ঘটনার সূত্রপাত একটি খুনের ঘটনা থেকে। তাইওয়ানে ছুটি কাটানোর সময় অন্তঃসত্ত্বা বান্ধবীকে হত্যার অভিযোগ ওঠে হংকংয়ের এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে। কিন্তু তাইওয়ানের সঙ্গে হংকংয়ের বন্দি বিনিময়ের কোনও চুক্তি না থাকায় সেই ব্যক্তিকে এখন তাইপেতে বিচারের জন্য পাঠানো যাচ্ছে না। এই সমস্যাকে কাজে লাগিয়েছে চীন। তারা এই সমস্যা সমাধানের জন্য অপরাধী প্রত্যর্পন আইন করতে চায় যার ফলে এক অঞ্চলের অপরাধীরা অন্য অঞ্চলে গিয়ে আশ্রয় না নিতে পারে।
হংকং-এর শাসক বেইজিংপন্থী, তাই তিনিও এই আইনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। কিন্তু এখন তাইওয়ানও জানিয়েছে, সন্দেহভাজন সেই খুনের মামলার আসামিকে ফেরত নিতে চায় না তারা। কেননা এটি এমন এক উদাহরণ তৈরি করবে যা চীন ভবিষ্যতে কাজে লাগাতে পারে।
চীনবিরোধী অব্যাহত বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে পড়েছে হংকং। গত ৯ জুন রাতে কথিত অপরাধী প্রত্যর্পণ বিলের বিরুদ্ধে অঞ্চলটির রাজপথে নামে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ। রাজপথে বিক্ষোভকারীদের ঢল এখনও অব্যাহত আছে। বুধবারও অঞ্চলটির সরকারি অফিসে যাওয়ার প্রধান সড়কগুলো অবরোধ করে রেখেছে হাজার হাজার বিক্ষোভকারী। তবে ব্যাপক গণআন্দোলনের মধ্যেই সোমবার অঞ্চলটির শাসক বেইজিংপন্থী হিসেবে পরিচিত ক্যারি ল্যাম সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, কথিত ওই অপরাধী প্রত্যর্পণ বিলে কোনও কাটছাঁট করা হবে না। বুধবার তার কার্যালয় সংলগ্ন রাস্তায়ও বিক্ষোভ প্রদর্শন করে বিক্ষুব্ধ মানুষ। এ সময় সেখানে মোতায়েন দাঙ্গা পুলিশের শত শত সদস্য তাদের আর সামনে অগ্রসর না হওয়ার হুঁশিয়ারি দেয়।
হংকং চীনের বিশেষ প্রশাসনিক অঞ্চল হিসেবে বিবেচিত হলেও ২০৪৭ সাল অবধি অঞ্চলটির স্বায়ত্তশাসনের নিশ্চয়তা দিয়েছে চীন। ১৫০ বছর ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনে থাকার পর লিজ চুক্তির মেয়াদ শেষে ১৯৯৭ সালের ১ জুলাই অঞ্চলটি চীনের কাছে ফেরত দেওয়া হয়েছিল।
হংকংয়ের জনসংখ্যা প্রায় ৭৪ লাখ হলেও, ১২শ’ জনের একটি বিশেষ কমিটি নেতা বাছাইয়ে ভোট দেওয়ার সুযোগ পান। অঞ্চলটির নেতা বা প্রধান নির্বাহী ক্যারি ল্যামের দাবি, হংকং যে বিশেষ স্বাধীনতা উপভোগ করে, নতুন আইনের ফলে তার কোনও ক্ষতি হবে না। তবে গণতন্ত্রপন্থী বিক্ষোভকারীরা বলছেন, আইনটির মাধ্যমে অঞ্চলটির রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বীদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করবে বেইজিং। এর প্রতিবাদ জানাতেই তারা রাজপথের বিক্ষোভে শামিল হয়েছেন।
সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ক্যারি ল্যাম দাবি করেন, এই আইনের প্রয়োজন রয়েছে এবং এতে মানবাধিকারের রক্ষাকবচগুলো যুক্ত করা হয়েছে। তার দাবি, প্রস্তাবিত আইনটি বেইজিংয়ের পক্ষ থেকে তোলা হয়নি। বিবেকের তাড়নায় এবং হংকংয়ের প্রতি অঙ্গীকার থেকেই এই প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়েছে।
হংকংয়ে প্রতিবাদ কর্মসূচিতে যোগ দেওয়া বিক্ষোভকারীরা বলেন, আমরা সবাই বুঝতে পারছি, হংকংয়ের বিচার ব্যবস্থায় নাড়া দিচ্ছে চীন।’ তারা মনে করেন, চীন সরকার কারও ওপর অসন্তুষ্ট হলেই তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করে, যা সুষ্ঠু বিচার ব্যবস্থার বহিঃপ্রকাশ নয়।
বাংলাদেশে থেকে আপাতদৃষ্টিতে আমার মনে হচ্ছে আইনটি বাস্তবায়ন হওয়া দরকার নইলে চীনের এক স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের অপরাধীরা অন্য অঞ্চলে গিয়ে আশ্রয় নেবে। কিন্তু আবার বিক্ষোভকারীদের অবস্থান দেখে ও চীনের কৌশল দেখে মনে হচ্ছে চীন মূলত এই আইনকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করবে। হংকং-এর সমাজতন্ত্রবিরোধী ও গণতন্ত্রপন্থী জনগণকে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দেবে এবং বেইজিং-এ নিয়ে আসবে। হংকংকে অবরুদ্ধ করে ফেলবে যেভাবে জিংজিয়াংকে তারা নিয়ন্ত্রণ করে।
হংকং-এর জনগণ যে চীনকে বিশ্বাস করে না তার অনেক কারণ আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় কারণ তারা চায় নিজেরাই নিজেদের নেতা নির্বাচন করবে। কিন্তু চীন তা মানতে নারাজ। ২০১৪ সাল থেকে চীন থেকে বলা হয়, তারা হংকংয়ের প্রধান নির্বাহী বেছে নেয়ার জন্য সরাসরি নির্বাচনের অনুমতি দেবে, কিন্তু তা কেবলই তাদের অনুমোদিত প্রার্থীদের তালিকার মধ্য থেকে। এই ঘোষণার পর হংকংয়ের জনগণ বিক্ষোভে রাস্তায় নেমে আসে, কারণ তারা এমন ব্যবস্থা চায়নি। তারা চেয়েছিল পূর্ণাঙ্গ গণতান্ত্রিক নির্বাচন ব্যবস্থা।
এখন সমাধান একটাই। অপরাধী প্রত্যর্পণ আইন বাস্তবায়ন হওয়া উচিত তবে তা যেন শুধুমাত্র ফৌজদারী অপরাধের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। রাজনৈতিকভাবে সেটি যাতে ব্যবহৃত না হতে পারে সেদিকে দৃষ্টি রেখে বিক্ষোভকারীদের সাথে আলোচনা করে সমাধানে আসা আবশ্যক।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন