মাওলানা মুহাম্মদ আলী জওহর |
বাংলা এবং উপমহাদেশের মুসলিমরা ইংরেজদের কাছে ক্ষমতা হারিয়ে ও নির্যাতিত হয়ে দারুণভাবে হতাশ ছিলো। সেই হতাশার মধ্যে একটু আশার প্রদীপ ছিলো তুর্কি সালতানাত। বিশাল সালতানাত মুসলিমদের বুকে সাহস যোগাতো। এদেশের মুসলিমরা তাদের মনোবেদনায় কিছুটা সান্ত্বনা লাভের চেষ্টা করেছিল তুরস্কের সুলতানকে অবলম্বন করে।
তুরস্ক শুধু মুসলিম রাষ্ট্রমাত্র ছিলনা, বরঞ্চ তুরস্কের সুলতানকে মুসিলম জাহানের খলিফা ও মুসলিম জাহানের ঐক্যের প্রতীক মনে করা হতো। অবশ্য যতদিন ভারতে মুগল সাম্রাজ্য শক্তিশালী ছিল, ততোদিন তুরস্কের সুলতানকে এ মর্যাদা দেয়া হয়নি।
যাই হোক, পরবর্তীকালে মুসলমানদের মধ্যে প্যান ইসলামী চেতনা জাগ্রত হয়। এজন্য জামালুদ্দিন আফগানীর আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়েছেন তুরস্কের শেষ কার্যকর সুলতান আব্দুল হামিদ দ্বিতীয়। জামালউদ্দিনের বিশ্বব্যাপী প্রচারের ফলে তুরস্কের সুলতানকেই এদেশের মুসলিমরা ঐক্যের প্রতীক হিসাবে গ্রহণ করে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্ক ব্রিটিশের বিপক্ষ দলে যোগদান করে। ভারতীয় মুসলমান আশা করেছিলো, ব্রিটিশকে তাদের অকুন্ঠ সমর্থনের কারণে তুরস্ককে কোন প্রকার শাস্তি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হবে। লয়েড জর্জ সে ধরনের আশ্বাসও দিয়েছিলেন। কিন্তু মুসলিম বিশ্বের ঐক্যপ্রতীক বিনষ্ট করাই ছিল ব্রিটিশদের উদ্দেশ্য। তার জন্যেই লরেন্সকে পাঠানো হয় আরবদের মধ্যে আরব জাতীয়তার বিষাক্ত মন্ত্রপ্রচারক হিসাবে। মক্কার শরীফ হুসাইন হাশেমী লরেন্সের প্রচারণায় প্রভাবিত হয়ে ‘আরবদদের জাতীয় স্বাধীনতার’ নামে বিশ্বমুসলিম ঐক্য উপেক্ষা করে মুসলমানদের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ শুরু করে। সে ছিলো কুরাইশ বংশের বনু হাশেমের বংশধর। তুর্কি সালতানাতে ভাষাভিত্তিক সংকীর্ণ আঞ্চলিক জাতীয়তার বিষবাষ্পে তুরস্কের সুলতানাত তথা মুসলিম বিশ্বের ঐক্যপ্রতীক বিনষ্ট করাই ছিল ব্রিটিশের লক্ষ্য এবং তা ফলপ্রসূ হলো।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সম্মিলিত ব্রিটিশ-আমেরিকা শক্তির জয় হলো এবং তারা যুদ্ধে জয়ী হবার সাথে সাথেই একটি গোপন চুক্তির মাধ্যমে বিরাট তুরস্ক সাম্রাজ্যকে ভাগ বন্টন করে ফেলে। ১৯১৯ সালের মে মাসে উসমানী রাজধানীতে নমসর্বস্ব সুলতান রয়ে গেলো। আলজিরিয়া থেকে বাহরাইন পর্যন্ত সমস্ত অঞ্চল খন্ডবিখন্ড করে ফ্রান্স, গ্রীস ও বৃটেনের মধ্যে বিতরণ করা হলো।
এভাবে উসমানীয় রাষ্ট্রকে খন্ডবিখন্ড করার কারণে ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ দেখা দেয়। মুসলিম নেতৃবৃন্দ ভারতের ভাইসরয়ের কাছে তাঁদের ক্ষোভ প্রকাশ করেন। মওলানা মুহাম্মদ আলী জওহর এবং সাইয়েদ সুলাইমান নদভী প্রমুখ নেতৃবৃন্দের একটি প্রতিনিধি দল লন্ডন গমন করে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের নিকটে তাঁদের মনোভাব ব্যক্ত করেন। প্রত্যুত্তরে বলা হলো যে, শুধু তুরস্কের ভূখন্ড ব্যতীত অন্যান্য অঞ্চল তুরস্ককে দেওয়া যাবে না। মুসলিম নেতারা তুরস্কে খেলাফত পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্যে ভারতে শুরু করে প্রচণ্ড আন্দোলন। যা খেলাফত আন্দোলন নামে পরিচিত হয়।
একটি খেলাফত কমিটি গঠিত হলো। সারা ভারতে বিশেষত বাংলায় প্রচণ্ড বিক্ষোভ তৈরি হলো। মুসলিমদের এই জাগরণ প্রচেষ্টার পথিকৃৎ ছিলেন মওলানা মুহাম্মদ আলী জওহর। তিনি ছিলেন ‘মুক্ত ভারতে মুক্ত ইসলাম’ প্রতিষ্ঠার স্বপ্নদিশারী। তিনি পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি ও বক্তব্য দেওয়ার মাধ্যমে মুসলমানদের মধ্যে নবজাগরণ সঞ্চারে সক্ষম হন। খেলাফত আন্দোলনে সাড়া দেয়াকে তিনি প্রতিটি মুসলমানের ফরজ বলে উল্লেখ করেন।
তিনি এতোটাই আন্দোলিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, কংগ্রেস সমর্থক দেওবন্দী আলেমদের সংগঠন জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দ খেলাফত আন্দোলনের প্রতি অকুন্ঠ সমর্থন জ্ঞাপন করলো। ১৯১৯ সালের ১০ই আগষ্ট সারা দেশে খেলাফত দিবস পালনের আবহান জানানো হলো।
সারাদেশে হরতাল, বিক্ষোভ প্রদর্শন ও সভাসমিতির মাধ্যমে অভূতপূর্ব ও অপ্রতিহত প্রাণচাঞ্চল্য শুরু হলো। এক মাসের মধ্যে বিশ হাজার মুসলমান কারাদণ্ডের জন্যে নিজেদেরকে পেশ করলো।
১৯১৯ সালের নভেম্বর মাসে দিল্লীতে খেলাফত কমিটির অধিবেশন শুরু হয়। আন্দোলনের তীব্রতা দেখে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী এতে যোগদান করেন। তিনি তার বক্তৃতায় ব্রিটিশ সরকারের সাথে ‘অসহযোগিতার’ নীতি অবলম্বনের পরামর্শ দেন। ১৯২০ সালের মে মাসে অনুষ্ঠিত খেলাফত কমিটির সম্মেলনে ‘অসহযোগ আন্দোলন’ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ তীব্রতর হতে থাকে।
কিন্তু এতকিছুর পরেও এ প্রানবন্ত খেলাফত আন্দোলন অপমৃত্যুর সম্মুখীন হয়। এর জন্য অবশ্য তুরস্কে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো দায়ি। তুরস্কের মোস্তফা কামাল পাশা অসীম সাহসিকতা ও বীরত্বের সাথে ইংরেজদের হাত হতে বহু অঞ্চল পুনর্দখল করেন। তুর্কীজাতিকে করেন ঐক্যবদ্ধ এবং তুরস্ককে পুনরায় গৌরবের মর্যাদায় ভূষিত করেন। ব্রিটিশ ও তাদের দালালদের পরাজিত করে তিনি তুরস্কের শাসন ক্ষমতা পুনর্দখল করেন। যদিও বিশাল তুর্কি সালতানাতের অন্যান্য অঞ্চল অধিকার করতে সক্ষম হন নি। তুরস্ক ব্রিটিশদের থেকে মুক্ত হওয়ার প্রেক্ষিতে খেলাফত আন্দোলন আরো বেগবান হয়ে উঠে।
কিন্তু ক্ষমতা লাভ করার পর মোস্তফা কামাল পাশা ১৯২২ সালের নভেম্বরে সুলতান মুহাম্মদ হাশেমকে ক্ষমতাচ্যুত করেন এবং ১৯২৪ সালের মার্চ মাসে তুরস্কের সর্বশেষ ও ক্ষমতাহীন পুতুল খলিফা সুলতান আবদুল মজিদকে দেশ থেকে নির্বাসিত করে খেলাফত ব্যবস্থার উচ্ছেদ করে। তুরস্ক থেকে যখন মুসলিম নামধারীরাই খেলাফত ব্যবস্থা অকার্যকর করেছে এবং ব্রিটিশরা তুরস্ক থেকে সরে এসেছে তখন ভারতে আর খেলাফত আন্দোলনের যৌক্তিকতা থাকে না। কামাল পাশার কার্যক্রমের কারণে হিন্দুস্থানে খেলাফত আন্দোলন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। মুসলমাদের মধ্যে নেমে আসে হতাশা।
উপমহাদেশে খেলাফত আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্ট মুসলমানদের অন্তরে চরম আঘাত করে কামাল আতাতুর্কের পদক্ষেপ। সকলের চেয়ে বেশী প্রাণে আঘাত পান মাওলানা মুহাম্মদ আলী। কারণ তিনিই ছিলেন এ আন্দোলনের উৎস ও প্রাণকেন্দ্র। যে আরবীয় শরীফ হুসাইন ছিল ব্রিটিশের তাঁবেদার এবং যে তার কার্যকলাপের দ্বারা মুসলিম বিশ্বের নিকটে ঘৃণার পাত্র হয়েছিল, সে শরীফ হুসাইন এখন নিজেকে খেলাফতের দাবীদার বলে ঘোষণা করলো। এ ব্যাপারে ব্রিটিশ তাকে কোন প্রকার সাহায্য করলোনা। ওদিকে ওহাবী নেতা আব্দুল আজিজ ইবনে সউদের অভিযান ব্যাহত করার শক্তিও তার হলোনা। বছর শেষ হবার সাথে সাথেই ইবনে সউদ মক্কা ও তায়েফের উপর অভিযান চালিয়ে তা হস্তগত করেন এবং এভাবে হেজাজের অধিকাংশ অঞ্চলের উপরে তিনি অধিকার বিস্তার করেন এবং সৌদি আরব প্রতিষ্ঠা করেন। আব্দুল আজিজ ইবনে সউদ বর্তমান সৌদি বাদশাহ সালমানের পিতা।
খেলাফত আন্দোলনের সময়ে হিন্দুস্থানে হিজরত আন্দোলনও শুরু হয়। মওলানা আবুল কালাম আজাদ ১৯২০ সালে রাঁচী জেল থেকে মুক্তিলাভের পর হিজরত আন্দোলন শুরু করেন। তার অনুসারী কওমী আলেমগণ ফতোয়া দিতে শুরু করেন, 'ভারত দারুল হারব এবং এখান থেকে হিজরত করে কোন দারুল ইসলামে যেতে হবে'। অথচ তিনি ভারতীয় জাতীয়তাবাদের দোহাই দিয়ে এতদিন মুসলিম লীগের বিরোধীতা করে আসছিলেন। জেলখানায় গিয়ে তার জাতীয়তাবাদ ছুটে যায়।
মওলানা আজাদের আহ্বানে বহু মুসলমান হিজরতের জন্যে বদ্ধপরিকর হয়। দিল্লীতে হিজরত কমিটি প্রতিষ্ঠিত হলো এবং যথারীতি অফিস খোলা হলো। এই আন্দোলন যেহেতু মওলানা আজাদ আহ্বান করেছেন তাই আফগানিস্তানে যাওয়ার জন্য লক্ষ লক্ষ মুসলিম প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করলো, তারা তাদের সকল সহায় সম্পত্তি বিক্রি করে দেশত্যাগের জন্য প্রস্তুতি নিলো। ১৯২০ সালের কেবলমাত্র আগস্ট মাসেই আঠারো হাজার মুসলিম হিজরত করে চলে যায়। এই মানুষগুলোর কোনো ব্যবস্থা হয় না আফগানে। তারা অবর্ণনীয় জিল্লতির শিকার হয়।
এদিকে প্রায় পাঁচ লক্ষ মুসলমান আফগানে যাওয়ার প্রস্তুতি হিসেবে তাদের ভিটেমাটি বিক্রয় করেছিলো। এ আন্দোলনের পেছনে ছিলো মূলত মওলানা আবুল কালাম আজাদের হুজুগ বা ঝোঁকপ্রবণতা। কোন একটি সুচিন্তিত পরিকল্পনা ছাড়াই এবং হিজরতের ফলাফল বিচার বিশ্লেষণ না করেই এ আন্দোলনে ঝাঁপ দেয়া হয়েছিল।
হিজরত কমিটির সেক্রেটারি তাজাম্মল হোসেন ছিলেন মাওলানা মওদূদীর আত্মীয়। তিনি মাওলানাকে হিজরতের জন্যে উদ্বুদ্ধ করেন। মাওলানা হিজরত কমিটির সাথে আলোচনা করে দেখেন তাদের কোনো সুষ্ঠু পরিকল্পনা নেই। দলে দলে লোক আফগানিস্তানে চলে গেলেও আফগান সরকারের সাথে এ ব্যাপারে কোনো কথা বলা হয়নি। মুফতী কেফায়েতুল্লাহ ও মওলানা আহমদ সাঈদ এ ব্যাপারে ছিলেন দায়িত্বশীল। মওদূদী সাহেব এ দুজনের সাথে দেখা করে একটি পরিকল্পনাহীন আন্দোলনের ত্রুটি বিচ্যুতিগুলো দেখিয়ে দেন।
তারা ত্রুটি স্বীকার করে মাওলানা মওদুদী সাহেবকে একটি পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্যে অনুরোধ করেন। মওদূদী সাহেব বলেন সর্বপ্রথম আফগান সরকারের নিকটে শুনতে হবে যে তাঁরা হিন্দুস্তান থেকে হিজরতকারীদের পুনর্বাসনের জন্যে রাজী আছেন কিনা এবং পুনর্বাসের পন্থাই বা কি হবে। আফগান রাষ্ট্রদূতের সংগে আলাপ করা হলো। তিনি বলেন, তাঁর সরকার বর্তমানে খুবই বিব্রত বোধ করছেন। যারা ইতোমধ্যে আফগানিস্তানে চলে গেছে তাদেরকে ফেরৎ পাঠাতে অবশ্য সরকার দ্বিধাবোধ করছেন। কিন্তু তথাপি তাদের বোঝা বহন করা সরকারের সাধ্যের অতীত’।
এরপর হিজরত কমিটি হতাশ হয়ে তাদের কার্যক্রম বন্ধ করে দেন। আফগানিস্তানের আমীরও মুসলিমদের আফগানিস্তানে যাওয়া রুখতে বলেন। সবমিলিয়ে এই আন্দোলন চরমভাবে ব্যর্থ হয়। উদ্বাস্তু হয় পনের থেকে বিশ লক্ষ মুসলিম। তাদের দুর্দশা চরমে পৌঁছায়। কিন্তু আন্দোলন আহ্বানকারী মৌলানা আজাদের খুব একটা ভ্রুক্ষেপ দেখা যায় না। এরপর ১৯২৩ সালে তিনি কংগ্রসের সভাপতি হয়ে ভুলে যান মুসলিমদের অধিকার ও দুঃখ দুর্দশার কথা। তিনি থাকেন ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতান্ত্রিক ধ্যানধারণা নিয়ে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন