৯ ফেব, ২০২০

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার আদ্যোপান্ত



সাবেক স্বৈরশাসক এইচ এম এরশাদের পর খালেদা জিয়া হলেন বাংলাদেশের দ্বিতীয় সরকারপ্রধান, যার বিরুদ্ধে কোনো দুর্নীতি মামলার রায় ও সাজা হয়েছে। দুর্নীতির দায়ে এরশাদের মতো জেলও খাটতে হয়েছে খালেদা জিয়াকে। তবে ব্যবধান হলো খালেদা জিয়ার মামলাটি বানোয়াট। এখানে যা ঘটনা এর সাথে দুর্নীতির সম্পর্ক নেই। মূল ঘটনা জানলে আপনি অবাকই হবেন।  

মামলা : 
প্রধানমন্ত্রীর এতিম তহবিলে ইউনাইটেড সৌদি কমার্শিয়াল ব্যাংক থেকে ১২.৫৫ লাখ মার্কিন ডলার আসে যা বাংলাদেশি টাকায় তৎকালীন ৪ কোটি ৪৪ লাখ ৮১ হাজার ২১৬ টাকা। তিনি প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় ১৯৯১ সালের ৯ জুন থেকে ১৯৯৩ সালের ৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই অর্থ দেশের প্রতিষ্ঠিত কোনো এতিমখানায় না দিয়ে অস্তিত্ববিহীন জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট গঠন করেন। অথচ কোনো নীতিমালা তিনি তৈরি করেননি, করেননি কোনো জবাবদিহির ব্যবস্থাও। অথচ খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রীর এতিম তহবিল থেকে ২ কোটি ৩৩ লাখ ৩৩ হাজার ৫০০ টাকা অস্তিত্ববিহীন জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টে পাঠান। পরে ওই টাকা আত্মসাৎ করেন যার জন্য তিনি দায়ী। তদন্ত কর্মকর্তা অভিযোগপত্রে বলেন, খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় থেকে নিজের পদমর্যাদা বলে সরকারি এতিম তহবিলের আর্থিক দায়িত্ববান বা জিম্মাদার হয়ে বা তহবিল পরিচালনার ভারপ্রাপ্ত হয়ে অপরাধজনক বিশ্বাসভঙ্গ করে দণ্ডবিধির ৪০৯ এবং ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারার অপরাধ করেছেন।

আসামি যারা :
দুর্নীতি দমন কমিশনের  তখনকার উপ সহকারী পরিচালক  হারুন-অর রশিদ (বর্তমানে উপ-পরিচালক) এ মামলার এজাহারে খালেদা জিয়াসহ মোট সাতজনকে আসামি করেন। বাকি ছয়জন হলেন- খালেদার বড় ছেলে তারেক রহমান, জিয়াউর রহমানের বোনের ছেলে মমিনুর রহমান, মাগুরার সাবেক সাংসদ কাজী সালিমুল হক (ইকোনো কামাল), সে সময় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিবের দায়িত্বে থাকা (পরে মুখ্য সচিব হন) কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী, ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ, গিয়াস উদ্দিন আহমেদ ও সৈয়দ আহমেদ ওরফে সায়ীদ আহমেদ।

দুদক কর্মকর্তা হারুন-অর রশিদ ২০০৯ সালের  ৫ অগাস্ট আদালতে যে অভিযোগপত্র দেন, সেখান থেকে গিয়াস উদ্দিন ও সায়ীদ আহমেদের নাম বাদ দেওয়া হয়। তাদের অব্যাহতির কারণ হিসেবে বলা হয়, গিয়াস উদ্দিন আহমেদ অনেক আগে থেকে সপরিবারে যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন। অভিযোগে তার সংশ্লিষ্টতার প্রমান পাওয়া যায়নি। আর সায়ীদ আহমেদ নামে কারও অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।  সাবেক সাংসদ কামাল জালিয়াতি করে ট্রাস্টের কাজে ওই দুই জনের নাম ব্যবহার করেছেন।

অভিযোগে যা রয়েছে :
এজাহারে বলা হয়, খালেদা জিয়া তার প্রধানমন্ত্রীত্বের প্রথম মেয়াদে ১৯৯১-১৯৯৬ সময়কালে এতিম তহবিল নামে সোনালী ব্যাংকের রমনা শাখায় একটি হিসাব খোলেন। একটি বিদেশি সংস্থা ১৯৯১ সালের ৯ জুন ওই হিসাবে ইউনাইটেড সৌদি কর্মাশিয়াল ব্যাংকের মাধ্যমে অনুদান হিসেবে ৪ কোটি ৪৪ লাখ ৮১ হাজার ২১৬ টাকা দেয়। ওই টাকা দীর্ঘ দুই বছর কোনো এতিমখানায় না দিয়ে জমা রাখা হয়। এরপর জিয়া পরিবারের তিন সদস্য তারেক রহমান, তার ভাই আরাফাত রহমান এবং তাদের ফুপাতো ভাই মমিনুরকে দিয়ে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট গঠন করে ওই টাকা তাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়।

মামলায় অভিযোগ করা হয়, ওই ট্রাস্ট গঠনের ক্ষেত্রে সরকারি নীতিমালা মানা হয়নি। এছাড়া ট্রাস্টের ঠিকানা হিসেবে খালেদা জিয়ার সেনানিবাসের ৬ নম্বর মইনুল রোডের বাড়ির ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে। পরে ওই টাকা দুইভাগে ভাগ করে ট্রাস্টের বগুড়া ও বাগেরহাট শাখার জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়। এর মধ্যে ২ কোটি ৩৩ লাখ ৩৩ হাজার ৫’শ টাকা ১৯৯৩ সালের নভেম্বরে বরাদ্দ দেওয়া হয় বগুড়া জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের নামে। ওই অর্থ থেকে ২ লাখ ৭৭ হাজার টাকায় ট্রাস্টের নামে বগুড়ার দাঁড়াইল মৌজায় ২.৭৯ একর জমি কেনা হয়।

কিন্তু অবশিষ্ট টাকা এতিমখানায় ব্যয় না করে ব্যাংকে জমা রাখা হয়। ২০০৬ সনের ১২ এপ্রিল পর্যন্ত তা সুদে আসলে বেড়ে ৩ কেটি, ৩৭ লাখ ৭ শ ৫৭ টাকা ৩২ পয়সা হয়। এজাহারে বলা হয়, ২০০৬ সালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা তার ছেলে তারেক রহমান ও মমিনুর রহমানকে দিয়ে তিন কিস্তিতে ছয়টি চেকের মাধ্যমে তিন কোটি ৩০ লাখ টাকা তুলে প্রাইম ব্যাংকের গুলশান শাখায় স্থায়ী আমানত (এফডিআর) করেন। এরপর ওই টাকা কাজী সালিমুল হক কামাল ও অন্যদের মাধ্যমে সরিয়ে অন্য খাতে ব্যবহার করা হয়। মামলায় জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টকে ‘নাম সর্বস্ব ও অস্তিত্বহীন’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়। 

কার দায় কতটুকু?
খালেদা জিয়া: অভিযোগপত্রে বলা হয়, সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া অসৎ উদ্দেশ্যে পরিকল্পিতভাবে প্রধানমন্ত্রীর এতিম তহবিলের নামে পাওয়া টাকা দেশের প্রতিষ্ঠিত কোনো এতিমখানায় না দিয়ে, কোনো নীতিমালা তৈরি না করে, জবাবদিহিতার ব্যবস্থা না করে নিজের পরিবারের সদস্যদের দিয়ে অস্তিত্বহীন ট্রাস্ট সৃষ্টি করে প্রধানমন্ত্রীর পরিচালিত তহবিলের টাকা ওই ট্রাস্টে দেন। পরে বিভিন্ন উপায়ে ওই টাকা আত্মসাত করা যায়, যার জন্য খালেদা জিয়াই দায়ী।

তারেক রহমান: প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সহায়তায় তার ছেলে তারেক তাদের বাসস্থানের ঠিকনা ব্যবহার করে ‘অস্তিত্বহীন’ জিয়া এতিমখানা ট্রাস্ট সৃষ্টি করেন। ওই ট্রাস্টের নামে সোনালী ব্যাংকের গুলশান নর্থ সার্কেল শাখায় হিসাব খুলে সেখানে তিনি প্রধানমন্ত্রীর এতিম তহবিলের টাকা জমা করেন। পরে ট্রাস্ট ডিডের শর্ত ভেঙে ওই টাকা তিনি ট্রাস্টের সঙ্গে সম্পর্কহীন সালিমুল হক কামালকে দেন। পরে সেখান থেকে ২ কোটি ১০ লাখ টাকা বিভিন্ন  প্রক্রিয়ায় আত্মসাত করা হয়।

মমিনুর রহমান: তারেকের ফুপাতো ভাই মমিনুর রহমানও একইভাবে প্রধানমন্ত্রীর এতিম তহবিলের টাকা আত্মসাতে সহযোগিতা করে অপরাধ করেছেন।

কাজী সালিমুল হক কামাল: সাবেক সাংসদ সালিমুল হক কামালের সঙ্গে ওই ট্রাস্টের কোনো সম্পর্ক না থাকার পরও তিনি তারেক রহমানের কাছ থেকে পাঁচটি চেক নিয়ে এফডিআর করেন এবং পরে তা ভাঙান। সে সময় প্রাইম ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি শাখা ব্যবস্থাপকদের দিয়ে সৈয়দ আহমেদ ও গিয়াস উদ্দিন আহমেদ নামের দুই ব্যক্তির নাম ব্যবহার করে জালিয়াতির মাধ্যমে এফডিআর ভাঙিয়ে সেই টাকা শরফুদ্দিন আহমেদের অ্যাকাউন্টে জমার ব্যবস্থা করেন।

কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী: প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের তখনকার সচিব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী প্রধানমন্ত্রীর এতিম তহবিল গঠন ও পরিচালনার জন্য কোনো নীতিমালা তৈরি না করে, কোনো জবাবদিহিতার ব্যবস্থা না করে তখনকার প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার অনুমোদন নিয়ে তার পরিবারের সদস্যদের দিয়ে অস্তিত্বহীন ট্রাস্ট সৃষ্টি করে সেখানে এতিম তহবিলের টাকা দেওয়ার সুযোগ তৈরি করেন। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের মূল নথি সংরক্ষণ না করে তা তিনি গায়েব করে দেন। ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে তিনি ওই অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় খালেদা জিয়া ও তার পরিবারকে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করেন।

শরফুদ্দিন আহমেদ: ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন এই আত্মসাতে সহযোগিতা করে ব্যংকে তার নিজের নামের অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তুলে আত্মসাতের প্রক্রিয়ায় অংশ নেন।

মূল ঘটনা : 
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের টাকা খরচই হয়নি। সব টাকা ব্যাংকে আছে। অতএব এখানে আত্মসাতের কোনো ঘটনা ঘটেনি। ২০০৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত বাংলাদেশি ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদের আশুলিয়ার জমি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টকে ৩ কোটি ২৫ লাখ টাকায় বিক্রির জন্য কথাবার্তা হয়। সে বছরই একটি চুক্তির আওতায় তিনি সোয়া ২ কোটি টাকা অগ্রিম নেন। ২০০৭ সালের ৩১ মের মধ্যে জমি বিক্রির দলিল সম্পাদনের তারিখ থাকলেও তা সেনা সরকারের হস্তক্ষেপে হয়নি। শরফুদ্দিন আহমেদ আদালতকে এ তথ্য দিয়ে আরও বলেন, ‘২০১২ সালের জানুয়ারিতে একটি টাকার মোকদ্দমা মামলায় আমি নোটিশপ্রাপ্ত হই যে ট্রাস্টকে ওই টাকা ফেরত দিতে হবে। আদালত ওই সোয়া ২ কোটি টাকা ২০১৩ সালে টাকা ফেরত দিতে ডিক্রি জারি করেন। এরপর আমি প্রাইম ব্যাংক নিউ ইস্কাটন ও গুলশান শাখা থেকে ১৩টি পে-অর্ডারের মাধ্যমে ট্রাস্টকে হস্তান্তর করি।’ এই হচ্ছে মূল ঘটনা। এখানে দুর্নীতির কোনো ঘটনাই ঘটেনি। 

আরেকটি অভিযোগ ছিলো প্রধানমন্ত্রীর তহবিলের টাকা কেন জিয়া অরফানেজ নামে নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের জন্য বরাদ্দ হবে। এই প্রসঙ্গে ২০১৫ সালে কুয়েত দূতাবাস পত্রের মাধ্যমে বাংলাদেশকে নিশ্চিত করেছে তারা। ২০১৫ সালের ১১ আগস্ট সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এ জে মোহাম্মদ আলীকে ঢাকার কুয়েত দূতাবাসের দেওয়া এক পত্রে উল্লেখ করা হয়, ‘উক্ত অনুদান '১২ লাখ ৫৫ হাজার ডলার' (৪ কোটি ৪৪ লাখ ৮১ হাজার টাকা) জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টকে দেওয়া হয়েছিল এবং তা কোনো ব্যক্তি কিংবা সরকার বা অন্য কোনো উদ্দেশ্যে দেওয়া হয়নি।’ অতএব এই টাকার বৈধ মালিক জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট। এটা বাংলাদেশ সরকারের টাকা নয়। কুয়েতের আমীর এই টাকা প্রধানমন্ত্রীর তহবিলে পাঠাননি।  

এখানে একটা কথা বলা যেতে পারে শুধু এতোদিন পর্যন্ত এই টাকা ব্যবহার করা হয়নি কেন? কিন্তু এতিমের টাকা মেরে দিয়েছে বলে যে কথা চালু করেছে তা নিতান্তই মিথ্যা ও বানোয়াট। টাকা এখনো ব্যাংকেই আছে। শুধু শরফুদ্দিন আহমেদ থেকে ট্রাস্টের নামে জমি ক্রয় করার কথা ছিলো। পরবর্তীতে ক্রয় করতে পারেনি তত্ববধায়ক সরকারের সময়ে। এবং তারাই এই মামলা করে বিএনপি'র শীর্ষ নেতৃত্বকে ফাঁসানোর জন্য।  

মঈন ফখরুদ্দিনের আমলে ভারতের নির্দেশে বিএনপিকে দুর্নীতিবাজ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। তারই অংশ হিসেবে খালেদা ও তারেককে দুর্নীতিবাজ হিসেবে উপস্থাপন করার জন্য তারা এই মামলা সাজায়। আর এই মামলাকে পুঁজি করে স্বৈরাচারী হাসিনা খালেদা জিয়াকে ফাঁসিয়ে দেয়।  

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন