সম্ভবত ১১ সালের কথা। একদিন হিজবুত তাহরীরের এক সমাবেশে উপস্থিত হয়ে জানতে পারলাম খিলাফত ১৯১৯ সালে ধ্বংস হয়েছে। আমি অবাক হয়ে রইলাম। অথচ আমি ছোটবেলা থেকেই জানি খিলাফত ধ্বংস হয়েছে আলী রা.-এর শাহদাতের মাধ্যমে। খিলাফত ও মুলুকিয়াতের মধ্যে পার্থক্য জানা খুব জরুরী। যে সংগঠন এই পার্থক্য জানে না তারা ইসলামের মূল চেতনায় নেই একথা বলাই যায়। কেউ নিজেকে খলিফা দাবী করলে সেই ব্যক্তি খলিফা বা তার রাষ্ট্র খিলাফত রাষ্ট্রে পরিণত হয়না। খিলাফত ও রাজতন্ত্রের মধ্যে কিছু মৌলিক পার্থক্য রয়েছে।
প্রথমত খলীফা নির্বাচন
খিলাফতের নেতা নির্বাচনের পন্থা ছিল জনগণের মতামত ও পরামর্শের ভিত্তিতে। কেউ নিজে ক্ষমতা লাভের চেষ্টা করেননি, নিজের চেষ্টা-তদবীর দ্বারা ক্ষমতা গ্রহণ করেননি, বরং জনগণ উম্মাতের নেতৃত্বের জন্য যাকে যোগ্য মনে করতো, পরামর্শক্রমে তাঁর ওপর দায়িত্ব ন্যস্ত করতো। বায়আত (আনুগত্যের শপথ) ক্ষমতার ফল ছিল না, বরং তা ছিল ক্ষমতার কারণ। বায়আত লাভে মানুষের চেষ্টা বা ষড়যন্ত্রের আদৌ কোন ভূমিকা ছিল না বায়আত করা না-করার ব্যাপারে জনগণ সম্পূর্ণ স্বাধীন মতামতের ভিত্তিতে বায়আত করত। বায়আত লাভের আগে কেউ ক্ষমতা গ্রহণ করতেন না। যে ব্যক্তি দায়িত্ব চেয়ে নেয় সে ব্যক্তি দায়িত্বের জন্য সবচেয়ে অযোগ্য ব্যক্তি।
এ নিয়মের ব্যতিক্রম থেকেই রাজতন্ত্রের সূচনা। হযরত মুআবিয়া (রাঃ)-এর খেলাফত এ ধরনের ছিল না যে, জনগণ খলিফা করেছে বলে তিনি খলিফা হয়েছিলেন- জনগণ খলিফা না করলে তিনি খলিফা হতেন না। যেভাবেই হোক তিনি খলিফা হতে চেষ্টা করেছেন। যুদ্ধ করে তিনি খেলাফত হাসিল করেছেন। মুসলমানদের সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টির তোয়াক্কা করেননি তিনি। জনগণ তাঁকে খলীফা করেনি, তিনি শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে খলীফা হয়েছেন। খেলাফতের সূচনাকালে একবার মদীনায় ভাষণদান প্রসঙ্গে তিনি নিজে বলেছিলেন, আল্লার কসম করে বলছি, তোমাদের সরকারের দায়িত্ব গ্রহণকালে আমি এ বিষয়ে অনবহিত ছিলাম না যে, আমার ক্ষমতায় আসীন হওয়ায় তোমরা সন্তুষ্ট নও, তোমরা তো পসন্দ করো না। এ বিষয় তোমাদের মনে যা কিছু আছে, আমি তা ভালো করেই জানি। কিন্তু আমার এ তরবারী দ্বারা তোমাদেরকে পরাভূত করেই আমি তা অধিকার করেছি। [আল-বেদায়া ওয়ান নেহায়া, ইবনে কাসীর, ৮ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ১৩২।]
দ্বিতীয়ত শাসকদের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন
রাজতন্ত্রের সূচনালগ্ন থেকেই বাদশাবেশধারী খলিফারা কায়সার ও কিসরার অনুরূপ জীবনধারা অবলম্বন করে। মহানবী (সঃ) এবং চারজন খোলাফায়ে রাশেদীন যে জীবনধারা অবলম্বন করেছিলেন, তারা তা পরিহার করে। তারা শাহী মহলে বিলাসবহুলভাবে বসবাস শুরু করে। রাজকীয় দেহরক্ষী বাহিনী তাদের রাপ্রাসাদের হেফাযতে নিয়োজিত হয় এবং সর্বদা তাদের পাহারায় নিযুক্ত থাকে। তাদের এবং জনগণের মধ্যে দেহরক্ষী ও প্রহরী অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়।
খলিফারা যে ধারায় শাসন কার্য পরিচালনা করতেন, এটা ছিল তার সম্পূর্ণ বিপরীত- একেবারেই তার পরিপন্থী। তাঁরা জনগণের মধ্যে বাস করতেন। সেখানে যে কোন ব্যক্তি স্বাধীনভাবে তাঁদের সাথে সাক্ষাৎ করতে পারতো। তাঁরা হাট-বাজারে গমন করতেন এবং যে কোন ব্যক্তি তাঁদের সাথে কথা বলতে পারতো। তাঁরা জনগণের সাথে সারিবদ্ধ হয়ে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করতেন এবং জুমার খোতবায় (অভিভাষণে) আল্লার যিকর এবং দ্বীনের শিক্ষার পাশাপাশি সরকারের নীতি সম্পর্কেও জনগণকে অবহিত করতেন। তাঁদের নিজেদের এবং সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের যে কোন অভিযোগের জবাব দিতেন তাঁরা। হযরত আলী (রাঃ) প্রাণের আশংকা সত্ত্বেও মুহুর্ত পর্যন্ত কুফায় এ নিয়ম বজায় রেখেছিলেন।
তৃতীয়ত বায়তুল মালের মালিকানা পরিবর্তন
বায়তুল মাল সম্পর্কিত ইসলামী নীতি এই ছিল যে, তা খলিফা এবং তাঁর সরকারের নিকট আল্লাহ এবং জনগণের আমানত। বায়তুল মাল কখনোই শাসকের সম্পত্তি নয়। একে কারো মর্জিমতো ব্যবহারের অধিকার নেই। খলীফা বে-আইনীভাবে তাতে কিছু জমা করতে পারেন না, পারেন না তা থেকে বে-আইনীভাবে কিছু ব্যয়ও করতে। এক একটি পাই পয়সার আয়-ব্যয়ের জন্য তাঁকে জবাবদিহি করতে হয়। সাধারণ জীবন যাপনের জন্য যতটুকু প্রয়োজন, কেবল ততটুকু গ্রহণ করার অধিকার আছে তার।
রাজতন্ত্রে বায়তুল মালের এ নীতি পরিবর্তিত হয়ে যায় এবং বায়তুল মাল বাদশা ও শাহী বংশের মালিকাধীন হয়ে পড়ে। প্রজারা পরিণত হয় বাদশার নিছক করদাতায়। সরকারের নিকট হিসেব চাওয়ার কারো অধিকারই থাকে না। এ সময় বাদশাহ এবং শাহজাদাদের এমনকি তাদের গভর্ণর এবং সিপাহসালাদের (সেনাপতিদের) জীবন যে শান-শওকতের সাথে নির্বাহ হয়ে থাকে, তা বায়তুল মালকে অন্যায়ভাবে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করা ছাড়া কিছুতেই সম্ভব নয়।
চতুর্থত স্বাধীন মতামত প্রকাশে পরিবর্তন
ইসলামে 'সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজে বাধা' এটাকে কেবল মুসলমানদের অধিকারই নয়, বরং ফরয বা কর্তব্য হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। জাতির সচেতন বিবেক জনগণের বাক-স্বাধীনতা, যে কোন অন্যায় কাজে সর্বোচ্চ আসনে সমাসীন ব্যক্তির সমালোচনা এবং প্রকাশ্যে সত্য কথা বলার স্বাধীনতার ওপরই ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্রের সঠিক পথে পরিচালিত হওয়া নির্ভরশীল ছিল। খিলাফতের সময়ে জনগণের এ স্বাধীনতা সম্পূর্ণ সংরক্ষিত ছিল। খলিফারা এ জন্য শুধু অনুমতিই দিতেন না বরং এজন্য জনগণকে উৎসাহিতও করতেন। তাঁদের শাসনামলে সত্যভাষীর কণ্ঠরোধ করা হতো না বরং এ জন্য তাঁরা প্রশংসা এবং অভিনন্দন লাভ করতেন। সমালোচকদেরকে দাবিয়ে রাখা হতো না, তাদেরকে যুক্তিসঙ্গত জবাব দিয়ে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করা হতো।
কিন্তু রাজতন্ত্রের যুগে বিবেকের ওপর তালা লাগান হয়, মুখ বন্ধ করে দেয়া হয়। প্রশংসার জন্য মুখ খোল অন্যথায় চুপ থাকো – এটাই তখন রীতিতে পরিণত হয়। যদি তোমার বিবেক এতই শক্তিশালী হয় যে, সত্য ভাষণ থেকে তুমি নিবৃত্ত থাকতে না পারো তাহলে কারাবরণ, প্রাণদন্ড ও চাবুকের আঘাতের জন্য প্রস্তুত হও। তাই সে সময়ে যারা সত্য ভাষণ এবং অন্যায় কাজে বাধা দান থেকে নিবৃত্ত হননি, তাদেরকে কঠোরতম শাস্তি দেয়া হয়েছে। সমগ্র জাতিকে একটা ভীতিকর অবস্থায় রাখাই মুলুকিয়াতের লক্ষ্য। হযরত মুআ’বিয়া (রাঃ)-এর শাসনামলে আল্লার রাসূলের সাহাবী একজন সাধক ও ইবাদতগুযার এবং উম্মাতের সৎ ব্যক্তিদের মধ্যে বিশিষ্ট মর্যাদার অধিকারী হযরত হুজর ইবনে আদীর হত্যার (৫১ হিজরী) মাধ্যমে এ নতুন পলিসির সূচনা হয়। এই ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে ইবনে কাসীরের বিদায়া ওয়ান নেহায়াতে।
পঞ্চমত বিচার বিভাগের ভূমিকার পরিবর্তন
ইসলামী রাষ্ট্রের অন্যতম মূলনীতি ছিল বিচার বিভাগের স্বাধীনতা। খেলাফতে রাশেদায় খলিফারাই বিচারক নিয়োগ করলেও আল্লার ভয় এবং নিজের জ্ঞান ও বিবেক ব্যতীত অন্য কিছুরই চাপ এবং প্রভাব খাটাতো না তাঁর ওপর। কোন শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিই আদালতের কাজে হস্তক্ষেপের সাহস করতে পারতো না। এমনকি, কাযী স্বয়ং খলীফার বিরুদ্ধে রায় দিতে পারতেন এবং দিতেনও। কিন্তু রাজতন্ত্রের আগমনে অবশেষে এ নীতিরও অবসান ঘটতে থাকে।
যেসব ব্যাপারে এ খলিফা নামধারী বাদশাহদের রাজনৈতিক এবং ব্যক্তিগত স্বার্থ জড়িত ছিল, সেসব ব্যাপারে সুবিচার করার ক্ষেত্রে আদালতের স্বাধীনতা হরণ করা হয়। এমনকি শাহযাদা, গভর্নর, নেতা-কর্তা ব্যক্তি এবং রাজমহলের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলায় সুবিচার করাও অসম্ভব হয়ে পড়ে। সে সময়ের সত্যাশ্রয়ী আলেমদের সাধারণত বিচারকের আসন গ্রহণে রাযী না হওয়ার এটাই ছিল অন্যতম প্রধান কারণ আর যেসব আলেম এ শাসকদের পক্ষ থেকে বিচারকের আসন গ্রহণ করতে রাযী হতেন, তারা সুবিচার করতে সক্ষম হতেন না।
রাজতন্ত্রের যুগে রাজা বাদশাহরা ব্যক্তিস্বার্থ, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য এবং বিশেষ করে নিজেদের শাসন পাকা-পোক্ত করার ব্যাপারে শরীয়াত নির্ধারিত বিধি-বিধান লংঘন এবং তার সীমারেখা অতিক্রমে কুণ্ঠাবোধ করেনি। যদিও তাদের সময়েও দেশের আইন ইসলামীই ছিল, তাদের কেউই আল্লার কিতাব এবং রাসূলের সুন্নার আইনগত মর্যাদা অস্বীকার করেনি। এ আইন অনুযায়ী আদালত ফয়সালা করতো, সাধারণ পরিস্থিতিতে শরীয়তের বিধান অনুযায়ী সকল বিষয়ের মিমাংসা হতো। কিন্তু শাসক ও ক্ষমতাসীনদের ব্যাপারে আইন একইভাবে প্রয়োগ হতো না। তাদের জন্য অনেক অবৈধ জিনিস বৈধ হয়ে যায়।
ষষ্ঠত শূরাভিত্তিক সরকারের অবসান
ইসলামী রাষ্ট্রের অন্যতম মূলনীতি ছিল, রাষ্ট্র শাসিত হবে পরামর্শের ভিত্তিতে আর পরামর্শ নেয়া হবে এমন সব লোকের, যাদের তত্ত্বজ্ঞান, তাকওয়া, বিশ্বস্ততদা এবং নির্ভুল ও ন্যায়নিষ্ঠ মতামতের ওপর জনগণের আস্থা রয়েছে। খুলাফায়ে রাশেদীনের শাসনামলে জাতির শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তিরা তাঁদের পরামর্শদাতা ছিলেন। তাঁরা ছিলেন পরিপূর্ণ দ্বীনী জ্ঞানের অধিকারী। নিজেদের জ্ঞান এবং বিবেক অনুযায়ী পূর্ণ স্বাধীনতার সাথে তাঁরা নিরপেক্ষ মতামত ব্যক্ত করতেন। তাঁরা কখনো সরকারকে ভুল পথে পরিচালিত হতে দেবেন না- গোটা জাতির এ ব্যাপারে পূর্ণ আস্থা ছিল। এদেরকেই স্বীকার করা হতো সমগ্র মুসলিম উম্মাতের দায়িত্বশীল ব্যক্তি হিসেবে।
কিন্তু রাজতন্ত্রের আগমনে এ নীতিরও পরিবর্তন সাধিত হয়। ব্যক্তি একনায়কত্ব শূরার স্থান দখল করে। বাদশাহরা স্বাধীন মতামত দানকারীদের জ্ঞানী, পণ্ডিত, তাকওয়াবান বাদ দিয়ে তাদের পরিবর্তে তোষামোদকারীরাই ছিল বাদশাহের পরামর্শদাতা।
সপ্তমত বংশীয় এবং জাতীয় ভাবধারার তৈরি
ইসলাম জাহেলী যুগের যেসব জাতি, বংশ-গোত্র ইত্যাদির ভাবধারা নিশ্চিহ্ন করে আল্লার দ্বীন গ্রহণকারী সকল মানুষকে সমান অধিকার দিয়ে এক উম্মতে পরিণত করেছিল, রাজতন্ত্রের যুগে তা আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। বনী উমাইয়া সরকার শুরু থেকেই আরব সরকারের রূপ ধারণ করেছিল, আরব মুসলমানদের সাথে অনারব মুসলমানদের সমান অধিকারের ধারণা এ সময় প্রায় অনুপস্থিত ছিল। ইসলামী বিধানের স্পষ্ট বিরুদ্ধাচারণ করে নওমুসলিমদের ওপর জিযিয়া আরোপ করেছিলো। এর ফলে কেবল ইসলাম বিস্তারের ক্ষেত্রেই মারাত্নক অন্তরায় দেখা দেয়নি; বরং অনারবদের মনে এ ধারণাও দেখা দিয়েছে যে, ইসলামের বিজয় মূলত তাদেরকে আরবদের গোলামে পরিণত করেছে। ইসলাম গ্রহণ করেও তারা এখন আর আরবদের সমান হতে পারে না। কেবল এখানেই সীমাবদ্ধ ছিল না এ আচরণ। শাসনকর্তা, বিচারপতি এমনকি সালাতের ইমাম নিযুক্ত করার বেলায়ও দেখা হতো, সে আরব, না অনারব। কুফায় হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফের নির্দেশ ছিল, কোন অনারবকে যেন সালাতে ইমামতি না করা হয়।
মাওলানা মওদূদীর 'খিলাফত ও মুলুকিয়াত' বই অবলম্বনে
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন