১২ জুল, ২০১৯

বঙ্গকথা পর্ব-১২ : অবহেলিত বাংলা যেভাবে 'শাহী বাংলা'-তে পরিণত হলো



শাহী বাংলা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৩৫২ সালে শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের হাত ধরে। এর মাধ্যমে বাংলা দিল্লি সালতানাত থেকে আলাদা হয়। সমগ্র বাংলা অঞ্চল, বিহার, আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়, নেপাল, আরাকানের অংশবিশেষ নিয়ে গঠিত হয় বাংলা সালতানাত। শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ পুনরায় সেই হারিয়ে যাওয়া শব্দ বঙ্গকে তুলে এনেছেন। বঙ্গ থেকেই তিনি সালতানাতের নাম দেন বাঙ্গালাহ। বাংলা ভাষা ও বাংলার জাতিসত্তা বিকাশে তাই শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের অবদান অনস্বীকার্য। স্বাধীন সুলতানী আমলে বাংলা পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে সম্পদশালী অঞ্চল হিসেবে বিবেচিত ছিলো। সেসময় বিশ্বের মোট উৎপাদনের (জিডিপির) ১২ শতাংশ উৎপন্ন হত সুবাহ বাংলায়, যা সে সময় সমগ্র ইউরোপের চেয়ে জিডিপির চেয়ে বেশি ছিল। সারা পৃথিবীতে থেকে এখানে ব্যবসায়ীরা আসতেন বাণিজ্য করার জন্য।

ইলিয়াস শাহ ইরানের সিজিস্তানের এক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। জীবনের শুরুর দিকে তিনি দিল্লির মালিক ফিরোজের অধীনে সেনানায়ক ছিলেন। পরে সাতগাঁও-এর তুগলক শাসনকর্তা ইজ্জউদ্দীন ইয়াহিয়ার অধীনে চাকরি গ্রহণ করেন। নিজ যোগ্যতা বলে তিনি মালিক পদে উন্নীত হন। ইজ্জউদ্দীন ইয়াহিয়ার মৃত্যুর পর তিনি ১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দে সাতগাঁওয়ের শাসক হন। সেখানে তার কর্তৃত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত করে তিনি লখনৌতির আলাউদ্দীন আলী শাহ-এর বিরুদ্ধে এক দীর্ঘ যুদ্ধে অবতীর্ণ হন এবং যুদ্ধে জয়লাভ করে তিনি সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ উপাধি নিয়ে ১৩৪২ খ্রিস্টাব্দে লখনৌতির সিংহাসনে আরোহণ করেন।

লখনৌতিতে তাঁর ক্ষমতা সুদৃঢ় করে ইলিয়াস শাহ রাজ্যবিস্তারে মনোনিবেশ করেন। তিনি ১৩৪৪ খ্রিস্টাব্দে সহজেই ত্রিহুত দখল করেন এবং ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দে নেপালের তরাই অঞ্চলে এক দুঃসাহসিক অভিযান পরিচালনা করেন। ইতঃপূর্বে কোনো মুসলিম বাহিনী এ অঞ্চলে প্রবেশ করতে পারে নি। তিনি রাজধানী কাঠমুন্ডু পর্যন্ত অগ্রসর হয়ে স্বয়ম্ভুনাথ মন্দির অধিকার করেন। অতঃপর ইলিয়াস শাহ পূর্ব বাংলায় অভিযান পরিচালনা করেন এবং ইখতিয়ারউদ্দিন গাজী শাহকে পরাজিত করে ১৩৫২ খ্রিস্টাব্দে সোনারগাঁও অধিকার করেন। এরূপে তিনি সমগ্র বাংলার অধিপতি হন। শামস-ই-সিরাজ আফিফ তাকে ‘শাহ-ই-বাঙ্গালাহ’, ‘শাহ-ই-বাঙ্গালিয়ান’ ও ‘সুলতান-ই-বাঙ্গালাহ’ বিশেষণে ভূষিত করেন।

ইলিয়াস শাহ উড়িষ্যা আক্রমণ করেন এবং জয়পুর ও কটকের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে চিল্কা হ্রদ পর্যন্ত পৌঁছেন। অতঃপর ইলিয়াস শাহ ১৩৫৩ খ্রিস্টাব্দে বিহার আক্রমণ করেন। বিহারের পরেও তিনি তাঁর কর্তৃত্ব চম্পারণ, গোরখপুর এবং বেনারস পর্যন্ত বিস্তৃত করেন।

ইলিয়াস শাহের সাথে দিল্লির সুসম্পর্ক তখনো হয়নি সুলতান ফিরুজ শাহ তুগলক ইলিয়াস শাহকে দমন করার জন্য বাংলা অভিমুখে অভিযান করেন। ইলিয়াস শাহ তাকে রুখে দেন। পরবর্তীতে ইলিয়াস শাহের সঙ্গে সন্ধি স্থাপন করে ফিরুজ শাহ তুগলক দিল্লি ফিরে যান। ইলিয়াস শাহ্ সফল সেনানায়ক ছিলেন। ফিরোজ শাহকে তিনি যেভাবে প্রতিহত করেন, তা থেকেই ইলিয়াস শাহর কুশলতার পরিচয় পাওয়া যায়। ১৫৫৩ সালে ৯০ হাজার অশ্বারোহী এবং এক লাখ পদাতিক সেনা ও তীরন্দাজ নিয়ে ফিরোজ বাংলা অভিযানে আসেন। শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ্ একডালা দুর্গে অবস্থান নেন।

দিল্লির দরবারের প্রখ্যাত ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দিন বারুণীর মতে, “পাণ্ডুয়ার পার্শ্বেই ‘একডালা’ নামে একটি দুর্গ আছে, যার একদিকে নদী, অন্যদিকে জঙ্গল।’’ ফিরোজ শাহ্ এই দুর্গ অবরোধ করলে প্রথম দিনই প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। এতে ইলিয়াস শাহের পুত্র সিকান্দার শাহ্ দিল্লির বাহিনীর হাতে বন্দি হন। ২২ দিন অবরোধের পরও দুর্গ দিল্লির দখলে নিতে পারলো না দিল্লির বাহিনী। তখন ফিরোজ শাহ্ একটি কৌশল অবলম্বন করেন। তিনি অবরোধ প্রত্যাহারের কথা বলে পিছু হটেন। এই দেখে ইলিয়াস শাহ দশ হাজার অশ্বারোহী, ২ লাখ পদাতিক সৈন্য এবং ৫০টি হাতী নিয়ে দিল্লির বাহিনীকে আক্রমণ করেন। ফিরোজ শাহ এটিই চেয়েছিলেন। তিনিও ঘুরে আক্রমণ প্রতিহত করেন। কিন্তু তার কৌশল কাজ করলেও শেষমেশ ফিরোজ জিততে পারেননি। পিছু হটে গিয়ে ইলিয়াস আবার দুর্গে প্রবেশ করেন।

ফিরোজ শাহ্ আবার দুর্গ অবরোধ করেন। অনেকদিন অবরোধের পর যুদ্ধে কাঙ্ক্ষিত সফলতা আসবে না চিন্তা করে ফিরোজ শাহ তুঘলক সন্ধি প্রস্তাব করেন। তাছাড়া বর্ষা ঋতু চলে আসায় তার সৈন্যরাও পড়েছিলো বিপদে।

১. ইলিয়াস শাহ্ বাংলার স্বাধীন শাসনকর্তা থাকবেন।
২. দিল্লির দরবারে বার্ষিক কর ও উপঢৌকন পাঠাবেন।
৩. পাণ্ডুয়ায় বন্দি সকল সৈন্যকে ফিরোজ শাহ্ মুক্তি দেবেন।

এর ফলে ইলিয়াস শাহ স্বাধীন সুলতান হিসেবে বাংলা শাসন করতে আর কোনো বাধা থাকলো না। পরবর্তীতে বাংলা ও দিল্লির সুলতানদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক উপহার ও দূত বিনিময়ের মাধ্যমে আরও দৃঢ় হয়। তাদের মধ্যে প্রায়ই দূত ও উপহার বিনিময় হয়েছিল। দিল্লির সুলতানের সঙ্গে আপোষ ইলিয়াস শাহকে পার্শ্ববর্তী ত্রিপুরা রাজ্যের ওপর তাঁর প্রভাব বিস্তার করার সুযোগ করে দেয়।

শাসন কাজেও ইলিয়াস শাহ্ দক্ষ ছিলেন। লক্ষণাবতী, সাতগাঁও ও সোনারগাঁ তিনি একীভূত করেন। অভিজ্ঞ কূটনীতিকের মতো তিনি সময় ও সুযোগকে ব্যবহার করে সমগ্র বাংলাকে একীভূত করেছিলেন। এবং তিনি রাজধানী লক্ষণাবতী থেকে সরিয়ে পাণ্ডুয়ায় আনেন। তিনি সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য স্থানীয় জনগণের সাহায্য নেন। স্থানীয় জনগণকে উদারভাবে সুযোগ-সুবিধা দিয়ে তিনি তাঁর শাসনকে গণশাসনের রূপ দেন। ইলিয়াস শাহ্ বর্ণ, গোত্র ও ধর্ম নির্বিশেষে যোগ্য লোকদের চাকরিতে নিয়োগ লাভের সুযোগ দেন। তিনিই প্রথম রাজকার্যে হিন্দুদের নিয়োগ দেন। ‘ইনশাহ-ই-মাহরু’ থেকে জানা যায় যে, খান, মালিক, উমারা, সদর, আকাবির ও মারিফগণ সামরিক ও বেসামরিক শাসনের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। এদের মধ্যে সম্ভবত খান, মালিক ও আমিরগণ ছিলেন জায়গির ভূমির অধিকারী ও রাজ্যের পদস্থ সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি। তাদের কেউ কেউ হয়তো মন্ত্রী হিসেবে সুলতানের উপদেষ্টাও ছিলেন।

শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ্ একজন ধার্মিক ব্যক্তি ছিলেন। তিনি সাধু, দরবেশ ও সুফি ব্যক্তিদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। তার রাজত্বকালে সাদত, উলামা ও মাশায়েখদের মতো হিন্দু সাধু-সন্ন্যাসীরাও সরকার থেকে বৃত্তি পেতেন। তাঁর দরবেশ প্রীতির একটি গল্প প্রচলিত আছে। ফিরোজ শাহ্ যখন একডালা দুর্গ অবরোধ করে রেখেছিলেন, তখন রাজা বিয়াবানি নামে এক মস্ত দরবেশ মৃত্যুবরণ করেন। ইলিয়াস শাহ্ এ খবর শুনে ছদ্মবেশে দুর্গের বাইরে যান এবং দরবেশের দাফনে অংশ নেন। ফেরার সময় ইলিয়াস তাঁর শত্রু, ফিরোজ শাহ শিবিরে প্রবেশ করেন। ফিরোজ তাঁকে চিনতে পারেননি। বরং দরবেশ ভেবে আপ্যায়ন করেন। ইলিয়াস দুর্গে ফেরার পর ফিরোজ শাহ্ আসল ঘটনা জানতে পারেন। ঐতিহাসিক গোলাম হোসেন সালিম তাঁর ‘রিয়াজ-উস-সালাতীন’ গ্রন্থে এ ঘটনাটি উল্লেখ করেছেন।

ইলিয়াস শাহ স্থাপত্য শিল্পের উদার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তিনি হাজিপুর শহরের প্রতিষ্ঠা করেন। সুফি সাধক আলা-উল-হকের সম্মানে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। এ ছাড়া দিল্লির শামসী হাম্মামখানার অনুকরণে ফিরোজাবাদে একটি হাম্মামখানা নির্মাণ করেন।

অভিজ্ঞ কূটনীতিকের মতো ইলিয়াস শাহ সমগ্র বাংলাকে একত্রিকরণের সময় ও সুযোগ তাঁর অনুকূলে না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করছিলেন। তিনি সুশাসন প্রবর্তনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন এবং তা প্রবর্তন করে বাংলার স্বাধীনতা টিকিয়ে রাখার জন্য জনসমর্থন লাভে প্রয়াসী হন। স্থানীয় জনগণকে উদারভাবে সুযোগ সুবিধা দিয়ে তিনি তাঁর শাসনকে গণশাসনের রূপ দেন। তিনি বর্ণ, গোত্র ও ধর্ম নির্বিশেষে যোগ্য লোকদের চাকরিতে নিয়োগ লাভের সুযোগ দেন।

তিনিই সর্বপ্রথম স্থানীয় লোকদেরকে অধিক সংখ্যায় সৈন্যবাহিনীতে নিয়োগ করেন। ইনশাহ-ই-মাহরু থেকে জানা যায় যে, খান, মালিক, উমারা, সদর, আকাবির ও মারিফগণ সামরিক ও বেসামরিক শাসনের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। এদের মধ্যে খান, মালিক ও আমীরগণ ছিলেন জায়গির ভূমির অধিকারী ও রাজ্যের পদস্থ সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি। তাদের কেউ কেউ হয়ত মন্ত্রী হিসেবে সুলতানের উপদেষ্টাও ছিলেন।

এভাবে সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ বাংলার স্বাধীন সালতানাতকে সুদৃঢ় করেন। এ সালতানাত প্রায় দুশ বছর টিকে ছিল। ষোল বছর গৌরবোজ্জ্বল রাজত্বের পর ১৩৫৮ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যু হয়।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন