৩০ মে, ২০২০

দাওয়াত দানে আমরা কাকে গুরুত্ব দিব?



একবার আমাদের মহানবী সা. মক্কার সর্দারদের কাছে ইসলামের দাওয়াত দিচ্ছিলেন। সেখানে ছিলেন উতবা, শাইবা, আবু জাহেল, উমাইয়া ইবনে খালাফ, উবাই ইবনে খালাফসহ আরো অনেক নেতৃবৃন্দ। সেসময় তারা মহানবী নানান বিষয়ে প্রশ্ন করছিলেন। মহানবী তাদের জবাব দিচ্ছিলেন। এটা নবুয়্যতি জিন্দেগীর একেবারে শুরুর দিকের ঘটনা। তখনো মক্কার নেতারদের সাথে রাসূলের সম্পর্ক মারামারির হয়ে উঠে নাই। ফলে রাসূল সা. তাদের বার বার বুঝানোর চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু তারা সত্য মেনে নিতে বার বার অস্বীকার করছিলেন।

এমন সময় আল্লাহর রাসূলের কাছে সত্যের প্রতি আগ্রহী হয়ে কিছু কথা জানতে এসেছেন আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম। মহানবীর কাছে ইসলাম সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন করতে চাইলেন। তিনি মোটেই প্রভাবশালী কেউ ছিলেন না। তবে তিনি ছিলেন আল্লাহর রাসূলের আত্মীয়। তিনি খাদিজা রা.-এর ফুফাতো ভাই। সেই হিসেবে আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম ছিলেন রাসূল সা.-এর শ্যালক। তার চোখে সমস্যা ছিলো। তিনি খুবই কম দেখতেন। 

রাসূল সা. যখন মক্কার নেতাদের সাথে কথা বলছিলেন তখন আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুমের প্রশ্ন রাসূল সা.-এর মনে বিরক্তি তৈরি করে। তার প্রশ্নে নেতাদের সাথে আলাপে বাধা সৃষ্টি হওয়ায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিরক্ত হলেন। তিনি তার কথায় কান দিলেন না। তিনি বিরক্ত হয়ে ভ্ৰকুঞ্চিত করলেন। আল্লাহর রাসূল ইবনে উম্মে মাকতুমকে কোনো কটু কথা বলেননি, তাড়িয়ে দেননি। শুধু ভ্রুকুঞ্চন করেছেন। 

আর এটাই পছন্দ করেননি আল্লাহ তায়াল। তিনি এই ঘটনার প্রেক্ষিতে সূরা আবাসা নাজিল করেছেন। আল্লাহ তায়ালা সূরা আবাসার ১-১২ নং আয়াতে বলেন, 
//সে ভ্রুকুঁচকাল ও মুখ ফিরিয়ে নিল। কারণ সেই অন্ধটি তার কাছে এসেছে। তুমি কী জানো, হয়তো সে শুধরে যেতো অথবা উপদেশের প্রতি মনোযোগী হতো এবং উপদেশ দেয়া তার জন্য উপকারী হতো? অথচ যেসব ব্যক্তি বেপরোয়া ভাব দেখায়, তুমি তার প্রতি মনোযোগী হচ্ছো। অথচ তারা যদি শুধরে না যায় তাহলে তোমার উপর এর দায়িত্ব বর্তাবে না। আর যে নিজে তোমার কাছে দৌড়ে আসে এবং সে (আল্লাহকে) ভয়ও করে, অথচ তার দিক থেকে তুমি মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছো। কখনো নয়, এটি তো একটি উপদেশ। যার ইচ্ছা এটি গ্রহণ করবে।// 

আল্লাহ কেন এই ঘটনাকে এতো গুরুত্ব দিয়েছেন? 
বিষয়টা এমন ছিলো না রাসূল সা. আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুমকে প্রশ্নের জবাব দেন নি বা দিবেন না। অথবা তাকে সত্যের দাওয়াত দিবেন না। এখানে মূল ব্যাপার হলো দ্বীন প্রচারের
ব্যাপারে রসূলুল্লাহ সা. একটি মৌলিক বিষয়ে অবহেলা প্রদর্শন করেছিলেন। আর এই বিষয়টি বুঝাবার জন্যই মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা প্রথমে ইবনে উম্মে মাকতূমের সাথে আচরণের ব্যাপারে রাসূল সা.-কে সতর্ক করলেন। তারপর সত্যের আহবায়কের দৃষ্টিতে কোন জিনিসটি সত্যিকারভাবে গুরুত্ব লাভ করবে এবং কোন জিনিসটি কম গুরুত্ব লাভ করবে তা তাঁকে জানান। 

একদিকে এক ব্যক্তির বাহ্যিক অবস্থা পরিস্কারভাবে একথা জানিয়ে দিচ্ছে যে, সে সত্যের সন্ধানে ফিরছে, বাতিলের অনুগামী হয়ে আল্লাহর গজবের মুখে পড়ে যাওয়ার ভয়ে সে ভীত। তাই সত্য সঠিক পথ সম্পর্কে জানার জন্য সে নিজে পায়ে হেঁটে চলে এসেছে। অন্যদিকে আরেক ধরনের ব্যক্তির আচরণ সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করছে যে, সত্য অনুসন্ধানের কোনো আগ্রহই তাদের মনে নেই। 

এই দুই কোয়ালিটির লোকের মধ্যে কে ঈমান আনলে দ্বীনের বেশি উপকার হতে পারে এবং কার ঈমান আনা দ্বীনের প্রচার আর প্রসারের জন্য খুব বেশি সহায়ক নয়, এটা দেখার বিষয় নয়। বরং এখানে দেখার বিষয় হচ্ছে, কে হেদায়াত গ্রহণ করে নিজেকে শুধরে নিতে প্রস্তুত এবং কে হেদায়াতের মতো এই মহামূল্যবান সম্পদকে কোনো মূল্যায়নই করে না। প্রথম ধরনের লোক অন্ধ, কানা, খোঁড়া, গরীব, শক্তি সামর্থহীন হলে এবং বাহ্যত দ্বীনের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বড় রকমের অবদান রাখার যোগ্যতাসম্পন্ন না হলেও দায়ির কাছে তিনিই হবেন মূল্যবান ব্যক্তি।  

তার দিকেই দায়িকে নজর দিতে হবে। কারণ এই দাওয়াতের আসল উদ্দেশ্য আল্লাহর বান্দাদের জীবন ও কার্যক্রম সংশোধন করা। আর এই ব্যক্তির অবস্থা একথা প্রকাশ করছে যে, তাকে উপদেশ দেওয়া হলে সে সংশোধিত হয়ে যায়। আর দ্বিতীয় ধরনের লোকদের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা স্পষ্ট করেছেন, তারা সমাজে যতই প্রভাবশালী হোক না কেন, সত্যের আহবায়কের তাদের পেছনে লেগে থাকার কোন প্রয়োজন নেই। কারণ তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মনীতিই প্রকাশ্যে একথা জানাচ্ছে যে, তারা সংশোধিত হতে চায় না। কাজেই তাদের সংশোধন করার প্রচেষ্টায় অধিকতর সময় ব্যয় করা সময়ের অপচয়। তারা সংশোধিত হতে না চাইলে তাদেরই ক্ষতি, সত্যের আহবায়কের ওপর এর কোন দায় দায়িত্ব নেই। 

এর মানে এই না যে আমরা প্রভাবশালীদের দাওয়াত দেব না। তাদের জন্য মেহনত করবো না। না, এখানে তা বুঝানো হয়নি। বরং আপনি প্রভাবশালীদের অবশ্যই টার্গেট করবেন। আপনার টার্গেটে বিশেষভাবে প্রভাবশালীদের রাখবেন। তবে গুরুত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে যারা সত্য গ্রহণে আগ্রহী তাদের গুরুত্ব দিবেন। আল্লাহর রাসূল সা. মক্কার যোগ্যতাসম্পন্ন নেতা আবুল হাকাম (আবু জাহেল) ও উমর ইবনুল খাত্তাবের জন্য বিশেষভাবে দোয়া করতেন। আল্লাহ যেন তাদেরকে ইসলামে দাখিল করান। এতে আল্লাহর রাসূল সা.-এর ইসলামের প্রচার অনেক সহজ হবে। 

তবে আমাদের সমাজে অনেককেই বলতে শোনা যায় ছাত্রশিবির আগের মতো মেধাবীদের টানতে পারে না। বর্তমান ছাত্রশিবির যারা করে তারা যোগ্যতাসম্পন্ন নয়। মেধাবীদের আগ্রহী করে তোলার মতো উপকরণ এখন জামায়াত শিবিরে নেই। আবার যারা আগে শিবির করেছেন এখন নানান কারণে জামায়াতে একটিভ হতে পারছেন না এমন ভাইদের সাথে দেখা হলেই তারা বলে কেউ তাদের সাথে যোগাযোগ করে না। খোঁজ নেয় না। যথাযথ মূল্যায়ন হচ্ছে না সংগঠনে। তাই তারা আগাতে পারছেন না। 

আমি মনে করি সেসব ভাইদের জন্যে 'আবাসা' সূরাটি উত্তম জবাব। দায় সংগঠনের কিংবা দায়ির নয়। আপনি কেন ইসলামী আন্দোলনে একটিভ হতে পারছেন না সত্য উপলব্ধি করার পরও এর দায় পুরোপুরি আপনার। সংগঠন ইসলামের উপদেশগুলো পৌঁছে দিয়েছে। যার ইচ্ছে গ্রহণ করবে। যা ইচ্ছে বিরত থাকবে। মেধাবী ও প্রভাবশালীরা আন্দোলনে এলেই সফল নতুবা ব্যর্থ এই ধারণা যেন আমাদের অন্তরে না থাকে। বরং আমরা সব মানুষের কাছে যথাযথভাবে দাওয়াত পৌঁছাতে পেরেছি কিনা সেটাই হবে আমাদের পর্যালোচনার বিষয়। আল্লাহর কাছে সেই সফল যে ইসলামের প্রতি আগ্রহী। আল্লাহ তায়ালা আমাদের কবুল করুন। 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন