ইংরেজরা বাংলা দখলের পর বাংলার মুসলিমরা ব্যাপক অত্যাচার ও নির্যাতনের মুখোমুখি হয়। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয় মুসলিমদের শিক্ষাব্যবস্থা। মুসলিমদের সবক'টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়। মুসলিম পণ্ডিত ও বিদ্বান ব্যাক্তিদের হত্যা করা হয়। সেসময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যা মাদরাসা নামে পরিচিত ছিলো সেখানে ধর্মীয় জ্ঞানের পাশাপাশি জাগতিক জ্ঞান চর্চাও সমানতালে হতো। কিন্তু ইংরেজরা বুঝতে পেরেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু থাকলে মুসলিমদের জাতিসত্তা টিকে থাকবে। তাই তারা মুসলিমদের শিক্ষাগ্রহণ বন্ধ করে দেয়। এভাবে দুই দশকের মধ্যেই বাঙালি শিক্ষার আলো থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একটি অন্ধকারচ্ছন্ন ও পশ্চাতপদ গোষ্ঠীতে পরিণত হয়।
এছাড়াও তারা মুসলমানদের হাত থেকে খাজনা আদায়ের তারা প্রজাদের উপরে শুরু করলো নির্মম শোষণ-পীড়ন। ব্রিটিশ নিম্নমানের বস্ত্রের বাজার সৃষ্টির জন্যে বাঙালি তাঁতীদের নির্মূল করার কাজ শুরু হলো। তাদের আঙ্গুল কেটে দেওয়া হয় যাতে তারা তাঁত চালাতে না পারে। ১৭৬৬ সালে প্রতিমণ লবণের উপর দু’টাকা হারে কর ধার্য করে লবণ ব্যবসা ইউরোপীয়দের একচেটিয়া অধিকারে নেয়া হলো। এভাবে মুসলমানরা সকল অর্থনৈতিক ক্ষেত্র থেকে বিতাড়িত হয়ে দারিদ্র্যে নিষ্পেষিত হতে লাগলো। আমাদের শিক্ষা, শিল্প ও অর্থনীতি পুরোপুরি পঙ্গু হয়ে যায়।
শুধু তাই নয়, ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পালনেও মুসলমানরা বাধাগ্রস্ত হতে লাগলো। অত্যাচারী হিন্দু জমিদারদের এলাকায় গো-কুরবানী এবং আজান দেয়া নিষিদ্ধ হলো। হিন্দু জমিদারগণ মুসলমান প্রজাদের দাড়ির উপরে ট্যাক্স ধার্য করলো। তাদের পূজা-পার্বণে মুসলমানদেরকে চাঁদা দিতে, পূজার যোগন ও বেগার দিতে বাধ্য করা হলো। মুসলমানদেরকে ধূতি পরতে ও দাড়ি কামিয়ে গোঁফ রাখতে বাধ্য করা হলো। মুসলমানদের ধর্ম, তাহজিব-তমদ্দুনকে ধ্বংস করে হিন্দুজাতির মধ্যে একাকার করে ফেলার এক সর্বনাশা পরিকল্পনা শুরু হলো। ধর্মপ্রাণ মুসলমান হয়ে উঠলো দিশেহারা। এর মধ্যে পর্যাপ্ত ধর্মীয় জ্ঞান না থাকায় মুসলিমরা হিন্দুদের অনুকরন করতে শুরু করে। মুসলিমদের মধ্যে প্রচুর শিরকি ও বিদআতি কর্মকাণ্ড পরিলক্ষিত হয়।
বাংলার মুসলমানদের এ চরম দুর্দিনের সময় ১৮২০ সালে ফরায়েজি আন্দোলনের সূচনা করে হাজী মুহাম্মদ শরিয়তুল্লাহ। তিনি ১৭৮৪ সালে ফরিদপুর জেলার বন্দর পরগণায় জন্মগ্রহণ করেন হাজী শরীয়তুল্লাহ। হাজি শরীয়তউল্লাহ ইসলামের পাঁচটি মৌল আদর্শের উপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব আরোপ করেন। তাওহীদে পরিপূর্ণ বিশ্বাস ও পূর্ণ অনুশীলনের উপর তিনি জোর দেন এবং মূল বিশ্বাস বা মতবাদ থেকে যে কোন বিচ্যুতিকে তিনি ‘শির্ক’ ও ‘বিদাত’ বলে ঘোষণা করেন। জন্ম, বিবাহ ও মৃত্যুর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বহুসংখ্যক আচার অনুষ্ঠান যেমন ছটি, পট্টি, চিল্লা, শাবগাস্ত মিছিল, ফাতিহা, মিলাদ ও ওরস নিষিদ্ধ করেন। পীরপূজা, পীরের প্রতি অতিশ্রদ্ধা প্রদর্শন, মহরমে তাজিয়া নির্মাণকেও শির্ক বলে ঘোষণা করেন। তিনি ন্যায়বিচার, সামাজিক সাম্য এবং মুসলমানদের সার্বজনীন ভ্রাতৃত্বের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন এবং সর্বপ্রকার সামাজিক বৈষম্য ও বর্ণগত কুসংস্কার বিলোপ সাধনের তত্ত্ব প্রচার করেন।
হাজী শরীয়তউল্লাহ বাংলায় ব্রিটিশ শাসনকে মুসলমানদের আধ্যাত্মিক জীবনের জন্য ক্ষতিকর বলে বিবেচনা করতেন। হানাফি আইনের অনুসরণে তিনি মত প্রকাশ করেন যে, বাংলায় বৈধভাবে নিযুক্ত একজন মুসলিম শাসকের অনুপস্থিতি মুসলমানদের জুমআর নামাজের জামায়াত অনুষ্ঠানের সুযোগ হতে বঞ্চিত করেছে। এ মত ছিল ফরায়েজী আন্দোলনের একটি ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য যা একে ওই সময়ের অপরাপর পুনর্জাগরণবাদী আন্দোলন থেকে আলাদা করে তুলেছে।
দিল্লীতে শাহ্ আবদুল আযীয দেহলভীর নেতৃত্বে ভারতভূমিতেও আবদুল ওহাব নজদীর অনুকরণে ইসলামী সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়, যা ‘ওহাবী আন্দোলন’ নামে পরিচিত ছিলো। তিনি ভারতবর্ষকে ‘দারুল হরব’ বলে ঘোষণা করেন এবং ‘দারুল হরব’কে ‘দারুল ইসলাম’ তথা একটি ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করার সক্রিয় আন্দোনে আত্মনিয়োগ করেন। সাইয়্যেদ আহমদ বেরেলভী, শাহ্ আবদুল আযীযের ভ্রাতুষ্পুত্র শাহ ইসমাইল ও জামাতা মাওলানা আবদুল হাই। হাজী শরীয়তুল্লাহও এ দেশকে ‘দারুল হরব’ ঘোষণা করেন এবং যতোদিন এ দেশ ‘দারুল ইসলাম’ না হয়েছে ততোদিন এখানে ‘জুমা’ ও ঈদের নামাজ সংগত নয় বলে ঘোষণা করেন। হিন্দুর পূজা-পার্বণে কোন প্রকার আর্থিক অথবা দৈহিক সাহায্য-সহযোগিতা ইসলাম-বিরুদ্ধ (শিরক ও হারাম) বলে অভিহিত করেন। তিনি আরও বলেন, মুসলমানদেরকে ধূতি ছেড়ে তহবন্দ-পায়জামা পরিধান করতে হবে, দাড়ি রাখতে হবে এবং সকল প্রকার কুসংস্কার থেকে তওবা করতে হবে। মোটকথা যাবতীয় পাপকাজ পরিত্যাগ করে নতুনভাবে ইসলামী জীবন যাপন করতে হবে।
শোষিত-বঞ্চিত ও নিষ্পেষিত মুসলমান জনসাধারণ হাজী শরীয়তুল্লাহর আহবাদে নতুন প্রাণসঞ্চারণ অনুভব করলো এবং দলে দলে তাঁর কাছে দীক্ষা গ্রহণ করতে লাগলো। অল্প সময়ের মধ্যে দশ হাজার মুসলমান তাঁর দলভুক্ত হলো। এটা হলো হিন্দু জমিদারদের পক্ষে এক মহাআতংকের ব্যাপার। এখন মুসলমান গ্র নিষ্পেষণ বন্ধ হয়ে যাবে এবং যেসব নিম্নশ্রেণীর দরিদ্র মুসলমানদেরকে তারা তাদের দাসানুদাসে পরিণত করে ইসলাম ধর্ম থেকেও দূরে নিক্ষেপ করেছে, তারাও তাদের হাতছাড়া হয়ে যাবে। অতএব, তাদের উদ্বিগ্ন ও আতংকিত হয়ে উঠারই কথা।
হাজী শরীয়তুল্লাহ্কে দমন করার জন্যে ঐক্যবদ্ধ ও বদ্ধপরিকর হলো হিন্দু জমিদারগণ। তাঁদের দলে যোগদান করলো কিছু সংখ্যক স্বার্থান্বেষী আধা-মুসলমান যারা ছিল হিন্দু জমিদারদের দাসানুদাস। অদূরদর্শী মোল্লা-মৌলভী ও পীর, যারা মুসলমানদের মধ্যে শিরক বিদয়াত প্রভৃতি কুসংস্কারের নামে দু’পয়সা কামাই করছিল, তারাও ফরায়েজী আন্দোলনের বিরুদ্ধে দাঁড়ালো। একদিকে ব্রিটিশ এবং অপরদিকে অত্যাচারী হিন্দু জমিদার মহাজনদের উপর্যুপরি অত্যাচার-নিষ্পেষণে মুসলমানরা অনন্যোপায় হয়ে মাথানত করে সবকিছু সহ্য করে যাচ্ছিল। শরীয়হতুল্লাহর আহ্বানে নিপীড়িত মুসলমানগণ দলে দলে তাঁর কাছে এসে জমায়েত হতে লাগলো এবং ব্রিটিশ ও হিন্দুদের বিরুদ্ধে এক দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলার শপথ গ্রহণ করলো।
হাজী শরিয়ত উল্লাহ ফরজের উপর বেশি গুরুত্বারোপ করেছিলেন বলেই ওনার ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন ফরায়েজি নাম লাভ করে। তিনি যাবতীয় ইসলাম বিরোধী রীতিনীতি পরিত্যাগ করে নবী মুহাম্মদ সা. প্রতিষ্ঠিত ইসলামের বিরোধী রীতিনীতি পরিত্যাগ করে নবী মুহম্মদের সা.-এর প্রতিষ্ঠিত ইসলামের পুনঃপ্রতিষ্ঠাই ছিল আরবের মুহাম্মদ বিন আবদুল ওহাব নজদী, সাইয়্যেদ আহমদ শহীদ, হাজী শরীয়তুল্লাহ, সৈয়দ নিসার আলী ওরফে তীতুমীর প্রমুখ মনীষীদের আন্দোলনের মুখ্য উদ্দেশ্য। এটিই ছিলো বাংলায় প্রথম ইসলামী আন্দোলন তথা খিলাফত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। এই আন্দোলন মুখ্যত ইংরেজবিরোধী না হলেও এর ফলে মুসলিমরা আত্মসচেতন হয়ে উঠেছে যা শাসকরা ভালো চোখে দেখেনি।
ঢাকা জেলার নয়াবাড়ী নাম স্থানে প্রথমে শরীয়তুল্লাহর নতুন কর্মক্ষেত্র স্থাপিত হয়। কিন্তু হিন্দু জমিদারদের চরম বিরোধিতার ফলে তাঁকে আপন গ্রামে ফিরে গিয়ে তাঁর প্রচারকার্য শুরু করতে হয়। তাঁর আন্দোলন ঢাকা, বরিশাল, নদীয়া, পাবনা, ময়মনসিংহ প্রভৃতি জেলায় বিস্তার লাভ করে। নিরক্ষর, চাষী, তাঁতী ও অন্যান্য সাধারণ মুসলমানদের নামাজ-রোজার প্রচলন, ধুতির পরিবর্তে তহবন্দ-টুপির ব্যবহার, মসজিদগুলির সংস্কার প্রভৃতি কাজ পূর্ণ উদ্যমে চলতে থাকে। হাজী শরীয়তুল্লাহ্ নিজে মাথায় প্রকাণ্ড পাগড়ী ও গায়ে জামার উপরে হুদরিয়া পরতেন যে পোশাক সাধারণত: কোন মুসলমান ব্যবহার করতো না। ১৮৪০ সালে তিনি পরলোক গমন করার পর তাঁর যোগ্য পুত্র দুদু মিয়া তাঁর আন্দোলন অব্যাহত রাখেন।
হাজী শরীয়তুল্লাহর পুত্র মোহাম্মদ মুহসীন ওরফে দুদু মিয়া ১৮১৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন। ১৮৩১ সালে তিনি হজ্ব পালনের জন্যে মক্কা গমন করে পাঁচ বৎসর অবস্থান করেন এবং প্রত্যাবর্তনের পর পিতার কাজে সাহায্য করেন।
পিতার ন্যায় দুদু মিয়াও অত্যাচারী জমিদারদের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন। জমিদারদের সংগে তাঁকে বার বার সংঘর্ষে আসতে হয়। ১৮৪২ সালে তিনি ফরিদপুরের জমিদার বাড়ী আক্রমণ করেন এবং মদন নারায়ণ ঘোষকে বন্দী ও পরে হত্যা করেন। পুলিশ তাঁকেসহ ১১৭জন ফরায়েজীকে গ্রেফতার করে। বিচারে ২২ জনের কারাদণ্ড হয়। কিন্তু দুদু মিয়াকে প্রমাণের অভাবে খালাস দেয়া হয়। ১৮৪৬ সালে এনড্রিও এন্ডারসন এর গোমস্তা কালি প্রসাদ মনিবের আদেশে সাত আটশ’ লোক নিয়ে দুদু মিয়ার বাড়ী চড়াও করে এবং প্রায় দেড় লক্ষ টাকা মূল্যের অলংকারাদিসহ বহু ধনসম্পদ লুণ্ঠন করে নিয়ে যায়।
জমিদার ও নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিচারপ্রার্থী হয়ে কোন সুবিচার না পেয়ে দুদু মিয়া এবার নিজ হাতে শত্রুদের উচিত শাস্তি দিতে মনস্থ করেন। ১৮৪৬ সালর নভেম্বর মাসে, তাঁর গৃহ লুণ্ঠিত হওয়ার একমাস পরে, তিনি শত্রুদের অত্যাচার-উৎপীড়নের ইন্ধন সংযোগকারী নীলকর ডানলপের কারখানা অগ্নিসংযোগে ভস্মীভূত করে দেন এবং গোমস্তা কালী প্রসাদকে হত্যা করেন। দুই বৎসর পর্যন্ত মামলা চলার পর দুদু মিয়া তাঁর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পান। জনসাধারণের মধ্যে দুদু মিয়ার অসাধারণ প্রভাব প্রতিপত্তি লক্ষ্য করে সরকার বিব্রত হয়ে পড়েন। ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ তথা সিপাহী বিদ্রোহ চলাকালে দুদু মিয়া উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারেন এই অজুহাতে তাঁকে কারাগারে আটক করে রাখা হয়। প্রথমে আলীপুরে এবং পরে তাঁকে ফরিদপুর জেলে রাখা হয়। ১৮৫৯ সাল মুক্তিলাভ করে তিনি ঢাকায় আসেন এবং এখানেই তাঁর মৃত্যু হয়।
দুদু মিয়া পিতার আন্দোলনকে অধিকতর শক্তিশালী করেছিলেন। হাজী শরীয়তুল্লাহ যে ছয়টি বিষয়ের উপর তাঁর আন্দোলনে ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন তা হচ্ছে- মুসলমান শাসিত দেশ ব্যতীত অন্য কোথাও জুমা ও ঈদের নামায বৈধ নয়; মহররমের পর্ব ও অনুষ্ঠান পালন ইসলাম বিরুদ্ধ এবং পাপকার্য; ‘পীর’ ও ‘মুরীদ’ পরিভাষাদ্বয়ের স্থলে ‘উস্তাদ’ ও ‘শাগরেদ’ পরিভাষাদ্বয়ের ব্যবহার। কারণ ‘মুরীদ’ তার যথাসর্বস্ব ‘পীরের’ কাছে সমর্পণ করে যা ঠিক নয়। পক্ষান্তারে ‘শাগরেদকে’ তা করতে হয় না।
এ আন্দোলনে যারাই যোগদান করবে তাদের মধ্যে উচ্চ-নীচ, ‘আশরাফ’-‘আতরাফ’ কোন ভেদাভেদ থাকবে না। তৎকালে পীরের হাতে হাত রেখে ‘বায়াত’ করার যে প্রথা প্রচলিত ছিল, তার পরিবর্তে ‘ফরায়েজী’ আন্দোলনে যোগদানকারী শুধুমাত্র সকল পাপ কাজ থেকে খাঁটি দিলে ‘তওবা’ করে পরিপূর্ণ ইসলামী জীবন-যাপন করার শপথ গ্রহণ করবে। জেমস টেইলর বলেন যে, কোরআনকে অক্ষরে অক্ষরে পালন করাই ফরায়েজী আন্দোলনের উদ্দেশ্য এবং কোরআন যেসব অনুষ্ঠানাদি সমর্থন করে না তা সবই বর্জনীয়। মহররমের অনুষ্ঠান পালনই শুধু নিষিদ্ধ নয়, এ অনুষ্ঠানের ক্রিয়াকলাপ দেখাও নিষিদ্ধ।
হাজী শরীয়তুল্লাহর মৃত্যুর পর আন্দোলনকে জোরদার করার জন্যে দুদু মিয়া সমগ্র পূর্ববাংলা কয়েকটি এলাকায় বিভক্ত করেন এবং প্রত্যেক এলাকায় একজন করে খলিফা নিযুক্ত করেন যাদের কাজ ছিল আন্দোলনের দিকে মানুষকে আহ্বান করা, কর্মী সংগ্রহ করা ও সংগঠন পরিচালনার জন্যে অর্থ সংগ্রহ করা।
হাজী শরীয়তুল্লাহর জিবদ্দশায় যে আন্দোলন পরিচালিত ছিল, তা ছিল মুখ্যত: ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন। অত্যাচারী জমিদারদের প্ররোচনায় দু’-একটি সংঘর্ষ ব্যতীত কায়েমী স্বার্থের বিরুদ্ধে, তাঁর আন্দোলনের সংঘর্ষ হয়নি। কিন্তু দুদু মিয়ার সময়ে আন্দোলন অনেকটা রাজনৈতিক রূপ ধারণ করে। সকল জমিদার ও নীলকরগণ তাঁর আন্দোলনের বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ হয়। তাই দুদু মিয়ার সারা জীবন তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেই কেটে গেছে। একদিকে গরীব প্রজাদের উপর জমিদার-নীলকরদের নানাপ্রকার উৎপীড়ন এবং তাদের দুঃখ মোচনে দুদু মিয়ার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা তাদেরকে দুদু মিয়ার নেতৃত্বে একতাবদ্ধ করে। দুদু মিয়ার সাংগঠনিক যোগ্যতাও ছিল অসাধারণ। বাংলার জমিদারগণ ছিলো প্রায়ই হিন্দু এবং নীলকরগণ ছিল ইংরেজ খৃষ্টান ও তাদের গোমস্তা কর্মচারী ছিল সবই হিন্দু। এ কারণেও কৃষক প্রজাগণ জমিদার-নীলকরদের বিরুদ্ধে দুদু মিয়ার নেতৃত্বে একতাবদ্ধ হয়েছিল। দুদু মিয়াকে সারা জীবন জমিদার-নীলকরদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতেই কেটে গেছে। নিত্য নতুন মিথ্যা মামলা-মোকদ্দমায় তাঁকে জড়িত করা হয়। এসবের জন্যে তাঁকে শেষ পর্যন্ত দারিদ্র্য বরণ করতে হয়।
ফরায়েজীগণ তাদের ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মানুশীলনে কতিপয় স্বাতন্ত্র্যসূচক বৈশিষ্ট্যসহ হানাফি মযহাবের অনুসারী ছিল। ঐ বৈশিষ্ট্যগুলিকে মোটামুটি পাঁচটি ফরায়েযী মতবাদের অন্তর্ভুক্ত করা যায়:
১. তওবা অর্থাৎ আত্মার পরিশুদ্ধির লক্ষ্যে অতীত পাপের জন্য অনুতপ্ত হওয়া,
২. ফরজ বা অবশ্য পালনীয় কর্তব্যসমূহ কঠোরভাবে পালন করা,
৩. কুরআন নির্দেশিত তৌহিদ বা একেশ্বরবাদ,
৪. ভারতবর্ষ ‘দারুল হরব’ বিধায় এখানে জুমআ ও ঈদের জামাত অনুষ্ঠান অত্যাবশ্যকীয় নয়,
৫. কুরআন ও সুন্নাহ বহির্ভূত সকল লোকাচার ও অনুষ্ঠানকে ‘বিদাত’ বলে পরিহার করা। পীর ও ‘মুরিদ’ অভিধার পরিবর্তে ফরায়েজীদের নেতাকে ‘ওস্তাদ’ বা শিক্ষক এবং তার অনুসারীদের ‘শাগরিদ’ বা শিষ্য বলা। ফরায়েজী জামায়াতে অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিকে ‘মুসলিম’ বা ‘মুমিন’ বলা।
সংগঠন ফরায়েজীদের সংগঠিত করার ক্ষেত্রে দুদু মিয়ার দুটি লক্ষ্য ছিল:
১. হিন্দু জমিদার ও ইউরোপীয় নীলকরদের অত্যাচার থেকে ফরায়েজী কৃষক সম্প্রদায়কে রক্ষা করা এবং
২. জনগণের জন্য সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা।
প্রথম লক্ষ্যটি অর্জনের জন্য দুদু মিয়া এক স্বেচ্ছাসেবক লাঠিয়াল বাহিনী গড়ে তোলেন এবং তাদের জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। দ্বিতীয় উদ্দেশ্যটি অর্জনের জন্য তিনি ফরায়েজীদের নেতৃত্বে সনাতন স্থানীয় সরকারব্যবস্থা (পঞ্চায়েত) পুনঃপ্রবর্তন করেন। প্রথমোক্তটি ‘সিয়াসতি’ বা রাজনৈতিক শাখা এবং পরেরটি ‘দ্বীনি’ বা ধর্মীয় শাখা হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। পরবর্তী সময়ে এ দুটি শাখা একীভূত করে ‘খিলাফত’ ব্যবস্থার রূপ দেওয়া হয়।
ফরায়েজী খিলাফত পরিকল্পনার লক্ষ্য ছিল সকল ফরায়েজীকে দুদু মিয়ার ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রতিনিধিদের (খলিফা) প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে আনা। খলিফাদের এই পরম্পরায় সর্বোচ্চ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত ছিলেন ‘ওস্তাদ’ দুদু মিয়া। তিনি তিন পদমর্যাদার খলিফা নিয়োগ করেন: উপরস্থ খলিফা, তত্ত্বাবধায়ক খলিফা ও গাঁও খলিফা। দুদু মিয়া ফরায়েজী বসতি এলাকাকে ৩০০ থেকে ৫০০ পরিবারের এক একটি ছোট এককে বিভক্ত করেন এবং প্রতি এককে একজন গাঁও বা ওয়ার্ড খলিফা নিযুক্ত করেন। অনুরূপ দশ বা তদোধিক একক নিয়ে একটি সার্কেল বা গির্দ গঠিত হতো। প্রতিটি সার্কেল বা গির্দে একজন করে তত্ত্বাবধায়ক খলিফা নিয়োজিত হতেন। তত্ত্বাবধায়ক খলিফাকে একজন পিয়ন ও একজন পেয়াদা বা পাহারাদার দেওয়া হতো। এই পিয়ন ও পেয়াদারা একদিকে তত্ত্বাবধায়ক খলিফার সঙ্গে গাঁও খলিফাদের এবং অন্যদিকে তত্ত্বাবধায়ক খলিফা ও ওস্তাদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করত। ‘উপরস্থ খলিফা’গণ ছিলেন ওস্তাদের উপদেষ্টা এবং তারা ফরায়েজী আন্দোলনের প্রধান কার্যালয় বাহাদুরপুরে ওস্তাদের সঙ্গে অবস্থান করতেন।
গাঁও খলিফা একজন সমাজপতির ভূমিকা পালন করতেন যার দায়িত্ব ছিল ধর্মীয় শিক্ষা বিস্তার, ধর্মীয় কর্তব্য পালনে লোককে উদ্বুদ্ধ করা, খানকাহও মসজিদ সংরক্ষণ, নৈতিকতা পর্যবেক্ষণ এবং বয়োজ্যেষ্ঠদের সঙ্গে পরামর্শক্রমে বিচারকার্য সম্পন্ন করা। কুরআন শিক্ষা এবং ছেলেমেয়েদের প্রাথমিক শিক্ষাদানের লক্ষ্যে একটি মকতব পরিচালনাও তার দায়িত্ব ছিল। তত্ত্বাবধায়ক খলিফার প্রধান দায়িত্ব ছিল গাঁও খলিফাদের কার্যক্রম তত্ত্বাবধান করা, তার অধীনস্থ গির্দের ফরায়েজীদের কল্যাণের প্রতি লক্ষ রাখা, ধর্মের মৌলনীতি প্রচার এবং সর্বোপরি গাঁও খলিফাদের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত কোন আপিল মামলার নিষ্পত্তি করা। এরূপ ক্ষেত্রে তিনি তার গির্দের খলিফাদের সমন্বয়ে গঠিত পরিষদে বসে আপিল মামলার শুনানি গ্রহণ করতেন। ধর্মীয় ও রাজনৈতিক সকল বিষয়ে দুদু মিয়ার সিদ্ধান্তই ছিল চূড়ান্ত এবং ওস্তাদ হিসেবে তিনি চূড়ান্ত আপিল আদালত হিসেবে কাজ করতেন।
দুদু মিয়ার মৃত্যুর পর তাঁর প্রথম ও দ্বিতীয় পুত্র যথাক্রমে গিয়াসউদ্দীন হায়দার ও নয়া মিয়া ফারায়েজী আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। নয়া মিয়ার মৃত্যুর পর দুদু মিয়ার তৃতীয় পুত্র আলাদীন আহমদ আন্দোলন পরিচালন করেন। তিনি ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ সমর্থনে নওয়াব সলিমুল্লাহর সাথে সহযোগিতা করেন। আলাদীনের পর তাঁর পুত্র বাদশাহ মিয়া আন্দোলন পরিচালনা করেন। ১৯২২ সালে তিনি খেলাফত আন্দোলনে যোগদান করেন এবং এ সময়ে সরকার তাঁকে গ্রেফতার করে। তারপর ফরায়েজী আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়ে। যে ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন নিয়ে এ আন্দোলনের শুরু হয়েছিল তা ক্রমশ: স্তিমিত হয়ে ক্রমশ: অন্য ধারায় প্রবাহিত হয়।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন