। 
২- বস্তুবাদী শিক্ষাব্যবস্থা পরিহার করে নৈতিক শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে হবে। 
৩- বিচারহীনতার সংস্কৃতি বন্ধ করে সর্বক্ষেত্রে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। 
৪- নারী নির্যাতনকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে। 
৫- অশ্লীল ও উদ্দেশ্যহীন টিভি সিরিয়াল, নাটক, সিনেমা ইত্যাদি বন্ধ করে শিক্ষামূলক বিনোদনের ব্যবস্থা করতে হবে। 
৬- অশ্লীল বিদেশী সিনেমা ও সিরিয়াল নিষিদ্ধ করতে হবে। 
৭- পুরুষ ও নারী উভয়কে পর্দার বিধান জানা ও মানার ক্ষেত্রে আগ্রহী করে তুলতে হবে। 
৮- বিয়ে সহজ করে তুলতে হবে এবং বিয়ে বহির্ভূত সম্পর্ক ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। 
৯- নারীদের সম্পদের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। 
১০- যৌতুক বন্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। 
১১- ইন্টারনেট থেকে অশ্লীল কন্টেন্ট মুছে ফেলতে সরকারি উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। 
১৩- নারী নির্যাতন বন্ধে ধর্মীয় ইমামদের নিয়মিত নসিহত করতে হবে। 
১৪- স্কুল ও মাদ্রাসায় সহশিক্ষা বন্ধ করতে হবে। 
১৫- নারীদের জন্য আলাদা ও নিরাপদ কর্মক্ষেত্র নিশ্চিত করতে হবে। 
১৬- পুরুষ ও নারী উভয়কে উগ্র ও আঁটোসাঁটো পোশাক পরিহার করে শালীন ও মার্জিত পোশাক পরিধান করতে হবে।  
১৭-  বেকার যুবক ও বখাটেদের পুনর্বাসন ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। 
১৮- নারী নির্যাতনকারীদের সঠিক শিক্ষা, চিকিৎসা ও মোটিভেশনের মাধ্যমে সুস্থ করে তুলতে হবে। 
১৯- নারী নির্যাতন বন্ধে সরকারকে আলাদা টাস্কফোর্স গঠন করতে হবে। 
২০- তামাক ও মাদক নির্মূলে সরকারকে আরো কঠোরভাবে আইনপ্রয়োগ করতে হবে।

এক্ষেত্রে উপরোক্ত বিষয়গুলো সুষ্ঠুভাবে প্রয়োগ করতে পারলে শাস্তি দেয়ার মত লোক খুঁজে পাওয়া যাবে না। ইনশাআল্লাহ।

যদি একলাইনে সমাধান চান তবে আল্লাহ প্রদত্ত বিধান অনুযায়ী সমাজ প্রতিষ্ঠা করলেই এর সমাধান সম্ভব। আসুন বিচ্ছিন্ন কথা না বলি, বিচ্ছিন্ন কাজ না করি। সবাই মিলে ইকামাতে দ্বীনের কাজ করি। আমরা আমাদের জাতিকে এই ভয়ানক ব্যাধি থেকে রক্ষা করতে সক্ষম হবো ইনশাআল্লাহ।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন