আমরা যারা ইনকাম করি এটা তাদের জন্য একটি বিশাল চিন্তার বিষয়। আচ্ছা চিন্তা করে দেখুন আপনার প্রিয় স্ত্রী, আপনার কলিজার টুকরা সন্তান, আপনার মাথার তাজ পিতামাতা, আপনার স্নেহের ভাই-বোন যদি বলে উঠে তোমার উপার্জন অবৈধ, তোমার সাথে আমরা নেই কেমন লাগবে? সহ্য করতে পারবেন?
শুধু কি আপনার নিকটজন? আপনার প্রভূর কথা কি চিন্তা করেছেন? তিনি আপনাকে কেমন দৃষ্টিতে দেখবেন। আপনার নামাজ, রোজা, দান, সাদকা, এগুলোর কোনো মূল্যই তাঁর কাছে নেই। আপনি কি বুঝতে পারছেন আপনি একটি মহাশূন্যে পরিণত হচ্ছেন হারাম উপার্জনের মাধ্যমে।
কিছু হারাম উপার্জন আছে যা সহজে বুঝা যায়, যেমন : সুদ, ঘুষ, হারাম খাবার ভক্ষণ (মদ, শূকরের গোস্ত ইত্যাদি)। আবার কিছু উপার্জন আছে যেগুলো খালি চোখে দেখা যায় না যেমন : কাজে ফাঁকি দেয়া, পণ্যের দোষ না বলে দেয়া ইত্যাদি।
আপনারা যারা সুদী লেনদেন করেন তাদের সময় এসেছে সাবধান হওয়ার। সুদ হারাম প্রত্যেকের জন্য যারা সুদে টাকা ধার দেয়, যারা সুদে টাকা ধার নেয়, যারা সুদের হিসেব রাখে, যারা সুদের কারবারে সাক্ষী থাকে। সুতরাং সুদী ব্যাংকে কাজ করা হারাম। আপনারা যারা সুদী ব্যাংকে চাকরি করেন তারা বিকল্প চিন্তা করুন এখনই। যত কষ্ট হোক চাকুরি ছেড়ে দিন।
ঘুষ খাওয়া তো ভয়ংকর অপরাধ। অনেকে আছেন নিজে ঘুষ খাননা কিন্তু সিস্টেমের কারণে ঘুষের ভাগ পান। সেদিন আমার এক প্রিয় ভাই তিনি একটি ইসলামী শরিয়ত মেনে চলা ব্যাংকের গার্ড। উনি আর ওনার অফিসার অন্য একটি ব্যাংক থেকে টাকা আনতে গেলেন। খরচ হয়েছে রিকশায় তিরিশ টাকা। কিন্তু অফিসার ব্যাংককে খরচ দেখিয়েছেন ১৭০ টাকা। এর মধ্যে ৫০ টাকা ঐ গার্ড ভাইকে দিয়েছেন। তিনি নিতে না চাইলে তাকে চাকরির হুমকি পর্যন্ত দিয়েছেন। এই পঞ্চাশ টাকা অবৈধ উপার্জন। বহু মানুষ এমন উপার্জনে সন্তুষ্ট থাকে। আমার প্রিয় ঐ গার্ড ভাই আরো কিছু কারণ যোগ করে ঐ চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। এর বিনিময়ে যে চাকরি পেয়েছেন তা তাঁর আগের বেতনের অর্ধেক। আল্লাহ ওনাকে বরকত দান করুন।
অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠান আছে যারা তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেন না। যেমন খাবারের মান মনিটর করার কিছু প্রতিষ্ঠান আছে কিন্তু তারা যদি তাদের দায়িত্ব পালন না করেন তাহলে তাদের উপার্জন হালাল হবে না। এভাবে আমরা যারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকুরি করি আমাদের সবার ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য। আমরা অনেকে অফিসের কাজে ফাঁকি দিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় সময় ব্যয় করি, পরিজনের সাথে ফোনে গল্প করি। এটা হারাম। আপনি যে বেতন নেন তার প্রাপ্য হিস্যা প্রতিষ্ঠানের মালিককে বুঝিয়ে দিতে হবে। ফাঁকিবাজি করলে আয় হালাল হবে না।
অনেক ব্যবসায়ি পণ্যের দোষ প্রকাশ করেন না শুধু গুনগুলো প্রকাশ করেন সেক্ষেত্রে আয় অবৈধ হবে। আর যদি প্রতারণা করে মিথ্যা বলে পণ্য বিক্রি করেন তাহলে সেটা তো আরো বড় অপরাধ। ব্যবসায়ীরা যে কোনো পণ্যের খারাপ দিক থাকলে অবশ্যই তা ক্রেতার নিকট বিক্রয় করার আগে প্রকাশ করতে হবে। না হলে তার আয় হালাল হবে না বলেছেন মুহাম্মদ সা.।
অনেক ব্যবসায়ি মজুতদারি করেন যাতে দাম বাড়ানো যায়। রাসূল সা. তাদের বিরুদ্ধে কঠোরসব কথা বলেছেন। আসলে আমরা সবাই জানি কী হালাল, কী হারাম! আমাদের সবার বিবেক আছে। আমরা ভালো এবং খারাপ আলাদা করতে পারি। তাই আসুন আমরা আমাদের উপার্জন হালাল করি।
আল্লাহ তায়ালা অসংখ্য-অগণিত নিয়ামতের মধ্যে ডুবিয়ে রেখেছেন আমাদের। খাদ্য-পানীয়, আলো-বাতাস, জীবন-জীবিকা সবই তিনি আমাদের দিয়েছেন সুচারুরূপে। একজন মানুষ জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মহান আল্লাহ তায়ালার অসংখ্য-অগণিত নেয়ামতে লালিত-পালিত হয়; যার সঠিক পরিসংখ্যান সম্ভব নয়। জীবনধারণের উপকরণ সন্ধান করা ইসলামি শরিয়তের একটি স্পষ্ট নির্দেশ। মানবআত্মা প্রকৃতিগতভাবে রিজিক অন্বেষণের পেছনে ছুটে চলে। আর আল্লাহ তায়ালা দিনকে করেছেন জীবিকা অর্জনের সময়কাল এবং রাতে বানিয়েছন বিশ্রামের সশয় হিসেবে। তিনি মানুষকে নির্দেশ দিয়েছেন ভূপৃষ্ঠে বিচরণ করতে এবং তার দেয়া রিজিক ভোগ করতে। হালাল রিজিক উপার্জন করে মানুষের দ্বারস্থ হওয়ার থেকে বেঁচে থাকাই বিশাল সম্মান ও মর্যাদার বিষয়।
আল-কোরানে হালাল রিজিক উপার্জন প্রসঙ্গ :
এক. ভূপৃষ্ঠে বিচরণকারী এমন কোন প্রাণী নেই যার রিযিকের দায়িত্ব আল্লাহর ওপর বর্তায় না এবং যার সম্পর্কে তিনি জানেন না, কোথায় সে থাকে এবং কোথায় তাকে সোপর্দ করা হয়। সবকিছুই এক সুবিন্যস্ত কিতাবে রয়েছে।'[সুরা-হুদ, আয়াত-৬]
দুই. আল্লাহ তায়ালা বলেন, অতঃপর নামাজ সমাপ্ত হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ তালাশ কর ও আল্লাহকে অধিক স্মরণ কর,তোমরা সফলকাম হবে।' [সুরা-আল-জুমা, আয়াত-১০]
তিন. আল্লাহ বলেন, হে বিশ্ববাসীগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় করো। আর সুদের যা বকেয়া আছে তা পরিহার করো; যদি তোমরা বিশ্বাসী হও। কিন্তু যদি তোমরা তা না করো তাহলে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও।’ [সুরা বাকারা-২৭৯]
চার. আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘হে রাসুলগণ, তোমরা পবিত্র ও ভালো বস্তু থেকে খাও এবং সৎকর্ম কর। নিশ্চয় তোমরা যা কর সে সম্পর্কে আমি সম্যক জ্ঞাত। [সুরা আল-মুমিনুন :৫১]
পাঁচ. আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘হে মুমিনগণ, আহার কর আমি তোমাদের যে হালাল রিজিক দিয়েছি তা থেকে এবং আল্লাহর জন্য শোকর কর, যদি তোমরা তারই ইবাদত কর। [সুরা বাকারা:১৭২]
আল-হাদিসে হালাল রিজিক উপার্জন প্রসঙ্গ :
এক. ইবনে মাসউদ [রা.] থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, আল্লাহর নির্ধারিত রিজিক পূর্ণমাত্রায় লাভ না করা পর্যন্ত কোনো জীবজন্তুই মারা যায় না। সাবধান! আল্লাহকে ভয় কর এবং বৈধ পন্থায় আয়-উপার্জনের চেষ্টা কর। রিজিক প্রাপ্তিতে বিলম্ব যেন তোমাদের তা উপার্জনে অবৈধ পন্থা অবলম্বনে প্ররোচিত না করে। কেননা আল্লাহর কাছে যা রয়েছে, তা কেবল তার আনুগত্যের মাধ্যমেই লাভ করা যায়। [ইবনে মাজাহ]
দুই. আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ [রা.] থেকে বর্ণিত নবী [সা.] ইরশাদ করেন, কোনো ব্যক্তি হারাম পন্থায় সম্পদ উপার্জন করে, তা থেকে দান-খয়রাত করলে তা কবুল করা হবে না এবং সে তার এ সম্পদে বরকত প্রাপ্ত হবে এরূপ কখনো হতে পারে না। তার পরিত্যক্ত হারাম মাল কেবল তার জন্য দোজখের পাথেয় হতে পারে (তা দিয়ে আখেরাতের সৌভাগ্য ও সাফল্য অর্জন করা যায় না)। আল্লাহতায়ালার নিয়ম হচ্ছে, তিনি মন্দের দ্বারা মন্দকে নিশ্চিহ্ন করেন না (হারাম মালের দান দ্বারা গুনাহ মাফ করেন না)। বরং ভালো দ্বারা মন্দ নিশ্চিহ্ন করেন (হালাল মালের দান দ্বারা গুনাহ মাফ করেন। নাপাক দ্বারা পবিত্রতা অর্জন করা যায় না। (মুসনাদে আহমাদ)।
তিন. নবী আকরাম [সা.] একটি হাদিসে বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি নিজের রুজি রোজগারের জন্য কাজ করে এবং সে কাজে লক্ষ্য থেকে আল্লাহর সন্তুটি অর্জন, তার দৃষ্টান্ত হজরত মুসা আ:-এর মায়ের মতো। তিনি নিজেরই সন্তানকে দুধ পান করান আবার তার বিনিময় লাভ করেন।
চার. শরিয়তের দৃষ্টিতে রিজিক অন্বেষণে শ্রম ব্যয়ের গুরুত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে নবিজি [সা.] বলেছেন, ‘নিজ হাতে উপার্জিত খাদ্য সর্বোত্তম খাদ্য’।
পাঁচ. রাসুলে করিম [সা.] হাদিসে পাকে ইরশাদ করেন, ‘হালাল রিজিক অন্বেষণ করা ফরজ আদায়ের পর আরেক ফরজ। [তিবরানি ও বায়হাকি শরিফ]
হালাল রিজিক অন্বেষণ করাও একটি ইবাদত :
আল্লাহই রিজিকের মালিক। কে কী উপার্জন করবে তা আল্লাহতায়ালা নির্ধারণ করে রেখেছেন। বান্দার উচিত হবে বৈধ পন্থায় আয়-উপার্জন করার প্রয়াসে নিয়োজিত থাকা। হালাল এবং হারামের পার্থক্য সম্পর্কে সতর্ক থাকা। কোনোভাবেই হারাম পথে প্রলুব্ধ না হওয়া। হারাম পন্থায় জীবিকা উপার্জনের দ্বারা কোনো ইবাদাত কবুল হবে না। বিষয়টিকে আমাদের অধিক গুরুত্ব দিতে হবে তা হলো, আমরা যা উপার্জন করছি তা পবিত্র কি-না, হালাল কি-না। কেননা আল্লাহ তায়ালা যা পবিত্র ও হালাল কেবল তাই ভক্ষণ করার নির্দেশ দিয়েছেন।
হালাল রিজিক অন্বেষণ করা কোনো ঐচ্ছিক বিষয় নয় :
পবিত্র ও হালাল রিজিক অন্বেষণ-উপার্জন করা আদৌ কোনো ঐচ্ছিক বিষয় নয় রবং টি একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ও আবশ্যিক বিষয়। কারণ কেয়ামতের ময়দানে বান্দাকে তার জায়গা থেকে এক চুল পরিমাণও নড়তে দেয়া হবে না যতক্ষণ না সে এই প্রশ্নের উত্তর প্রদান করতে পারবে যে, সে তার জীবিকা কীভাবে অর্জন করেছে এবং কোথায় তা ব্যয় করেছে। তাই প্রত্যেক মুসলমানের ঈমানি কর্তব্য হলো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা যে, সে তার জীবিকা কীভাবে উপার্জন করছে! সে যা উপার্জন করছে তা হালাল কি-না, পবিত্র কি-না তা অবশ্যই যাচাই করতে হবে।
ইবাদত কবুল হওয়ার পূর্বশর্ত হালাল রিজিক :
প্রসিদ্ধ সাহাবি হজরত সাহল ইবনে আবদুল্লাহ [রা.] বলেন, মুক্তি বা পরিত্রাণ লাভ তিনটি বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল- ১. হালাল খাওয়া ২. ফরজ আদায় করা এবং ৩. রাসুলে করিম [সা.]-এর সুন্নতগুলোর আনুগত্য বা অনুসরণ করা। হালাল খাদ্য গ্রহণের মধ্যে ব্যক্তিজীবনের নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত, দান-খয়রাত, লেনদেনসহ যাবতীয় নেক আমল কবুল হওয়ার সমূহ আশা বিদ্যমান এবং হারাম খাদ্যের প্রতিক্রিয়ায় তা কবুল না হওয়ার প্রবল আশঙ্কাই রয়েছে। এ ব্যাপারে উম্মতকে সতর্ক করতে রাসুল [সা.] ইরশাদ করেন, ‘বহু লোক এমন দীর্ঘ সফর করে আসে এবং অত্যন্ত ব্যাকুলভাবে দুহাত তুলে আল্লাহর দরবারে বলতে থাকে, হে পরওয়ারদেগার! রব! কিন্তু যেহেতু সে ব্যক্তির পানাহারসামগ্রী হারাম উপার্জনের, পরিধেয় পোশাক-পরিচ্ছদ হারাম পয়সায় সংগৃহীত, এমতাবস্থায় তার ইবাদত-বন্দেগি, নামাজ-রোজা কী করে কবুল হতে পারে?’ অন্যত্র তিনি ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি হারাম মালের এক লোকমা তার পেটে ঢুকাবে, ৪০ দিন পর্যন্ত তার নামাজ-রোজা, ইবাদত-বন্দেগি কবুল হবে না
[তিরবানি শরিফ]
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন