আল্লাহ্ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেন, “এবং তারা নিজেদের সব কাজ পরস্পর পরামর্শের ভিত্তিতে চালায়।”(সূরা শূরাঃ ৩৮)। এ বিষয়টিকে এখানে ঈমানদারদের সর্বোত্তম গুণাবলীর মধ্যে গণ্য করা হয়েছে এবং সূরা আল ইমরানের ১৫৯ নং আয়াতে পরামর্শভিত্তিক কাজ করার আদেশ করা হয়েছে। এ কারণে পরামর্শ ইসলামী জীবন প্রণালীর একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। পরামর্শ ছাড়া সামষ্টিক কাজ পরিচালনা করা শুধু জাহেলী পন্থাই নয়, আল্লাহর নির্ধারিত বিধানের সুস্পষ্ট লংঘন।
পরামর্শের ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনার বৈশিষ্ট্যগুলো নিম্নরূপ
০১. পরামর্শের বিষয় যাদের অধিকার ও স্বার্থের সাথে সম্পর্কিত তাদের মত প্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা থাকতে হবে এবং কার্যক্ষেত্রে ব্যাপারগুলো কিভাবে পরিচালিত হচ্ছে সে বিষয়ে তাদের অবহিত রাখতে হবে। তারা যদি তাদের নেতৃত্বে কোনো ত্রুটি, অপবিপক্কতা বা দুর্বলতা দেখে তাহলে তা তুলে ধরার ও তার প্রতিবাদ করার এবং সংশোধিত হতে না দেখলে পরিচালক ও ব্যবস্থাপকদের পরিবর্তন করার অধিকার থাকতে হবে। মানুষের মুখ বন্ধ করে, হাত পা বেঁধে এবং তাদেরকে অনবহিত রেখে তাদের সামষ্টিক ব্যাপারসমূহ পরিচালনা করা সুস্পষ্ট প্রবঞ্চনা।
০২. রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব যাকেই দেয়া হবে তাকে যেনো এ দায়িত্ব সবার স্বাধীন মতামতের ভিত্তিতে দেয়া হয়। জবরদস্তি ও ভয়ভীতি দ্বারা অর্জিত কিংবা লোভ লালসা দিয়ে খরিদকৃত অথবা ধোঁকা প্রতারণা ও চক্রান্তের মাধ্যমে লুন্ঠিত সম্মতি প্রকৃতপক্ষে কোনো সম্মতি নয়। যে সম্ভাব্য সব রকম পন্থা কাজে লাগিয়ে কোনো জাতির নেতা হয় সে সত্যিকার নেতা নয়। সত্যিকার নেতা সেই যাকে মানুষ নিজেদের পছন্দানুসারে সানন্দ চিত্তে নেতা হিসেবে গ্রহণ করে।
০৩. নেতাকে পরামর্শ দানের জন্যও এমন সব লোক নিয়োগ করতে হবে যাদের প্রতি জাতির আস্থা রয়েছে। এটা সর্বজনবিদিত যে, যারা চাপ সৃষ্টি করে কিংবা অর্থ দ্বারা ক্রয় করে অথবা মিথ্যা ও চক্রান্তের সাহায্যে বা মানুষকে বিভ্রান্ত করে প্রতিনিধিত্বের স্থানটি দখল করে তাদেরকে সঠিক অর্থে আস্থাভাজন বলা যায় না।
০৪. পরামর্শদাতাগণ নিজেদের জ্ঞান, ঈমান ও বিবেক অনুসারে পরামর্শ দান করবে এবং এভাবে মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রে তাদের পূর্ণ স্বাধীনতা থাকতে হবে। এ দিকগুলো যেখানে থাকবে না, যেখানে পরামর্শদাতা কোনো প্রকার লোভ লালসা বা ভীতির কারণে অথবা কোনো দলাদলির মারপ্যাঁচের কারণে নিজের জ্ঞান ও বিবেকের বিরুদ্ধে মতামত পেশ করে সেখানে প্রকৃতপক্ষে হবে খিয়ানত ও বিশ্বাসঘাতকতা।
০৫. পরামর্শদাতাদের ‘ইজমা’র (সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত) ভিত্তিতে যে পরামর্শ নেয়া হবে, অথবা যে সিদ্ধান্ত তাদের অধিকাংশের সমর্থন লাভ করবে তা মেনে নিতে হবে। কেননা সবার মতামত জানার পরও যদি এক ব্যাক্তি অথবা একটি ছোট্ট গ্রুপকে স্বেচ্ছাচার চালানোর সুযোগ দেয়া হয় তাহলে পরামর্শ অর্থহীন হয়ে যায়। আল্লাহ একথা বলছেননা যে, “তাদরে ব্যাপার তাদের পরামর্শ গ্রহণ করা হয়” বরং বলছেন, “তাদের কাজকর্ম পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে চলে।” শুধু পরামর্শ করলেই এ নির্দেশ পালন করা হয়না। তাই পরামর্শের ক্ষেত্রে সর্বসম্মত অথবা সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুসারে কাজকর্ম পরিচালনা প্রয়োজন।
০৬. ইসলামের পরামর্শভিত্তিক রাষ্ট্র পরিচালনা নীতির এই ব্যাখ্যার সাথে সাথে এই মৌলিক কথাটির প্রতিও লক্ষ্য রাখতে হবে যে, মুসলমানদের পারস্পরিক বিষয়সমূহ পরিচালনায় এই শুরা স্বেচ্ছাচারী এবং সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী নয়। বরং অবশ্যই সেই দ্বীনের বিধি বিধান দ্বারা সীমাবদ্ধ আল্লাহ্ নিজেই যার জন্য বিধান রচনা করেছেন।
সাথে সাথে তা সেই মূল নীতিরও আনুগত্য করতে বাধ্য, যাতে বলা হয়েছে “যে ব্যাপারেই তোমাদের মধ্যে মতভেদ হবে তার ফয়সালা করবেন আল্লাহ্।” এবং “তোমাদের মধ্যে যে বিরোধই বাধুক না কেনো সে জন্য আল্লাহ্ তাঁর রসূলের দিকে ফিরে যাও।“ এই সাধারণ সূত্র অনুসারে মুসলমানরা শরয়ী বিষয়ে মূল গ্রন্থের কোন অংশের কি অর্থ এবং কিভাবে তা কার্যকর করা যায় সে বিষয়ে পরামর্শ করতে পারে যাতে তার মূল উদ্দেশ্য পূরণ হয়।
কিন্তু যেসব ব্যাপারে আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসূল সিদ্ধান্ত দিয়েছেন সে ব্যাপারে তার নিজেরা স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে এ উদ্দেশ্যে কোনো পরামর্শ করতে পারেনা।
পরামর্শদাতা গণের ব্যাপারে নির্বাচনে নজির আল্লাহর রাসূল ও খলিফাদের মধ্যে দেখা যায়নি। তবে যেটা পাওয়া যায় সেটা হলো আল্লাহর রাসূল সা. দুই ধরণের যোগ্যতার ভিত্তিতে পরামর্শ নিতেন।
১- আমানতদারী, জ্ঞানগত যোগ্যতা, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পারদর্শিতা।
২- আনসার ও মুহাজিরদের মধ্যে যারা গোত্র প্রধান।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে একটি সাজেশন এমন হতে পারে।
১- যারা একটি নির্দিষ্ট ইলমি যোগ্যতা হাসিল করবে তারাই ভোটাধিকার পাবে। কোনো প্রতারণামূলক অপরাধে তার ভোটাধিকার স্থগিত হওয়ার নিয়ম থাকতে পারে।
২- ভোটাররা তাদের বিবেক অনুসারে প্রতি জেলায় প্রতিনিধি নির্বাচন করবে।
৩- যাদেরকে প্রতিনিধি নির্বাচন করা হবে তাদের অবশ্যই নির্দিষ্ট ইলমি যোগ্যতা অর্জন করতে হবে এবং আমানতদার হতে হবে।
৪- প্রতি জেলা থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধি ও কিছু জ্ঞানী ব্যক্তির সমন্বয়ে পার্লামেন্ট গঠিত হবে।
৫- এই পার্লামেন্টই রাষ্ট্রের নেতা নির্বাচন করবে ও দেশ পরিচালনায় নেতাকে সহায়তা করবে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন