২৪ জানু, ২০২০

বঙ্গকথা পর্ব-২৭ : রংপুরের নূরুলদীনের কৃষক বিদ্রোহ


রংপুরের বিখ্যাত 'জাগো বাহে, কুন্ঠে সবাই' স্লোগানের সাথে সারাদেশে সবাই পরিচিত। এই ডাক দিয়ে কৃষকদের জাগাতে চেয়েছেন রংপুরের এক প্রতিবাদী কৃষক নেতা নূর উদ্দিন। আঞ্চলিক ভাষায় তার পরিবর্তিত নাম নূরুলদীন। রংপুরের বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেওয়া নূরলদীন মাটির নবাব হিসেবে পরিচিত হয়েছেন কৃষকদের কাছে।  

পলাশীতে বিপর্যয়ের পর বাংলা অঞ্চল তখন পার করছিল একটি হাহাকারময় সময়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অপশাসন ও লুটপাটের ফলে ১১৭৬ বঙ্গাব্দে সৃষ্ট ‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তরে’ কোটি মানুষ মারা গেছে না খেয়ে। ইংরেজ শাসন ভারতের কৃষি-সমাজে ব্যাপক পরিবর্তন আনে। রাজস্ব আদায় আগে হতো গ্রাম-সমাজ থেকে, কোনো ব্যক্তির নিকট নয়। ইংরেজ বেনিয়ারাই সর্বপ্রথম ব্যক্তিগতভাবে রাজস্ব আদায়ের প্রথা প্রচলন করাসহ রাজস্ব হিসাবে ফসলের বদলে মুদ্রাপ্রথা প্রচলন করে। তারা মোগল যুগের জমিদার বা রাজস্ব আদায়কারী গোমস্তাদের সরিয়ে প্রভাবশালী হিন্দুদের জমির মালিক বলে ঘোষণা করে। এরা কৃষকের কাছ থেকে ইচ্ছামতো খাজনা ও কর আদায় করে সেখান থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ ইংরেজদের দিতো।

খেয়াল-খুশীমতো রাজস্ব আদায়ের ফলে বাংলা ও বিহারের রাজস্ব মোগলযুগের শেষ সময়ের রাজস্ব অপেক্ষা দ্বিগুণ হয়। ১৭৬৪-৬৫ খ্রিষ্টাব্দে রাজস্ব আদায় হয় এক কোটি ২৩ লাখ টাকা, ১৭৬৫-৬৬ খ্রিষ্টাব্দে যা বেড়ে হয় দুই কোটি ২০ লাখ টাকা। ভূমি রাজস্ব, কর্মচারীদের উৎকোচগ্রহণ ও ব্যক্তিগত ব্যবসায় যে মুনাফা পেতো, তার পরিমাণও ছিল অবিশ্বাস্য। প্রকৃতপক্ষে এটি ছিল লুণ্ঠন। বাংলা ও বিহারের জনসাধারণের টাকায় নামমাত্র মূল্যে এ দেশের পণ্য ক্রয় করে ইউরোপের বাজারে অধিক মূল্যে বিক্রয় করা হতো। কার্ল মার্কস, রেজিনাল্ড রেনল্ডসের মতো লেখকরা এই ব্যবসাকে বলেছেন ‘প্রকাশ্য দস্যুতা’।

ইংরেজদের শাসন ও শোষণের মাত্রা ক্রমশ ভয়ংকর হয়ে ওঠে। ফলে ১৭৭০ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা ও বিহারে দেখা দেয় দুর্ভিক্ষের ভয়াল ছায়া। যার নিষ্ঠুর থাবায় অসংখ্য মানুষ নির্মম মৃত্যুর শিকার হন। ইংরেজ সৃষ্ট এই দুর্ভিক্ষ ১৭৭৬ সালে মহাদুর্ভিক্ষে রূপ নেয়। ছিয়াত্তরের মন্বন্তর নামে পরিচিত এই দুর্ভিক্ষে চাষিরা ক্ষুধার জ্বালায় তাদের সন্তান বিক্রি করতে বাধ্য হয়, কোথাও কোথাও জীবিত মানুষ মৃত মানুষের মাংস খেয়ে প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করে। নদীর তীর মৃত ও মুমূর্ষু মানুষের ভাগাড়ে পরিণত হয়। মারা যাওয়ার আগেই মুমূর্ষু মানুষকে শিয়াল-কুকুরে খাওয়ার ঘটনাও ঘটে।

অত্যাচার, নিপীড়ন আর লুণ্ঠনের মাধ্যমে অর্জিত টাকায় কোম্পানির অবস্থা তখন খুবই রমরমা। রাজস্ব ক্ষমতা হাতে পেয়ে ইংরেজরা তখন চালু করেছিল ইজারাদারি  প্রথা। আর এই ইজারাদারি ব্যবস্থায় রংপুর, দিনাজপুরের ইজারাদারি লাভ করে একজন অত্যাচারী জমিদার দেবী সিংহ। দেবী সিংহ মুর্শিদাবাদ এসেছিলেন সূদুর পানিপথ থেকে। মুর্শিদাবাদে এসে ডাকাতির মাধ্যমে প্রভূত সম্পদের মালিক হয়ে ক্ষমতার কাছাকাছি যেতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। পলাশীর যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন ইংরেজদের পক্ষে। একারণে ছিলেন ব্রিটিশদের সুনজরে। পরবর্তীকালে মুর্শিদাবাদের দেওয়ান হিসেবে দায়িত্ব লাভ করার পর তার কঠোরতায় প্রজাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে পড়েছিল। এরপর তিনি লাভ করেন পূর্ণিয়ার শাসন ও রাজস্ব আদায়ের ক্ষমতা। এখানেও তার অত্যাচার আর নিপীড়নে কৃষকরা একরকম বনে-জঙ্গলে পালাতে বাধ্য হয়েছিল। যার ফলে হেস্টিংস নিজেই তাকে পদচ্যুত করেন। কিন্তু দেবীসিংহ ছিলেন খুবই ধুরন্ধর প্রকৃতির মানুষ। প্রচুর অর্থ উপঢৌকনের বিনিমেয়ে হেস্টিংসকে বাগে আনেন সহজেই। এবার তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয় মুর্শিদাবাদের প্রাদেশিক রেভিনিউ বোর্ডের সহকারী কার্যাধক্ষ্যের পদে। এখানেও তিনি  প্রজাদের উপর নিপীড়ন অব্যাহত রাখেন। একসময় প্রচুর অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। হেস্টিংস বাধ্য হন সেই রেভিনিউ বোর্ড ভেঙে দিতে।

নিখিলনাথ রায় তার মুর্শিদাবাদ কাহিনীতে দেবী সিংহের অত্যাচারের ইতিহাস তুলে ধরে বলেছেন, “যদি কেহ অত্যাচারের বিভীষিকাময় মূর্তি দেখিতে ইচ্ছা করেন, যদি কেহ মানবপ্রকৃতির মধ্যে শয়তানবৃত্তির পাপ অভিনয় দেখিতে চাহেন, তাহা হইলে একবার দেবী সিংহের বিবরণ অনুশীলন করিবেন। দেখিবেন, সেই ভীষণ অত্যাচারে কত কত জনপদ অরণ্যে পরিণত হইয়াছে। কত কত দরিদ্র প্রজা অন্নাভাবে জীবন বিসর্জ্জন  দিয়াছে। কত কত জমীদার ভিখারীরও অধম হইয়া দিন কাটাইয়াছে।...দেবী সিংহের নাম শুনিলে, আজিও উত্তরবঙ্গ প্রদেশের অধিবাসিগণ শিহরিয়া উঠে! আজিও অনেক কোমলহৃদয়া মহিলা মূর্চ্ছিতা হইয়া পড়েন। শিশুসন্তানগণ ভীত হইয়া, জননীর ক্রোড়ে আশ্রয় লয়!"

নির্যাতন, নিপীড়ন আর অন্তহীন লুণ্ঠনে তখন সর্বশ্রান্ত উত্তরবঙ্গের কৃষককূল। প্রাণ যখন একেবারেই ওষ্ঠাগত, তখন এ মৃত্যুপুরী থেকে মুক্তির  স্বপ্ন তাদের এগিয়ে নিলো একটি পূর্ণাঙ্গ বিদ্রোহের দিকে। নিজের মাটি, ইজ্জত ও অস্তিত্ব রক্ষায় তারা ঘুরে দাঁড়ালেন একটি রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে। আর তখনই আবির্ভাব একজন নূরলদীনের। নূরলদীন একজন মানুষ ছিলেন । একজন কৃষক ছিলেন। একজন মহৎপ্রাণ কৃষক, যার নেতৃত্বে হাজারো কৃষক বুকের তাজা রক্ত ঢেলে বিদ্রোহী হয়েছিল নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায়। এর বেশি ইতিহাসে নূরলদীনের আর কোনো পরিচয় পাওয়া যায় না। 

নূরুলদীন এক ঘোষণাপত্রে দেবী সিংহকে কর না দেওয়ার আদেশ দেন। বিদ্রোহের ব্যয় পরিচালনার জন্য ‘ডিংখরচা’ নামে চাঁদা আদায় করেন। এভাবে রংপুর, দিনাজপুর, কুচবিহারসহ উত্তরাঞ্চলের প্রায় সব কৃষক নূরুলউদ্দিনের নেতৃত্বে দেবী সিংহের বর্বর শোষণ-উৎপীড়নের প্রতিশোধ গ্রহণ ও এই অঞ্চল থেকে ইংরেজ শাসন উচ্ছেদের লক্ষ্যে প্রস্তুত হন।

১৭৮২ সালের শেষদিক থেকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কৃষকদের কণ্ঠ সোচ্চার হতে থাকে। যা দ্রুতই এগিয়ে যায় বিদ্রোহের দিকে। কাজিরহাট, কাকিনা, টেপা ও ফতেপুর চাকলা অঞ্চলে কৃষকরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিদ্রোহ শুরু করলে কুচবিহার ও দিনাজপুর অঞ্চলের কৃষকরাও এই বিদ্রোহে শামিল হন। কৃষকগণ নূরলদীনকে তাদের 'নবাব' হিসেবে ঘোষণা দেন। দয়াশীল নামে আরেকজনকে নিযুক্ত করা হয় তার দেওয়ান হিসেবে। নবাব নূরলদীন কৃষকদের মুক্তির স্বপ্নে বিভোর করে তোলেন। কৃষকরা নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় নূরলদীনকে স্বতঃফূর্তভাবে সহায়তা করতে থাকেন। প্রথমদিকে নূরলদীন ও উত্তরাঞ্চলের কৃষকদের প্রতিবাদ ছিল শান্তিপূর্ণ। তারা ভেবেছিলেন, ইংরেজ সরকার হয়েতো দেবী সিংহের অত্যাচারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। এ লক্ষ্যে তারা কৃষকদের উপর অত্যাচারের বিবরণ তাদের সই সহ গুডল্যান্ডের নিকট পাঠান। এবং ব্যবস্থা নিতে নির্দিষ্ট সময়ও বেঁধে দেওয়া হয়। কিন্তু গুডল্যান্ড নিজেই দেবী সিংহের সুবিধাভোগী ছিলেন। দেবী সিংহের লুটের টাকার বড় অংশ আসতো তার পকেটে। কাজেই তিনি এদিকে ভ্রূক্ষেপও করলেন না। 

১৭৮৩ খ্রিষ্টাব্দের শুরুতেই বিদ্রোহ প্রবল আকার ধারণ করে। বিদ্রোহী কৃষকেরা রংপুর থেকে দেবী সিংহের কর সংগ্রহকারীদের বিতাড়িত করে। টেপা, ফতেপুর ও বাকলায় বিদ্রোহ ভীষণ আকার ধারণ করে। টেপা জমিদারির নায়েব বিদ্রোহে বাধা দিতে এসে নিহত হন। কাকিনা, কাজিরহাট, ডিমলা এলাকায়ও একইরকম ঘটনা ঘটে। ডিমলার জমিদার গৌরমোহন চৌধুরীও বিদ্রোহী কৃষকদের বাধা দিতে এসে নিহত হন। বিদ্রোহীদের সাফল্যে উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন স্থান থেকে বিশেষ করে দিনাজপুর, কুচবিহারের কৃষকেরাও ‘নবাব’ নূরুলদীনের বাহিনীতে যোগ দিয়ে বিপ্লবে অংশগ্রহণ করে।

বিদ্রোহ যখন চরমে, তখন রংপুরের কালেক্টর গুডল্যাড দেবী সিংহকে রক্ষায় ও কৃষকদের ন্যায্য দাবি পর্যুদস্ত করার জন্য কয়েক দল সিপাহি পাঠান, যার নেতৃত্বে ছিলেন লেফটেন্যান্ট ম্যাকডোনাল্ড। লেফটেন্যান্ট ম্যাকডোনাল্ড অবশ্য নূরলদীনের সাথে সম্মুখ সমরের দিকে গেলেন না। তিনি আশ্রয় নিলেন কূটকৌশলের। ছদ্মবেশ নিয়ে এগিয়ে গিয়ে কৌশলে রাতের আধাঁরে ঘিরে ফেললেন বিদ্রোহীদের ঘাঁটি পাটগ্রাম। দিনটি ১৭৮৩ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারি। অতি ভোরে ঘুমন্ত মুক্তিকামী কৃষকদের উপর ভারি অস্ত্রসহ হামলে পড়লেন লেফটেন্যান্ট ম্যাকডোনাল্ড ও তার বাহিনী।

বিদ্রোহ দমনে ইংরেজরা বর্বরের ভূমিকায় অংশ নেন। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয় এবং মানুষ দেখামাত্রই পশুর মতো গুলি করে। বিদ্রোহের নায়ক ‘নবাব’ নূরুলদীন গুরুতর আহত হয়ে শত্রুদের হাতে গ্রেপ্তার হন এবং তাঁর বিশ্বস্ত দেওয়ান দয়াশীল নিহত হন। কিছুদিন পর নির্মম অত্যাচারের শিকার হয়ে ‘নবাব’ নূরুলদীন মারা যান।

যুদ্ধে পরাজয় ও নূরলদীনের মৃত্যু কৃষকদের হতোদ্যম করলেও লড়াই থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। বিচ্ছিন্নভাবে তাদের প্রতিরোধ অব্যাহত থাকে। শহীদ নবাব নূরলদীনের আদেশকে মান্য করে তারা বন্ধ করে দেয় সকল প্রকার খাজনা প্রদান। প্রচুর টাকা খাজনা বাকি পড়লে ইংরেজ শাসকদের টনক নড়ে। ঘটনা তদন্তে আসেন পিটারসন নামক ইংরেজ সেনা অফিসার। তিনি অবশ্য রেভিনিউ কমিটির কাছে নির্মোহভাবে কৃষকদের উপর নিপীড়নের চিত্র তুলে ধরেন। অতঃপর দেবী সিংহকে রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় আর কালেক্টর গুডল্যান্ডকে প্রত্যাহার করে নিয়ে যাওয়া হয় কলকাতায়।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন