খিলজী রাজবংশ হল মধ্য যুগের মুসলিম রাজবংশ যারা ১২৯০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৩২০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ভারতের বিশাল অংশ শাসন করত। জালাল উদ্দিন ফিরোজ খিলজী এর প্রতিষ্ঠাতা। খিলজী শাসনামল অবিশ্বাস, হিংস্রতা এবং দক্ষিণ ভারতে তাদের শক্ত অভিযানের জন্য খ্যাত হলেও খিলজী শাসনামল মূলত ভারতে বর্বর মোঙ্গলদের বারংবার অভিযান রুখে দেওয়ার জন্য সুপরিচিত।
খিলজীরা ছিল দিল্লির মামলুক রাজবংশের সামন্ত এবং দিল্লির সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবনের সেনাপতি। বলবনের উত্তরাধিকারীদের ১২৮৯-১২৯০ সালে হত্যা করা হয় এবং এর পরপরই মামলুকদের মধ্যে ক্ষমতা নিয়ে কোন্দল শুরু হয়ে যায়। এই কোন্দলের মধ্যে জালালউদ্দিন ফিরোজ খিলজীর নেতৃত্বে বিদ্রোহ সংগঠিত হয় এবং মামলুকদের বংশের শেষ উত্তরাধিকারী ১৭ বছর বয়সী মুইজ উদ দিন কায়কোবাদকে অপসারণ করে তিনি দিল্লির সালতানাতে অধিষ্ঠিত হন।
জালালউদ্দিন খিলজী একজন প্রজাদরদি এবং বিনয়ী সুলতান ছিলেন। তুর্কি অভিজাতদের বিরুদ্ধাচরণ সত্বেও তিনি ১২৯০ সালে দিল্লির মসনদে বসেন। জালাল উদ্দিনের এই আরোহণ সবাই মেনে নিতে পারেনি। তার ৬ বছরের শাসনে বলবনের ভাইপো মামলুকদের প্রতি অনুগত সামরিক অধিনায়কদের নিয়ে বিদ্রোহ করে। জালালউদ্দিন এই বিদ্রোহ রুখে দেন। তিনি তার ভাইপো জুনা খানকে সাথে নিয়ে মধ্য ভারতের সিন্ধ নদী তীরে মঙ্গোল বাহিনীকে সফলভাবে প্রতিহত করেন।
জালালউদ্দিন খিলজির মৃত্যুর পর আলাউদ্দিন খিলজী (জুনা খান) দিল্লির মসনদে বসেন। তিনি ছিলেন জালাল উদ্দিন খিলজীর ভাইপো এবং জামাতা। আলাউদ্দিন খিলজি হিন্দু রাজ্য মহারাষ্ট্রের রাজধানী দেবগীরি অধিকার করেন।
আলাউদ্দিন খিলজী ২০ প্রায় বিশ বছর এই উপমহাদেশ শাসন করেন। তিনি ভারতের গুজরাটের রাজা কর্ণদেব, রণ-থম্ভোরের রাজপুত নেতা হামির দেব, মেবারের রাজা রতন সিং ও মালবের অধিপতি মহ্লক দেবকে পরাজিত করেন। এরপর তিনি মালিক কাফুরের নেতৃত্বে দক্ষিণ ভারতে অভিযান প্রেরণ করেন । কাফুর দেবগিরির রাজা রামচন্দ্র, বরঙ্গলের কাকতীয়রাজ প্রতাপ রুদ্র, দোরসমুদ্রের হোয়্সলরাজ তৃতীয় বল্লালকে পরাজিত করবার পর ভাতৃবিরোধের সুযোগ নিয়ে পান্ড্য রাজ্য অধিকার করেন। এরপর তিনি রামেশ্বর পর্যন্ত অগ্রসর হন।
আলাউদ্দিন খিলজি অবশ্য দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলি সরাসরি সাম্রাজ্যভুক্ত না করে সেখানকার রাজাদের মৌখিক আনুগত্য ও করদানের প্রতিশ্রুতি নিয়েই করদ রাজ্যে (কর দিতে স্বীকৃত) পরিণত করেন। বিজেতা হিসাবে আলাউদ্দিন খিলজি ছিলেন দিল্লির সুলতানদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। আলাউদ্দিনের দৃঢ়ত ও তার অসম সাহসিকতাপূর্ণ যুদ্ধকৌশলের কারনে তিনি ইতিহাস বিখ্যাত হয়ে আছেন। এছাড়াও তিনি দু'বার ভারতের দিকে ধেয়ে আসা মঙ্গোল বাহিনীকে সফলভাবে প্রতিহত করে।
আলাউদ্দিন খিলজি কয়েকটি কারণে বিখ্যাত
১- কেন্দ্রীয় শাসন শক্তিশালীকরণ। যে কোনো নির্দেশ বা আইন অল্প সময়ের মধ্যে সারা রাজ্যে তিনি বাস্তবায়ন করতে পারতেন।
২- বাজারদর নিয়ন্ত্রণ। তার শাসনামলে তিনি ব্যবসায়ীদের জনগণের স্বার্থে নিয়ন্ত্রণ করতেন। মজুতদারি ও প্রতারণা বন্ধ করেছেন। ব্যবসায়ীরা যাতে মূল্যের বেশি টাকা দাবি না করে, তার জন্য তিনি কঠোর প্রসাশনিক ব্যবস্থা গ্রহন করেছিলেন । বিষয়টির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিলে ‘শাহানা-ই-মান্ডি’ ও ‘দেওয়ান-ই-রিসালাত’ -এর উপর।
৩- জমি জরিপ ও রাজস্ব সংস্কার। দিল্লী সুলতানদের মধ্যে তিনিই প্রথম জমি জরিপ করে রাজস্বব্যবস্থার সংস্কার করেছিলেন। দেশে যাতে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় থাকে সেদিকেও তিনি নজর দেন। অপরাধীদের কঠোর শাস্তির বিধান দেওয়া হত । গুপ্তচরদের মাধ্যমে তিনি দেশের সমস্ত খবরাখবর রাখতেন। তিনি এক সুদৃঢ় ও কঠোর শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করে দিল্লি সালতানাতকে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করিয়েছিলেন।
৪- বর্বর মঙ্গোলদের রুখে দিয়েছিলেন তিনি। তাদের শোচনীয়ভাবে প্রতিহত করেছিলেন।
১৩১৫ সালের ডিসেম্বরে আলাউদ্দিন খিলজীর মৃত্যু হয়। এর পরপরই সাম্রাজ্য জুড়ে বিশৃঙ্খলা,একে অপরের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান, গুপ্তহত্যা ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি মালিক কাফুর নিজেকে সুলতান দাবি করে বসে। কিন্তু আমীরদের সম্মতি থাকায় তিনি মসনদ ধরে রাখতে পারেন নি এবং কয়েক মাসের মধ্যে তাকেও হত্যা করা হয়।
পরবর্তী তিন বছরে একের পর এক অভ্যুত্থান মধ্য দিয়ে তিনজন সুলতান দিল্লির মসনদে বসেন। নানান গোলযোগের পর সেনাপ্রধান গাজী মালিক বিশাল বাহিনী নিয়ে দিল্লিতে অভ্যুত্থান ঘটান এবং দিল্লীর মসনদ নিজ দখলে নেন। এরপর তিনি নিজের নাম বদলে গিয়াস উদ্দিন তুঘলক নাম ধারণ করেন এবং তুঘলক রাজবংশের গোড়াপত্তন করেন।
সুলতান গিয়াসউদ্দীন তুঘলক প্রজাহিতৈষী ছিলেন। তিনি ভূমিকর হ্রাস করে উৎপন্ন ফসলের ১০ ভাগের ১ ভাগে নামিয়ে আনলেন। সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় খরচে সাম্রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় কৃষিকাজে সেচের জন্য খাল খনন করেন। সুলতান গিয়াসউদ্দীন তুঘলকের অমর কীর্তি হচ্ছে তাঁরই নির্মিত তুঘলকাবাদ। পুরো শহরটি গোলাপী রঙয়ের গ্রানাইট পাথর দ্বারা তৈরি করা হয়েছিলো। নিরাপত্তার জন্য শহরটি উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা ছিলো। এই প্রাচীরগুলোকেও দেখলে অনেকটা দুর্গের মতো মনে হয়।
১৩২৩ সালে সুলতান গিয়াসউদ্দীন তুঘলক তেলেঙ্গানার কাকতীয় রাজা প্রতাপ রুদ্রের বিরুদ্ধে একটি অভিযান চালান। কাকতীয় রাজ্যের রাজধানী ওয়ারঙ্গল দখল করে এর নাম রাখা হলো সুলতানপুর। পুত্র জুনাহ খানের নেতৃত্বে দাক্ষিণাত্যেও তিনি একটি সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন। সে সময় বাংলায় বিভিন্ন স্বাধীন সুলতানদের শাসন প্রতিষ্ঠিত ছিলো। সুলতান গিয়াসউদ্দীন তুঘলক বাংলাকে দিল্লী সালতানাতের অধীনে নিয়ে আসতে চাইলেন। ১৩২৪ সালে তিনি বাংলায় অভিযান চালান এবং সফল হন।
১৩২৫ সালে গিয়াসউদ্দীন তুঘলকের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র উলুগ খাঁ জুনাহ খান দিল্লির রাজসিংহাসনে বসেন। ইতিহাসে তুঘলক বংশের এই শাসক মুহাম্মদ বিন তুঘলক নামেই বেশি প্রসিদ্ধ। ‘মুহাম্মদ বিন তুঘলক’ নামের মানে হচ্ছে তুঘলকের পুত্র মুহাম্মদ। ১৩২৫ সালে সুলতান মুহাম্মদ বিন তুঘলকের সিংহাসনে আরোহণের পর হিন্দুস্তান যেন এক নতুন যুগে প্রবেশ করলো। তিনি শাসনব্যবস্থায় অনেকগুলো সংস্কার নিয়ে আসেন, তাম্রমুদ্রা প্রচলন করেন এবং রাজধানী স্থানান্তর করেন। মুহাম্মদ বিন মুহাম্মদ যুক্তি, দর্শন, গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞানে একজন পন্ডিত ছিলেন এবং শারিরীক বিজ্ঞান এবং ঔষধবিজ্ঞানে তার ভাল ধারণা ছিল । এছাড়াও তুর্কিশ, আরবি, ফার্সি এবং উর্দু ভাষা তার আয়ত্তে ছিল। মুলতানে জন্মগ্রহনকারী তুগলক বংশের এই শাসক সম্ভবত মধ্যযুগের সবচেয়ে শিক্ষিত, যোগ্য ও দক্ষ সুলতান ছিলেন। একমাত্র বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা তার শাসনামলের সমালোচনা করেন। আল্লামা গোলাম মর্তুজার মতো অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন ব্যক্তিগত বিদ্বেষের কারণেই তিনি এমনটা লিখেছেন।
তার আমলেই বাংলা দিল্লি থেকে আলাদা হয়ে যায় শাহ-ই-বাঙ্গালাহ'র নেতৃত্বে। মুহাম্মদ বিন তুঘলক ১৩৫১ সাল পর্যন্ত দিল্লির সুলতান ছিলেন। তার মৃত্যুর পর তার চাচাতো ভাই ফিরোজ শাহ তুঘলক দিল্লির ক্ষমতায় আসীন হন। এদিকে বাংলা, বিহার, আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়, নেপাল, আরাকানের অংশবিশেষ নিয়ে গঠিত হয় বাংলা সালতানাত। ১৩৪২ সালে সেনাপতি শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহ নিজেকে লখনৌতির সুলতান ঘোষণা করেন। তিনি অন্যান্য স্বাধীন রাজ্যসমূহও জয় করার মাধ্যমে নিজের শাসন সংহত করেন এবং ১৩৫২ সালে নিজেকে স্বাধীন বাংলার সুলতান ঘোষণা করেন। এজন্য তাকে শাহ-ই-বাঙ্গালাহ বলা হয়ে থাকে। আগামী পর্বে বাংলার স্বর্ণযুগ নিয়ে আলোচনা থাকবে।
এই সিরিজ কি বই হিসাবে পাবো ভাই
উত্তরমুছুনইনশাআল্লাহ পাবেন।
মুছুন