মাওলানা সাইয়েদ নিসার আলী তিতুমীর (১৭৮২-১৮৩১) ১৮২১ সালে সাইয়েদ আহমদ বেরেলভীর সাথে মক্কা, মদীনা, ইরাক, সিরিয়া, মিশর, ইরান, আফগানিস্তান প্রভৃতি দেশ সফর করেন। বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম মনীষীর সাথে সাক্ষাত এবং মুসলিম দুনিয়া সম্পর্কে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে দেশে ফিরে তিনি সাইয়েদ আহমদ শহীদের একজন খলীফা বা প্রতিনিধি হিসেবে বাংলায় জিহাদ আন্দোলনে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করেন। হাজী শরীয়তুল্লাহর ফরায়েজী আন্দোলনের সমসাময়িককালে পরিচালিত তিতুমীরের আন্দোলনের সামাজিক পটভূমি ছিল অভিন্ন।
মারাঠা-বর্গীদের দ্বারা লুণ্ঠিত পশ্চিমবাংলায় হিন্দু জমিদার ও নীলকরদের দ্বারা নিষ্পেষিত জনগণ অথনৈতিক ও সামাজিকভাবে ধ্বংসের প্রান্তসীমায় উপনীত হয়েছিল। মুসলমানদের ওপর চেপে বসেছে হিন্দুদের সাংস্কৃতিক আধিপত্য। তহবন্দ-এর পরিবর্তে ধুতি, সালামের পরিবর্তে আদাব-নমস্কার, নামের আগে শ্রী ব্যবহার, মুসলমানী নাম রাখতে জমিদারের পূর্বনুমতি ও খারিজানা, হিন্দুদের পূজার জন্য পাঁঠা যোগানো ও চাঁদা দেওয়া, দাড়ির ওপর ট্যাক্স, মসজিদ তৈরি করলে নজরানা, গরু জবাই করলে ডান হাত কেটে নেওয়া প্রভৃতি জুলুম ছিল নিত্য দিনের ঘটনা। এই পটভূমেই জিহাদ আন্দোলনের বিপ্লবী চেতনায় উজ্জীবিত মাওলানা তিতুমীর কাজ শুরু করেন।
বিভিন্ন স্থানে সভা-সমাবেশ করে তিনি জনগণকে তাদের ভূমিকা সম্পর্কে সচেতন করে তোলেন। ধর্মীয় আদেশ পূর্ণরূপে অনুসরণ এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে জিহাদের প্রেরণায় তিনি সকলকে উজ্জীবিত করেন। বিরান হয়ে যাওয়া মসজিদসমূহ তিনি সংস্কারের ব্যবস্থা করেন এবং সেখানে পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের প্রচলন করেন। তিনি পূজার চাঁদা দান বা তাতে অংশগ্রহণের মতো কাজ বন্ধ করেন। তিতুমীরের আন্দোলনের ফলে অল্প সময়ের মধ্যে নির্যাতিত নিপীড়িত মুসলমানগণ এবং বহু অমুসলমান কৃষক দ্রুত জোটবদ্ধ হলেন। তিতুমীরের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে এক বিরাট ইসলামী জামাত। তিতুমীরের সংগ্রাম ছিল জমিদারী প্রথার বিরুদ্ধে। তাঁর স্লোগান ছিল ‘লাঙ্গল যার জমি তার’। তাঁর বক্তব্য ছিল ‘প্রত্যেকের শ্রমের ফসল তাকে ভোগ করতে দিতে হবে’।
পলাশী যুদ্ধের পঁচিশ বছর পর এবং উনবিংশ শতকের পঞ্চম দশকের সমগ্র ভারতব্যাপী আযাদী সংগ্রামের (১৮৫৭) পঁচাত্তর বছর পূর্বে ১৭৮২ খৃষ্টাব্দে সাইয়েন নিসার আলী ওরফে তিতুমীর পশ্চিম বাংলার চব্বিশ পরগণা জেলার চাঁদপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মীর (সাইয়েদ) হাসান আলী এবং মাতার নাম আবেদা রোকাইয়া খাতুন। (শহীদ তিতুমীর, আবদুল গফুর সিদ্দিকী, পৃঃ ১)।
ইংরেজ ইতিহাস লেখকগণ অবজ্ঞাভরে এবং তিতুমীরকে ছোটো করে দেখাবার জন্যে তাঁকে এক অনুল্লেখযোগ্য কৃষক পরিবারের সন্তান বলে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তিনি প্রখ্যাত সাইয়েদ বংশে জন্মলাভ করেন। প্রাচীনকালে যে সকল ওলী-দরবেশ ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে বাংলায় আগমন করেন তাঁদের মধ্যে সাইয়েদ শাহ হাসান রাজী ও সাইয়েদ শাহ জালাল রাজীর নাম পুরাতন দলীল দস্তাবেজে পাওয়া যায়। দুই সহোদর ভাই সাইয়েদ আব্বাস আলী ও সাইয়েদ শাহ শাহাদত আলী যথাক্রমে সাইয়েদ শাহ জালাল রাজী ও সাইয়েদ শাহ হাশমত আলীর ত্রিংশ অধস্তন পুরুষে জন্মগ্রহণ করেন মীর নিসার আলী ওরফে তিতুমীর। (শহীদ তিতুমীর, আব্দুল গফুর সিদ্দিকী, পৃঃ ৩-৪)।
তৎকালীন মুসলিম সমাজের সম্ভ্রান্ত পরিবারে প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী তিতুমীরের বয়স যখন চার বছর, তখন তাঁর পিতা উস্তাদ মুন্সী লালমিয়াকে তার গৃহশিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত করেন। আরবী, ফার্সী ও উর্দুভাষা শিক্ষা দেয়ার জন্যে মুন্সী লালমিয়াকে নিয়োগ দেয়া হয়। মাতৃভাষা শিক্ষার প্রতিও তাঁর পিতামাতা উদাসীন ছিলেন না মোটেই। সেজন্যে পার্শ্ববর্তী শেরপুর গ্রামের পন্ডিত রারকমল ভট্টাচার্যকে বাংলা, ধারাপাত, অংক ইত্যাদি শিক্ষার জন্যে নিযুক্ত করা হয়। এ সময়ে বিহার শরীফ থেকে হাফেজ নিয়ামতুল্লা নামে জনৈক পারদর্শী শিক্ষাবিদ চাঁদপুর গ্রামে আগমন করলে, গ্রামের অভিভাবকগণ তাঁকে প্রধান শিক্ষক নিযুক্ত করেন এবং তার কাছেই তিনি কোরআনের হাফেজ হন। উপরন্তু আরবী ব্যাকরণ শাস্ত্র, ফারায়েজ শাস্ত্র, হাদীস ও দর্শনশাস্ত্র, তর্কশাস্ত্র, তাসাউফ, এবং আরবী-ফার্সী কাব্য ও সাহিত্যে বিশেষ পান্ডিত্য লাভ করেন। তিনি আরবী, ফার্সী ও বাংলা ভাষায় অনর্গল বক্তৃতা করতে পারতেন। যে যুগে তিতুমীর জন্মগ্রহণ করেন, বাংলার কিশোর ও যুবকরা তখন নিয়মিত শরীরচর্চা করতো। চাঁদপুর ও হায়দারপুর গ্রামের মধ্যস্থলে প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসা প্রাঙ্গনটি ছিল শরীরচর্চার উত্তম স্থান। হায়দারপুর নিবাসী শেখ মুহাম্মদ হানিফ শরীরচর্চা শিক্ষা দিতেন।
১৮২২ সালে তিতুমীর মক্কায় হজ্জ পালনের উদ্দেশ্যে যান এবং সেখানেই সাইয়েদ আহমদ বেরেলভীর সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। এখানেই মীর নিসার আলী তাঁর হাতে জিহাদের শপথ নেন। হজ্জ্ব ও অন্যান্য কাজ শেষে সাইয়েদ আহমদ বেরেলভী তাঁর খলিফা মওলানা শাহ মুহাম্মদ ইসমাইল ও মওলানা ইসহাককে নিম্নরূপ নির্দেশ দেন, “তোমরা আপন আপন বাড়ী পৌঁছে দিন পনেরো বিশ্রাম নিবে। তারপর তোমরা বেরেলী পৌঁছুলে তোমাদের নিয়ে ভারতের বিভিন্ন স্থান সফর করব। পাটনায় কয়েকদিন বিশ্রামের পর কোলকাতা যাব।
বাংলাদেশের খলিফাগণের প্রতি তাঁর নির্দেশ ছিল এমন, আমি পাটনায় পৌঁছে মওলানা আদুল বারী খাঁ (মওলানা আকরাম খাঁর পিতা), মওলানা মুহাম্মদ হোসেন, মওলানা হাজী শরীয়তুল্লাহ, মওলানা সাইয়েদ নিসার আলী (তিতুমীর), মওলানা সুফী খোদাদাদ সিদ্দিকী ও মওলানা কারামত আলীকে খবর দিব। আমার কোলকাতা পৌঁছার দিন তারিখ তোমরা তাদের কাছে জানতে পারবে। কোলকাতায় আমাদের যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে তাতে আমাদের চূড়ান্ত কর্মসূচী গৃহীত হবে। (বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস, আব্বাস আলী খান)
অতঃপর সকলে মক্কা থেকে স্ব স্ব গৃহে প্রত্যাবর্তন করেন। পরে নির্দিষ্ট সময়ে তাঁরা কোলকাতার শানসুন্নিসা খানমের বাগানবাড়ীতে সমবেত হন। আলোচনার পর স্থিরীকৃত হয় যে পাটনা মুজাহিদগণের কেন্দ্রীয় রাজধানী হবে এবং প্রত্যেক প্রদেশে হবে প্রাদেশিক রাজধানী। প্রাদেশিক রাজধানী থেকে কেন্দ্রে জিহাদ পরিচালনার অর্থ প্রেরণ করা হবে।
এসব সিদ্ধান্তের পর মওলানা সাইয়েদ নিসার আলী (তিতুমীর) উক্ত বৈঠকে যে ভাষণ দান করেন তা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেন-
বাংলাদেশের মুসলমানদের ঈমান খুবই দুর্বল হয়ে পড়েছে। তাদেরকে খাঁটি মুসলমান না করা পর্যন্ত তাদেরকে জেহাদে পাঠানো বিপজ্জনক হবে। আমি তাদের মধ্যে ইসলামী দাওয়াত পৌঁছাবার দায়িত্ব নিচ্ছি। শুধু তাই নয়, আমি মনে করি, নিম্নশ্রেণীর হিন্দুরাও আমাদের সংগ্রামে যোগদান করতে পারে।….কারণ ব্রাহ্মণ, বৈদ্য, ক্ষত্রিয় ও কায়স্থ জাতির উপর নিম্নশ্রেণীর হিন্দুরা সন্তুষ্ট নয়। আমরা যদি মুসলমানদেরকে পাকা মুসলমান বানিয়ে নিম্নশ্রেণীর হিন্দু ও মুসলমানদেরকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারি তাহলে …কেন্দ্রের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে কেন্দ্রকে সাহায্য করা আমাদের পক্ষে দুঃসাধ্য হবে না।
পরামর্শ সভায় অতঃপর স্থির হলো, বাংলা কেন্দ্রকে অপর সকল বিষয়ে গোপনে সাহায্য করবে। কিন্তু প্রকাশ্যভাবে জেহাদে অংশগ্রহণ করবে না। তবে যাঁরা কেন্দ্রের সাথে যোগদান করার ইচ্ছা করবে, তাদেরকে বাধা দেয়া হবে না। (শহীদ তিতুমীর, আবদুল গফুর সিদ্দিকী, পৃঃ ২২-৩৭)।
তিতুমীর কোলকাতায় সাইয়েদ আহমদ বেরেলভীর পরামর্শ সভা সমাপ্তের পর নিজ গ্রাম চাঁদপুরে ফিরে এসে কিছুদিন বিশ্রাম গ্রহণের পর দাওয়াতের কাজ শুরু করেন। তিতুমীরের দাওয়াতের মূলকথা ছিল ইসলামে পরিপূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন এবং প্রত্যেকটি কাজেকর্মে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের নির্দেশ পালন। হিন্দু জমিদার ও নীলকরদের অত্যাচার উৎপীড়নকে তিনি উপেক্ষা করতে পারেন না। তাই বলেন যে, কৃষক সম্প্রদায়ের হিন্দুদের সাথে একতাবদ্ধ হয়ে তাদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। সারফরাজপুর নামক গ্রামবাসীর অনুরোধে তিনি তথাকার শাহী আমলের ধ্বংসপ্রাপ্ত মসজিদের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন এবং প্রচারের জন্যে তাঁর একটি খানকাহ স্থাপন করেন। এখানে জুমার নামাজের পর তিনি সমবেত হিন্দু-মুসলমানকে আহবান করে যে ভাষণ দিয়েছিলেন তা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি বলেন,
ইসলাম শান্তির ধর্ম। যারা মুসলমান নয় তাদের সাথে শুধু ধর্মের দিক দিয়ে পৃথক বলে, বিবাদ বিসম্বাদ করা আল্লাহ ও তাঁর রসূল কিছুতেই পছন্দ করেন না। তবে ইসলাম এ কথা বলে যে, যদি কোন প্রবল শক্তিশালী অমুসলমান কোন দুর্বল মুসলমানের উপর অন্যায় উৎপীড়ন করে, তাহলে মুসলমানরা সেই দুর্বলকে সাহায্য করতে বাধ্য। তিনি আরও বলেন, মুসলমানদেরকে কথাবার্তায়, আচার-আচরণে প্রকৃত মুসলমান হতে হবে। তারা যদি অমুসলমানের আচার-আচরণ, চাল-চলন ও কাজকর্ম পছন্দ করে তাহলে শেষ বিচারের দিন আল্লাহ তাদেরকে অমুসলমানদের সাথে স্থান দিবেন। তিতুমীর বলেন, ইসলামী আদর্শেই রয়েছে আমাদের ইহকাল পরকালের মুক্তি। এর প্রতি কেউ উপেক্ষা প্রদর্শন করলে আল্লাহ তাকে কঠোর শাস্তি দিবেন। নামাজ পড়া, রোজা রাখা, দাড়ি রাখা, গোঁফ ছাঁটা মুসলমানদের অবশ্য পালনীয় কর্তব্য। যারা অমুসলমানদের আদর্শে এসব পরিত্যাগ করবে, আল্লাহ তাদেরকে কঠোর শাস্তি দিবেন।
সরফরাজপুরের ধ্বংসপ্রাপ্ত মসজিদের পুনঃসংস্কার, আবার জামায়াতে নামাজ আদায়ের ব্যবস্থা, নামাজান্তে সমবেত লোকদের সামনে তিতুমীরের জ্বালাময়ী ভাষণ –পুঁড়ার জমিদার কৃষ্ণদেব রায়কে সন্ত্রস্ত ও চঞ্চল করে তুলেছে। তিতুমীরের গতিবিধি ও প্রচার-প্রাচারণা সংবাদ সংগ্রহের ভার জমিদারের অনুগত ও বিশ্বস্ত মুসলমান পাইক মতির উপর অর্পিত হলো। জমিদার মতিকে বললো, তিতু ওহাবী ধর্মাবলস্বী। ওহাবীরা তোমাদের হযরত মুহাম্মদের ধর্মমতের পরম শত্রু। কিন্তু তারা এমন চালাক যে, কথার মধ্যে তাদেরকে ওহাবী বলে ধরা যাবে না। সুতরাং আমার মুসলমান প্রজাদেরকে বিপথগামী হতে দিতে পারি না। আজ থেকে তিতুর গতিবিধির দিকে নজর রাখবে এবং সব কথা আমাকে জানাবে। মুসলিমদের মধ্যে মাযহাবগত প্রার্থক্যের সুযোগ এখনো মুশরিকরা নিচ্ছে তখনও নিয়েছিলো।
অতঃপর কৃষ্ণদেব রায় গোবরা গোবিন্দপুরের জমিদার দেবনাথ রায় এবং গোবরডাঙার জমিদার কালী প্রসন্ন মুখোপাধ্যয়ের সঙ্গে পরামর্শক্রমে তিতুমীরের বিরুদ্ধে শাস্তিভংগের নালিশ করার জন্যে কিছু প্রজাকে প্রস্তুত করলো। তারপর জমিদারের আদেশে মতিউল্লাহ, তার চাচা গোপাল, জ্ঞাতিভাই নেপাল ও গোবর্ধনকে দিয়ে জমিদারের কাচারীতে উপস্থিত হয়ে নালিশ পেশ করলো। তার সারমর্ম নিম্নরূপ-
চাঁদপুর নিবাসী তিতুমীর তার ওহাবী ধর্ম প্রচারের জন্যে আমাদের সরফরাজপুর গ্রামে এসে আখড়া গেড়েছে এবং আমাদেরকে ওহাবী ধর্মমতে দীক্ষিত করার জন্যে নানারূপ জুলুম জবরস্তি করছে। আমরা বংশানুক্রমে যেভাবে বাপদাদার ধর্ম পালন করে আসছি, তিতুমীর তাতে বাধা দান করছে। তিতুমীর ও তার দলের লোকেরা যাতে সরফরাজপুরের জনগণের উপর কোন প্রকার অত্যাচার করে তাদের ধর্মে দীক্ষিত করতে না পারে, জোর করে আমাদের দাড়ি রাখতে, গোঁফ ছাঁটতে, গোহত্যা করতে, আরব দেশের নাম রাখতে বাধ্য করতে না পারে, হিন্দু-মুসলমানে দাঙ্গা বাধাতে না পারে, হুজুরের দরবারে তার বিহিত ব্যবস্থার জন্যে আমাদের নালিশ। হুজুর আমাদের মনিব।
গোপাল, নেপাল, গোবর্ধনের টিপসইযুক্ত উক্ত দরখাস্ত পাওয়ার পর জমিদার কৃষ্ণদেব রায় হুকুম জারী করলো।
১। যারা তিতুমীরের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে ওহাবী হবে, দাড়ি রাখবে, গোঁফ ছাঁটবে তাদেরকে দাড়ির জন্যে আড়াই টাকা ও গোঁফের ছাঁটার জন্যে পাঁচ সিকা করে খাজনা দিতে হবে।
২। মসজিদ তৈরী করলে প্রত্যেক কাঁচা মসজিদের জন্যে পাঁচশ’ টাকা এবং প্রতি পাকা মসজিদের জন্যে এক হাজার টাকা করে জমিদার সরকারে নজরানা দিতে হবে।
৩। বাপদাদা সন্তানদের যে নাম রাখবে তা পরিবর্তন করে ওহাবী মতে আরবী নাম রাখলে প্রত্যেক নামের জন্যে খারিজানা ফিস পঞ্চাশ টাকা জমিদার সরকারে জমা দিতে হবে।
৪। গোহত্যা করলে তার ডান হাত কেটে দেয়া হবে –যাতে আর কোনদিন গোহত্যা করতে না পারে।
৫। যে ওহাবী তিতুমীরকে বাড়ীতে স্থান দিবে তাকে ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করা হবে।
(শহীদ তিতুমীর –আবদুল গফুর সিদ্দিকী পৃঃ ৪৮, ৪৯; স্বাধীনতা সংগ্রাসের ইতিহাস, আবু জাফর পৃঃ ১১৯; Bengal Criminal Judicial Consultation, 3 April 1832, No. 5 and 6)।
তিতুমীর কৃষ্ণদেব রায়কে একটি পত্রের মাধ্যমে জানিয়ে দেন যে, তিনি কোনো অন্যায় কাজ করেননি, মুসলমানদের মধ্যে ইসলাম প্রচারের কাজ করছেন। এ কাজে হস্তক্ষেপ করা কোনক্রমেই ন্যায়সঙ্গত হতে পারে না। নামাজ পড়া, রোজা রাখা, দাড়ি রাখা, গোঁফ ছাঁটা প্রভৃতি মুসলমানের জন্যে ধর্মীয় নির্দেশ। এ কাজে বাধা দান করা অপর ধর্মে হস্তক্ষেপেরই শামিল। তিতুমীরের জনৈক পত্রবাহক কৃষ্ণদেব রায়ের হাতে পত্রখানা দেয়ার পর তার প্রতিক্রিয়া ছিলো এরকম...
পত্রখানা কে দিয়েছে জিজ্ঞেস করলে পত্রবাহক চাঁদপুরের মাওলানা সাইয়েদ তিতুমীর সাহেবের নাম বলেন। তিতুমীরের নাম শুনতেই জমিদার ক্ষেপে যান। বাগান্বিত হয়ে বললেন, কে সেই ওহাবী তিতু? আর তুই ব্যাটা কে? উপস্থিত মুচিরাম ভান্ডারী বললো, ওর নাম আমন মন্ডল। বাপের নাম কামন মন্ডল। ও হুজুরের প্রজা। আগে দাড়ি কামাতো, আর এখন দাড়ি রেখেছে বলে হুজুর চিনতে পারছেন না।
পত্রবাহক বললো, হুজুর আমার নাম আমিনুল্লাহ, বাপের নাম কামালউদ্দীন, লোকে আমাদেরকে আমন-কামন বলে ডাকে। আর দাড়ি রাখা আমাদের ধর্মের আদেশ। তাই পালন করেছি।
কৃষ্ণদেব রাগে থর থর করে কাঁপতে কাঁপতে বললো, ব্যাটা দাড়ির খাজান দিয়েছিস, নাম বদলের খাজনা দিয়েছিস? আচ্ছা, দেখাচ্ছি মজা। ব্যাটা আমার সাথে তর্ক করিস, এত বড়ো তোর স্পর্ধা? এই বলে মুচিরামের উপর আদেশ হলো তাকে গারদে বন্ধ করে উচিত শাস্তির। বলা বাহুল্য, অমানুষিক অত্যাচার ও প্রহারের ফলে তিতুমীরের ইসলামী আন্দোলনের প্রথম শহীদ হলো আমিনুল্লাহ। সংবাদটি চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো।
মুসলমানরা মর্মাহত হলো, কিন্তু সামর্থ ও সাক্ষী প্রমাণের অভাবে শক্তিশালী জমিদারের বিরুদ্ধে কিছুই করতে না পেরে তারা নীরবে ধৈর্য ধরেছেন। তবে শহীদ আমিনুল্লাহর শাহদাত তিতুমীরের দাওয়াতী প্রচেষ্টাকে খুব দ্রুতই সর্বাত্মক জিহাদে রূপান্তরিত করে। এভাবেই বাংলায় প্রথম প্রতিরোধ জিহাদের পটভূমি রচিত হয়।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন