এখন থেকে প্রায় চার হাজার বছর আগের কথা। আর্য নামের এক জাতি ধ্বংসপ্রবণ জাতি প্রবেশ করেছিল উত্তর ভারতে। তবে বাংলা দখল করতে তাদের আরো এক হাজার বছর প্রয়োজন হয়। দ্রাবিড় অধ্যুষিত সিন্ধু, পাঞ্জাব ও উত্তর ভারত আর্যদের দখলে চলে যাওয়ার পর এই যাযাবরদের অত্যাচারে টিকতে না পেরে অধিকাংশ দ্রাবিড় দক্ষিণ ভারত, শ্রীলংকা ও বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। আর্যরা তাদের দখল বাড়াতে আরো পূর্বদিকে অগ্রসর হয়। সামরিক বিজয়ের সাথে সাথে বৈদিক আর্যরা তাদের ধর্ম-সংস্কৃতির বিজয় অর্জনেও সকল শক্তি নিয়োগ করে। পুরো উত্তর ভারত আর্যদের অধীনতা স্বীকার করে নেয়। কিন্তু স্বাধীন মনোভাব ও নিজ কৃষ্টির গর্বে গর্বিত বঙ্গবাসীরা আর্য আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রবলভাবে রুখে দাঁড়ায়। ফলে করতোয়ার তীর পর্যন্ত এসে সামরিক অভিযান বন্ধ হয়ে যায় আর্যদের।
বাংলাদেশের পূর্বপুরুষদের এই প্রতিরোধ-যুদ্ধ সম্পর্কে অধ্যাপক মন্মথমোহন বসু বলেন, “প্রায় সমস্ত উত্তর ভারত যখন বিজয়ী আর্য জাতির অধীনতা স্বীকার করিয়াচিল, বঙ্গবাসীরা তখন সগর্বে মস্তক উত্তোলন করিয়া তাহাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াইয়াছিল। শতপথ ব্রাহ্মণ বলেন, আর্যদের হোমাগ্নি সরস্বতী তীর হইতে ভাগলপুরের সদানীরা (করতোয়া) নদীর পশ্চিম তীর পর্যন্ত আসিয়া নিভিয়া গিয়াছিল। অর্থাৎ সদানীরার অপর পারে অবস্থিত বঙ্গদেশের মধ্যে তাঁহারা প্রবেশ করিতে পারেন নাই”। (বাংলা নাটকের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ, দ্বিতীয় সংস্করণ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৫৯, পৃষ্ঠা ২১)
জাবি অধ্যাপক ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ বলেন, আর্যদের আদিবাস ছিল ইরানের শেষ উত্তরে। কাস্পিয়ান সাগরের তীরে। কৃষিকাজ ছিল তাদের প্রধান পেশা। জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি তাদের কৃষি জমির সংকট দেখা দেয়। ফলে তাদের খাদ্যের অভাব প্রকট হয়। বাধ্য হয়ে এরা নতুন জমির খোঁজে ছড়িয়ে পড়ে নানা দেশে। এদেরই একটি দল দক্ষিণে এসে ইরানের মূল ভূমিতে বসতি গড়ে। এখানে বসবাস করতে করতে এক সময় খোঁজ পায় ভারত আর বাংলার। জানতে পারে সম্পদশালী এই দেশগুলোর মাটি খুব উর্বর। প্রচুর ফসল ফলে ওখানে। কৃষিজমির লোভে একসময় আর্যরা ভারতের দিকে অগ্রসর হয়। প্রথমে বসতি স্থাপন করে ভারতে। তারপর সুযোগ মত চলে আসে বাংলায়।
তবে যত সহজে ভারতে আসতে পেরেছিল— বাংলায় প্রবেশ করা ততটা সোজা ছিল না। প্রথমদিকে বাংলার বীর যোদ্ধারা রুখে দিয়েছিল আর্য আগমন। আর্যদের এসময়ের ইতিহাস জানার একমাত্র উপায় আর্যদের লেখা ধর্মগ্রন্থ। এই গ্রন্থের মূল নাম বেদ। একারণে আর্যদের ধর্মকে বলা হয় ‘বৈদিক ধর্ম’। এই বৈদিক ধর্ম থেকেই '‘সনাতন ধর্মে’র জন্ম হয়। সনাতন ধর্মকে আমরা সাধারণভাবে ‘হিন্দু ধর্ম’ বলে থাকি। বেদগ্রন্থের অনেক খণ্ড ছিল। যেমন ঋগবেদ, যযুর্বেদ, অথর্ববেদ, ব্রাহ্মণ ইত্যাদি। বেদের লেখা থেকে জানা যায়, খুব নাক উঁচু জাতি ছিল আর্যরা। অর্থাৎ নিজেদের সকল জাতি থেকে অনেক বড় মনে করতো। অন্যায়ভাবে ভারত দখল করেছিল তারা। কিন্তু নিজেদের অন্যায়কে আড়াল করতে চেয়েছে বেদগ্রন্থে।
মোহাম্মদ আবদুল মান্নান তাঁর জাতিসত্তার বিকাশধারা বইতে লিখেন, সামরিক অভিযান ব্যাহত হওয়ার পর আর্যরা অগ্রসর হয় বুদ্ধির আশ্রয় নেয়। তারা বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অভিযান পরিচালনা করে। তাই দেখা যায়, আর্য সামাজের ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যরা এ দেশে প্রথম আসেনি, আগে এসেছে ব্রাহ্মণেরা। তারা এসেছে বেদান্ত দর্শন প্রচারের নামে। কেননা, ধর্ম-কৃষ্টি-সংস্কৃতি-সভ্যতার বিজয় সম্পন্ন হয়ে গেলে সামরিক বিজয় সহজেই হয়ে যাবে। এ এলাকার জনগণ ব্রাহ্মণ্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম পরিচালনা করেন, তা ছিল মূলত তাদের ধর্ম-কৃষ্টি-সভ্যতা হেফাযত করার লড়াই। তাদের এই প্রতিরোধ সংগ্রাম শত শত বছর স্থায়ী হয়। ‘স্বর্গ রাজ্যে’ প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা নিয়ে দেবতা ও অসুরদের মধ্যে দীর্ঘকাল দ্বন্দ্ব-সংঘাত-সংগ্রামের যে অসংখ্য কাহিনী ঋগ্বেদ, সামবেদ, যজুর্বেদ প্রভৃতি আর্য সাহিত্যে ছড়িযে আছে, সেগুলো আসলে আমাদের পূর্বপুরুষদের প্রতিরোধ ও মুক্তি সংগ্রামেরই কাহিনী। আমাদের পূর্ব পুরুষদের গৌরবদীপ্ত সংগ্রামের কাহিনীকে এসব আর্য সাহিত্যে যেভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে, পৃথিবীর অন্য কোন জাতির ধর্মশাস্ত্রে কোন মানবগোষ্ঠীকে এমন নোংরা ভাষায় চিহ্নিত করার নজির পাওয়া যাবে না।
একই কথা বলেছেন কামরুদ্দীন আহমদ তাঁর ‘সোশ্যাল হিস্ট্রি অব বেঙ্গল’ বইয়ে, "তিন স্তরে বিভক্ত আর্য সমাজের ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যরা প্রথমে বাংলায় আসেনি। এদেশে প্রথমে এসেছে ব্রাহ্মণেরা। তারা এসেছে বেদান্ত দর্শন প্রচারের নামে। বাংলা ও বিহারের জনগণ আর্য-অধিকারের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন পরিচালনা করেন, তাও ছিল ধর্মভিত্তিক তথা সাংস্কৃতিক।
বেদগ্রন্থগুলোকে সাধারণভাবে বৈদিক সাহিত্য বলা হয়। এমন একটি বৈদিক সাহিত্যের নাম ‘শতপথ ব্রাহ্মণ’। কিভাবে আর্যরা ভারতে এসেছে তা বলতে গিয়ে একটি গল্প সাজিয়েছিলেন আর্য লেখক। বলেছেন ভারত একটি অপবিত্র দেশ। নিচু জাতির মানুষেরা বাস করে এখানে। অগ্নি উপাসক উঁচু জাতির আর্যরা অমন দেশে বাস করতে পারে না। তারপরও তারা ভারতে এসেছে কেন? বলেছে এই সমস্যাটির সমাধান করে নিয়েছিল আর্যরা। বইতে লেখা আছে, আর্যদের একজন মুনি অর্থাৎ ধর্মগুরু ছিলেন, যার নাম বিদেঘ। বিদেঘের ছিল একটি বিশেষ গুণ ছিলো তাঁর মুখ দিয়ে আগুন বেরুতো। সে আগুনে পুড়ে পবিত্র হয়েছিল ভারত ভূমি। আর সেই পবিত্র মাটিতেই বসতি গড়েছিল আর্যরা। তবে বাংলায় পৌঁছতে তখনো অনেকটা বাকি ছিল।
বঙ্গ-দ্রাবিড়দের প্রতিরোধের ফলে অন্তত খ্রিস্টপূর্ব চার শতক পর্যন্ত এদেশে আর্য-প্রভাব রুখে দেওয়া সম্ভব হয়। খ্রিস্টপূর্ব চার শতকে মৌর্য এবং তার পর গুপ্ত রাজবাংশ প্রতিষ্ঠার আগে বাংলায় আর্য ধর্মের প্রভাব বিস্তৃত হয়নি। মৌর্যদের বিজয়কাল থেকেই বাংলাদেশে আর্য প্রভাব বাড়তে থাকে। তারপর চার ও পাঁচ খ্রিস্টাব্দের গুপ্ত শাসনামলে আর্য ধম, আর্য ভাষা ও আর্য সংস্কৃতি বাংলাদেশে প্রত্যক্ষভাবে শিকড় গাড়ে।
মৌর্য বংশের শাসনকাল পর্যন্ত বৌদ্ধ-ধর্ম ব্রাহ্মণ্যবাদের সাংস্কৃতিক আগ্রাসন থেকে আত্মরক্ষা করতে সমর্থ হয়। আশোকের যুগ পর্যন্ত এই ধর্মে মূর্তির প্রচলন ছিল না। কিন্তু তারপর তথাকথিত সমন্বয়ের নামে বৌদ্ধ ধর্মে ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু তান্ত্রিকতার প্রবেশ ঘটে। হিন্দু দেব-দেবীরা বৌদ্ধ মূর্তির রূপ ধারণ করে বৌদ্ধদের পূজা লাভ করতে শুরু করে। বৌদ্ধ ধর্মের এই বিকৃতি সম্পর্কে মাইকেল এডওয়ার্ডট ‘এ হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া’ বইয়ে লিখেছেন,
“Buddhism had, for a variety of reasons, declined and many of its ideas and forms had been absorbed into Hinduism. The Hinduization of the simple teachings of Gautama was reflected in the elevation of th Buddha into a Divine being surrounded, in sculptural representations, by the gods of the Hindu partheon. The Buddha later came to be shown as an incarnation of Vishnu.”
সতিশচন্দ্র মিত্র তাঁর ‘যশোর খুলনার ইতিহাস’ গ্রন্হে লিখেছেনঃ
“যোগীরা এখন হিন্দুর মত শবদেহ পোড়াইয়া থাকেন, পূর্বে ইহা পুঁতিয়া রাখিতেন। …….. উপবিষ্ট অবস্থায় পুঁতিয়া রাখা হিন্দুদের চোখে বিসদৃশ লাগিত, তাঁহারা মনে করিতেন, উহাতে যেন শবদেহ কষ্ট পায়”।
অর্থাৎ হিন্দুদের চোখে বিসদৃশ লাগার কারণে এভাবে বৌদ্ধদেরকে পর্যায়ক্রমে তাদের ধর্ম-সংস্কৃতি তথা জীবনাচরণের অনেক বৈশিষ্ট্যই মুছে ফেলতে হয়েছিল। অশোকের সময় পর্যন্ত বুদ্ধের প্রতিমা-পূজা চালু ছিল না। পরে বুদ্ধের শূন্য আসনে শোভা পেল নিলোফার বা পদ্ম ফুল। তারপর বুদ্ধের চরণ দেখা গেল। শেষে বুদ্ধের গোটা দেহটাই পূজার মণ্ডপে জেঁকে বসল। এভাবে ধীরে ধীরে এমন সময় আসল, যখন বৌদ্ধ ধর্মকে হিন্দু ধর্ম থেকে আলাদা করে দেখার সুযোগ লোপ পেতে থাকল।
গুপ্ত আমলে বাংলাদেশে আর্য ব্রাহ্মণ্যবাদীদের দোর্দন্ড প্রতাপ শুরু হয়। আর্য ভাষা ও সংস্কৃতির স্রোত প্রবল আছড়ে পড়ে এখানে। এর মোকাবিলায় জনগণের প্রতিরোধ সংগ্রাম পরিচালিত হয় জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মকে আশ্রয় করে। জৈন ও বৌদ্ধ ধর্ম ও সংস্কৃতি বাংলা ও বিহারের জনগণের আত্মরক্ষার সংগ্রামে এ সময় প্রধান ভূমিকা পালন করে। আর জনগণের আর্য-আগ্রাসনবিরোধী প্রতিরোধ শক্তিকে অবলম্বন করেই বৌদ্ধ ধর্ম ও সংস্কৃতি দীর্ঘদিন এ এলাকার প্রধান ধর্ম ও সংস্কৃতিরূপে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়। রাখালদাস বন্দোপাধ্যায়ের মতে ঐতিহাসিকও স্বীকার করেছেন,
“আর্যরাজগণের অধঃপতনের পূর্বে উত্তরাপথের পূর্বাঞ্চলে আর্য ধর্মের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী আন্দোলন উপস্থিত হইয়াছিল। জৈন ধর্ম ও বৌদ্ধ ধর্ম এই আন্দোলনের ফলাফল”।(বাঙ্গালার ইতিহাস, পৃষ্ঠা ২৭-২৮)
এ আন্দোলনের তোড়ে বাংলা ও বিহারে আর্য রাজত্ব ভেসে গিয়েছিল। আর্য-দখল থেকে এ সময় উত্তরাপথের পুব-সীমানার রাজ্যগুলো শুধু মুক্তই হয়নি, শতদ্র নদী পর্যন্ত সমস্ত এলাকা অনার্য রাজাদের অধীনতা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিল। ব্রাহ্মণ্যবাদী ধর্ম ও সংস্কৃতির অনাচারের বিরুদ্ধে সৃষ্ট গণজোয়ারের শক্তিতেই আর্যরা পরাজিত হয় বাংলায়।
এই আন্দোলনের নেতা শিশুনাগবাংশীয় মহানন্দের শূদ্র-পুত্র মহাপদ্মনন্দ ভারত ভূমিকে নিঃক্ষত্রিয় করার শপথ নিয়েছিলেন এবং ক্ষত্রিয় শাসকদের নির্মূল করে সমগ্র ভারতকে অনার্য অধিকারে আনার শপথ করেছিলেন। তিনি এজন্য ‘একরাট’ উপাধি ধারণ করেছিলেন।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন