বঙ্গোপসাগরে তৎকালীন নোয়াখালীর অন্তর্গত সন্দ্বীপের মানুষ সবসময় স্বাধীনচেতা ছিলো। ১৯৫৪ সালে সন্দ্বীপ নোয়াখালী থেকে আলাদা হয় এবং চট্টগ্রামের সাথে যুক্ত হয়। 'সন্দ্বীপ বিদ্রোহ' হলো ১৭৬৭ সাল থেকে ১৮১৯ পর্যন্ত ইংরেজদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে ওখানকার মানুষদের তিনটি বিদ্রোহ। তাদের বিদ্রোহের কারণ জানতে হলে একটু পেছন থেকে শুরু করা দরকার। তাদের স্বাধীন শাসক ছিলেন দেলওয়ার খাঁ যিনি দিলাল রাজা নামে বহুল পরিচিত। মুঘল আমলে শায়েস্তা খান যখন বাংলার সুবাদার হন তখন তিনি পর্তুগীজ দস্যুদের ও মগ দস্যুদের হাত থেকে বাংলাকে রক্ষা করতে চেয়েছেন। আগের সুবাদাররা এই কাজে সুবিধে করতে পারেন নি কারণ তাদের শক্তিশালী নৌবাহিনী ছিলো না। শায়েস্তা খান তার ছেলে বুজুর্গ উমেদ খাঁ-কে চট্টগ্রাম অধিকার করা ও দস্যুদের লুন্ঠন থেকে বাঁচানোর আদেশ করলেন।
উমেদ খাঁ নোয়াখালীতে একটি নৌঘাঁটি স্থাপনের চিন্তা করলেন। এজন্য তার নৌ-সেনাপতি আবুল হাসানকে এই কাজের দায়িত্ব দিলেন। তিনি নোয়াখালীর সন্দ্বীপে ঘাঁটি স্থাপনের চিন্তা করলেন। তাকে বাধা দেন দেলওয়ার খাঁ। মোগল সেনাপতি আবুল হাসান তাঁকে সপরিবারে বন্দী করে ঢাকায় নিয়ে যান। এই ঘটনাটি ঘটে ১৬৬৫ সালে। পরবর্তী বছর অর্থাৎ ১৬৬৬ সালে শায়েস্তা খাঁ আবদুল করিম খাঁ নামক এক ব্যক্তিকে সন্দ্বীপের মোগল ফৌজদার নিযুক্ত হন। তখনকার দিনে ফৌজদারগণ বর্তমান সময়ের ম্যজিস্ট্রেট-এর দায়িত্ব পালন করতেন। অবশ্য শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার প্রয়োজনে তাঁদের অধীনে কিছু সৈন্য থাকতো। যেমন, সন্দ্বীপে ফৌজদারের নিয়ন্ত্রণে ১০০ অশ্বারোহী ও ৪০০ পদাতিক সৈন্য ছিলো। রাজস্ব আদায় কার্যে সুবিধার জন্য সন্দ্বীপে মোহাম্মদ কাশেম নামক একজন সুদক্ষ ও সুচতুর লোককে আহাদদার নিযুক্ত করা হয়। ‘আহাদদার’ অর্থ সচিব।
দেলওয়ার খাঁ প্রায় অর্ধ শতাব্দীকাল স্বাধীন নৃপতি হিসাবে সন্দ্বীপ শাসন করেন। বহিরাগত মোগল বাহিনীর হাতে তাঁর পরাজয় এবং সে সাথে দ্বীপটির স্বাধীন মর্যাদা বিলুপ্ত হওয়ায় স্বভাবতই স্থানীয় অধিবাসীরা বিক্ষুব্ধ ছিলো। কিন্তু মুঘল প্রশাসনের বিশেষ করে শায়েস্তা খানের সুশাসনে পরিস্থিতি মুঘলদের অনুকূলে চলে আসে। প্রথমত সেখানে ট্যাক্স ধার্য করা হয় দেলওয়ার খাঁর আমলের প্রায় অর্ধেক। দ্বিতীয়ত দেলওয়ার খাঁর আত্মীয় ও প্রভাবশালীদের ইজারা দেয়া হয়। এতে তারা সম্মান ও আর্থিকভাবে লাভবান হয়। অল্প সময়ে সন্দ্বীপ মুঘলদের পূর্ণ আনুগত্য করতে থাকে।
রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য অর্জনের জন্য দিলাল জামাতা চাঁদ খাঁ'র কাছে সন্দ্বীপ ইজারা বন্দোবস্ত দেয়া হয়। চাঁদ খাঁ ইজারা বন্দোবস্ত নেয়ার পর বুঝতে পারেন যে, একা তাঁর পক্ষে সুবিস্তীর্ণ সন্দ্বীপ পরগণার রাজস্ব আদায় করা সম্ভব হবে না। উপর্যুক্ত বিবেচনা থেকেই তিনি তাঁর দু’আত্মীয় বক্তার মোহাম্মদ ও মোহাম্মদ হানিফ এবং তখনকার কানুনগো দপ্তরের কর্মচারী বাকলা (চন্দ্রদ্বীপ) নিবাসী মধুসুদনকে বিভিন্ন অংশ ইজারা বন্দোবস্ত দেন। এটা ছিলো অনেকটা সাব-কন্ট্রাক্ট-এর মতো। বলাবাহুল্য, এই ইজারাদারগণই পরবর্তীকালে সন্দ্বীপের জমিদার হন।
১৬৯০ থেকে ১৭৩০ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত চাঁদ খাঁ’র দু’পুত্র জুনুদ খাঁ ও মুকিম খাঁ, মোহাম্মদ হানিফের পুত্র মোহাম্মদ মুকিম এবং মধুসুদনের পুত্র জনার্দন সন্দ্বীপের জমিদার ছিলেন। জুনুদ খাঁ ও মুকিম খাঁ ছিলেন অর্ধেকের বেশি জমিদারির মালিক। সে কারণে সন্দ্বীপের নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব ওদের হাতেই ছিলো বলে ধরে নেয়া যায়। আনুমানিক ১৭৩০ সাল থেকে ১৭৫০ সাল পর্যন্ত সন্দ্বীপের প্রভাবশালী জমিদারদের মধ্যে জুনুদ খাঁ ছেলে মোহাম্মদ রাজা, মুকিম খাঁ’র ছেলে মোহাম্মদ হোসেন, মোহাম্মদ মুকিমের ছেলে বাখর মোহাম্মদ ও জাফর মোহাম্মদ এবং জনার্দনের ছেলে রামচন্দ্রের নাম উল্লেখযোগ্য। বাখর মোহাম্মদের নামানুসারে তাঁর জমিদারি বাখরপুর জমিদারি নামে পরিচিত ছিলো। মুকিম খাঁর ছেলে জমিদার মোহাম্মদ হোসেন মারা যান ১৭৪৩ সালে। তার থেকে জমিদারি পান তার ছেলে আবু তোরাব।
আবু তোরাব, মোহাম্মদ মুরাদ, মোহাম্মদ ইব্রাহিম, মোহাম্মদ ওয়াছিম, মোহাম্মদ আকবর, সূর্য নারায়ণ প্রমুখ ১৭৪৩ থেকে ১৭৫০ সালের মধ্যে সন্দ্বীপের জমিদারি লাভ করেন। ওদের মধ্যে সবচাইতে বেশি প্রভাবশালী জমিদার ছিলেন আবু তোরাব। আনুমানিক ১৭৫০ থেকে ১৭৬৩ সাল পর্যন্ত তিনি অত্যন্ত দাপটের সাথে সন্দ্বীপে জমিদারি পরিচালনা করেন। ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির প্রতিনিধি হ্যারি ভেরেলেস্ট নবাব মীর কাসেম খানের আদেশ বলে ১৭৬১ সালে চট্টগ্রামের শাসন ক্ষমতা গ্রহণ করেন। এই ভেরেলেস্ট-এর প্রধান কার্যালয়ের কেরানী ছিলেন খিদিরপুরের ঘোষাল বংশের প্রতিষ্ঠাতা গোকুল ঘোষাল নামক একজন ধূর্ত ক্ষমতালোলুপ ব্যক্তি। তারই পরামর্শে ভেরেলেস্ট সন্দ্বীপকে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির শাসনাধীন করেন। সন্দ্বীপের জমিদারদের সেই সক্ষমতা ছিলো না ইংরেজদের ঠেকাবে।
মুঘল নিয়মানুসারে শেষ ওয়াদাদার ওজাকুর মলকে অগ্রাহ্য করে ১৭৬৩ সালে ভেরেলেস্ট গোকুল ঘোষালকে বেনামীতে সন্দ্বীপের ওয়াদাদার নিযুক্ত করেন। তাঁর একজন বিশ্বস্ত কর্মচারী বিষ্ণুচরণ বসুর নামে ওয়াদাদারী নেন। কাজেই কাগজে কলমে এই বিষ্ণুচরণ ছিলেন সন্দ্বীপে বৃটিশ আমলের প্রথম ওয়াদাদার। তখন নায়েবে ওয়াদাদার নিযুক্ত হয়েছিলেন রাম কিশোর বাডুজেজ। বলাবাহুল্য, তখনকার প্রতাপশালী জমিদার আবু তোরাব চৌধুরী গোকুল ঘোষালের মতো ক্ষমতালোলুপ লোককে কিছুতেই গ্রহণ করতে পারেননি। নায়েবে ওয়াদাদার রাম কিশোর বাডুজ্জের সন্দ্বীপে আগমনের সাথে সাথেই আবু তোরাব প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন।
গোকুল ঘোষাল ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির পক্ষে আহাদদার হিসাবে রাজস্ব সংগ্রহের উদ্দেশ্য সন্দ্বীপ আগমন করেন ১৭৬৩-৬৪ সালে। তার সাথে আবু তোরাবের বিরোধ চরমে পৌঁছে ১৭৬৭ সালে। জমিদার আবু তোরাব ইংরেজ ওয়াদদাদারের কাজে রাজস্ব জমা দেয়া থেকে পুরাপুরি বিরত থাকেন। তাছাড়া, গোকুল ঘোষালের প্রতিনিধিদের সন্দ্বীপ থেকে বিতাড়ণের জন্য আবু তোরাব তাঁর সেনাপতি মালকামকে নির্দেশ প্রদান করেন।
অতঃপর মীর জাফরের জামাতা নবাব মীর কাসেমের নির্দেশে চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী থেকে নবাবের অনুগত একদল সৈন্য এসে তোরাব আলীর মুখোমুখি হয়। কিন্তু প্রতিরোধ ও চাপের মুখে কিছুদিনের মধ্যে ওয়াদাদারের লোকজন সন্দ্বীপ ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়। অবশেষে ক্যাপ্টেন নলিকিন্স এবং আরো কয়েকজন সেনাধ্যক্ষের নেতৃত্বে ইংরেজ সেনাবাহিনী নদী পার হয়ে সন্দ্বীপে পৌঁছায়। ১৭৬৭ সালের মধ্যভাগে সন্দ্বীপ শহরের সামান্য উত্তরে চার আনি হাটের অদূরবর্তী কিল্লাবাড়িতে আবু তোরাব বাহিনীর সাথে ক্যাপ্টেন নলিকিন্স-এর বাহিনীর তুমুল যুদ্ধ হয়। বীর বিক্রমে যুদ্ধ করে আবু তোরাব পরাজিত ও নিহত হন। আবু তোরাব চৌধুরী জমিদার হলেও সুশাসনের কারণে কৃষক প্রজারা তাঁকে ভালবাসতেন। এ করণে উপরিউক্ত যুদ্ধে সন্দ্বীপের কৃষকগণ আবু তোরাব চৌধুরীর পক্ষাবলম্বন করেন। ইতিহাসে এটি সন্দ্বীপের প্রথম কৃষক বিদ্রোহ বলেও খ্যাত হয়।
আবু তোরাবের পতনের পরে সন্দ্বীপের অন্যান্য জমিদারগণ ইংরেজদের আনুগত্য মেনে নেন। জমিদারদের তাঁদের জমিদারি ফিরিয়ে দেয়া হয়। এদিকে গোকুল ঘোষাল আবু তোরাবের জমিদারি জনৈক ভবানীচরণ দাসের নামে বন্দোবস্ত করে নেন। গোকুল ঘোষাল সন্দ্বীপের সর্বময় কর্তা হয়ে ওঠেন। জমিদারদের সাময়িকভাবে জমিদারি ফিরিয়ে দেয়া হলেও গোকুল ঘোষাল আবার তা কেড়ে নেয়। এরপর থেকে তিনি সন্দ্বীপের অধিবাসীদের ওপর অত্যাচার উৎপীড়ন শুরু করেন। কৃষকেরা তার বিরুদ্ধে ইংরেজদের কাছে নালিশ করে। কিন্তু সেই কথা শোনার ইচ্ছে নেই ইংরেজ লুটেরাদের।
এদিকে সকল প্রকার আবেদন নিবেদন ব্যর্থ হলে সন্দ্বীপের কৃষকেরা বেপরোয়া হয়ে গোকুল ঘোষাল এবং ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হতে শুরু করে। প্রথমে তারা খাজনা প্রদান বন্ধ করে বিদ্রোহের সংকেত প্রদান করে। এদিকে গোকুল ঘোষাল ও সহজে দমবার পাত্র নন। জোরপূর্বক খাজনা আদায়ের জন্য তিনি কৃষকদের ঘরে ঘরে পেয়াদা ও পুলিশ পাঠাতে শুরু করেন। তারা জবরদস্তিমূলকভাবে খাজনা আদায়- অন্যথায় প্রজাদের সর্বস্ব কেড়ে নিতে থাকে। পরিণামে অসন্তোষ দানা বেঁধে ওঠে। কৃষকগণ সম্মিলিত হয়ে ওদের প্রতিরোধ করতে শুরু করে। ১৭৬৯ সালে এ নিয়ে সন্দ্বীপে দাঙ্গা-হাঙ্গামা এবং এমনকি ব্যাপক সংঘর্ষ লেগে যায়। অসন্তুষ্ট, হৃতসর্বস্ব জমিদারগণ কৃষকদের পক্ষাবলম্বন করেন। অবশেষে গোকুলের আবেদন ক্রমে সে বছরের শেষের দিকে ইংরেজ সৈন্যদল সন্দ্বীপে গিয়ে বিদ্রোহ দমন করতে সক্ষম হয়। এটি সন্দ্বীপের দ্বিতীয় বিদ্রোহ।
ইংরেজ শাসকেরা সন্দ্বীপের প্রজা বিদ্রোহ, কৃষক অসন্তোষ দমনে অত্যাচারী গোকুল ঘোষালের পক্ষাবলম্বন করলেও তারা বুঝতে পারে যে, একটা কিছু পরিবর্তন না আনলে পরিস্থিতি সামাল দেয়া কষ্টকর হবে। এমতাবস্থায় ১৭৭২-৭২ সালে সন্দ্বীপে ওয়াদাদারের পদ বিলুপ্ত করে একজন আমিন (ম্যাজিসট্রেট) নিয়োগের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। কিন্তু এই পরিবর্তন সত্ত্বেও কার্যতঃ গোকুল ঘোষালই সন্দ্বীপে কর্তৃত্ব করতে থাকেন। অবশেষে জমিদারগণ কোম্পানীর নিকট গোকুল ঘোষালের বিরুদ্ধে আবেদন জানাতে বাধ্য হন। তারই ফলে ঢাকায় প্রাদেশিক কর্তৃপক্ষ ১৭৭৮ সালে ডানকান নামক একজন ইংরেজকে প্রকৃত পরিস্থিতি জানার জন্য সন্দ্বীপ পাঠায়। ১৭৮৩ সালে তাঁর হস্তক্ষেপে কোরেশা বানু এবং আরও দু’ একজন জমিদার তাঁদের জমিদারি ফিরে পান। কিন্তু আবু তোরাব চৌধুরীর জমিদারি তাঁর ছেলে আলী রাজাকে না দিয়ে ভবানী চরণ দাসের নামে গোকুল ঘোষাল অধিকার করেন।
এদিকে গোকুল ঘোষাল, ভবানীচরণ দাস প্রমুখ জমিদারের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সন্দ্বীপের স্থানীয় জমিদার, তালুকদার এবং কৃষকদের সংগ্রাম দিন দিন তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। একই প্রেক্ষাপটে ১৮১৯ সালে সন্দ্বীপে কৃষক বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। উল্লেখ্য, স্বনামে বেনামে জমিদারির মালিকানা, দুর্নীতি, লুণ্ঠন দীর্ঘদিনের আহাদাদারি, লবণের ইজারা ইত্যাদি খাত থেকে গোকুল ঘোষাল বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিক হন। সন্দ্বীপ থেকে উপার্জিত, লুণ্ঠিত সে সম্পদের দ্বারা কোলকাতার খিদিরপুরের ভুর্কেলাসের রাজপ্রাসাদের ঘোষাল রাজবংশ প্রতিষ্ঠিত হয়। এই গোকুল ঘোষালের নাম সন্দ্বীপের লোকেরা এখনো ঘৃণার সাথে স্মরণ করে। ১৮১৯ সালের বিদ্রোহও দমন করে ইংরেজরা। তবে তারা এরপর গোকুলকে সরিয়ে দেয়। এই তিন বিদ্রোহে শত শত মুসলিম কৃষক শাহদাতবরণ করেন।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন