১ অক্টো, ২০১৯

আমার শিক্ষক মুমতাজুল মুহদ্দিসীন মাওলানা আবদুর রহীম


কিছু মানুষ আছেন যাদের কখনো দেখিনি। শুধু বই পড়ে উস্তাদ মেনেছি। এমনি একজন মাওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম। উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইসলামী চিন্তাবিদ, সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ, সাবেক সংসদ সদস্য, ইসলামী আন্দোলনের সিপাহসালার ছিলেন হযরত মওলানা মুহাম্মাদ অবদুর রহীম (রহ.)

জন্ম :
১৯১৮ সালের ১৯ জানুয়ারি বাংলাদেশের পিরোজপুর জেলার কাউখালি থানার অন্তর্গত শিয়ালকাঠি গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি।

শিক্ষা ও ক্যারিয়ার :
তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয় পৈতৃক বাড়িতে স্থাপিত মক্তব ও ইবতেদায়ী মাদরাসায়। পরে শর্ষীণা আলিয়া মাদরাসা থেকে আলিম এরপর কলকাতা আলিয়া মাদরাসা থেকে ১৯৪০ সালে ফাযিল এবং ১৯৪২ সালে কামিল (প্রথম শ্রেণী) ডিগ্রি লাভ করে মুমতাজুল মুহদ্দিসীন উপাধিতে ভূষিত হন। 

১৯৪৫-৪৭ সালে বরিশালের নাজিরপুর হাই মাদ্রাসা এবং ১৯৪৭ - ১৯৪৮ সালে কেউন্দিয়া-কাউখালী মাদ্রাসার হেড মাওলানা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫০ সালে বরিশালে ‘তানজীম’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা সম্পাদনা করেন।

১৯৫৯-৬০ সালে তিনি দৈনিক নাজাত পত্রিকার জেনারেল ম্যানেজার ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার, বাংলাদেশ ইসলামী ইনস্টিটিউট এবং ওআইসি-র ফিকহ একাডেমীরও সদস্য ছিলেন। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সেমিনার ও সম্মেলনে যোগদানের জন্য তিনি সৌদি আরব, ইরান, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, বার্মা, থাইল্যান্ড, বৃটেন প্রভৃতি দেশ সফর করেন। এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ১৯৭৭ সালে মক্কার বাদশাহ আবদুল আজিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বিশ্ব ইসলামী শিক্ষা সম্মেলন, ১৯৭৭ সালে করাচীতে অনুষ্ঠিত রাবেতার প্রথম এশীয় ইসলামী সম্মেলন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ছাড়াও বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠত ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠায় তাঁর চিন্তাগত অবদান রয়েছে। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা আন্দোলনেও তিনি বিশেষভাবে অবদান রাখেন।

জামায়াত ও ইসলামী রাজনীতি : 
১৯৪২ সাল থেকেই জামায়াতে ইসলামী সম্পৃক্ত হন মাওলানা আবদুর রহীম। ১৯৪৫ থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত তিনি বরিশাল বিভাগীয় জামায়াতের আমীর ছিলেন। ১৯৫০ থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর সাধারণ সম্পাদক এবং ১৯৫৫ সাল থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমীর ছিলেন। ১৯৭০ সালে তিনি পুরো পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর ছিলেন।

১৯৭১-এ পট পরিবর্তনের ফলে মাওলানা আব্দুর রহীম আর এদেশে আসতে পারেননি। আর তাছাড়া তিনি পাকিস্তানে নায়েবে আমীরের দায়িত্বও পালন করছিলেন। ১৯৭৪ সালে তিনি পাকিস্তান জামায়াত থেকে ইস্তফা দিয়ে নিজ দেশ বাংলাদেশে ফিরে আসেন ও বাংলাদেশ জামায়াতে যোগ দেন। তখন জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমীর আব্বাস আলী খান। জামায়াত আন্ডারগ্রাউন্ডে একটিভ ছিলো। 

১৯৭২ সাল থেকে তিনি প্রত্যক্ষ রাজনীতির পরিবর্তে সাহিত্য সাধনায় নিয়োজিত হন। ১৯৭৫ সালে দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর তিনি উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেম এবং রাজনৈতিক নেতা খতিবে আজম মাওলানা সিদ্দিক আহমদ (রহ.) এর নেতৃত্বে নেজামে ইসলাম পার্টি, জামায়াতে ইসলামী, পি.ডি.পি. খেলাফতে রাব্বানী প্রভৃতি দল সমন্বয়ে ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ছিলেন এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সহ-সভাপতি। 

বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশ ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ ভেঙ্গে গেলে তিনি ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ (আইডিএল) জামায়াত গ্রুপের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে আইডিএল মুসলিম লীগ নির্বাচনী জোটের প্রার্থী হিসেবে তিনি জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। সংসদে তিনি আইডিএল পার্লামেন্টারী গ্রুপের নেতা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।

জামায়াত যখন নিজ নামে আবার রাজনীতিতে আত্মপ্রকাশ করতে যায় তখন মাওলানা আব্দুর রহীমসহ জামায়াতের মধ্যকার একটি পক্ষ চান নতুন করে জামায়াত আর রাজনীতিতে না আসুক। জামায়াত যেন ইসলাহ টাইপের একটি দল হিসেবে থাকে। মাওলানার যুক্তি ছিলো জামায়াতের বিরুদ্ধে কিছু আলেম ওলামাদের অবস্থান যা ছিলো তা আর থাকবে না। এছাড়া জামায়াতের বিরুদ্ধে যত প্রকার অভিযোগ আছে সেগুলো আর কাঁধে নিতে হবে না। এছাড়া আইডিএলের প্রধান শক্তি জামায়াত তাই আইডিএলকে সহজেই জামায়াতিকরণ করা যাবে। 

অন্যদিকে অন্যান্য শুরা সদস্যরা এই প্রস্তাবটিকে সমর্থন জানান নি। তারা দাবি ছিলো আইডিএল থাকবে জোট হিসেবে (যেভাবে আছে)। আর জামায়াত তার নিজস্ব এজেন্ডা নিয়ে অগ্রসর হবে। জামায়াতের এজেন্ডা কখনোই আইডিএলে বাস্তবায়ন করা যাবে না। কারণ জামায়াতের রাজনৈতিক কর্মকান্ডের চাইতেও বেশি রয়েছে লোক গঠনের এজেন্ডা। 

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো এই অঞ্চলে জামায়াতই মুসলিমদের মধ্যে এই জাগরণ ঘটয়েছে যে, রাজনীতি ইসলামের বাইরে নয়। ইসলাম ব্যক্তিজীবনের জন্য নয়, বরং সামগ্রিক জীবন ব্যবস্থার নাম। অতএব জামায়াত যখন রাজনীতি থেকে দূরে সরে যাবে তখন ইসলামের যে তাজদিদ জামায়াত শুরু করেছে তা ব্যর্থতায় পরিণত হবে। 

অতএব শুরায় জামায়াত নিজ নামে রাজনীতিতে কাজ শুরু করার ক্ষেত্রে অধিকাংশ শুরা মেম্বার মত দেন। ৪২ জন শুরা সদস্যের মধ্যে ৪০ জনই জামায়াত নাম নিয়ে রাজনীতিতে একটিভ হওয়ার পক্ষে তাদের মতামত ব্যক্ত করেন।

জামায়াতের শুরার এই মতামত মেনে নিতে পারেননি মুমতাজুল মুহদ্দিসীন খ্যাত মাওলানা আব্দুর রহীম। তিনি আইডিএলকে একটি দলে পরিণত করার চেষ্টা করে গিয়েছেন। ওনার সহযোগী হিসেবে ছিলেন কুষ্টিয়ার এড. সা'দ আহমদ ও পাবনার মাওলানা আব্দুস সুবহান। এভাবেই তিনি জামায়াত ছেড়ে চলে যান। তিনি ভেবেছেন আইডিএলের মাধ্যমে সহজে ইসলাম প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে। মাওলানা আব্দুস সুবহান অবশ্য কিছুকাল পরেই আবার জামায়াতে যোগদান করেন। ১৯৮১ সালে আইডিএল প্রার্থী হিসেবে মাওলানা আব্দুর রহীম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন।

পরবর্তীতে তিনি বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা হযরত মাওলানা মোহাম্মদ উল্লাহ হাফেজ্জী হুজুরের নেতৃত্বে ১১টি ইসলামী সংগঠনের সমন্বয়ে সম্মিলিত খেলাফত সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে গোটা দেশব্যাপী ব্যাপক গণ-জোয়ার এবং গণ-আন্দোলন গড়ে তোলেন। তিনি কয়েকটি ইসলামী রাজনৈতিক দল, আলেম, পীর মাশায়েখদের সমন্বয়ে “ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন” গড়ে তোলেন। রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছাড়াও তিনি বহু সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলেন।

সাহিত্য ও লেখালেখি :
কৈশোরেই মওলানা আবদুর রহীমের মধ্যে সাহিত্য প্রতিভার উন্মেষ ঘটে। তাঁর সাহিত্যিক বড় ভাইয়ের উৎসাহ ও প্রেরণায় তিনি বাংলাভাষা ও সাহিত্যচর্চার প্রতি প্রবলভাবে অনুরক্ত হন। এপর্যায়ে ছোটখাট কিছু পত্র-পত্রিকায় তিনি লেখালেখির কাজও শুরু করেন। সাড়ে ১২ বছর বয়সে তাঁর প্রথম রচনা প্রকাশিত হয়, পটুয়াখালীর একটি স্কুল ম্যাগাজিনে। এরপর কলকাতা আলিয়া মাদরাসায় ফাযিল শ্রেণীতে অধ্যায়নকালে আবুল মনসুর আহমদ সস্পাদিত দৈনিক কৃষক, মওলানা আকরম খাঁ সম্পাদিত দৈনিক আজাদ, সুন্নাতুল জামাত ইত্যাকার পত্রিকায় তিনি নিয়মিত লেখালেখি করতেন।

১৯৫০ সালে তাঁর প্রথম বই ‘কালেমা তাইয়্যেবা’ প্রকাশিত হয়। এদেশের ইসলামী চিন্তার ক্ষেত্রে এ বইটির প্রকাশনা ছিল একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। কেননা কালেমা তাইয়্যেবা ইসলামের মূলমন্ত্র হলেও এ দেশের সাধারণ জনগণ এ কালেমার সঠিক তাৎপর্য জানতেন না।

বাংলা ভাষায় তিনি শুধু ইসলামী সাহিত্যের কলেবরই বৃদ্ধি করেননি, এ ভাষাকে ইসলামী বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল করতেও তিনি অসামান্য ভূমিকা রেখেছেন। চল্লিশের দশক অবধি বাংলা ভাষায় ইসলামী ভাবধারা প্রকাশের উপযোগী কোনো পরিভাষা ছিল না। এর প্রায় সমগ্র পরিভাষাই ছিল শিরক ও পৌত্তলিকতাদুষ্ট। মওলানা আবদুর রহীম নতুন নতুন ইসলামী পরিভাষা উদ্ভাবন করে বাংলা ভাষাকে শিরক ও পৌত্তলিকতার জঞ্জাল থেকে বহুলাংশে মুক্ত করেন এবং ইসলামী সাহিত্যচর্চার পথ সুগম করে তোলেন। তিনিই প্রথম বাংলায় ‘ইসলামী জীবনব্যবস্থা’, ‘ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা’, ‘ইসলামী শাসনতন্ত্র’, ‘ইসলামী অর্থব্যবস্থা’ এই পরিভাষাগুলো চালু করেন।

মাওলানা আবদুর রহীমের মৌলিক গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় ৭০ এবং অনূদিত গ্রন্থের সংখ্যাও প্রায় ৭০। ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ তাঁর মেধা ও প্রতিভার মূল্যায়ন করে ১৯৭৭ ও ১৯৮৩ সালে তাঁকে মৌলিক গবেষণা ও অনুবাদ কর্মের জন্যে দুটি পুরস্কার দিয়েছে।

মাওলানা আব্দুর রহিম-এর গ্রন্থসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, ‘বর্তমান বিশ্বে ইসলামের পুনর্জাগরণের সম্ভাবনা’, ‘মানবতা বিধ্বংসী দু’টি মতবাদ’, ‘ইসলামে ভূমি, কৃষি, শিল্প ও শ্রম আইন’, ‘হাদিসের আলোকে সমাজজীবন’, ‘বিশ্ব সভ্যতার মুক্তি কোন পথে’, ‘ইসলামী সভ্যতায় নারীর মর্যাদা’, ‘সুরায়ে ফাতেহায় তফসীর’, ‘বিশ্ব মানবতার মুক্তি সনদ’, ‘ঈমানের অগ্নি পরীক্ষা’, ‘জিয়ারাতে বায়তুল্লাহ’, ‘পরকালের সাথী’, ‘বেহেশতের চাবি’, ‘যুগের দুর্জন’, ‘নাজাতের পথ’, ‘ইসলাম পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান’, 'পরিবার ও পারিবারিক জীবন' ইত্যাদি।

১৯৮৭ সালের ১ অক্টোবর তিনি আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে পরপারে চলে যান। আজিমপুর গোরস্তানে তাঁকে সমাহিত করা হয়।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন