মুঘল সম্রাট বাবরের বিশতম বংশধর ও শেষ সম্রাট বাহাদুর শাহ ১৮৩৭ সালে ক্ষমতায় আরোহন করেন। এই ক্ষমতা নিরঙ্কুশ ছিল না। তিনি ছিলেন মূলত ইংরেজদের অনুদানপ্রাপ্ত। তিনি প্রকৃত শাসক ছিলেন না। তিনি কোম্পানি থেকে বার্ষিক এক লক্ষ টাকা ভাতা গ্রহণ করতেন। ইংরেজদের সাথে ভাতা ও উত্তরাধিকার নিয়ে তার মনোমালিন্য ছিল। এর মধ্যেই শুরু হয় সর্বাত্মক স্বাধীনতা আন্দোলন। এই আন্দোলনের মূল নেতা হিসেবে ধারণা করা হয় সম্রাট বাহাদুর শাহকে। যদিও তিনি আসলে কতটুকু নেতৃত্ব দিয়েছেন তা প্রশ্নবিদ্ধ।
বাহাদুর শাহ সম্রাট হিসেবে আরোহণের ২০ বছর পর সূত্রপাত হয় ঐতিহাসিক স্বাধীনতা বিদ্রোহের। এটি পলাশীর যুদ্ধের ১০০ বছর পরের ঘটনা। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সমগ্র ভারতবর্ষ দখল করে নিয়েছে। দেশবাসীর সাথে সাথে ইংরেজদের অধীনে থাকা এদেশীয় সৈন্যদের ওপরও চলছে জুলুম, বঞ্চনা ও নির্যাতন। একের পর এক দেশীয় রাজ্য ইংরেজ অধিকারে নিয়ে যাওয়া, লাখেরাজ ও দেবোত্তর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা, কারাগারে হিন্দু-মুসলমান সিপাহিদের জন্য একই খাবারের ব্যবস্থা, ঘিয়ের মধ্যে চর্বি ও আটার মধ্যে হাড়গুঁড়োর সংমিশ্রণ, গরু ও শূকরের চর্বি মিশ্রিত কার্তুজ বিতরণ ইত্যাদি ভারতবর্ষের জনমনে এবং সৈনিকদের মনে ব্যাপক প্রভাব ফেলে।
ভারতীয় সিপাহীদের মধ্যে ধূমায়িত বিক্ষোভ ও অস্থিরতার প্রথম বহিঃপ্রকাশ ঘটে ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দের ২২ জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের দমদম সেনাছাউনিতে। সিপাহীরা ইংরেজ অফিসারকে জানায়, এনফিল্ড রাইফেলের জন্য যে কার্তুজ তৈরি হয়, তাতে গরু ও শূকরের চর্বি মেশানো থাকে এবং এতে তাদের ধর্ম নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কর্তৃপক্ষ সিপাহীদের বুঝিয়ে শান্ত করে। কিন্তু খবরটি একে একে বিভিন্ন সেনাছাউনিতে পৌঁছে যায় এবং তা সিপাহীদের মধ্যে বিদ্রোহের রূপ ধারণ করে। প্রথম বিস্ফোরণ ঘটে পশ্চিমবঙ্গের বহরমপুর সেনাছাউনিতে ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি। ১৯ নম্বর পদাতিক বাহিনীর সিপাহীরা কার্তুজ নিতে অস্বীকার করে, রাতে অস্ত্রাগারের দরজা ভেঙে পুরনো মাসকেট বন্দুক ও কার্তুজ সংগ্রহ করে। তারা এনফিল্ড রাইফেলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করছিল। পরিস্থিতি সামাল দিতে সিপাহীদের নিরস্ত্র ও বরখাস্ত করা হয়। এই সংবাদও দ্রুত পৌঁছে যায় বিভিন্ন সেনানিবাসে। ২৯ মার্চ রোববার ব্যারাকপুরের দেশীয় সিপাহিরা বিদ্রোহ করে। মঙ্গল পান্ডে নামের সিপাহি গুলি চালিয়ে ইংরেজ সার্জেন্টকে হত্যা করে।
প্রহসনমূলক বিচারে মঙ্গল পান্ডে তাকে সহায়তার অভিযোগে জমাদার ঈশ্বরী পান্ডেকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। ৮ এপ্রিল সকাল ১০টায় তাদের ফাঁসি দেয়া হয়। এর পরিণতিতে বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়ে ভারতের উত্তর থেকে মধ্যপ্রদেশ এবং জলপাইগুড়ি থেকে পূর্ববাংলার দক্ষিণ-পূর্ব কোণের চট্টগ্রাম পর্যন্ত। ৯ মে উত্তর প্রদেশের মিরাটের সিপাহীরা বিদ্রোহ ঘোষণা করেন দিল্লির পথে অগ্রসর হন। ১১ মে সিপাহীরা দিল্লি অধিকার করে বহু ইংরেজকে হত্যা ও বিতাড়ন করেন। দেশপ্রেমিক সিপাহিরা এ দিন লালকেল্লায় প্রবেশ করে নামেমাত্র মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফরকে ভারতের স্বাধীন সম্রাট বলে ঘোষণা করেন। সিপাহীরা সম্রাটের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে শপথ নেন। এদিন গভীর রাতে লালকেল্লায় একুশবার তোপধ্বনির মাধ্যমে ৮২ বছরের বৃদ্ধ সম্রাটকে দেওয়ান-ই খানোস এ সম্মান জানানো হয়।
বাহাদুর শাহ জাফর সিপাহীদের বিপ্লব তথা ভারতবর্ষের প্রথম সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব দিচ্ছেন এ সংবাদ কানপুর, লক্ষ্মৌ, বিহার, ঝাঁশি, বেরিলি থেকে শুরু করে পশ্চিম ও পূর্ববাংলার সর্বত্র সিপাহিরা গর্জে ওঠে ‘খালক-ই খুদা, মুলক ই বাদশাহ, হুকুম ই সিপাহী।’ অর্থাৎ আল্লাহর দুনিয়া, বাদশার রাজ্য, সিপাহির হুকুম। একের পর সেনাছাউনিতে বিদ্রোহ হতে থাকে। ইংরেজরা অতি নির্মমভাবে বিদ্রোহ দমন করে। হাজার হাজার স্বাধীনতাকামীর রক্তে রঞ্জিত হয় ভারতবর্ষের মাটি। ইংরেজদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষও বিক্ষুব্ধ ছিল। তারাও এই বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করে।
কিন্তু ভারতীয়দের এই সংগ্রাম সফল হতে পারেনি। ইংরেজরা দিল্লি দখল করে নেয় এবং সম্রাট ২১ সেপ্টেম্বর আত্মসমর্পণ করেন। ইংরেজ সৈন্যরা মীর্জা মোগল, মীর্জা খিজির সুলতান, মীর্জা আবু বকরসহ ২৯ জন মুঘল শাহজাদাসহ বহু আমির ওমরাহ, সেনাপতি ও সৈন্যকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। সম্রাটকে বিচারের নামে প্রহসনের আদালতে দাঁড় করানো হয়। হাজির করা হয় বানোয়াট সাক্ষী। বিচারকরা রায় দেন, দিল্লির সাবেক সম্রাট ১০ মে থেকে ১ অক্টোবর পর্যন্ত ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ সংগঠনের দায়ে অপরাধী। তার শাস্তি চরম অর্থাৎ মৃত্যুদণ্ড হওয়া উচিত। কিন্তু তার বার্ধক্যের কথা বিবেচনা করে প্রাণ দণ্ডাদেশ না নিয়ে নির্বাসনে পাঠানোর সুপারিশ করা হয়। অবশেষে বাহাদুর শাহকে ইয়াঙ্গুনে নির্বাসনে পাঠানো হয় এবং সেখানেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
বাহাদুর শাহকে বাংলাদেশে প্রাক্তন ভিক্টোরিয়া পার্ককে বাহাদুর শাহ পার্ক নামকরণ করা হয়। বাংলাদেশের প্রধান নৌবন্দর সদরঘাটে এই পার্ককে ঘিরে রয়েছে সাতটি রাস্তা। সিপাহী বিদ্রোহের সাথে সংশ্লিষ্ট সৈনিক ও দেশপ্রেমিক জনতার একটি অংশকে এই পার্কের গাছগুলিতে ঝুলিয়ে কার্যকর করা হয়। ১৯৫৭ সালে পাকিস্তান আমলে ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা আন্দোলনের ১০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে শহীদদের স্মরণে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয় এবং এই পার্কের নাম পরিবর্তন করে বাহাদুর শাহ পার্ক নামকরণ করা হয়। এই কাজটি করে ডিআইটি তথা ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট। ডিআইটির বর্তমান নাম রাজউক তথা রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন