অনেকেই মনে করেন ইখতিয়ার উদ্দিন মাধ্যমেই এদেশে ইসলাম এসেছে। কথাটা পুরোপুরি ঠিক নয়। আমরা গত পর্বে বলেছিলাম বখতিয়ারের বিজয়ের আগেই এদেশে ইসলাম প্রচারক আলেম, দরবেশ ও মুজাহিদগণ জনগণকে সাথে নিয়ে ব্রাহ্মণ্যবাদী সেন-রাজত্বের বিরুদ্ধে নিরন্তর সংগ্রাম পরিচালনা করেন।
ব্রাহ্মণ্যবাদীদের বর্ণবৈষম্য ও শ্রেণিবৈষম্যে নির্যাতিত মানুষের পাশে ইসলামের দায়ীরা দাড়িয়েছিলো। তার মধ্যে দিয়ে ইসলামের প্রতি জনগণের সমর্থন গড়ে ওঠে। জনসমর্থনের সে দৃঢ় ভিত্তির ওপর ১২০৩ সালের মার্চ মাসে সম্পন্ন হয় ইখতিয়ারউদ্দীন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজীর ঐতিহাসিক বিজয়। তিব্বতীয় বৌদ্ধ-ভিক্ষু লামা তারানাথ তাঁর ষোল শতকের বিবরণীতে জানান, বৌদ্ধরা মুসলমানদের বিজয়কে অভিনন্দিত করেছিল এবং ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজীকে বিজয়ে সাহায্য করেছিল। শ্রীচারু বন্দোপাধ্যায় ও প্রসঙ্গে উল্লেখ করেন যে, বৌদ্ধরা মুসলমান বিজেতার সাহায্যে হিন্দুদের অত্যাচারের প্রতিশোধ নিয়ে কিছুটা শান্তি লাভ করেছিল। (জাতিসত্তার বিকাশধারা)
এদেশের মানুষের ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে বখতিয়ার খিলজি। ইদানিংকালে কিছু সাহিত্যিক ও বাহ্মণ্যবাদীরা বলতে চান বখতিয়ার কোনটা দুর্গ আর কোনটা বিশ্ববিদ্যালয় তা বুঝতেন না। তিনি দুর্গ মনে করে বৌদ্ধদের বিশ্ববিদ্যালয় বা বিহারগুলো ধ্বংস করেছিলো। অথচ বৌদ্ধ ঐতিহাসিকরাই জানিয়েছেন বৌদ্ধরা মুসলিমদের স্বাগত জানিয়েছে এদেশে। খিলজিকে বৌদ্ধরা সমগ্র বিহার ও বাংলা অঞ্চল দখল করতে সাহায্য করেছিলো। সুতরাং নালন্দা বিহারসহ অন্যান্য বিহার ধ্বংসের যে অভিযোগ খিলজির উপর আরোপ করা হয়েছে তা পুরোটাই অসত্য ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত। মূলত সেন আমলে আর্য ব্রাহ্মণ্যবাদীরা বৌদ্ধদের উপর যে অত্যাচার চালিয়েছিলো তার দায় তারা মুসলিমদের উপর চাপাতে চেয়েছে।
ইখতিয়ার উদ্দিন বখতিয়ার খলজি ছিলেন জাতিতে তুর্কি আর পেশায় ভাগ্যান্বেষী সৈনিক। জীবনের প্রথম ভাগে তিনি ছিলেন আফগানিস্তানের গরমশির বা আধুনিক দশত-ই-মার্গের অধিবাসী। তিনি গজনির সুলতান মুহাম্মাদ ঘুরির সৈন্যবাহিনীতে চাকুরিপ্রার্থী হয়ে ব্যর্থ হন। আকারে খাটো, লম্বা হাত এবং অসুন্দর চেহারার অধিকারী হওয়ায় সেনাধ্যক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হন। গজনীতে ব্যর্থ হয়ে তিনি দিল্লিতে কুতুবউদ্দীন আইবেকের দরবারে হাজির হন। এখানেও তিনি চাকরি পেতে ব্যর্থ হন। অতঃপর তিনি বদাউনে যান। সেখানকার শাসনকর্তা মালিক হিজবর-উদ্দিন বখতিয়ার খলজিকে নগদ বেতনে সেনাবাহিনীতে চাকরি প্রদান করেন। অল্পকাল পর তিনি বদাউন ত্যাগ করে অযোদ্ধায় যান। অযোদ্ধার শাসনকর্তা হুসামউদ্দিন তাকে বর্তমান মির্জাপুর জেলার পূর্ব দক্ষিণ কোণে ভগবৎ ও ভিউলি নামক দুইটি পরগনার জায়গির প্রদান করেন। ( বাংলাদেশের ইতিহাস- ড. মুহাম্মদ আব্দুর রহিম। পৃষ্ঠাঃ ১৪৯)
মুসলিমদের দুর্দশা ও ব্রাহ্মনদের অত্যাচারের প্রেক্ষিতে ১২০১ সালে বখতিয়ার মাত্র দু হাজার সৈন্য সংগ্রহ করে পার্শ্ববর্তী হিন্দু রাজ্যগুলো আক্রমণ করতে থাকেন। সেই সময়ে তার বীরত্বের কথা চারিদিক ছড়িয়ে পড়তে থাকে এবং অনেক মুসলিম সৈনিক তার বাহিনীতে যোগদান করতে থাকে, এতে করে তার সৈন্যসংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। তিনি তার সেনাবাহিনী নিয়ে বিহার অধিকার করেন।
বিহার জয়ের পর বখতিয়ার খলজি কুতুব-উদ্দিন আইবকের সাথে দেখা করতে যান এবং কুতুবউদ্দিন কর্তৃক সম্মানিত হয়ে ফিরে আসেন। এর পরই তিনি বাংলা জয়ের জন্য সাহস এবং শক্তি সঞ্চয় করতে থাকেন। তৎকালীন বাংলার রাজা লক্ষণ সেন বাংলার রাজধানী নদিয়ায় অবস্থান করছিলেন কারণ নদিয়া ছিল সবচেয়ে সুরক্ষিত অঞ্চল। বলা হয়ে থাকে যে নদিয়ায় আসার কিছু আগে রাজসভার কিছু দৈবজ্ঞ পণ্ডিত তাকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে এক তুর্কি সৈনিক তাকে পরাজিত করতে পারে। এতে করে লক্ষণ সেনের মনে ভীতির সঞ্চার হয় এবং নদিয়ার প্রবেশপথ রাজমহল ও তেলিয়াগড়ের নিরাপত্তা জোরদার করেন। লক্ষণ সেনের ধারণা ছিল যে ঝাড়খণ্ডের শ্বাপদশংকুল অরণ্য দিয়ে কোনো সৈন্যবাহিনীর পক্ষে নদিয়া আক্রমণ করা সম্ভব নয় কিন্তু বখতিয়ার সেইপথেই তার সৈন্যবাহিনীকে নিয়ে আসেন। নদিয়া অভিযানকালে বখতিয়ার ঝাড়খণ্ডের মধ্য দিয়ে এত দ্রুতগতিতে অগ্রসর হয়েছিলেন যে তার সাথে মাত্র ১৮ জন সৈনিকই তাল মেলাতে পেরেছিলেন।
বখতিয়ার সোজা রাজা লক্ষণ সেনের প্রাসাদদ্বারে উপস্থিত হন এবং দ্বাররক্ষী ও প্রহরীদের হত্যা করে প্রাসাদের ভিতরে প্রবেশ করেন। এতে প্রাসাদের ভিতরে হইচই পড়ে যায় এবং লক্ষণ সেন দিগ্বিদিক হারিয়ে ফেলে প্রাসাদের পেছনের দরজা দিয়ে নৌপথে বিক্রমপুরে আশ্রয় নেন। নদিয়া জয় করে পরবর্তীতে লক্ষণাবতীর (গৌড়) দিকে অগ্রসহ হন এবং সেখানেই রাজধানী স্থাপন করেন। এই লক্ষণাবতীই পরবর্তীকালে লখনৌতি নামে পরিচিত হয়। গৌড় জয়ের পর আরও পূর্বদিকে বরেন্দ্র বা উত্তর বাংলায় নিজ অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনি এলাকাগুলোকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে একজন করে সেনাপতিকে শাসণভার অর্পণ করেন। বখতিয়ারের সেনাধ্যক্ষদের মধ্যে দুজনের নাম পাওয়া যায়। এদের মধ্যে আলি মর্দান খলজি বরসৌলে, হুসামউদ্দিন ইওজ খলজি গঙ্গতরীর শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। লাখনৌতিকে কেন্দ্র করে বাংলার নব প্রতিষ্ঠিত মুসলিম রাজ্যের সীমানা ছিল উত্তরে বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের পুর্নিয়া শহর, দেবকোট থেকে রংপুর শহর, পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বে তিস্তা ও কারতোয়া, দক্ষিণে গঙ্গার মূলধারা (পদ্মা) এবং পশ্চিমে কুশী নদীর নিম্নাঞ্চল থেকে গঙ্গার কিনারায় রাজমহল পাহাড় পর্যন্ত বিস্তৃত। পরবর্তী একশ’ বছরের মধ্যে বাংলার প্রায় সমগ্র এলাকা মুসলিম শাসনাধীনে আসে।
ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির বাংলা জয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রায় সাড়ে পাঁচশত বছরের মুসলিম শাসন শুরু হয়। এই আমলই ছিলো বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ সময়। শিক্ষা, সভ্যতায় ও সম্পদে বাংলা হয়ে উঠেছিলো পৃথিবী বিখ্যাত স্থান। সারা পৃথিবীতে থেকে পর্যটক ও অনুসন্ধিৎসু ব্যক্তিরা বাংলায় আসতেন বাংলার রূপ, রস, সৌন্দর্য ও গন্ধ উপভোগ করতে। ভারতে মুসলিম বিজয় সম্পর্কে গোপাল হালদার মন্তব্য করেন, “ইসলামের বলিষ্ঠ ও সরল একেশ্বরবাদ এবং জাতিভেদহীন সাম্যদৃষ্টির কাছে ভারতীয় জীবনধারা ও সংস্কৃতির………. এ পরাজয় রাষ্ট্র-শক্তির কাছে নয়, ইসলামের উদার নীতি ও আত্ম-সচেতনতার কাছে। ………. কারণ ইসলাম কোন জাতির ধর্ম নয়, প্রচারশীল ধর্ম। ইহা অন্যকে জয় করেই ক্ষান্ত হয় না, কোলে তুলে নেয়”। (সংস্কৃতির রূপান্তর, পৃষ্ঠা ১৯৬)
ভারতে বৌদ্ধ ও হিন্দু সংস্কৃতির ব্যর্থতা ও ইসলামী সংস্কৃতির বিজয়ের কারণ চিহ্নিত করে কমরেড এম. এন. রায় ‘ইসলামের ঐতিহাসিক অবদান’ নামক গ্রন্হে লিখেছেন, “ভারতে বৌদ্ধ বিপ্লবের পরাজয় ঘটেনি বরং তার অভ্যন্তরীণ দুর্বলতার জন্যই তা ব্যর্থ হয়েছে। সেই বিপ্লবকে জয়ের পথে নিয়ে যাওয়ার জন্য সমাজ-শক্তি তেমনভাবে দানা বেঁধে উঠতে পারেনি। তার ফল হলো এই য, বৌদ্ধ মতবাদের পতনের সঙ্গে-সঙ্গেই সমগ্র দেশ অর্থনৈতিক দুর্গতি, রাজনৈতিক অত্যাচার, বিচার-বুদ্ধির স্বেচ্ছাচারিতা আর আধ্যাত্মিক স্বেচ্ছাচারিতার মধ্যে ডুবে গেল। বাস্তবিকপক্ষে সমগ্র সমাজ তখন ধ্বংস ও বিলুপ্তির ভয়াবহ কবলে পড়ে গেছে। এজন্য নিপীড়ত জনগণ ইসলামের পতাকার নীচে এসে ভীড় করে দাঁড়াল……….। ইসলামের সমাজ ব্যবস্থা ভারতীয় জনগণের সমর্থন লাভ করল। তার কারণ তার পিছনে জীবনের প্রতি সে দৃষ্টিবঙ্গি ছিল, হিন্দু দর্শনের চাইতে তা ছিল শ্রেয়; কেননা হিন্দু দর্শন সমাজদেহে এনেছিল বিরাট বিশৃঙ্খলা আর ইসলামই তা থেকে ভারতীয় জনসাধারণেকে মুক্তির পথ দেখায়”।(পৃষ্ঠা ৬১-৬২)
মুসলিম শাসন আমল বাংলার ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা গঠনমূলক যুগ হিসেবে ঐতিহাসিকদের বিবেচনা লাভ করেছে। এ জনপদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলো এ যুগেই একটি উন্নত ও সংহত রূপ লাভ করে। রাজনৈতিকভাবে এ যুগেই বাংলার জনগণ একটি আদর্শের ভিত্তিতে সামাজিক ঐক্যমঞ্চে সংঘবদ্ধ হয়। বাংলা ভাষা ও বাঙালির ইতিহাসের ভিত্তিও এই যুগেই প্রতিষ্ঠিত হয়। এ প্রসঙ্গে ড. এম এ রহীমের মন্তব্য, “যদি বাংলায় মুসলিম বিজয় ত্বরান্বিত না হতো এবং এ প্রদেশে আর কয়েক শতকের জন্য ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসন অব্যাহত থাকত, তবে বাংলা ভাষা বিলুপ্ত এবং অথীতের গর্ভে নিমজ্জিত হতো”। (বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস, প্রথম খণ্ড, ভূমিকা)
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন